মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণকালে জহরলাল পাল চৌধুরী

যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছি তারা আমাদের চেয়ে ভালো থাকতে দেখলে অপমানিত হই

1908495_816807085021656_1469833574272682385_nহর লাল পাল চৌধুরী একাত্তরের সাহসী সৈনিক। বাবা রাজারকুলের বিখ্যাত জমিদার পবিরারের সন্তান যোগেন্দ্র পাল চৌধুরী ও মা প্রেম বালা পাল চৌধুরী। জন্ম রামু উপজেলার রাজারকুল ইউনিয়নের রাজারকুল এলাকায়। ছাত্র জীবনে ছাত্র ইউনিয়নের একজন সক্রিয় কর্মী ছিলেন। একাত্তরের যুদ্ধের সময় জহর লাল পাল চৌধুরী ছিলেন একজন যুবক। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। কক্সবাজার পতনের পর নিরাপত্তার স্বার্থে পার্শ্ববর্তী দেশ বার্মার (মিয়ানমার) চার মাইল নামক স্থানে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নেন। ওখানে কক্সবাজার থেকে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নেয়া মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও বেঙ্গল রেজিমেন্টে এবং ইপিআর থেকে আগত মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের সাথে পরামর্শ করে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার উদ্দেশ্যে সেপ্টেম্বরের দিকে ক্যাপ্টেন হারুনের পরামর্শ মতে ইপিআর হাবিলদার ইদ্রিস মোল্লার নেতৃত্বে ঘুমধুম সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেন। অংশ নেন লামা থানা, আলীকদম থানা, সাতকানিয়া থানা, রাজঘাট ব্রীজ, চুনতি অপারেশনসহ বিভিন্ন অপারেশনে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে সময় তার বাড়ি ঘর জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছিল। বর্তমানে তিনি কক্সবাজার শহরের ঝাউতলা গাড়ীর মাঠস্থ ভাড়া বাসায় স্বপরিবারে বসবাস করছেন এবং বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কক্সবাজার জেলা ইউনিটের ডেপুটি কমাণ্ডার। পাকিস্তানি জল্লাদ সেনাবাহিনীর গাড়ীকে গতিরোধ করে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর ২২ সদস্যকে আত্মসমর্পন করতে বাধ্যকারী মুক্তিযুদ্ধের সাহসী সৈনিক জহর লাল পাল চৌধুরীর মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক জানতে মুখোমুখি হয়েছিলেন ‘ভাষা আন্দোলনে কক্সবাজার’ গ্রন্থের লেখক ও কক্সবাজারের মুক্তিযুদ্ধ গবেষক কালাম আজাদ। সাক্ষাৎকারের চম্বুক অংশ ইতিহাসের স্বার্থে  পাঠকদেরকে জন্য তুলে ধরা হলো:

প্রশ্ন : দাদা, কেমন আছেন?

জহর লাল পাল চৌধুরী: ভালোই তো আছি।
প্রশ্ন: একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করেন?
জহর লাল পাল চৌধুরী: সাম্প্রদায়িক ভাগবাটোয়ার মধ্য দিয়ে ভারত ও পাকিস্তান নামক দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠিত হয়। ওই সময় পূর্ব বাঙলাকেও পাকিস্তানের অন্তর্ভূক্ত করা হয়। পুর্ব বাঙলার জন্যে এ স্বাধীনতা ছিল মরিচিকা মাত্র। পাকিস্তান রাষ্ট্রের পর পরই শুরু পূর্ব বাঙলার জনগণের উপর পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর শাসন শোষণ। দ্বিজাতি তত্ত্বের আলোকে পাকিস্তান রাষ্ট্রের ঊষালগ্নেই বাঙালির স্বপ্নভঙ্গের সূচনা হয় রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে। সংখ্যালঘুর বুলি উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার নামে বাঙালির স্বকীয়তা ও স্বাতন্ত্র্যবোধের কবর রচনার যে ষড়যন্ত্র তা বুকের রক্তে প্রতিরোধ করে এ দেশের যুব সমাজ। এরপরে বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রাম সংঘটিত হয় বাংলায়। ২৪ বছর পাকিস্তান শাসন-শোষণে অতিষ্ঠ হয়ে বাঙালির স্বাধিকার আদায়ের লক্ষ্যে এবং বাংলাকে স্বাধীন করার অভিপ্রায়ে বঙ্গবন্ধুর ডাকে অন্যান্য সকল মুক্তিকামী জনতার পাশাপাশি আমিও মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করি এবং দেশকে স্বাধীন করে ঘরে ফিরি। এটাই ছিল আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মূল প্রেরণা।  মুক্তিযুদ্ধ প্রত্যেক বাঙালির অহংকার ও গৌরবের। বাঙালির এ যুদ্ধকে খাটো করার দু:সাহস কারোর নেই। যাদের আছে তারা স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকার আল বদর আল শামস।
প্রশ্ন: ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানের বঙ্গবন্ধুর ভাষণের সময় কোথায় ছিলেন এবং ওই দিনের রামু-কক্সবাজারের অবস্থা সম্পর্কে কী জানেন?
জহর লাল পাল চৌধুরী:  বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের সময় আমি ঢাকাতেই ছিলাম। ফলে কক্সবাজারের অবস্থা তেমন জানি না। তবে শুনেছি কক্সবাজারের আওয়ামী লীগ ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নসহ বিভিন্ন সংগঠনের নেতারা ৭ মার্চের ভাষণ স্বাগত জানিয়ে মিছিল মিটিং করেছেন এবং অসহযোগ আন্দোলন সংঘঠিত করেছিলেন।
প্রশ্ন : ২৫ মার্চের কালো রাতে রামু-কক্সবাজারের চিত্র সম্পর্কে বলুন এবং ২৬ মার্চ  থেকে ৫ মে আপনি কোথায় ছিলেন?
জহর লাল পাল চৌধুরী : পাকিস্তানের কুখ্যাত ইয়াহিয়া খান সমঝোতার নামে ২৫ মার্চ ঢাকা এসে বাঙালি হত্যার নির্দেশ দিয়ে ঢাকা ত্যাগ করে। ২৫ মার্চ ভয়াল কালো রাতে নিরস্ত্র বাঙালির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। চালায় নগ্ন হামলা। পাশাপাশি পূর্ব বাংলায় জারি করা হয় সামরিক শাসন। বের হওয়া মাত্র গুলি এবং আটক। ভয়ে সন্ত্রস্ত জনগণ। এ দিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানে ডাকে শুরু হয় স্বাধীনতা সংগ্রাম। কক্সবাজারের মুক্তিযোদ্ধাদের সমন্বয়ে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ২৯ মার্চ মেজর জিয়া, ক্যাপ্টেন অলি আহমদসহ ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের বেশ কয়েকজন সৈন্য নিয়ে কক্সবাজারে আসেন। ওই সময় মেজর জিয়া ও ক্যাপ্টেন অলি আহমদ অগ্নিযুগের বিপ্লবী এডভোকেট জ্যোতিশ্বর চক্রবর্তীর সাথে দেখা করতে তার বাসায় যান। ওই সময় আমি, স আ ম শামসুল হুদা চৌধুরীর ছেলে ইউসুফ মোহাম্মদ শামসুল হুদা, ছাত্র ইউনিয়ন নেতা সুভাষ চন্দ্র পাল, দেবব্রুত চৌধুরী, লালু সহ আরো বেশ কয়েকজন উপস্থিত ছিলাম। ৫ মে এর আগ পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল কক্সবাজার। ৫ মে পাক হানাদার বাহিনী  কক্সবাজার দখলে নেয়ার পর এখানকার কনভেশন মুসলিম লীগ, এনএসএফ, জামায়াত-ছাত্র সংঘেরনেতা এবং পাকিস্তানি দোসররা তাদের আগমনকে স্বাগত জানায় এবং বাঙালি হত্যায় সহযোগিতা করে। অবস্থা বেগতিক দেখে আমরা কয়েকজন মুক্তিকামী ছাত্র-যুবা- বার্মায় আশ্রয় নিই।
প্রশ্ন : বার্মায় শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নেবার পর আপনাদের অবস্থা কেমন ছিলো?
জহর লাল পাল চৌধুরী : পাক বাহিনীর গণহত্যা ও নির্যাতনের মুখে আমি পরিবারের বৃদ্ধ মাতা, ছোট শিশু, নারী, ছেলের নিরাপত্তার কথা ভেবে সীমান্ত অতিক্রম করে প্রতিবেশী দেশ বার্মার ৪ মাইল নামক স্থানে পাড়ি দিই। ৪ মাইল নামক স্থানে দেখা হয় রামু-উখিয়া টেকনাফ আসনের এমপিএ ওসমান সরওয়ার আলম চৌধুরী, চকরিয়ার আ’লীগ নেতা ডা. শামসুদ্দিন, ক্যাপ্টেন হারুন, ইপিআরসহ বেশকিছু সৈনিকের সঙ্গে। সেখানে থাকার সময় যারা বাঙলাদেশ থেকে যাচ্ছে তাদের সাথে দেখা হচ্ছে। কিন্তু পরাশক্তি চীন পাকিস্তানের পক্ষে থাকায় বার্মা রাজনৈতিক কারণে পাকিস্তানের পক্ষালম্বন করে। তারপরেও আমাদের আশ্রয় দিয়েছে কিন্তু তাদের দেশে থেকে মুক্তিযুদ্ধের পরিকল্পনা, মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করা যাবে না বলে সাফ জানিয়ে দেয়। বলতে গেলে এক প্রকার আমাদেরকে বন্দি করে বার্মা সরকার। এক পর্যায়ে ৪ মাইল ছাড়াও ঢেকিবনিয়া, টংবৈয়, নাকপুরা, বলিবাজার,  ঢেকিবনিয়া, সাববাজারের শরণার্থীদের ৪ মাইল নামক পাহাড়ের পাদদেশে বন্দি করে রাখে সরকার।
প্রশ্ন : তো, এমন পরিস্থিতিতে কখন মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করেন, কি নিয়ে এবং কার নেতৃত্বে?
জহর লাল পাল চৌধুরী : প্রতিকুল পরিস্থিতিতে আমরা যারা শরণার্থী ক্যাম্পে আশ্রয়ে ছিলাম তারাকেউ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে তেমন ভূমিকা রাখতে পারেনি। দেশের খবরাখবর জানতে বার্মা সরকারের কড়া নিরাপত্তা সত্বেও আমরা বেশ কয়েকজন মুক্তিকামী যুবকদেশের জন্য যুদ্ধ করার জন্য পরামর্শ করতাম। গোপনে সংগঠিত হয়ে সীমিত পরিসরে গেরিলা তৎপরাত চালাতে সেপ্টেম্বরের ১ম সপ্তাহে ক্যাপ্টেন হারুনের (কালুরঘাট যুদ্ধে আহত হয়ে আওয়ামী লীগ নেতাদের সহায়তায় তিনি বার্মায় আশ্রয় নিয়েছিলেন) পরামর্শক্রমে ইপিআর হাবিলদার ইদ্রিস মোল্লাহর নেতৃত্বে ইপিআরের ৯ জন, সাহসী যুবক  অজিত পাল ( মুক্তিযুদ্ধের শহীদ), আমিসহ মোট ১১ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে আমরা ঘুমধুম সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করি। ঘুমধুম আসার পথে অনেক বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছে। ফুরাইক্ষ্যা বাহিনী আমাদেরকে পাক বাহিনীদের হাতে তুলে দেওয়ার চেষ্টা চালায়। কিন্তু কৌশলী গ্রুপ কমান্ডার ইদ্রিস মোল্লার কারণে এ যাত্রায় বেঁচে যাই। সেখানথেকে বার্মার ঢেকিবনিয়ায় হলদিয়া পালং ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান ও মহকুমা সংগ্রাম কমিটির সদস্য বাদশা মিয়া চৌধুরীর সাথে দেখা হয়। তিনি আমাদের খাওয়াবের ব্যবস্থা করে এবং তিনি নিজে দুইটি গ্রেনেড দিয়ে আমাদের হাতে তুলে দেন। এই ছিল আমাদের হাতে আসা প্রথম অস্ত্র। রাতের বেলায় বাংলাদেশে প্রবেশ করে প্রিয় মাতৃভূমিকে স্বাধীন করার শপথ নিয়ে সোনাইছড়ির আমার এক বন্ধু ওঁথাতুর বাড়িতে আশ্রয় নিই আমরা। তিন দিন থাকার পর পরামর্শ করে আমরা সেখান থেকে আরো দুট্ িঅস্ত্র সংগ্রহ করি। সেখানে আরো ২ জন মগের ছেলে আমাদের দলে যোগদান করায় আমাদের দলের সংখ্যা ১৩-তে পেীঁছায়। এর মধ্যে আমরা রামু এলাকার মোহাম্মদ আলী নামে এক রাজাকারকে হত্যা করি। পরে আমরা বাইশারীতে অবস্থানরত হাবিলদার সোবহান (পরবর্তীতে ক্যাপ্টেন) এর সাথে যোগাযোগ করে লামা থানা অপারেশনের সিদ্ধান্ত নিই।
প্রশ্ন : তো, লামা থানা অপারেশন বাস্তবায়ন হয়েছিলে কী?
জহর লাল পাল চৌধুরী : হাবিলদার সোবহন সোবহান ও আমাদের গ্রুপ কমান্ডার ইদ্রিস মোল্লার পরামর্শ মতে আমরা লামা থানা অপারেশন করি। লামা থানা অপারেশনে পুলিশ, রাজাকার বাহিনীর পতন হওয়ায় ৩৮টি থ্রি নট রাইফেল ও ১০৬৫৯ রাউন্ড গুলি আমাদের হস্তগত হয়।
প্রশ্ন : আর কোনো অপারেশনে ছিলেন?
জহর লাল পাল চৌধুরী : লামা থানা অপারেশনের পর হাবিলদার সোবহান ও ইদ্রিস মোল্লাহর পরামর্শমতে পাহাড়ে নয়-মূল ভূখণ্ডে গিয়ে যুদ্ধ করার অভিপ্রায়ে ইদ্রিস মোল্লাহর নেতৃত্বে একটি গ্রুপ আমিসহ আলীকদমে চলে যাই। লামা থানা অপারেশনশেষ করে আলিকদমে যাওয়ার পথে হাবিলদার সোবহান গ্রুপের সদস্য হ্নীলার আইয়ুব বাঙালি, উখিয়ার পরিমল বড়–য়া, হ্নীলার সিরাজুল হক সিকদার, নুরুল আমিন সিকদার, কবির আহমদ আমাদের সাথে যাত্রা করে। আমাদের শক্তি আরো বৃদ্ধি পায়। ইদ্রিস মোল্লার নেতৃত্বে আমরা আলীকদম বাজারে স্বাধীন বাঙলার পতাকা উত্তোলন করি এরমধ্যে চকরিয়ার অনেক মুক্তিযোদ্ধা আমাদের গ্রুপে যুক্ত হতে থাকে। এ দিকে কয়েকজন চাকমা রাজাকার গোপনে আমাদের খবরাখবর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে পৌছে দেওয়ার তথ্যের প্রমাণ পেয়ে ২ জন চাকমাকে বেয়নেট খুঁচিয়ে হত্যা করা হয়।
প্রশ্ন: এরপরে কোথায় ছিলেন? আপনি নাকি চুনতি অপারেশনেও ছিলেন?
জহর লাল পাল চৌধুরী : এর পর আমরা পাক হানাদার বাহিনীর সাথে সম্মুখ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার অভিপ্রায়ে আমিরাবাদের দিকে যাত্রা করি। পথে এফএফ ১১২ নং গ্রুপের কমান্ডার শামসু মিয়ার সাথে দেখা হয়। তার নেতৃত্বে ২০ জন ভারত থেকে ট্রেনিং প্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা ছিলো। প্রচুর অস্ত্রসস্ত্র আমরা পেয়ে যাই। আমাদেরকে ফুরিখ্যা বাহিনীর সাথেও আমাদের যুদ্ধ করতে হয়েছে। যুদ্ধে আমরা বিজয়ী হয়েছিলাম। পরে আমরা আমিরাবাদ পুটিবিলা জোড়া পুকুর নামক স্থানের একটি স্কুলে আমরা ক্যাম্প করি। ওই ক্যাম্পে থাকাকালি সময় আমরা খবর পাই রাজাকারেরা কিছু উপজাতির ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিচ্ছে। এ খবরে আমরা ওই এলাকা গিয়ে রাজাকারের বাড়ি ঘর জ্বালিয়ে দিই। আরো কয়েকদিন পর আমিরাবাদ টেলিফোন অফিসে অবস্থিত রাজাকার ক্যাম্পে হামলা চালায়। সেখানে রাজাকারদের সাথে আমাদের সম্মুখ যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে প্রায় ১০/১৫ জন রাজাকারকে হত্যা করে রাস্তায় সারিবদ্ধ করে রাখি। এরপর আমরা সাতকানিয়া আক্রমণ করি। রাজাঘাট ব্রীজে আমাদের সাথে রাজাকারদের সম্মুখ যুদ্ধ হয়। ইতোমধ্যে পাকিস্তান ভারতে হামলা করে। ফলে শুরু হয় ভারতীয় বাহিনীর আক্রমণ। পাশাপাশি তারা মিত্রবাহিনী নামকরণ করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। পূর্বাঞ্চলে বাঙলাদেশে-ভারত মিত্রবাহিনীর সৈনিকদের অগ্রাভিযান ঠেকাতে না পেরে এক পর্যায়ে পাক বাহিনী পিছু হঠা আরম্ভ করে। বাংলাদেশ ভূখণ্ডে অবস্থানরত মুক্তিবাহিনীর অগ্রবর্তী গেরিলা যুদ্ধে পাক বাহিনীর ঝটিকা আক্রমণের মাধ্যমে নাস্তানুবাদ করে চলছি আমরা। এর মধ্যে ১০ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক চুনতি মুক্তিযুদ্ধ প্রশিক্ষণ ক্যাম্প পরিচালক মো. এরশাদুল হক (যিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের একজন সদস্য ছিলেন) পুটিবিলা জোড়া পুকুর এলাকার মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প অবস্থানকালে আজিজ উদ্দিন সিগারেট ফ্যাক্টরির শ্রমিক মো. শ্রমিক ইসলাম ( ইতিপূর্বে মুন্সেফ বাজার ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ গ্রহণকারী) এর মাধ্যমে খবর পায় যে, আজিজনগর এলাকায় অবস্থানকারী কক্সাবাজার থেকে আগত পাকিস্তান বাহিনীর দলটি ওই দিন বিকালে চারটায় চট্টগ্রাম শহরের দিকে রওয়ানা দিবে’। এমন খবর পেয়ে আরেক মুক্তিযোদ্ধা সংগঠক অধ্যাপক নাজিম উদ্দিনের পরামর্শমতে মো. এরশাদুল হক আমাদের ক্যাম্পে ছুটে আসেন। আমাদের গ্রুপ কমান্ডার ইদ্রিস মোল্লার সাথে পরামর্শ করে। তখন ইদ্রিস মোল্লা এরশাদুল হককে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘আপনি একজন মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক এবং বিগত মার্চ এপ্রিলে চুনতি মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং ক্যাম্প পরিচালনা করেছিলেন। চুনতি এলাকার একটি সুবিধাজনক স্থানে অপারেশন পয়েন্ট ঠিক করে আপনার নেতৃত্বে  ও দায়িত্বে অপারেশনের ব্যবস্থা করেন। নিজেদের ক্ষয়ক্ষতি যাতে কম হয় সেভাবেই পরিকল্পনা নেবেন।’ এই বলে ইদ্রিস মোল্লাহ আমাকে ডেকে একটি দল প্রস্তুত করতে বলেন। তখন এরশাদুল হক বলেন, সার্বিক পরিচালনায় আমি থাকব কিন্তু জহর লাল পাল চৌধুরীকে অপারেশন কমান্ডারের দায়িত্ব দিলে উত্তম কাজ হবে কারণ তিনি খুবই সাহসী ও স্মার্ট। ’ ওই সময় অধ্যাপক নাজিম উদ্দিন এরশাদুল হক ও আমাকে জড়িয়ে ধরেন এবং অপারেশনের সফলতা কামনা করে আমাদেরকে সাহস রাখার পরামর্শ দেন। এর মধ্যে এরশাদুল হক ও আমরা চুনতি পুলিশ বিটে গিয়ে তাদের সহযোগিতা কামনা করি এবং তারা রাজী হয়। কয়েকজন পুলিশ সদস্য ওই সময় চুনতি পুলিশ বিটে অবস্থান করছিল। তাদের মধ্যে থেকে ৩ জন সশস্ত্র জোয়ান পুলিশকে এরশাদুল হক এ্যাম্বুশ পয়েন্টে আবগারী পাহাড়ে আমাদের সাথে রাখে। অতিরিক্ত গোলাবারুদসহ আরো দুইটি রাইফেল নিয়ে কাশেম ও আইয়ুবকে দায়িত্ব দেয়া হয় অবজারভেশনের জন্যে। ৩ পুলিশ, কাশেম, খোকা দে, আয়ুব আবগারী পাহাড়ে অবস্থান করে পজিশন নেয়। আমি আমার গ্রুপসহ ৪ টার দিকে চুনতি বাজার পয়েন্ট গিয়ে এরশাদুল হকের সাথে যোগাযোগ করি। অপারেশনের নেতৃত্ব দানকারী হিসেবে এরশাদুল হক আমার কথামতো সবাইকে অস্ত্র চালানোর নির্দেশ দেন। সাথে তিনি আমাদের অবস্থানস্থল কোথায় হবে তাও জানিয়ে দেন। আলাপের এক পর্যায়ে আমি চুনতি ডেপুটি বাজারের আবগারী পাহাড়কে অ্যাম্বুশ এর জন্য উৎকৃষ্ট স্পট চিহ্নিত করি। শেষ বিকালের দিকে আমাদের কয়েকজন সদস্য আবগারি পাহাড়ের বিভিন্ন স্থানে গাছের পাশে পাশে অবস্থান নেয়। অপারেশন কমান্ডার হিসেবে আমি আরাকান রোডের পাশের একটি গাছের আড়ালে অবস্থান নিই এবং মুক্তিযোদ্ধাদেকে আরাকান রোডের উভয় পাশে বিভিন্ন পজিশনে অবস্থান নেয়ার নির্দেশ দিই। আমি ফায়ার না করার আগ পর্যন্ত কাউকে ফায়ার না করার সিদ্ধান্ত ছিল। আমি আরাকান রোডের একটি আম গাছের আড়ালে পজিশন নিয়ে শত্রুবাহিনীকে সারেন্ডার করানোর উদ্দেশ্যে অতর্কিত সামনাসামনি চেইজ করার গুরুত্বপূর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ দায়িত্ব নিজেই নিই। শেষ বিকেলের দিকে একটি মিলিটারি জীপসহ আরো দুইটি গাড়ি আসতে দেখে আমরা পজিশন নিয়ে শত্রুবাহিনীকে আমাদের সম্পূর্ণ রেইঞ্জ-এ পেীঁছতে দেওয়ার অপেক্ষায় উত্তেজনাকর অবস্থার মধ্যে ছিলাম। শত্রুবাহিনী রেইঞ্জ এর একদম ভিতরে আসলেও আমার কথা ছাড়া ফায়ার থেকে বিরত থাকে আমার সাথে থাকা মুক্তিযোদ্ধারা। আমি সাহস করে অস্ত্র হাতে লাফ দিয়ে বের হয়ে আমার সামনে আসা শত্রুবাহিনীকে হ্যান্ডসআপ ‘হাতিয়ার ঢাল দো বলে চড়াও হই। ইতোমধ্যে আমার সাথে থাকা মুক্তিযোদ্ধারা অস্ত্র তাক করে আক্রমণের প্রতিক্ষায়।  আমি দীর্ঘদেহী শরীরে গঠন এবং গায়ের রঙ দেখতে পশ্চিমাদের মতো হওয়ায় এবং নির্ভুল উর্দু উচ্চারণ শুনে পাকিস্তানি রাজাকার মনে করে উচ্চস্বরে তাদের ক্যাপ্টেন (ক্যাপ্টেনের নাম মনে পড়ছে না স্বাধীনতার এত বছর পরে) গাড়ি থেকে বলে উঠল ‘আপ তো হাম লোগ কা আদমি হো। কিউ এছা করতা। প্রত্যুত্তরে আমি বলি ‘ঠিক হ্যায়, আপ লোগ পহলে হাতিয়ার ঢাল দে আউর হ্যান্ডসআপ হো যাই য়ে’। বাইনচোদ হাম তেরা বাপ হো, হামারা মুক্তিবাহিনী।’ ওরা অস্ত্র নিচে রেখে তুলে অপেক্ষা করতে লাগলো। ততক্ষণে আমার সাথে থাকা মুক্তিযোদ্ধারা জয় বাঙলা ধ্বনি দিয়ে তাদেরকে ঘিরে ফেলে। ওই সময় দোকানদার, সাধারণ জনগণ এগিয়ে আসে আমাদের সাথে একাত্ব হয়ে  পিছমোড়া করে তাদের সবাইকে বেঁধে ফেলে। ওই সময়   আমেরিকান একজন ডাক্তারকেও গ্রেফতার করি। যিনি পাক বাহিনীর দোসর ছিলেন। এরপর সবাইকে আমাদের মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে নিয়ে আসি। উৎসুক হাজারো জনতার সামনে কমান্ডার ইদ্রিস মোল্লার নির্দেশে ২২ জন পাক বাহিনীর সদস্যকে গুলি করে হত্যা করি। আমার সাথে থাকা মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে ছিলেন চুনতির এরশাদুল হক, হ্নীলার আইয়ুব বাঙালি, চকরিয়ার সৈয়দ নুর হোসেন, পরিমল বড়ুয়া (উখিয়া), খোকা দে, নুরুল ইসলাম, মো. কাসেম, আইয়ুব, হ্নীলার সিরাজুল হক সিকদার অন্যতম। অন্যদের নাম এ মুহূর্তে মনে পড়ছে না। তবে একেকজনের নাম এ মুহুর্তে বেশি মনে পড়ছে যিনি ইস্ট বেঙ্গলের সদস্য ছিলেন এবং আমাদের সাথে যুদ্ধ করতে গিয়ে তার কান চলে গিয়েছিল। তার নাম মো. শফি।
প্রশ্ন : সাহস করলেন কীভাবে?
জহর লাল পাল চৌধুরী : এটা কি কথা। সাহস ছিলো বলেই প্রাণের ভয়কে ত্চ্ছু মনে করে মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছি এবং সাহসিকতার সাথে যুদ্ধ করেছি।
প্রশ্ন: এরপর আর কোন কোন অপারেশনে ছিলেন?
জহর লাল পাল চৌধুরী : এরপরে হাবিলদার ইদ্রিস মোল্লাহর নেতৃত্বে আমরা কক্সবাজারের দিকে যাত্রা করি। ১৩ ডিসেম্বর আমরা কক্সবাজার পৌঁছি। টেকনাফের দিকে যাত্রা করি। টেকনাফে পৌঁছে আমরা কুখ্যাত রাজাকার নজির চেয়ারম্যানকে গ্রেফতার করি। ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হলে আমরা বার্মায় অবস্থানরত শরণার্থীকে চিঠি দিই দেশ স্বাধীন হয়েছে বলে উল্লেখ করে।  অথচ মিয়ানমারের শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নেয়া সংগঠক নজরুল ইসলাম চৌধুরীসহ একটি গ্রুপ ১১ ডিসেম্বর মিয়ানমার থেকে কক্সবাজারে এসেছেন বলে বলে বেড়াচ্ছেন।
প্রশ্ন : মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন তথা অপারেশনে এমন কোনো স্মৃতি আছে যা আপনাকে এখনো পর্যন্ত নাড়া দেয়?
জহর লাল পাল চৌধুরী : ওই যে বললাম, চুনতি অপারেশনে সাহসিকতার সাথে জল্লাদ পাক বাহিনীর সম্মুখে দাঁড়িয়ে তাদের সারেন্ডার করতে বাধ্য করি এবং গ্রেফতারপূর্বক তাদের ২২ সদস্যকে নিধন করি। সে স্মৃতিই আমাকে এখনো পর্যন্ত নাড়া দেয় এবং গর্ববোধ করি ওই অপারেশনের একজন সৈনিক হিসেবে।
প্রশ্ন: আপনার সাথে অংশ নিয়েছেন এমন কোনো মুক্তিযোদ্ধা কী শহীদ হয়েছেন ? হলে তার সম্পর্কে বলুন।
জহর লাল পাল চৌধুরী : অবশ্যই আমার সাথে থাকা একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়েছেন। আমার বাল্যকালের সিনিয়র বন্ধু অজিত কুমার পাল। আমাদের বাড়ির পাশেই তার বাড়ি। বাবা ক্ষিরোধ চন্দ্র পাল ও মা ননী গোপাল পাল। ষাটের দশকে একজন প্রাণবন্ত যুবক ছিলেন। অসহযোগ আন্দোলনসহ বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতিটি আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন। অসহযোগ আন্দোলন তথা ২৬ মার্চ থেকে ২৭ এপ্রিল পর্যন্ত রামুুতে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করার দায়ে এমএলআর ৭, ১২, ১৪, ১৭ ২০ এবং পাকিস্তানি দ-বিধি ২১ এবং ২১ (ক) ধারায় যে রাষ্ট্রদ্রোহী মামলা (যার নং-জিআর ১০০/৭১) দায়ের করা হয়েছিল তাতে ২৯ নং আসামী ছিলেন তিনি। রাষ্ট্রদ্রোহী মামলার গ্রেফতারি পরোয়ানা নিয়ে কিছুদিন আত্মগোপনে থাকলেও ৫ মে কক্সবাজার পতনের পর আমাদের সাথে বার্মায় আশ্রয় নেয়। সেপ্টেম্বরের দিকে ইপিআরের ইদ্রিস মোল্লাহর নেতৃত্বে আমাদের সাথে ঘুমধুম হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। লামা থানা অপারেশনেও অংশ নেন। এরমধ্যে মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত এসে উখিয়ায় পাক হানাদার  বাহিনীর দোসর শান্তি কমিটি,রাজাকার আলবদরদের হাতে ধরা পড়েন। উখিয়া শান্তি কমিটির সভাপতি মীর কাসেম চৌধুরীসহ অন্যান্যেরা তাকে কক্সবাজার সিভিল রেস্ট হাউসে অবস্থানে পাক বাহিনীর হাতে সোপর্দ করে। পাক বাহিনীর সদস্যরা তাকে নির্যাতন করে হত্যা করে।
প্রশ্ন : একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আপনি এ পর্যন্ত কোনো সরকারি সুযোগ সুবিধা পেয়েছেন কী? প্রকৃত স্বীকৃতি বলতে যা বোঝায়। 
জহর লাল পাল চৌধুরী :  ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হলে আমরা যার যার ঘরে পৌছি। কিন্তু বাড়িতে গিয়ে দেখি আমি এবং আমার ভাই অজিত পাল চৌধুরী (যিনি পাকিস্তান বাহিনী কর্তৃক দায়েরকৃত রাষ্ট্রবিদ্রোহী মামলার ২৮ নং আসামী ছিলেন) এবং সুভাষ পাল চৌধুরী ( রাষ্ট্রবিদ্রোহী মামলার ২৭ নং আসামী) মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করায় আমাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিয়েছে। আমাদের পরিবারের উপর চালিয়েছে নির্যাতন। কিন্তু এখনো পর্যন্ত নির্যাতিত পরিবার হিসেবে স্বীকৃতি পাইনি। এখনো আমাদের উপর নির্যাতন চালিয়ে আসছে ওই পাকিস্তান বাহিনীর দোসররা। যুদ্ধে আমাদের বাড়িঘর ধ্বংস করল, অথচ আমরা কিছু পেলাম না। এখনো পর্যন্ত আমি বাড়া ঘরে বসবাস করে আসছি। ২০১৩ সালে সরকার আমাকে একটি ঘর বরাদ্ধ দিয়েছিলেন কিন্তু রামুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আমাকে বাদ দিয়ে যার ঘর আছে তাকে দিয়ে দিয়েছে। তবে কিছু পায়নি বললে ভুল হবে আমি মুক্তিযোদ্ধা গেজেটে অন্তর্ভুক্ত হয়েছি। যার নং ৩১৫। মুক্তিবার্তা নং- ০২১৩০২০০০৫। কিন্তু যাদের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ করলাম তারা আমাদের চেয়ে ভালো থাকতে দেখে অপমানবোধ করি। প্রকৃত যে স্বীকৃতির কথা আপনি বলছেন তা কি পেয়েছি? একজন পাক বাহিনীর সদস্য মেরে অন্যরা যেখানে বীর প্রতীকের স্বীকৃতি পায় আর আমি ২২ জন মেরে আমি কী পেলাম?
প্রশ্ন : স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে যে বিতর্ক চলছে একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আপনার অভিমত কী?
জহর লাল পাল চৌধুরী : এটাতো রাজনৈতিক প্রশ্ন। আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা। বঙ্গবন্ধুর ডাকে আমি স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নিয়েছি। স্বাধীনতার ঘোষক নিয়ে যে বিতর্ক চলছে তা আদৌ ঠিক নয়। এটা মীমাংসিত বিষয়। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রীমকোট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে। আর আওয়ামী লীগ নেতা ও বেতার কর্মীদের চাপে এবং সেনাবাহিনী দিয়ে ঘোষণার প্রয়োজন ছিল বিধায় মেজর জিয়া বাধ্য হয়ে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে ২৭ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেছেন মাত্র। এর আগে এম এ হান্নান, বেতার কর্মী বেলাল মোহাম্মদ, আবুল কাসেম সন্দ্বীপসহ প্রমুখ বঙ্গবন্ধুর পক্ষে ঘোষণা পাঠ করেছেন। তারাও তো দাবি করতে পারতেন। আর একটি সহজ উপায় আপনাকে বলছি, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় বাঙালির মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার অপরাধে পাকিস্তান সরকার যেসব রাষ্ট্রদ্রোহী মামলা করেছিলো সেখানেই তো শেখ মুজিুবুর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। ‘যাতে লেখা ছিল:
On the same it was renounced by the Awami Leagueleader that Sk. Mozibur Rahman , Chief of the said party had declaredIndependence of East Pakistan & named it Swadin Bangladesh.
তাহলে স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে অত বির্তক কেন? আর কেউ দাবি করলে যে স্বাধীনতার ঘোষক হয়ে যাবে তা মেনে নেয়া যায় কী?
প্রশ্ন : আমরা লোকে মুখে শুনছি, কক্সবাজারে মুক্তিযুদ্ধ হয়নি? এ ব্যাপারে আপনার মন্তব্য কী?
জহর লাল পাল চৌধুরী : লোকেমুখে যা শুনছেন তা রাজাকার এবং স্বাধীনতা বিরোধীদের অপপ্রচার। যদি কক্সবাজারে মুক্তিযুদ্ধ না হয় তাহলে- স্বাধীনতা ঘোষণার পরপরেই ইপিআর হাবিদদার জোনাব আলীসহ বাঙালি ইপিআর সদস্য এবং স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে অবস্থানকারী ১১ জন অবাঙালি ইপিআরকে বন্দি করে এবং পরবর্তীতে পানেরছড়া ঢালায় নিয়ে গিয়ে হত্যা করে। এটা কী মুক্তিযুদ্ধের অংশ নয়? আর যদি যুদ্ধই না হয় তাহলে অত মানুষ শহীদ এবং বধ্যভূমিতে এত কঙ্কাল পাওয়া গেল কেন?
প্রশ্ন : আমরা শুনেছি ৭৫ এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর নাকি আপনি কক্সবাজারের বাইরে ছিলেন এবং কেন? 
জহর লাল পাল চৌধুরী : ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কতিপয় কুলাঙ্গার জাতির জনক বঙ্গবন্ধুশেখ মুজিবুর রহমানকে স্বপরিবারে হত্যা করে। রাজনৈতিক পরিস্থিতি জটিল হয়ে যায়। এপ্রেক্ষিতে কক্সবাজারের রাজাকার, আলবদর, আল-শাসমরা আমাদেরকে মেরে ফেলার হুমকি প্রদান করে।
নিজের এবং পরিবারের নিরাপত্তার কথা ভেবে পরিবারসহ কক্সবাজার ত্যাগ করে অন্যত্র আত্মগোপন করি। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলে ২০ বছর পর স্বপরিবারে চলে আসি।
প্রশ্ন : বিগত জোট সরকারের আমলে অন্যান্য জেলার ন্যায় কক্সবাজারেও স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে। এতে শহীদের অসম্পূর্ণ তালিকা সন্নিবেশিত করা হয়েছে। এ ব্যাপারে আপনার অভিমত কী?
জহর লাল পাল চৌধুরী : ঘটনাটি সত্য। এখানে আমার সাথে অপারেশনে থাকা শহীদ মুক্তিযোদ্ধা অজিত কুমার পালের নাম পর্যন্ত আসেনি। শুধু তাই নয়, বাদ দেওয়া হয়েছে কক্সবাজারের একমাত্র শহীদ বুদ্ধিজীবী শহীদ সাবের, কক্সবাজার রণাঙ্গনের প্রথম শহীদ টেকনাফ উপজেলার কেরুনতলীর আমির হামজা, শহীদ আইনজীবী জ্ঞানেন্দ্র লাল চৌধুরী, শহীদ শিক্ষক ইলিয়াছ মাস্টার, ২৮ মার্চ চট্টগ্রামের চেরাগী পাহাড়ে শহীদ হওয়া ছাত্রলীগ নেতা উখিয়ার রত্মাপালং এলাকার দীপক বড়ুয়া, (মুক্তিযোদ্ধা সুনিল বড়ুয়া, ধর্ম দর্শী বড়ুয়া, ড. সঞ্জয় বড়ুয়ার আত্মীয়), ছাত্র ইউনিয়ন নেতা ফরহাদ, কালারমারছড়া ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শরীফ, শফিকুর রহমান, মুহাম্মদ ইউনুছ, খুরুশকুলের সতীশ চন্দ্র দে মহাজন, চকরিয়ার আবুল হোসেন, ফরিদপুর জেলার নাড়িয়া থানার সুংডা আবদুল আওয়ালের পুত্র সিপাহী আবুল হোসেন (ই,পি,আর ১৬৩১৫ নং), হ্নীলার শামসুল আলম, উখিয়ার ভট্ট মহাজন, আমান উল্লাহ, ইপিআর হাবিলদার রহিম বখশ ( জিলংজা), হ্নীলার ইপিআর সিপাহী লাল মোহাম্মদ, মেরুংলোয়ার যামিনী মোহন শর্মা, শশাংক বড়ুয়া, কালিবাড়ির স্বপন ভট্টাচার্য, চকরিয়ার পরিতোষ চন্দ্র দাশ, মনিন্দ্র কুমার দাশ, মহেশখালীর ব্যবসায়ী বিমল দাশ,  মহেশখালীর গোরকঘাটা হিন্দু পাড়ার মনোহরি দে, শরৎ চন্দ্র দে,  সুধীর চন্দ্র দে, যত ননী গোপল দে, হরিপদ দে, কালু দে, বাশি রাম দে, ফণিভূষণ ভট্টাচার্য্য, বড় মহেশখালীর আবু জাফর, খাইস্যার অমূল্য দে, পুটিবিলার জাফর, হ্নীলার মোহাম্মদ আলী, চকরিয়া লক্ষ্যাচরের মনিন্দ্র নাথ দে, ধুরংখালীর নির্মল ধর, ভট্ট মহাজন, হলদিয়া পালং এর মনীন্দ্র লাল বড়ুয়া, ফাসিয়াখালীর পিয়ারী মোহন দে, অনিল কান্তি দাশ,পেকুয়ার নুরুচ্ছফা চৌধুরী, চৌফলদণ্ডীর মোহাম্মদ আলী, আবুল কাসেম, আবু শামা, কবির আহমদ, বড় মহেশখালীর সাধন চন্দ্র দাশ, কুতুবদিয়ার নিরানন্দ নাথ, বশির আহমদ মাস্টার, মাস্টার শাহ আলম, মুক্তারকুলের হরেন্দ্র লাল ভট্টাচার্য, চকরিয়া হারবাং এর দীনবন্ধু চৌধুরী, লক্ষ্যাচরের কিরণ চন্দ্র দাশ, পুটিবিলার অতুল চন্দ্র পাল, ভুপেন্দ্র পাল, ক্ষিরোধ পাল, প্রভারাণী পাল, বজ্রেন্দ মোহন দে, জগবন্ধু, সোন্দর রামদে, রসিক চন্দ্র পাল, মহেন্দ্র ভট্টাচার্য, মন্টুকুমার দাশ, বাসনী পাল, বড় মহেশখালীর আবদুস সাত্তার, শামসুন নাহার, রামুর সোনাইছড়ির শামসুল আলম, মেরুংলোয়ার কামিন মোহন, চিরিঙ্গার মনিন্দ্র কুমার দাশ, আবুল হোসেন, মহেশখালী ঠাকুরতলা  রাখাইন বৌদ্ধ বিহারের ভান্তে উতেজিন্দা, আদু মং, অংটিন, মাদ্রা, উ-ঞানাসহ অনেক শহীদের নাম। শিগগিরই এই তালিকা সংশোধন করে সকল শহীদ মুক্তিযোদ্ধার নাম কক্সবাজার শহীদ স্মৃতিস্তম্ভে অন্তর্ভূক্ত করার জন্য দাবি জানাচ্ছি।
প্রশ্ন :এতক্ষণ সময় দেয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।   
জহর লাল পাল চৌধুরী : ধন্যবাদ আপনাকেও। সাথে সিটিএন এর প্রধান সম্পাদক, সম্পাদকসহ কর্মকর্তা-কর্মচারী, পাঠক এবং শুভানুধ্যায়ীসহ সকলকে।

শেয়ার করুন