মোহাম্মদ আব্দুর রশিদ ছিদ্দিকী : তার নিরীক্ষা ও নির্মিতি

abdur Rashid Siddikiহাসান মুরাদ ছিদ্দিকী :
দ্বিতীয় সহস্রাব্দের শেষ শতকে গুটিকয় বাঙালি মুসলিম কর্মবীর অবিভক্ত ভারতে সাংবাদিকতা ও সাহিত্যে অবিস্মরণীয় অবদান রেখে গেছেন। কক্সবাজারের মোহাম্মদ আব্দুর রশিদ ছিদ্দিকী তাঁদের মধ্যে অন্যতম। ১৮৯৪ সালের মার্চে কক্সবাজার জেলার চকরিয়া থানার কাকারা গ্রামে ছিদ্দিকীর জন্ম। শৈশবে মাতৃহারা ছিদ্দিকী পিতা মুন্সি আবদুল হাকীম মিয়াজী ও বিমাতার কাছে যথেষ্ট আনুকুল্য পেলেও দারিদ্র ও দুরন্তপনার কারণে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে পারেননি। তবে আপন উদ্যম ও প্রচেষ্টায় তিনি বাংলা আরবী ইংরেজী উর্দু ও ফার্সি ভাষায় উল্লেখযোগ্য পাণ্ডিত্য অর্জন করেন। শৈশব থেকেই তিনি স্বাধীনচেতা ও বিদ্রোহী চেতনার অধিকারী ছিলেন। তাঁর কর্মক্ষেত্র বৈচিত্রপূর্ণ ও বিস্তৃত।
১৯০৫ সালের বঙ্গ-ভঙ্গ আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে এদেশের জনগোষ্ঠির এক বিপুল অংশ খুশি হতে পারেনি। ১৯১২ সালে তুরস্কে উসমানী সালতানাতের পতনও এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম মানসে এনেছিল ব্যাপক হতাশা ও চাঞ্চল্য। ১৯১৫ সালে খেলাফত আন্দোলনের মূল নেতা মওলানা মোহাম্মদ আলী ও মওলানা শওকত আলী গ্রেফতার হন। ১৯১৮ সালে খেলাফত আন্দোলন এবং কংগ্রেস যৌথভাবে ‘মন্টেগু চেম্স ফোর্ড সংস্কার’ প্রত্যাখান করে। বাংলাসহ সারা ভারতে ইংরেজ বিরোধী ভাবধারা বহুমুখী ডালপালা প্রসারিত হয়ে চলেছে। এমন এক ক্রান্তিক পরিবেশে ছিদ্দিকী অসীম সাহস ও মনোবল নিয়ে এগিয়ে এলেন ‘সাধনা’ সম্পাদনার ঝুঁকি নিয়ে ১৯১৯ সালে। পত্রিকা প্রকাশ তাঁর নিতান্ত ব্যক্তিগত ও একক প্রচেষ্টার ফসল। সে সময় ভাটি বাংলায় মুসলিম কবি সাহিত্যিক ও সাংবাদিকের সংখ্যা ছিলো হাতে গোনা। মুসলিম মানসে স্বাধীনতার প্রতীতি সঞ্চার, চেতনার আলোকায়ন ও জাতীয় সমৃদ্ধিতে স্বতস্ফুর্ত অংশ গ্রহণে প্রণোদনাই তাঁর ইপ্সিত- পরবর্তিতে চট্টগ্রাম থেকে ‘সাধনা’র কার্যালয় কলকাতায় স্থানান্তর ও সেখান থেকে আরো কয়েকটি পত্রিকা সম্পাদনায় তার প্রমাণ মেলে। সাংবাদিকতাই শুধু নয় সাহিত্য চর্চা, সক্রিয় রাজনীতি, গ্রামে গ্রামে ঘুরে অনলবর্ষী বক্তৃতা, জাতীয় রাজনৈতিক কর্মসুচী ও নির্বাচনে অংশ গ্রহণ, বহুমুখী সামাজিক আন্দোলন এবং নিরাপোষ তৎপরতায় কারাবরণ- আমাদের অভিমতের সত্যায়ন করে।
পাক-ভারত স্বাধীনতা সংগ্রামে তিনি সক্রিয় অংশ গ্রহণ করেন। ১৯২০ সালে অসহযোগ আন্দোলনে যোগদান করে তিনি বিভিন্ন সভা-সমিতিতে বক্তৃতা করেন এবং এক পর্যায়ে চকরিয়া থানা প্রাঙ্গন হতে গ্রেপ্তার হন। ১৯২২ সালে নদিয়া জেলার শিকারপুরস্ত এক তদন্ত কমিশন সভায় বক্তৃতা করার কারণে ছিদ্দিকী পুনরায় গ্রেপ্তার হন। তাকে কুষ্টিয়া কোর্টে প্রেরণ করা হয়। ১৯৩৬ সালে তিনি বঙ্গিয় ব্যবস্থা পরিষদে এবং ১৯৪৬ সালে ছিদ্দিকী বঙ্গীয় প্রদেশিক পরিষদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দিতা করেন। ছিদ্দিকীর কর্মোদ্যম ও বৈষয়িক বুদ্ধির পরিচয় মেলে তার কর্মনিয়োগ এজেন্সিতে আত্মনিয়োগ। তদানিন্তন বাংলায় তিনিই প্রথম ব্যক্তি যিনি বেকার যুবকদের কর্মসংস্থানের জন্য যৌথ সমিতি গঠন করেছিলেন।
বৃটিশ ভারতে বাঙালি মুসলিম সমাজে ধর্মান্ধতা কুসংস্কার ও মোল্লাতান্ত্রিক নিষ্পেষণে নারী সমাজের অবস্থা ছিলো অত্যন্ত নাজুক। সমাজ সংসার এমনকি শিক্ষা লাভের অধিকার থেকেও নারীদের বঞ্চিত রাখা হয়। সামগ্রিক মানবিক দিক থেকে এটি ছিলো নিতান্ত গর্হিত। ছিদ্দিকী বিষয়টি গভীরভাবে উপলব্ধি করেন এবং নারী সমাজের উন্নয়নে সর্বাগ্রে তাদের আত্মজাগৃতির প্রয়োজনীয়তা সামনে রেখে মহিলা বিষয়ক পত্রিকা প্রকাশের পদক্ষেপ নেন। ১৯২১ সালের এপৃলে তাঁর সহধর্মিনী সুফিয়া খাতুনকে সম্পাদক রেখে ‘আন্নেসা’। এটি ছিলো মুসলিম মহিলা সম্পাদিত প্রথম বাংলা সাময়িকী।
সা¤্রাজ্যবাদি শাসন শোষণে নিষ্পেষিত ভারতীয় উপমহাদেশ। প্রত্যন্ত অঞ্চলে বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন জোরদার, মহাত্মা গান্ধী আমরণ অনশনে ব্যাপৃত, জনগণ মুক্তির অন্বেষায় ব্যাকুল। হিন্দু মুসলিম দ্বৈত আন্দোলনে বৃটিশ বিতাড়নে সচেষ্ট। ভারতবর্ষ থেকে আগ্রাসী জাতি লেজ গুটিয়ে নেবার ক্রান্তিকাল। নিভু নিভু প্রদীপে শাসনভার পরিচালনায় হিমশিম খেতে হচ্ছে মাউন্ট ব্যাটেনকে। জনগণের স্বচ্ছ রাজনৈতিক চিন্তা, হিন্দু মুসলিমের অসাম্প্রদায়িক মনোভাব এবং স্বরাজের পরিবর্তে পূর্ণ স্বাধীনতা প্রাপ্তির তাড়নায় পুরো জাতি উদ্বেলিত- ঠিক এমনি এক সন্ধিক্ষণে ১৯২২ সালে ছিদ্দিকী সম্পাদিত ‘মুসলিম জগৎ’ পত্রিকার প্রথম প্রকাশ। এর চার মাস পর ছিদ্দিকী চট্রগ্রাম যাবার প্রাক্কালে পত্রিকা পরিচালনার জন্য ময়মনসিংহের আবুল কালাম মুহাম্মদ শামসুদ্দিনকে (পরবর্তিতে দৈনিক আজাদ ও দৈনিক পাকিস্তানের খ্যাতিমান সম্পাদক ও সাহিত্যিক) সহকারী সম্পাদক নিযুক্ত করেন। ছিদ্দিকী বাড়ি এসেই ৩১ শে অক্টোবর কলকাতা থেকে  টেলিগ্রাম পান যে, সরকার বিরোধী সম্পাদকীয় লেখার জন্য তাঁর বিরুদ্ধে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির চীফ সেক্রেটারীর নামে ওয়ারেন্ট জারি করা হয়েছে। ‘সময় থাকতে সাবধান বুঝে চল বৃটিশ’ শীর্ষক সম্পাদকীয় প্রবন্ধ লেখার জন্য ভারতীয় দন্ডবিধির ১২৪ ও ১৫৩ ধারা অনুযায়ী তাঁর বিরুদ্ধে এ অভিযোগ আনা হয়। ছিদ্দিকী চীফ সেক্রিটারীর কাছে একমাস সময় নিয়ে কলকাতায় তার সঙ্গে দেখা করেন। সরকার পক্ষ তাঁকে একটি মুচলেকা দেওয়া এবং অসহযোগ আন্দোলনের বিরুদ্ধাচারণ করার শর্তে অভিযোগ প্রত্যাহার এবং চার হাজার টাকা এককালীন সাহায্য হিসেবে দেওয়ার প্রস্তাব দেন। ছিদ্দিকী সবগুলো প্রস্তাবই প্রত্যাখ্যান করেন। এ প্রেক্ষিতে ১৯২২ সালের ২২ ডিসেম্বর শুক্রবার সকাল ১০টায় তাঁকে পত্রিকা ভবন থেকে গ্রেফতার করা হয়। ২৫ দিন কারারুদ্ধ থাকার পর ১৮ই জানুয়ারি ১৯২৩ সালে তিনি মুক্তি লাভ করেন। প্রখ্যাত কবি প্রাবন্ধিক খান মুহাম্মদ মঈন উদ্দিন লিখেন “আমি এবং জনাব শামসুদ্দিন মোসলেম জগতের সাথে জড়িত ছিলাম। এ সময় মোসলেম জগৎ সম্পাদক আবদুর রশিদ ছিদ্দিকী রাজনৈতিক মতবাদের জন্য সরকারের রোষানলে পড়ে হাজতবাস করছেন।” উল্লেখ্য, সরকার বিরোধী রাজনৈতিক মতবাদের জন্য মুসলমানদের মধ্যে সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে প্রথম গ্রেফতার হন ‘ধুমকেতু’ সম্পাদক কাজী নজরুল ইসলাম, দ্বিতীয়জন আবদুর রশিদ ছিদ্দিকী। আন্নেসা ৫ম সংখ্যা থেকে প্রকাশনার স্থান কলকাতা কার্যালয় । ১ম পৃষ্ঠার প্রারম্ভে লিপিবদ্ধ থাকত পবিত্র কুরআনের বাণী “নিশ্চয় আল্লাহ কোন জাতির অবস্থার পরিবর্তন করেন না, যে পর্যন্ত সে জাতি নিজেদের অবস্থার পরিবর্তন সাধনে মনোনিবেশ করে।”

এম আব্দুল জব্বারের মতে, আন্নেসা ১৩২৭ বঙ্গাব্দ হতে দুই বছর প্রকাশিত হয়েছিল। বাংলা একাডেমী গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত ১ম বর্ষ ৬ষ্ঠ সংখ্যা থেকে দ্বাদশ সংখ্যার হদিস পাওয়া যায়। ‘আন্নেসা’ জনপ্রিয় করতে এবং নারী সমাজের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলার জন্য ছিদ্দিকী বিচিত্র ও অভিনব পন্থা গ্রহণ করেন। আন্নেসায় পাঠকবর্গের কাছে ৫টি জটিল প্রশ্ন করা হবে এবং প্রশ্নের উত্তরের জন্য ২০ টাকা পুরস্কার দেওয়া হবে। সাহিত্য চর্চায় নারী সমাজের জন্য এটাই প্রথম প্রণোদনা মূলক পদক্ষেপ। পুরুষের ন্যায় নারীদের সম-অধিকার আদায়ের জন্য আন্নেসা ব্যাপক প্রচেষ্টা চালায়। আন্নেসার সম্পাদিকা হিসাবে বেগম সুফিয়া খাতুনের নাম উল্লেখ থাকলেও পত্রিকাটি সম্পূর্ণ সম্পাদনা করতেন আবদুর রশিদ ছিদ্দিকী। আন্নেসার ১ম বর্ষ ৯ম সংখ্যায় শামসুন নাহার ( পরে মুসলিম নারী জাগরণের অন্যতম অগ্রনায়িকা বেগম শামসুন নাহার মাহমুদ) এর ‘পর্দা প্রথা ও নারী স্বাধীনতা’ শীর্ষক সম্পাদকীয় প্রকাশিত হলে নারী সমাজের মধ্যে হৈ চৈ শুরু হয়ে যায়। বেগম মাহমুদা খাতুন ছিদ্দিকা, বেগম ফাতেমা খাতুন, বেগম আয়েশা খাতুন, শ্রীমতি মাখন মতি, শ্রীমতি হেমলতা দেবী, শ্রীমতি কুমুদিনী বসু প্রমুখ প্রতিথযশা লেখিকাদের লেখালেখি আন্নেসায় নিয়মিত প্রকাশ হত। ১৯৩৩ সালে ‘রক্তকেতু’ ও ১৯৪৬ সালে ‘কক্সবাজার হিতৈষী’ নামে আরো দুটি পত্রিকা তিনি সম্পাদনা করেছিলেন। উল্লেখ্য ‘কক্সবাজার হিতৈষী’ কক্সবাজারের সর্ব প্রথম সংবাদপত্র।

সাংবাদিকতার পাশাপাশি সাহিত্য চর্চায়ও প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছিলেন তিনি। কাব্য উপন্যাস গবেষণা মিলে তিনি ২৭টি গ্রন্থ রচনা করেন । তাঁর লেখালেখিতে জীবন ও মূল্যবোধের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। প্রেম প্রকৃতি ও জীবন মৃত্যুর চিরন্তন পরম্পরা এবং পারলৌকিক চিন্তাও তাঁর ভাবনার বিষয়বস্তু হয়েছে। ইসলামের ঐতিহাসিক কাহিনীও তাঁর সাহিত্য চর্চার পেছনে প্রেরণা যুগিয়েছে। মহাকবি ফেরদৌসীর অমর মহাকাব্য ‘শাহনামা’র অন্যতম চরিত্র রোস্তম সোহরাব এর কাহিনী অবলম্বনে ছিদ্দিকী ‘রোস্তম সোহরাব’ কাব্য রচনা করেন। এই আখ্যান কাব্যটির পরিচিতি প্রসঙ্গে ছিদ্দিকীর জীবনীকার এম. আবদুল জব্বার লিখেন- বাংলা ১৩২৪ সালে ছিদ্দিকী ‘রোস্তম সোহরাব’ কাব্যগ্রন্থ রচনা করেন। তাঁহার গ্রন্থে এক সুন্দরতম কবি প্রতিভা ফুটিয়া উঠিয়াছিল।” গ্রন্থটি বর্তমানে দুষ্প্রাপ্য। তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘বাংলা মৌলুদ শরীফ’। হযরত মুহাম্মদ (স.) এর জন্ম, মি’রাজ, বেহেশত-দোযখের বর্ণনা, জুমা ও ঈদের মূল আরবী খুৎবা, উর্দ্দু পদ্যে বাংলা অনুবাদ এবং বাংলা গজলসহ গ্রন্থটি অনন্য সৃষ্টি। বইটি মুহাম্মদী বুক এজেন্সি , ২৯ নং আপার সার্কুলার রোড, কলকাতা থেকে প্রকাশিত। ১৩৫২ বাংলা সনে দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয় ‘যবন বধ কাব্য’। কাব্যটি মূলতঃ ভারত বর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনে হিন্দু মুসলিমের যৌথ প্রয়াসের অবিকল্পতার প্রেক্ষিতে রচিত। ভারতের স্বাধীনতার জন্য প্রয়োজন দুই পক্ষের সম্মিলিত শক্তি, যে কোন হঠকারিতা বিদ্বেষ আক্রোশ তাতে ব্যত্যয় ঘটাবে।
অনৈক্যের রূদ্ধ কপাট ভাঙ্গিয়া খোল মিলন দোর
সত্যিকারের স্বাধীন ভারত তার ফলে মিলন তোর। ওসব কেবল হঠকারীতা আয় দুজনে মিলাও হাত বিজয় দিনের উষা ফুটুক, ঘুচুক দুঃখের আঁধার রাত। ছিদ্দিকীর চতুর্থ কাব্য ‘চিত্ত দর্পন’। প্রখ্যত সাহিত্যিক ও গবেষক মুহাম্মদ আবুল ফজল বলেন, ১৩৪৪ সালে আমি আবদুর রশিদ ছিদ্দিকীর ‘চিত্ত দর্পন’ কাব্য গ্রন্থের পান্ডুলিপি দেখেছি। এ ক্ষুদ্র কাব্য গ্রন্থে মহত্ব ও সত্যের সন্ধানে তাঁর প্রাণ যে আকুল হয়েছে তার পরিচয় মেলে। সত্য পথের সত্তা চেয়ে নিত্য আকুল চিত্ত মোর বিত্ত নিয়ে মত্ত জীবন তত্ত্বহারা ধূর্ত চোর। সন্ধানেরই তীব্র পিয়াস সপ্ত সাগর মন্থনে দেখতে চাহি সত্ত্বা তারি চিত্তের এই দর্পনে। ধুধু তাই নয়, প্রকৃতি ও বিশ্ব জগতে সৃষ্টির যে ছবি তিনি দেখতে পেয়েছেন তাতে একজন ভক্ত সূফী ও প্রেমিক হৃদয়ের পরিচয় ফুঠে উঠে –
‘আকাশে যে ভাষা ফুটিয়ে রয়েছে তারকা যে কথা কহিছে জোনাকী যে আশা ধরিয়া জ্বলিছে পবন যে আশে রহিছে
তারকার ভাষা যদিও কঠিন
জোনাকীর আশা যদিও মলিন
তোমার মনের কামনা বাসনা ফুটিয়া তাহাতে রহিছে
তোমার প্রিয়ার রূপ ছবি জ্যোতি তাদের আলোতে ফুটিছে।
মৌলিক কাব্য রচনা ছাড়াও ছিদ্দিকী পবিত্র কোরআনের আমপারা খন্ডের বঙ্গানুবাদ করেছেন ‘ মহাকোরান কাব্য’ নামে। বাংলা ভাষায় তিনিই প্রথম আমপারার কাব্যানুবাদ করেন, দ্বিতীয় জন কাজী নজরুল ইসলাম। উক্ত গ্রন্থের সুরা ফাতিহার অনুবাদে তাঁর অসাধারণ কাব্য প্রভা পরিলক্ষিত হয়- অনন্ত মহিমা জ্বলন্ত গরিমা রয়েছে দিগন্তে ভরিয়া
হে বিশ্ব রাজন, হে নিঃস্ব শরন, হে প্রেম পূণ্যের দরিয়া, অন্তিম দিনের তুমি বিচারক প্রেমের আধার মঙ্গলকারক দাও হে শক্তি এ দাসেরে প্রভু রয়েছি চরণে লুটিয়া সহজ সরল সঠিক পন্থা দেখাও এ দাসে বিপদ হন্তা চালাও সে পথে যে পথে তোমার প্রেমিকে নিয়েছ তরিয়া। এ ছাড়া ‘চিন্তার ফুল, কলির বাংলা, পাকিস্তান বিজয় কাব্য’ নামে আরো কয়েকটি কাব্যগ্রন্থ তিনি রচনা করেন। সাধনা পত্রিকায় প্রকাশিত এবং ছিদ্দিকীর জীবনীকার এম. আব্দুল জব্বার কৃত জীবনী সূত্রে জানা যায় তিনি পাঁচটি উপন্যাস রচনা করেন- ‘জরিনা, উপেন্দ্র নন্দিনী, প্রণয় প্রদীপ, মেহেরুন্নেসা ও নুরুন্নাহার’। তাঁর উপন্যাসের প্রধান ধারা রোমান্টিকতা। প্রেম বিরহ এবং প্রতিনায়কের ভূমিকা, নানা সামাজিক দুরভিসন্ধি, পরিশেষে মিলন, সত্যের জয় এবং অসত্যের পরাজয়- মোটামুটি এ পরিকল্পনায় তাঁর উপন্যাসগুলো রচিত। তাঁর উপন্যাসের ভাষা বঙ্কিম চন্দ্রের এবং কলাকৌশলে ইসমাঈল হোসেন সিরাজির প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। ছিদ্দিকীর উপন্যাস ‘উপেন্দ্র নন্দিনী’ ইসমাঈল হোসেন সিরাজির ‘রায় নন্দিনী’ এবং তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘জরিনা’ মোজাম্মেল হকের ‘জোহরা’ উপন্যাসকে স্মরন করিয়ে দেয়। ছিদ্দিকীর ‘প্রণয় প্রদীপ’ সাধনায় ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হয়েছিল। ‘জরিনা’ উপন্যাস থেকে কিছু উদ্ধৃতি দেওয়া যায় তাঁর উপন্যানের সাথে পরিচিতি লাভের জন্য ঃ ‘বালিকা আকুল প্রাণে চিন্তা করিতেছে। সই লতিফা আসিয়া অনেকক্ষণ হইতেই তাহার পেছনে দাঁড়াইয়া তাহার এই উদাসিনতা ও চিন্তাক্লিষ্ট ছবিখানী সম্বন্ধে নানা প্রকার ভাবিতেছিল। আজ প্রাণে কোন নতুন কল্পনা, অভিনব আশার উদ্রেক হইয়াছে। অনেকক্ষণ পরেও দেখিল, জরিনার মোহ ভাঙ্গিল না। আজ হাসির সঙ্গে বিষাদ, লহরে ভাবের প্রকাশ, হাসির ঢেউয়ে চিন্তার প্রবাহ, হাসির সৌন্দর্যে আশার প্রহেলিকা। লতিফা বিস্মিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিল: কি জরিনা! আজ তোমায় বড় চিন্তিত দেখিতেছি, হয়েছে কি ? জরিনা উত্তর করিল: কই বোন চিন্তা কিসের ? চিন্তা নাই তবে একা হলেই ভাবনা আসে। জরিনা বলিল: না, উপহাসের কথা নয়। বাস্তবিক এক নতুন জিনিস দেখলুম। ঠিক দুপুর বেলায় আমি উদ্যানে বসিয়া একটি ফুলহার গাঁথছিলুম, এমন সময় হঠাৎ এক যুবক আসিয়া উপস্থিত। আমি তাকে দেখিয়াই লজ্জায় জড়সড় হইয়া চলিয়া আসি। তাকে দেখিয়াই যেন কোন আত্মীয় স্বজন বলিয়া ধারনা হইল। লতিফা বাধা দিয়া বলিলঃ বাহ ! আত্মীয় ভাবিয়া ফেলিয়াছ ? আর কিছু ভাবিলে ঠিক হতো। জরিনা বলিলঃ আর কি ভাবিবো ? লতিফা বলিলঃ পতি! জরিনা বলিলঃ ছি,ছি, তোমার মুখে ছাই …। ছিদ্দিকী কাব্য উপন্যাস ছাড়াও চট্টগ্রামী ভাষা ও তার উৎপত্তি এবং বিকাশ সম্পর্কিত তিনটি গবেষণা গ্রন্থ লিখেছেন যা বাংলা ভাষার ব্যাকরণ ও গতি প্রকৃতি জানার ব্যাপারে আমাদের অনেকাংশে সাহায্য করবে। ড. মুহাম্মদ এনামুল হক তাঁর ‘চট্টগ্রামী বাঙ্গালার রহস্য ভেদ’ গ্রন্থে ছিদ্দিকীর প্রকাশিত বইয়ের কথা উল্লেখ করেছেন। চট্টগ্রামী ভাষার ধ্বনিতাত্ত্বিক ও গাঠনিক শক্তির উৎকর্ষ বিশ্লেষণ করে ছিদ্দিকী ‘চট্টগ্রামী ভাষাতত্ত্ব’ ও ‘চট্টগ্রামী রোমাই তত্ত্ব’ নামে দুটি তথ্যবহুল গ্রন্থ রচনা করেন। পান্ডিত্য ও মেধায় ছিদ্দিকী ছিলেন স্বমহিমায় প্রোজ্জ্বল। আব্দুর রশিদ ছিদ্দিকীর কাব্য ও সাহিত্য কর্ম নিয়ে আধুনিক শিল্প ও সাহিত্য সমালোচকরা চুলচেরা বিচার বিশ্লেষণ করলে বাংলা সাহিত্য ভান্ডার আরো সমৃদ্ধ হবে। যে যুগ ও পরিবেশে ব্যক্তিগত প্রচেষ্টা ও উদ্যমে উদ্দিপ্ত হয়ে তিনি সাহিত্য সাংবাদিকতার মাধ্যমে জাতীয় জাগরণের প্রয়াস চালিয়েছেন তাও আমাদের বিবেচনায় রাখতে হবে। আমাদের ইতিহাস ও বৃটিশের হাত থেকে স্বাধীনতা আন্দোলনের পটভূমি বিচার বিশ্লেষণে অনেক দূও এগুলেও এদেশের অনেক সাহিত্য ও সমাজ কর্মীর অবদান এখনো সঠিক মূল্যায়ন বা উম্মোচন করতে পারিনি। প্রখ্যাত সাহিত্যিক অধ্যাপক আবুল ফজল তাঁদের কথা স্বীকার করে লিখেছেন- “এদের উদ্যোগ, উদ্যম আর প্রচেষ্টার পরিচয় ও মূল্যায়ন দরকার। তা নইলে আমাদের সাংবাদিকতা ও সাহিত্যের ইতিহাস অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। আমাদের সাহিত্য সাধনার ধারা যতই ক্ষীণ হোক তার মধ্যেও আগাগোড়া একটা যোগসুত্র আছে। আর তা ঐতিহাসিক ক্রমবিবর্তনের অংশ। প্রায় অর্ধশতাব্দি আগে আমাদের পূর্বসূরীরা যে চিন্তা ভাবনা করেছেন তার পরিচয় মূল্যহীন বিবেচিত হওয়ার কোন কারণ নেই। সামাজিক ও ইতিহাসের দিক থেকে এসবের গুরুত্বপূর্ণ মূল্য রয়েছে।” আমরা এই অভিমতের সাথে একমত পোষণ করে আবদুর রশিদ ছিদ্দিকীর রচনাবলি প্রকাশ ও তাঁর কর্মের যথাযথ মূল্যায়নে সরকারি পদক্ষেপ প্রত্যাশা করি।
হাসান মুরাদ ছিদ্দিকী: কবি ও প্রাবন্ধিক। সর্বশেষ প্রকাশিত গ্রন্থ : চিন্তাবৃত্তি আহমদ ছফা ও অন্যান্য


শেয়ার করুন