মেগা প্রকল্প হাতির খোরাকে পরিণত

সিটিএন ডেস্কঃ

মেগা প্রকল্প যেন হাতির খোরাকে পরিণত হয়েছে। যে ব্যয়ে অনুমোদন দেয়া হয়েছে সেই খরচে প্রকল্প সমাপ্ত করা যাচ্ছে না। তেমনি একটি মেগা প্রকল্প মাতারবাড়ি ১২০০ মেগাওয়াট আল্ট্রাসুপার ক্রিটিক্যাল কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ। ৯ বছরের প্রকল্পে ৭ বছরে এসে ৪৫.৫৬ শতাংশ বা ১৬ হাজার ৪০৪ কোটি টাকা খরচ বাড়ছে। যেখানে বিবিধ খাতেই বাড়ছে ১৯১ কোটি টাকা। অনুমোদিত খরচ ৩৫ হাজার ৯৮৪ কোটি ৪৬ লাখ টাকা। প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে হচ্ছে ৫২ হাজার ৩৮৮ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। অন্যান্য মেগা প্রকল্পেরও একই দশা। পরিকল্পনা কমিশনের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ বলছে, এত বড় একটি ব্যয়বহুল এবং উন্নয়ন মহাপরিকল্পনার সাথে সংশ্লিষ্ট প্রকল্পের সম্ভাব্যতা বিশ্লেষণে চ্যানেলের ব্যাপারটি উপেক্ষিত হয়েছে। প্রকল্পের প্রাথমিক নিরীক্ষার কাজে চ্যানেলের বিষয়টি যথাযথভাবে দেখা হয়নি।

পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা গেছে, সরকার সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় পাওয়ার সেক্টর মাস্টার প্ল্যান অনুযায়ী আগামী ২০৩০ সালে দেশে ৪০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছে। আর সে আলোকে বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করছে। বর্তমানে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা হলো ২৫ হাজার মেগাওয়াটের কিছু বেশি। এ পর্যন্ত সর্বোচ্চ দৈনিক চাহিদা সাড়ে ১৩ হাজার থেকে ১৩ হাজার ৭০০ মেগাওয়াট। বিদ্যুতের চাহিদা পূরণে কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলায় মাতারবাড়িতে ২টি ৬০০ মেগাওয়াটের মোট ১২০০ মে.ও. আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল কোল ফায়ার্ড পাওয়ার প্রজেক্ট (প্রথম সংশোধন) ২০১৪ সালের ১২ আগস্ট একনেক থেকে অনুমোদন দেয়া হয়। প্রকল্প ঋণসহ ৩৫ হাজার ৯৮৪ কোটি ৪৫ লাখ ৯৮ হাজার টাকা ব্যয়ের এই প্রকল্পটি সমাপ্ত করার সময় ছিল ২০২৩ সালের জুনে। কিন্তু এখন এটার খরচ বাড়িয়ে ৫২ হাজার ৩৮৮ কোটি ৭৭ লাখ ১১ হাজার টাকা করার প্রস্তাব দেয়া হচ্ছে। আর প্রকল্পের মেয়াদ আরো সাড়ে ৩ বছর বাড়িয়ে ২০২৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত করার প্রস্তাব হচ্ছে। খরচ বাড়ছে ১৬ হাজার ৪০৪ কোটি ৩১ লাখ ১৩ হাজার টাকা। প্রকল্পে জাইকা থেকে ঋণ নেয়া হয়েছে। সিপিজিসিএল প্রকল্পটি বাস্তবায়নকারী সংস্থা।

জানা গেছে, যেখানে ২০২৩ সালের জুনে প্রকল্পটি সমাপ্তির সময় নির্ধারণ করা আছে, সেখানে ২০১৪ সাল থেকে চলতি ২০২১ সালের এপ্রিল পর্যন্ত প্রকল্পের বাস্তব অগ্রগতি মাত্র ৪২ শতাংশ। অর্থ ব্যয় হয়েছে ৪৫.৬ শতাংশ। আর ইপিসি কাজের অগ্রগতি ৫২.১১ শতাংশ। প্রকল্পের আওতায় কাজগুলো হলো, ২টি ৬০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তির বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ, প্রকল্প এলাকার জন্য সমুদ্র গভীর নাব্যতার চ্যানেল এবং তেল ও কয়লার জন্য পৃথক পৃথক দুটি জেটি নির্মাণ, স্থায়ী টাউনশিপ নির্মাণ, বিভিন্ন পূর্তকাজ,
ভূমি অধিগ্রহণ ও উন্নয়ন।

প্রকল্পের উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে নির্বাচিত জাপানি ঠিকাদার এবং বিশ্বের বিভিন্ন পরামর্শক রয়েছে। ইপিসি ঠিকাদার হলো, জাপানের সুমিতোমো করপোরেশন, তোশিবা এনার্জি সিস্টেম অ্যান্ড সলুশন করপোরেশন এবং আইএইচআই করপোরেশন। আর পরামর্শক প্রতিষ্ঠান হিসেবে রয়েছে জাপানের টেপসকো, নিপপন কওই, জার্মানির ফিথনার এবং অস্ট্রেলিয়ার এসএমইসি।

প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পোর্ট ও জেটি নির্মাণ প্রক্রিয়া সবচেয়ে দৃশ্যমান। সমুদ্রগামী বিভিন্ন জাহাজ থেকে প্রকল্পের মালামাল খালাসে গত ডিসেম্বর থেকে নবনির্মিত একটি স্থায়ী জেটি ইতোমধ্যেই ব্যবহার করা হচ্ছে। আরেকটি জেটি নির্মাণকাজ চলমান আছে। প্রকল্প এলাকার জন্য সমুদ্র গভীর নাব্যতার চ্যানেল এবং তেল ও কয়লার জন্য পৃথক পৃথক দুটি জেটি নির্মাণ, স্থায়ী টাউনশিপ নির্মাণ, বিভিন্ন পূর্তকাজ, ভূমি অধিগ্রহণ ও উন্নয়ন কাজ চলমান আছে।

প্রকল্প সংশোধনের কারণ হলো, ২০১৪ সালে মূল প্রকল্পটি অনুমোদন দেয়া হয়। বিভিন্ন কারণে প্রকল্পের ব্যয় বাড়ছে। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, চ্যানেল ড্রেজিং ও চ্যানেলের অন্যান্য আনুষঙ্গিক স্থাপনা নির্মাণ ও জেটি নির্মাণকাজ। আর প্রকল্পের ওয়ারেন্টি সেবার সময় বৃদ্ধির কারণে সংশোধন করা হয়েছে। প্রকল্প এলাকায় মাটি প্রফাইলের পূর্ণ অনুসন্ধান তথ্য অনুযায়ী, প্রকল্প এলাকার মাটির গুণগত অবস্থা জাইকার জরিপের প্রাথমিক ফলাফলে অপ্রত্যাশিতভাবেই খুবই দুর্বল।

প্রাপ্ত তথ্য পর্যালোচনায় আইএমইডি বলছে, বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ এবং চ্যানেল ও জেটি নির্মাণে ব্যয় বেড়েছে দ্বিগুণ। মূল ডিপিপিতে ব্যয় ধরা হয় ৭ হাজার ৯১ কোটি ২৫ লাখ টাকা। সেটা এখন বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ১৪ হাজার ৩২৬ কোটি ৯৭ লাখ ৬৯ হাজার টাকা। ফলে এই অঙ্গের ব্যয় ২১ হাজার ৪১৮ কোটি ২৩ লাখ টাকা বা মোট খরচের ৮৭.৩৪ শতাংশ।

বাড়তি খরচের মধ্যে মাতারবাড়ি বন্দর উন্নয়নে অতিরিক্ত কাজের জন্য ২ হাজার ৩৫০ কোটি ১৩ লাখ ১৩ হাজার টাকা ব্যয় হবে। পাওয়ার প্ল্যান্ট মাটির উন্নয়নে ব্যয় ১১ হাজার ৯৭৬ কোটি ৮৪ লাখ ৫৬ হাজার টাকা। বলা হচ্ছে অতিরিক্ত কাজ ও ব্যয় ভ্যারিয়েশন অর্ডারের মাধ্যমে প্রকল্পের ইপিসি ঠিকাদার ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠান কর্তৃক কার্যকর করা হবে। বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ইপিসির অংশ বয়লার নির্মাণে ব্যয় ৬৫০ কোটি ৮৫ লাখ ৪২ হাজার টাকা বৃদ্ধি পাচ্ছে। যেখানে এই খাতে অনুমোদিত ব্যয় ছিল ৮ হাজার ৩৭ কোটি ১৯ লাখ টাকা।

ইপিসি অংশে টারবাইন ও জেনারেটর নির্মাণে ব্যয় বরাদ্দ ছিল ৪ হাজার ৫৭৯ কোটি ৬ লাখ টাকা। এখন তা বৃদ্ধি পেয়ে হচ্ছে ৬৪২ কোটি ১৯ লাখ টাকা। আর কয়লা ও ছাই হ্যান্ডেলিং সিস্টেমের জন্য ব্যয় বরাদ্দ ছিল ২ হাজার ২২৩ কোটি ৫৯ লাখ ৩৮ হাজার টাকা। এখানেও খরচ বাড়ছে ১৯২ কোটি ২৯ লাখ ২৯ হাজার টাকা। ১২০ জন মাস প্রশিক্ষণ কার্যক্রমের জন্য অনুমোদিত ব্যয় ছিল ১৪ কোটি ৮৭ লাখ ৭০ হাজার টাকা। সেখানেও বাড়ছে ৭ কোটি ৫০ লাখ টাকা। ট্রায়াল রান ইপিসির অংশে খরচ ধরা হয়েছিল ১ হাজার ৯২৬ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। এখন ব্যয় বাড়ছে ২৫২ কোটি ৮৩ লাখ ৫৬ হাজার টাকা। বলা হচ্ছে ইপিসির চুক্তি মূল্যের পরিপ্রেক্ষিতে এই ব্যয় বৃদ্ধি।

স্টার্টআপ যন্ত্রপাতির ক্ষেত্রে খরচ বাড়ছে ১ কোটি ৯৩ লাখ টাকা। ইন্স্যুরেন্স স্থানীয় পরিবহন হ্যান্ডেলিং চার্জ বাড়ছে ১০৬ কোটি ৮১ লাখ ১৭ হাজার টাকা। দেশী ও বিদেশী পরামর্শক সেবায় ব্যয় বাড়ছে ৩২৭ কোটি ৮১ লাখ ৫৯ হাজার টাকা। ফলে পরামর্শক খাতে ব্যয় ৫০৭ কোটি ১১ লাখ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৮৩৪ কোটি ৯৩ লাখ টাকা, যা মোট খরচের ২ শতাংশ। নির্মাণকালীন সুদ দিতে হবে ১ হাজার ৩৯২ কোটি ৬ লাখ টাকা।

আইএমইডি বলছে, এক নম্বর চুক্তিতে ৪৭৯ কোটি টাকার ডিজাইন ও পরামর্শক সেবার দরপত্র বিক্রির সংখ্যা এবং জমার সংখ্যার বিপরীতে কোনো তথ্যই উল্লেখ নেই। দুই নম্বর চুক্তির প্যাকেজে ১১টি দরপত্র বিক্রি করা হয়েছিল। এর মধ্যে ৩টি জমা হয়েছে। এই দরপত্রের বিজ্ঞাপন সিপিটিইউর মাধ্যমে ই-জিপিতে যায়নি। একইভাবে চুক্তি নম্বর তিন এর প্যাকেজে ৭টি দরপত্র বিক্রি করা হয়। মাত্র একটি জমা হয়েছে। কিন্তু এই দরপত্রের বিজ্ঞাপন সিপিটিইউর মাধ্যমে ই-জিপিতে যায়নি। চার নম্বর চুক্তির প্যাকেজে ১০টি দরপত্র বিক্রি করা হয়। জমা পড়ে ৩টি। এই দরপত্রের বিজ্ঞাপন সিপিটিইউর মাধ্যমে ই-জিপিতে যায়নি। চুক্তির ক্ষেত্রে প্রাক্কলিত ব্যয়ের চেয়ে প্রকৃত ব্যয়ের বিচ্যুতি ৩২.১ শতাংশ।

প্রকল্পে মাটির গুণগত মান অপ্রত্যাশিত দুর্বল। ডিটেইল্ড ডিজাইনে এসে চ্যানেলের নাব্যতা সঙ্কটটি ধরা পড়ে। ২০১৬ সালে গুলশানের হোলে আর্টিসানের ঘটনায় ইপিসি বিড সাবমিশন দীর্ঘায়িত হয়। ইপিসি কাজ শুরু করে প্রকল্প অনুমোদনের তিন বছর পর, ২০১৭ সালের ২ আগস্ট।

এদিকে, প্রকল্পের ব্যাপারে সুপারিশে আইএমইডি বলেছে, পাওয়ার প্ল্যান্ট ও জেটি নির্মাণে প্রাক্কলিত খরচ ১৩ হাজার ১৯৬ কোটি টাকা বাড়ানোয় ইপিসি চুক্তির যাবতীয় তথ্যের বিষয়ে আইএমইডিকে অবহিত করতে হবে। প্রকল্পটি সুষ্ঠু বাস্তবায়নে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি কর্তৃক নিয়মিত তদারকি করা প্রয়োজন। প্রকল্পের জন্য বিদেশে প্রস্তুতাধীন যন্ত্রপাতি নির্মাণকাজ কোন পর্যায়ে আছে তা নিয়মিতভাবে মনিটরিং করা প্রয়োজন।
আইএমইডি বলছে, বেশ কয়েকটি অঙ্গে ডিপিপির চেয়ে অধিক ব্যয়ে চুক্তি করা হয়েছে। চলতি বছরের মে পর্যন্ত ডিপিপি সংস্থানের চেয়ে অতিরিক্ত ব্যয়ও করা হয়েছে। আর অঙ্গগুলো হলো, বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ, ইলেক্ট্রিফিকেশন, ইরেকশন ও কমিশনিং, ভ্যাট ও আয়কর এবং পুনর্বাসন ও ক্ষতিপূরণ।

প্রকল্পের খরচ বৃদ্ধির ব্যাপারে পরিকল্পনা কমিশনের শিল্প ও শক্তি বিভাগের সদস্য (সচিব) শরিফা খানের সাথে গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ফোনে জানতে চাওয়া হলে তিনি নয়া দিগন্তকে বলেন, প্রথমে যখন পিইসি হয় তখন আমাদের পক্ষ থেকে বেশ কিছু অবজারভেশন দেয়া হয়েছিল। সে আলোকে তারা আরডিপিপি পাঠিয়েছে। এখন আমরা সেটা পর্যালোচনা করব। খরচ বাড়ছে বেশ কয়েকটি অঙ্গ নতুন করে যুক্ত হয়েছে। বিশেষ করে মূল ডিপিপিতে ডিপ সিপোর্ট ছিল না। এখন সেটা করতে হচ্ছে। দুটি ডিপো লাগবে। সেখানে ব্যয় বাড়ছে।

আগে শুধু বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কয়লার জন্য যতটা দরকার ছিল ততটা করার লক্ষ্যমাত্রা ছিল। এখন এলএনজি এবং কমার্শিয়াল জেটিও করতে হচ্ছে। তিনি বলেন, প্রথমে ৩.৮ কিলোমিটার চ্যানেল নির্মাণের কথা ছিল। এখন সেটা সাড়ে ১৪ কিলোমিটার হচ্ছে। পোর্ট উন্নয়নের জন্য বাড়তি ১০০ কিলোমিটার চ্যানেল ড্রেজিং করতে হচ্ছে।


শেয়ার করুন