মৃত্যুর অপেক্ষায় তারা

2016_03_03_15_19_24_ImX8ELYfNPYnSBfpfn5zJ2krbt6xef_originalফিচার ডেস্ক

কোলে মাত্র ১৮ মাসের ছেলেকে নিয়ে স্বাস্থ্যকর্মীর পাশে দাঁড়িয়ে আছেন মদিনা বরু। স্বাস্থ্যকর্মী অনেক চেষ্টা করে যাচ্ছেন শিশুটির চর্মসর্বস্ব হাতটিতে ফিতে প্যাঁচানোর জন্য। কিন্তু শিশুটির হাত অনাহারে অর্ধাহারে এতটাই শুকনো যে ফিতে পেঁচাতেও কষ্ট হচ্ছে স্বাস্থ্যকর্মীর। মদিনা বরুর সন্তান ইথিওপিয়ার সেই চার লাখ শিশুর মধ্যে একজন যারা ভয়াবহ ক্ষুধা ও দারিদ্রের মধ্যে বেড়ে উঠছে। প্রায় এক দশকেরও বেশি সময় ধরে চলমান খরা পরিস্থিতিতে ইথিওপিয়ার সাধারণ জনগণের অবস্থা এখন ভয়াবহ রকমের খারাপ। বছরের পর বছর বর্ষা না হওয়ায় খরায় ফুটিফাটা মাঠে কিছুই ফলছে না। মদিনা বরুর সন্তানের মতো হাজার হাজার ইথিওপিও শিশু তাই আজ মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে।

ইথিওপিয়ার সরকারের এক পরিসংখ্যান মতে, দেশটিতে গত এক দশকে খরা পরিস্থিতির কারণে প্রায় ১১ মিলিয়ন মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং তারা মানবেতর জীবনযাপন করছে। দেশটির রাজধানী আদ্দিস আবাবা থেকে মাত্র ১৬০ কিলোমিটার দক্ষিণের একটি গ্রাম অগলচো। এই গ্রামে আছে একটি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র, যে কেন্দ্রের দেয়ালে দাগ কেটে দেখানো আছে ওই অঞ্চলে বসবাসকারী পাঁচ বছর বয়সের নিচে শিশুদের জন্য খাবারের তালিকা। প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত অভিজ্ঞ স্বাস্থ্যকর্মীরা দুঃস্থদের মাঝে ওষুধ ও মাখন সরবরাহ করে। শিশুদের শরীরের পুষ্টি ঘাটতি মোকাবেলায় এই মাখন দেয়া হয়।

2016_03_03_15_19_22_Ymkb15gZXwv7poTEMgfuOz5JvXewGK_originalমানবেতর সমস্যা শুধুমাত্র ইথিওপিয়াতেই বিরাজ করছে না। পার্শ্ববর্তী দেশ দক্ষিণ সুদানেও একই অবস্থা বিরাজ করছে। কিন্তু দক্ষিণ সুদানে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা মানবিক সহায়তা করলেও ইথিওপিয়ার জনগণের পাশে রয়েছে শুধুই সরকার। সরকারকেই খাবার সরবরাহ করা থেকে, খাল খনন, ট্রাকে করে খরা অঞ্চলে পানি সরবরাহ এবং ৩৮ হাজার সেনা সদস্যকে স্বাস্থ্যকর্মী হিসেবে কাজে লাগাতে হচ্ছে। দেশটির গ্রামাঞ্চলগুলোতে স্বাস্থ্যসেবার জন্যই তাদের নিয়োজিত করা হয়েছে। ইথিওপিয়ায় নিযুক্ত জাতিসংঘ কর্মকর্তা পল হ্যান্ডলি বলেন, ‘এখানে সত্যিকার অর্থেই সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা জরুরী। একটা উন্নত পরিকল্পনার ভিত্তিতে এখানে মানবিক সহায়তায় এগিয়ে আসা প্রয়োজন।’

ইথিওপিয়া সরকার ইতোমধ্যেই ২৭০ মিলিয়ন পাউন্ড ব্যয় করেছে খরা পরিস্থিতি মোকাবেলায়। কিন্তু রাষ্ট্রের তহবিলও তলানিতে ঠেকায় সরকারের পক্ষেও তার জনগণের পাশে দাঁড়ানো সম্ভব হচ্ছে না। অন্যদিকে বিভিন্ন অর্থ লগ্নিকারী প্রতিষ্ঠান ও মানবাধিকার দলগুলো যার যার নিজস্ব এজেন্ডা নিয়ে দেশটির সরকারের সঙ্গে দেনদরবার করতে চাইছে। সরকারের জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিশনের কমিশনার মিতিকু কাস্সা এবিষয়ে বলেন, ‘দেশের উন্নয়ন খাতের বাজেট স্থানান্তর করে অন্য খাতে ব্যবহার করার জন্য বিভিন্ন মানবাধিকার বিষয়ক অংশীদাররা চাপ প্রয়োগ করে আসছে। কিন্তু এর ফলে যে দেশ আগামীতে আরও বড় বিপর্যয়ের মুখে পরবে তা বুঝতে পারছে না।’

এতকিছু স্বত্ত্বেও দেশটির সরকার এবং বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলে আসছে যে, খরায় আক্রান্ত মানুষদের সহায়তা করা হচ্ছে নিয়মমাফিক। কিন্তু সরেজমিনে দেখা যায় ভিন্ন চিত্র। অগলচো গ্রামের বাসিন্দা মদিনা বরোই অভিযোগ করে জানান যে, সরকারের পক্ষ থেকে যে খাবার দেয়া হয় তা একটা পরিবারের জন্য যথেষ্ট নয়। ‘আমাদের পরিবারের লোকসংখ্যা দশজন। কিন্তু আমাদের যে খাবার দেয়া হয় তা মাত্র পাঁচ জনের জন্য। যদি সত্যিই তারা পর্যাপ্ত খাবার দিতো তাহলে আমার সন্তানের অন্তত দুধের অভাব হতো না। তখন আর আমার সন্তানকে এরকম দেখতে লাগতো না।’

2016_03_03_15_19_18_pPF15whmfT8lxvXFrsH57mC8eiH07G_originalস্থানীয় চাষীরা সরকারের সমালোচনা করছেন। তাদের মতে, সরকার ঠিকমত খাবার বিতরণ করছে না এবং খাবার সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্নীতিতে আক্রান্ত। আজো মাইহেষা নামের এক চাষী জানান, ‘স্থানীয় যাদের কাছে সরকার থেকে সহায়তা আসে তারা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সেই ত্রানের সিংহভাগই নিজেদের জন্য রেখে দেন এবং বাকী অংশ চাষীদের মাঝে বিতরণ করে।’ ১৯৮৪ সালে ইথিওপিয়ায় খরাজনিত কারণে আরও একবার দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল, তখন বিপুল সংখ্যক মানুষ মারা গিয়েছিল দেশটিতে। গবেষকদের ধারণা, ইথিওপিয়ায় যদি বর্তমান অবস্থা আর দীর্ঘমেয়াদে চলতে থাকে তাহলে দেশটির প্রায় চার লাখ শিশু স্রেফ খাদ্যাভাবে মারা যাবে।

আন্তর্জাতিক বিশ্ব আজ যুদ্ধ আর সংঘাতে লিপ্ত। বিপুল অর্থ ব্যয় করে শত্রু নিধনে মরণাস্ত্র নির্মানে ব্যস্ত উন্নত দেশগুলোর পক্ষে ইথিওপিয়ার মতো অনুন্নত দেশগুলোর দিতে তাকানোর সময় নেই। এমনকি জাতিসংঘের মতো প্রতিষ্ঠানও ইরান কিংবা উত্তর কোরিয়ায় অবরোধ জারি বিষয়ে যতটা তৎপরতা অব্যাহত রাখে, ঠিত ততটাই অনাগ্রহ খরাপ্রবণ দেশগুলোর ব্যাপারে। ইথিওপিয়ায় আজ এমন একটা পরিবার পাওয়া যাবে না যাদের ঘরে গৃহপালিত পশু খেতে পাচ্ছে। কৃষিনির্ভর দেশটি আজ ক্ষুধা মন্দায় জর্জরিত। তাইতো মদিনার কণ্ঠে ফুটে ওঠে অসহায়ত্ব, ‘আমাদের যা ছিল তা শেষ করে ফেলেছি। আমাদের গরুগুলো একটা একটা করে মারা যাচ্ছে। কোনো অলৌকিক ঘটনা ছাড়া আমরা স্রেফ মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করছি।’


শেয়ার করুন