মুক্ত মতপ্রকাশের পথে পথে কাঁটা

সুলতানা কামাল

আমরা পত্রিকায় লিখি, অনেকে লিখেন ব্লগে। আমরা পত্রিকায় সমাজের বিভিন্ন ঘটনা নিয়ে মতপ্রকাশ করে থাকি। ব্লগে যারা লিখেন তারাও একই কাজ করেন, তারা সমাজে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনা নিয়ে আলোচনা করে থাকেন, যুক্তি উপস্থাপন করেন। এতে পাল্টা মত আসে। যুক্তি আসে। আমরা ভিন্নমতকে সাধুবাদও জানাই। স্বাগত জানাই। এ কথা ঠিক যে পত্রপত্রিকায় লেখালেখিতে অনেক সময় নানা বাধা-নিষেধ আরোপিত হতে পারে। সম্পাদক, মালিক-এর মতানুযায়ী লেখা সাজাতে হতে পারে। কিন্তু ব্লগ এমন একটা ক্ষেত্র, যেখানে মন খুলে নিজের মতামত তুলে ধরা যায়। তাই সেখানে নানা মতের প্রকাশ ঘটে থাকে। তাই বলে মতপ্রকাশের কারণে, ব্লগে লেখার অপরাধে কাউকে হত্যা করা হবে? কেন বারবার এসব হত্যাকান্ড ঘটছে?
ওয়াশিকুর রহমান বাবু ব্লগে লিখত। ফেসবুকে লিখত। মুক্তমতের এই ছেলেটিকে হত্যা করা হলো তখন, যখন বিজ্ঞান গবেষক ও লেখক অভিজিৎ হত্যার মাস পার হয়েছে মাত্র। ওয়াশিকুর রহমান বাবুর হত্যাকান্ড ধারাবাহিক হত্যাকান্ডেরই অংশ। ধারাবাহিক এই হত্যাকান্ডের জন্য মূলত বিচারহীনতার সংস্কৃতিই দায়ী। কেননা, অন্যায় করে যখন কেউ পার পেয়ে যায়, তখন অপরাধপ্রবণতা সমাজে বেড়ে যায়। এই অপসংস্কৃতি আমরা তৈরি করেছি। সবচেয়ে বড় কথা হলোÑ যারা সন্ত্রাসী, অস্ত্র আছে যাদের হাতে, জঙ্গিবাদী কর্মকান্ড করে, তারা এখন অনেক বেশি সুযোগ পাচ্ছে। এর ফলে অপরাধের মাত্রা বেড়ে গেছে। এটা শুধু দেশে নয়, আন্তর্জাতিকভাবেই বিস্তার লাভ করেছে। একদিকে তালেবান, অন্যদিকে আইএস এবং আরও নানা গোষ্ঠী জঙ্গিবাদী কর্মকান্ড চালাচ্ছে। এরা গোটা পরিস্থিতিই ঘোলাটে করে ফেলেছে।
একটা সময় জামায়াতে ইসলামী দল নিজ নামেই এসব হত্যাকান্ড সংঘটিত করত। নৃশংসতা করত। কিন্তু দিন পরিবর্তন হয়েছে, এখন জঙ্গিবাদীরা ভিন্ন ভিন্ন নামে নৃশংসতা চালাচ্ছে। এদের উদ্দেশ্য এক, উৎসও অধিকাংশ ক্ষেত্রে এক। শুধু কৌশল পরিবর্তন করে ভিন্নভাবে তাদের কর্মকান্ড পরিচালিত করছে। একসময় বাংলা ভাই জামায়াতের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল, পরে অন্য সংগঠনের নামে সমাজে অনাচার চালিয়েছে। বর্বরোচিত হত্যাকান্ড সংগঠিত করে কখনো সামনে কখনো পেছনে থেকে কাজ করেছে।
একাত্তরে আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছি। যে স্বাধীনতা আমরা চেয়েছিলাম, তা অর্জিত হয়েছে। পেয়েছি একটি স্বাধীন ভূখন্ড। ভূখন্ডের দিক থেকে স্বাধীনতা পেলাম, সামনের দিকে এগোনোর জন্য আমরা প্রস্তুতিও নিতে থাকলাম। কিন্তু পঁচাত্তরে এমনই এক অঘটন ঘটল এবং তার ফলে যে আঘাত এলো আমাদের ওপর, বাংলাদেশের যে মৌলিক চেতনা তৈরি হয়েছিল বহুদিন ধরে, পঁচাত্তরের পর তা একেবারে পিছনের দিকে ঠেলে দেওয়া হলো। এখন প্রশ্ন উঠছে, যে চেতনায় আমরা বিশ্বাসী, যে চেতনার ওপর ভর করে বাহান্নর ভাষা আন্দোলন, একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ করেছি, সেটি আমরা আর কি পরিপূর্ণভাবে ফিরে পাব? আমার বিশ্বাস আছে পাওয়ার। আমার আস্থা রয়েছে মানুষের ওপর। গোটা সমাজের ওপর। যে সমাজের মানুষেরা ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন করে, ভাষা আন্দোলন করে, একাত্তরে অকাতরে রক্ত দিতে পারে, সে সমাজ বিনষ্ট হতে পারে না। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিলুপ্ত হতে পারে না। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এখনো মানুষ ভালোভাবেই ধারণ করে বলেই আমার বিশ্বাস। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে রক্ষা করার জন্যই তো গণতন্ত্র, মানবাধিকার সংরক্ষণ করা আমাদের দায়িত্ব। তা যদি আমরা শক্ত হাতে সংরক্ষণ করতে না পারি, সেটার প্রতি দৃঢ় সমর্থন জোগাতে না পারি, এ দেশের সংকট শেষ হবে না। বারবার প্রগতিশীলতার ওপর, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ওপর আঘাত আসবেই।
রাজনীতিবিদেরা অনেক কৌশল নেন। আপোসকামিতার পথেও হাঁটেন। তবে কৌশল ও আপোসকামিতার মধ্যে তফাত রয়েছে। বাস্তবতার কারণেও অনেক সময় কৌশলী হতে হয়। এখন আমরা যা দেখি তা হলোÑ আপোসকামিতা। কিসের জন্য? ক্ষমতার জন্য। আধিপত্য বজায় রাখার জন্য। এই জিনিসটি ঢুকে গেছে আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে, যা একটি প্রগতিশীল রাষ্ট্র গঠনের পথে বাধা হিসেবেই কাজ করবে। সেটা কোনোভাবেই কাক্সিক্ষত নয়।
ধর্মচর্চা নিয়ে নানা কথা রয়েছে সমাজে। নানা ভাবনা রয়েছে মানুষের মধ্যে। রাজনীতিবিদেরা মনে করেন, আমি যত বেশি ধর্মানুরাগী হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করব, তত বেশি মানুষের সমর্থন পাব। রাজনীতিবিদেরা যতক্ষণ ধর্মমিশ্রিত ক্ষমতার রাজনীতির চর্চা করবেন, ততদিন তারা এই নিয়ম থেকে বের হতে পারবেন না। ধর্ম নিয়ে রাজনীতি চলতে দিলে এ পরিস্থিতির পরিবর্তন হবে না। কিন্তু লাখো মানুষের রক্তে অর্জিত এই দেশে এমনটি হতে পারে না। কারণ আমাদের মূল কথাই ছিল জাতি, ধর্ম, শ্রেণী, লিঙ্গ, কে কোথায় জš§গ্রহণ করেছে নির্বিশেষে সমান অধিকার ও সমান মর্যাদার দাবিদার হবে। রাষ্ট্র কোনো কারণেই কারও প্রতি বৈষম্য প্রদর্শন করবে না।
ব্লগ লিখেন কোনো একজন মানুষ। লেখক সেই মানুষটিকে যখন হত্যা করা হয়, তখন সেই মানুষটি মানুষ না হয়ে, হয়ে যান ব্লগার! আমাদের দায়িত্বশীল গণমাধ্যমই এই কাজটি করে আসছে, রাজীব হায়দার হত্যাকান্ডের পর থেকেই। আমাদের দায়িত্বশীল গণমাধ্যমেÑ একজন রক্তমাংসের মানুষকে জনগণের সামনে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয় ব্লগার হিসেবে! প্রগতিশীল, দায়িত্বশীল, মুক্তচিন্তার গণমাধ্যম কীভাবে এই কাজটি করে?
অভিজিৎ একজন বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ। বিজ্ঞান নিয়ে তিনি কাজ করেছেন। তার বাবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক। সেই অভিজিৎকে, মানুষ অভিজিৎ পরিচয় না দিয়ে, আমাদের গণমাধ্যম তাকে জনগণের সামনে ব্লগার হিসেবে তুলে ধরেছে! যেন ব্লগার একটি বিশেষ ক্যাটাগরি! এটি কী ধরনের দায়িত্বজ্ঞান? আর যদি রাজীব হায়দার, অভিজিৎ কিংবা ওয়াশিকুরÑ যারা ধর্মনিরপেক্ষতা বা বিজ্ঞানের চর্চার কথা লেখে তাদের ব্লগার হিসেবে অভিহিত করা হবে, তাহলে যারা ওই একই ব্লগে ধর্ম প্রবক্তার ভূমিকা নেয়, তারা ব্লগার নয় কেন? ব্লগার এর সঙ্গে নাস্তিকতাকে সমার্থক বলে দেখানোর কী যুক্তি থাকতে পারে? এবং তাকে হত্যাই বা করা হবে কেন?
কোনো যুক্তিতেই, কোনোভাবেই হত্যাকান্ড বৈধতা পেতে পারে না। কারণ হত্যাকান্ড হচ্ছেÑ ফৌজদারি অপরাধ। আমাদের দেশের আইন অনুযায়ী, যিনি হত্যা করেন তাকে আইন অনুযায়ী শাস্তি পেতে হয়।
কোনো একজন ব্যক্তিরÑ যেকোনো কথা, বক্তব্য কারও কাছে গ্রহণযোগ্য হতে পারে, কারও কাছে গ্রহণযোগ্য নাও হতে পারেÑ কোনো একটি মত, কারও একটি বক্তব্য পছন্দ হবে না বলে কাউকে হত্যা করতে হবে, এটা কী ধরনের কথা? একটা সমাজে বহু মানুষ থাকে, তাদের চিন্তা চেতনাও বহু রকম হয়। এটা খুবই স্বাভাবিক। সেটার সঙ্গে তো হত্যাকান্ডের কোনো সম্পর্ক থাকতে পারে না। এ রকম হত্যাকান্ড হলে অন্যায়কারীকে আইনের অধীনে এনে তার বিচার নিশ্চিত করতেই হবে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, সেটি আমাদের দেশে ব্যতিক্রম বলেই ধরে নিতে হয়। আর সেই কারণেই হুমায়ুন আজাদ, রাজীব হায়দারসহ একের পর এক হত্যাকান্ড ঘটছে। দৃশ্যমান হত্যাকান্ডগুলোর বাইরেও হয়তো আরও ঘটনা ঘটছে, যা আমরা জানি না। এসব বন্ধ করতে হবে।
এটা স্পষ্ট যে, মানুষকে আতঙ্কিত করে উদ্দেশ্য হাসিলের কৌশল নিয়েছে জঙ্গিবাদীরা। সাম্প্রতিক সময়ের অভিজিৎ হত্যাকান্ড, ওয়াশিকুর রহমান হত্যাকান্ডে এর মাত্রা বেড়েছে। খুব কম সময়ের মধ্যে, পর পর ঘটে যাওয়া হত্যাকান্ডগুলো মানুষকে আতঙ্কিত করে তুলেছে। এ রকম চলতে দিলে, কিছুদিন পর দেখা যাবে যে, প্রতিদিনই এ রকম ঘটনা অহরহ ঘটছে। কারণ সরকার সঠিক প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারছে না। সঠিক পদক্ষেপটি নিতে পারছে না, অথবা নিচ্ছে না।
সমাজ তো কোনো খন্ড খন্ড জনগোষ্ঠী নয়, সব মিলিয়েই এই সমাজ। সমাজের সকল স্তরে উগ্র মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদের সমর্থক, বিশেষত ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তিকে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। অপরাধের প্রতিকার দেওয়ার দায়িত্বে যারা থাকেনÑ পুলিশ থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে তারা অধিষ্ঠিত।
একটা অসম্প্রদায়িক দেশ গড়তে হলে, সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। এটা সম্ভবও। এ দেশের অধিকাংশ মানুষই প্রগতিশীল, মুক্তমতে বিশ্বাস করে, অসাম্প্রদায়িকতায় বিশ্বাস করে, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে বিশ্বাস করে। সুযোগ পেলে তারা এগিয়ে আসবে। এগিয়ে তারা সব সময় এসেছে। ১৩ সালে ৫ ফেব্র“য়ারিতে গণজাগরণ ঘটিয়ে এ দেশের মানুষ তার প্রমাণ আরও একবার রেখেছে। প্রয়োজনে আবারও তারা সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে, জঙ্গিবাদ-মৌলবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াবে। তবে তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে রাষ্ট্রকে। সরকারকে। গণমাধ্যমকেও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। মানুষের হয়ে কাজ করতে হবে।
আমার জানা মতে, অভিজিৎ হত্যাকান্ডের পর প্রধানমন্ত্রী প্রফেসর অজয় রায়কে ফোন করেছিলেন, আসাদুজ্জামান নূর গেছেন তার বাসায়। কিন্তু আমাদের গণমাধ্যমে তা প্রকাশিত হয়নি। কেন হয়নি। কেন তারা তা প্রকাশ করতে সাহস পায়নি? কিসের ভয়ে? এভাবে যদি নতজানু হয়ে অন্যায়কে উৎসাহিত করা হয়, এতে শুধু একটা বিশেষ জনগোষ্ঠীই আক্রান্ত হবে না, গোটা সমাজ আক্রান্ত হবে। অন্যায়কে প্রশ্রয় দিলে প্রশ্রয়দাতাকেও তার ফল ভোগ করতে হয়। সে জন্যই অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হয় সব সময়।
আমরা মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষ শক্তির কথা বলি। মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষ শক্তি মানে তো কোনো বায়বীয় ব্যাপার নয়। মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষ শক্তি মানেÑ তাদের গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, অসাম্প্রদায়িকতা মানতে হবে। সম্প্রসারিত দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে সবকিছু দেখতে হবে। নিজেকে যদি মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষ শক্তি বলি, তাহলে আমাকে মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধগুলোর প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করতে হবে। আমি মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষ শক্তির কথা বলছি, কিন্তু আমি আনুগত্য প্রকাশ করছি না, বরং বিপরীতধর্মী কর্মকান্ডের প্রতি সহনশীলতা প্রদর্শন করছি, সেটা গ্রহণযোগ্য নয়। মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষ শক্তি হিসেবে নিজেকে দাবি করলে, আমাকে তা প্রমাণ করতে হবে। দৃশ্যমান করতে হবে। কার্যকর পদক্ষেপ ছাড়া এ সমস্ত কথা মানুষ বিশ্বাস করবে না।
মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশের জন্য, গণতান্ত্রিক অসম্প্রদায়িক সমাজ গঠনের স্বার্থেÑ সকল নাগরিকের সমান অধিকার ও সমান মর্যাদা প্রতিষ্ঠার স্বার্থেÑ সংকীর্ণ জঙ্গিবাদ-মৌলবাদমুক্ত সমাজ গঠনই হবে মুক্তমত, মুক্তপথ ও প্রগতিশীল রাষ্ট্রবিরোধীদের জন্য উপযুক্ত জবাব।

লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা


শেয়ার করুন