মিয়ানমারে সামরিক সরঞ্জাম বিক্রির কথা ভাবছে ভারত

বাংলাদেশ সীমান্তে মিয়ানমার বাহিনীর আগুন, গুলি ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৭,বৃহস্পতিবার, ১৭:০২ প্রিন্ট 12 4 0 Google 0 19 বাংলাদেশ সীমান্তে মিয়ানমার বাহিনীর আগুন, গুলিবাংলাদেশ সীমান্তে মিয়ানমার বাহিনীর আগুন, গুলি বাংলাদেশ সীমান্ত-সংলগ্ন মিয়ানমারের

মিয়ানমারের কাছে ভারতের সামরিক সরঞ্জাম বিক্রির বিষয়ে আলোচনা চলছে, যা রোহিঙ্গাদের ওপর দমন-পীড়নে সমালোচনার মুখে থাকা দেশটির প্রতি নয়াদিল্লির জোরালো সমর্থনের ইঙ্গিত দিচ্ছে।

মিয়ানমারের নৌপ্রধানের নয়াদিল্লি সফরে এই বিষয়ে আলোচনা হয়েছে বলে ভারতীয় কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে বৃহস্পতিবার রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়।
ভারতের শীর্ষস্থানীয় প্রতিরা প্রতিষ্ঠানগুলোতে মিয়ানমারের নৌবাহিনী সদস্যদের প্রশিণের বিষয়েও দুই পরে মধ্যে আলোচনা হয়েছে। ওই সব প্রতিষ্ঠানে ভারতীয় সেনাকর্মকর্তাদের প্রশিণ দেয়া হয়ে থাকে।

পূর্বাঞ্চলীয় প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমারের সাথে ভারতের সামরিক সহযোগিতা বৃদ্ধির আলোচনার সিদ্ধান্ত দৃশ্যত এই অঞ্চলে চীনের প্রভাবের বিপরীতে নিজেদের দাঁড়ানোর চেষ্টার অংশ। এমন একটি সময় ভারত এই সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, যখন রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর সেনাবাহিনীর দমন-পীড়নের জন্য বিশ্বব্যাপী সমালোচনা চলছে।
রোহিঙ্গাদের প্রতি সহিংসতা বন্ধে মিয়ানমারের সশস্ত্র বাহিনীর পদপে চেয়ে দেশটির সেনাবাহিনীর প্রশিণ কর্মসূচি স্থগিত করেছে যুক্তরাজ্য।

ব্রিটিশ সরকারের একজন মুখপাত্র মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে বলেন, ‘বার্মার রাখাইন প্রদেশে চলমান সহিংসতার কারণে সৃষ্ট মানবিক সঙ্কট এবং সেখানে মানবাধিকার লঙ্ঘনের যেসব ঘটনা ঘটছে তা নিয়ে আমাদের গভীর উদ্বেগের কারণে সেখানকার বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে গ্রহণযোগ্য কোনো সমাধানে না আসা পর্যন্ত বার্মিজ সেনাবাহিনীর সব শিা কোর্স স্থগিতের সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমরা।’

মিয়ানমার নৌবাহিনীর কমান্ডার-ইন-চিফ অ্যাডমিরাল তিন অং সান বুধবার ভারতের প্রতিরামন্ত্রী নির্মলা সীতারমন এবং দেশটির সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর প্রধানের সাথে সাাৎ করেন। দুই পরে মধ্যে সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকায় টহল নৌযান সরবরাহের বিষয়ে আলোচনা হয় বলে একজন সেনাকর্মকর্তা জানিয়েছেন।

বৃহস্পতিবার শেষ হওয়া চার দিনের এই সফরে মিয়ানমারের নৌপ্রধান মুম্বাইয়ে ভারতের নৌজাহাজ নির্মাণ এলাকা পরিদর্শন করেছেন।
ভারতের ওই সেনাকর্মকর্তা বলেন, ‘মিয়ানমার আমাদের পূর্বমুখী নীতির একটি স্তম্ভ এবং সম্পর্কের একটি বড় জায়গা প্রতিরক্ষা।’

নয়াদিল্লিভিত্তিক অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের ভারতের প্রতিবেশী নীতিবিশেষজ্ঞ কে ইওমে বলছেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যখন মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সমালোচনা করছে সে সময় উচ্চপর্যায়ের সামরিক কর্মকর্তাদের আনছে ভারত সরকার, এটা একটি বার্তা দিচ্ছে। ‘বার্তাটি হচ্ছে, রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে উদ্বেগ থাকলেও ভারত মিয়ানমার সরকারের সাথে আছে।’

গত মাসে রাখাইনে এই সঙ্কট শুরু হওয়ার পর মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চির পাশে দাঁড়ায় নয়াদিল্লি। নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের হামলার নিন্দা জানায় তারা। পরে সেনাবাহিনীর রোহিঙ্গা নিপীড়নের প্রতিবাদে আন্তর্জাতিক মহল উচ্চকিত হলে লাখ লাখ রোহিঙ্গার বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া নিয়ে উদ্বেগ জানায় ভারত।

এ বিষয়ে চীনও মিয়ানমারের পাশে দাঁড়িয়েছে। চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই সম্প্রতি জাতিসঙ্ঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেসকে বলেছেন, জাতীয় নিরাপত্তার সুরায় মিয়ানমারের পদপেকে সমর্থন এবং রাখাইনে সহিংস হামলার প্রতিবাদ জানায় তারা।
বাংলাদেশ সীমান্তে মিয়ানমার বাহিনীর আগুন, গুলি
বাংলাদেশ সীমান্ত-সংলগ্ন মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলিম গ্রামগুলোতে নতুন করে আগুন দেয়ার খবর পাওয়া গেছে। এছাড়া বাংলাদেশ এলাকা থেকে সেখানে গোলাগুলির হওয়ার শব্দও শোনা যায়।

আজ বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে তমব্রু সীমান্তের ডেকুবুনিয়া উত্তর পাড়ায় একটি গ্রামে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে।
আমাদের সংবাদদাতারা জানান, বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে গুলির শব্দ শোনা যাচ্ছে। ভীত-সন্ত্রস্ত্র অনেক রোহিঙ্গা বাংলাদেশ সীমান্তের পালিয়ে আসার চেষ্টা করছে। আগুনের লেলিহান শিখা সীমান্তের এপার থেকেও দেখা যাচ্ছে।
রোহিঙ্গাদের জন্য খোলা কারাগার
রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের মানুষদের জন্য সাতটি আশ্রয়শিবির খোলার ঘোষণা দিয়েছে মিয়ানমার। এখনো যারা পালিয়ে যেতে সমর্থ হয়নি তাদের জোরপূর্বক ওই ক্যাম্পগুলোতে রাখা হবে বলে আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে।
বাংলাদেশ থেকে কাউকে ফিরিয়ে নিলে তাদেরও ওই ক্যাম্পে রাখবে মিয়ানমার। আলজাজিরার মার্চ মাসের এক খবরে সেখানকার রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরগুলোর ভয়াবহতা ফুটে উঠেছিল। মানবাধিকার সংগঠনগুলোর আশঙ্কা, নতুন আশ্রয়শিবিরগুলোও রোহিঙ্গাদের উন্মুক্ত কারাগার হতে যাচ্ছে।

গত তিন সপ্তাহে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও পুলিশের হাতে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর প্রায় এক হাজার রোহিঙ্গা নিহত হয়েছেন বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে জাতিসঙ্ঘ। সংস্থাটির মানবাধিকারবিষয়ক প্রধান জাইদ রা’দ আল ঘটনাকে ‘জাতিগত নিধনযজ্ঞের পাঠ্যপুস্তকীয় দৃষ্টান্ত’ আখ্যা দিয়েছেন। মহাসচিব গুতেরেস এর আগে প্রশ্ন রেখেছেন, এক-তৃতীয়াংশ মানুষ দেশ থেকে উচ্ছেদ হলে তাকে জাতিগত নিধন ছাড়া আর কী নামে ডাকা যায়।

মানবাধিকার সংস্থাগুলো জানাচ্ছে, এখনো এক লাখের বেশি রোহিঙ্গা আটকা পড়ে আছে রাখাইন রাজ্যে। মাইন পুঁতে রাখা সীমান্ত কিংবা নাফ নদী পেরিয়ে তারা বাংলাদেশে আসতে সমর্থ হয়নি। তাদের ওই সাত ক্যাম্পে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে মিয়ানমার।
মিয়ানমার সরকারের একজন মুখপাত্র জো হতাই এক সাক্ষাৎকারে রাখাইনে নিপীড়নের শিকার হওয়া ওই জনগোষ্ঠীকে বাঙালি বলে উল্লেখ করেন। তিনি জানান, ওই ক্যাম্পগুলো বাঙালিদের জন্য। স্থানীয় আদিবাসীরা তাদের গ্রামে ফিরতে পারবেন।
তিনি জানান, রাখাইনে থেকে যাওয়া রোহিঙ্গাদের পাশাপাশি বাংলাদেশ থেকে কেউ ফিরতে চাইলে তাদেরও রাখা হবে ওই ক্যাম্পে।
এদিকে গত সপ্তাহে সরকারের পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, রাখাইনের ৪৭১ মুসলিম গ্রামের মধ্যে ইতোমধ্যে ১৭৬টি জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। পুড়িয়ে কিংবা গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে সাত হাজার বাড়িঘর।
সু চি বাংলাদেশে নথিভুক্ত আশ্রিতদের ফিরিয়ে নেয়ার যে দাবি করেছেন, সু চির এই দাবির সত্যতা প্রমাণ দুঃসাধ্য। কেননা বরাবরই রোহিঙ্গাদের কাঠামোবদ্ধভাবে নথিবদ্ধকরণ প্রক্রিয়ার বাইরে রাখা হয়। এমনকি ঔপনিবেশিক সীমান্ত ব্যবস্থার আগে থেকে যারা এখানে বাস করছেন রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সেই মানুষদেরও নথিবদ্ধ করা হয়নি।
সেখানকার আশ্রয় শিবিরগুলোতে জাতিসঙ্ঘের ত্রাণ কার্যক্রম বন্ধ হওয়ার কারণে এক লাখ ২০ হাজার মানুষ মানবিক বিপর্যয়ের মুখে পড়ে। রাখাইনে এখনো থেকে যাওয়া রোহিঙ্গারা বিপন্ন অবস্থায় রয়েছেন। জাতিসঙ্ঘসহ ২০টি মানবিক সহায়তা দানকারী প্রতিষ্ঠান মিয়ানমারের ডি-ফ্যাক্টো সরকারের অসহযোগিতা ও বাধাকে কারণ উল্লেখ করে ত্রাণকার্যক্রম স্থগিত রেখেছিল সেখানে। সীমিত পরিসরে আবারো ত্রাণকার্যক্রম শুরু হলেও সেখানে রয়েছে ব্যাপক প্রতিবন্ধকতা। ত্রাণকর্মীদের ‘রোহিঙ্গা জঙ্গি’ প্রমাণে সরকারি ত্রাণ বণ্টন সংস্থার প থেকেই প্রচারণা চালানো হয়। সে কারণে স্বেচ্ছাসেবী হতে ভয় পায় সবাই।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ত্রাণকর্মী বলেন, ত্রাণ বণ্টনকে অসম্ভব করে তুলেছে মিয়ানমার। খোদ রাখাইনের কর্মীদের জন্য এটি ভীতিকর হয়ে উঠেছে। কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, সেখানকার ত্রাণ ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব রেড ক্রসের হাতে তুলে দেয়া হবে। চিকিৎসা সহায়তা দানকারী আন্তর্জাতিক সংগঠন এমএসএফ বেনয়েট দি গ্রেসে এই পদপেকে আখ্যা দিয়েছেন নতুন কার্যপ্রণালী হিসেবে, যা ত্রাণের সহজলভ্যতাকে সীমাবদ্ধ করে ফেলবে।
অবশ্য রেড ক্রসের পক্ষ থেকে ওই ত্রাণ ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব নেয়ার ব্যাপারে জানতে চাইলে মানবিক সহায়তা দানকারী ওই প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে তা অস্বীকার করা হয়েছে।
রেড ক্রস বলছে, এ ব্যাপারে সরকারের সাথে কোনো আলোচনা হয়নি। বিশ্লেষকেরা বলছেন, নতুন আশ্রয়শিবিরগুলো নতুন নতুন ঝুঁকি সৃষ্টি করবে। কর্মক্ষম লাখো মানুষকে নির্ভরশীল করে তুলবে মানবিক সহায়তার ওপর।
রাখাইন রাজ্যের রাজধানী সিত্তে। শহরটিতে মুসলিম ও বৌদ্ধরা যুগ যুগ ধরে বসবাস করে আসছে। সিত্তের একজন মাছ বিক্রেতা ৩৬ বছর বয়স্ক আবদুর রহমান। তিনি জানান, সহিংসতার পর মুসলিমদের সব দোকান বন্ধ করে দেয় পুলিশ। এখন রেশনের ওপর ভরসা করে থাকতে হচ্ছে রোহিঙ্গাদের। আবদুর রহমান বলেন, ‘তারা আমাদের জীবন পশুর মতো করে দিয়েছে।’ অক্সফামের পরিচালক পল জোসি জানান, তাদের একটি স্থানীয় সহযোগী প্রতিষ্ঠানকে লক্ষ্য করেও তাণ্ডব চালিয়েছে মিয়ানমার সেনারা। তিনি বলেন, ‘তাদের প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ড নামিয়ে ফেলা হয় এবং অফিস থেকে সবাইকে বের করে দেয়া হয়।’
স্থানীয় সংবাদমাধ্যমগুলো থেকেও নিষ্ঠুরতার অনেক দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। রাখাইনের উগ্রপন্থী বৌদ্ধরা এক নারীর চুল কেটে তার হাতে ‘বেঈমান’ সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে শহর প্রদক্ষিণ করিয়েছে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ সে রোহিঙ্গাদের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সরবরাহ করছিল।
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি এত ভয়াবহভাবে বিনষ্ট হয়েছে যে ত্রাণকর্মীরা আশঙ্কা করছেন আর কখনোই আগের অবস্থা ফিরে আসবে না। এনজিও ও ত্রাণসংস্থার কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, রাখাইন রাজ্যে এটিই ‘শেষ সময়’। আশ্রয়শিবিরে থাকা রোহিঙ্গারাও হতাশা প্রকাশ করেছে। তারা জানায়, তাদের জীবন ও ভবিষ্যৎ ধ্বংস হয়ে গেছে।
ক্যাম্পের এক বাসিন্দা মোহাম্মদ আলম বলেন, ‘এনজিওগুলোকে কাজ করতে দেয়া না হলে যেন আমাদের নিজেদেরকেই নিজেদের কবর খুঁড়তে হবে। মিয়ানমারে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের গবেষক নাওরা হাই। রাখাইনের আশ্রয়শিবিরগুলো নিয়ে তার বক্তব্য, রাখাইনের আশ্রয়শিবিরগুলো সুরা দিচ্ছে না। বরং এগুলো এক একটি উন্মুক্ত কারাগারে রূপান্তরিত হয়েছে।’
তিনি জানান, মানবিক সহায়তা দানকারীদের প্রবেশ সহজ নয়। ক্ষোভ-রাগ-রোগ-মৃত্যু; এগুলোই সেখানকার দৈনন্দিন বাস্তবতা। মানবাধিকার কর্মীদের আশঙ্কা, একটি জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বৃহত্তর কারাব্যবস্থার শ্বেতপত্র হয়ে উঠতে যাচ্ছে শরণার্থী শিবিরগুলো

–নয়া দিগন্ত ডেস্ক


শেয়ার করুন