মিয়ানমারে গণহত্যার প্রমাণ

2015_10_27_11_46_37_JvkVcFHPtxGwGt1hwUc6sAp9QZtsvy_originalসিটিএন ডেস্ক :

দীর্ঘদিন ধরেই মিয়ানমারে রোহিঙ্গা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছিল অনেক সংস্থা। উদ্বেগ প্রকাশকারী সংস্থাগুলোর মধ্যে যেমন আছে মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠন, তেমনি রয়েছে কিছু আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম যারা দীর্ঘদিন ধরেই রোহিঙ্গাদের উপর ধারাবাহিকভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। তেমনি একটি গণমাধ্যম হলো কাতারভিত্তিক আল জাজিরা। সম্প্রতি গণমাধ্যমটি মিয়ানমারের সরকারের হাতে রোহিঙ্গাদের গণহত্যার প্রশ্নে কিছু গুরুত্বপূর্ণ দলিল প্রকাশ করেছে। আল জাজিরা অবশ্য ইয়েল আইন বিশ্ববিদ্যালয়ের বরাত দিয়ে এসব তথ্য প্রকাশ করেছে।

মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের উপর চালানো নির্যাতনের তথ্যাদি সংগ্রহ করতে গত আট মাস ধরে কাজ করেছে দ্য লোনস্টেইন ক্লিনিক নামের একটি সংস্থা। এই সংস্থাটি অবশ্য আল জাজিরা এবং বেশ কয়েকটি আইন সহয়তাকারী প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে মিয়ানমার সম্পর্কিত তথ্যাদি সংগ্রহ করে। ক্লিনিকটির পক্ষ থেকে প্রাথমিক তদন্তে বলা হয়, ‘সেখানকার রাজনীতিকরা রোহিঙ্গা বিষয়টি নিয়ে এমন মাত্রায় কথা বলেন যে, রোহিঙ্গা প্রশ্নে বর্তমানে কি হচ্ছে তা এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।’

আল জাজিরা এবং ফর্টি রাইটস নামের সংস্থাটির যৌথ উদ্যোগে বের হয় যে, মিয়ানমারের সরকার রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্য মুসলিম বিরোধী দাঙ্গা লাগিয়ে ফায়দা লুটছে। মিয়ানমারের অধিবাসী এবং মুসলিমদের মধ্যে বিভিন্ন বক্তব্য প্রদান করে বৈষম্য বাড়ানো হচ্ছে। এর বাইরেও কট্টর বৌদ্ধ সংগঠনগুলোকে ক্রমাগত অর্থসহায়তা দিয়ে সরকার নিজেদের পেছনে সমর্থন আদায় করছে। শুধু তাই নয়, ঘটনা উদঘাটনে আরও জানা যায়, সামরিক বাহিনী সমর্থিত ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভলপমেন্ট পার্টি(ইউএসডিপি) রোহিঙ্গাদের লক্ষ্য করে মুসলিমদের কোনঠাসা করার চেষ্টা চালাচ্ছে। এবিষয়ে আল জাজিরা মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট ভবন থেকে সরকারের বিভিন্ন স্তরে কথা বলার চেষ্টা করলেও কোনো পক্ষই সাড়া দেননি।

ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের অধ্যাপক এবং ইন্টারন্যাশনাল স্টেট ক্রাইম ইনিশিয়েটিভের(আইএসসিআই) প্রধান পেনি গ্রীন বলেন, ‘বার্মার অভ্যন্তর থেকে মুসলিমদের বিতারণ, ক্ষমতার খর্বায়ন এবং সরিয়ে রাখার জন্য প্রেসিডেন্ট থেইন সেইন সরকারের পক্ষ থেকেই ঘৃণিত বক্তব্য প্রচার করছেন। এটা মূলত গণহত্যার একটা প্রক্রিয়া মাত্র।’ আইএসসিআই ২০১২ সালে মিয়ানমারে অনুষ্ঠিত দাঙ্গার ঘটনা তদন্ত করে দেখে যে, সেখানে ওই দাঙ্গা তৈরি করা হয়েছিল পূর্বনির্ধারিত পরিকল্পনার অংশ হিসেবে। সেই দাঙ্গায় উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ মারা যায়, সহস্রাধিক মানুষ গৃহহীন হয়ে মানবেতর জীবনযাপন শুরু করে।

গ্রীনের মতে, ‘এটা কোনো সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছিল না। সম্পূর্ণ পরিকল্পিত ঘটনা ছিল সেটা। এক্সপ্রেস বাস ভর্তি করে দাঙ্গা লাগানোর জন্য বাহির থেকে মানুষ আনা হয়েছিল। যাদের আনা হয়েছিল তাদের মনোরঞ্জনের ব্যবস্থা থেকে খাবার-দাবারের ব্যবস্থাও ছিল। আর এজন্য অবশ্যই কাউকে না কাউকে অর্থ যোগান দিতে হবে। এসব ঘটনা এটাই প্রমাণ করে যে, পুরো ঘটনাটিই ছিল পূর্ব পরিকল্পিত। পুরো দৃশ্যপটই সেনাবাহিনী বেশ নিরাপদ দূরত্ব থেকেই নিয়ন্ত্রন করে। তারা সরাসরি ঘটনার সঙ্গে যুক্ত হয় না। যারা এই কাজে পারদর্শী সেনাবাহিনী তাদেরই অর্থ সহায়তা দিয়ে থাকে।’

আল জাজিরা তাদের কাছে থাকা বিভিন্ন সামরিক বেসামরিক তথ্যাদি সম্প্রতি একটি ডকুমেন্টারির মাধ্যমে প্রকাশ করতে যাচ্ছে। এই ডকুমেন্টারিতে সরকার কিভাবে তার দেশের জনগণের উপর পরিকল্পিত উপায়ে নির্যাতন চালায় তা স্পষ্ট করা হয়েছে। মিয়ানমারের এক সাবেক সামরিক সদস্য নিজের নাম প্রকাশ না করে সরকারের বিভিন্ন পরিকল্পনা এবং পদক্ষেপ সম্পর্কে জানায়, যা এই ডকুমেন্টারিতে উল্লেখ থাকছে।

আগামী নভেম্বর মাসে মিয়ানমারে যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে তাতে ইউএসডিপি মূলত বিভিন্ন নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠি এবং অন্যান্য পার্টির বিরুদ্ধে লড়াই করবে। কিন্তু দৃশ্যত তারা অং সান সুচি’র পার্টি ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসির(এনএলডি) বিরুদ্ধাচারণ করে প্রচার প্রচারণা চালাচ্ছে। গত ২০১০ সালেই মূলত সামরিক সমর্থিত সরকার একটি স্বাধীন ও অবাধ নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু গত পাঁচ বছরেও সেই পরিস্থিতি তৈরি হয়নি মিয়ানমারে যে, একটি স্বাধীন ও অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। একদিকে চীন এবং অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র সমাজতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মডেল নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই মিয়ানমারের সাধারণ জনগণের যাপিত জীবনের উপর চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু যতদিন পর্যন্ত মিয়ানমারের এই দাঙ্গা সমস্যার সমাধান না হচ্ছে ততদিন পর্যন্ত মিয়ানমারের সাধারণ জনগণ বুঝতেই পারবে না যে, তাদের জন্য কোন পন্থাটি সঠিক।


শেয়ার করুন