সামনে ঈদক ইয়াবা ব্যবসায়ীরা সক্রিয়

মিয়ানমারের ৪০টি কারখানা থেকে আসছে ইয়াবা

protom1-14শফিক আজাদ, উখিয়া :

কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে দেশের সর্বদক্ষিণে সীমান্তবর্তী উপজেলা উখিয়া-টেকনাফের সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে প্রতিদিন কোটি কোটি টাকার মরণব্যাধী ইয়াবা চালান ঢুকে পড়ছে। ক্ষমতাশীন দলের ছত্রছায়ায় মিয়ানমারের সীমান্ত এলাকায় গড়ে তোলা হয়েছে ৪০টি ইয়াবা কারখানা। এসব কারখানা তৈরীকৃত কোটি কোটি টাকার ইয়াবা পাচারের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন স্থানে পৌছে যাচ্ছে নিরাপদে। সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করছে টেকনাফের স্থানীয় প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতাসহ ৩০ জন তালিকাভূক্ত মাদক ব্যবসায়ী। উখিয়া-টেকনাফে ৫ হাজার মানুষ প্রত্যক্ষভাবে এখন মাদক ব্যবসায় জড়িত রয়েছে। পুলিশ, র‌্যাব ও বিজিবির সদস্যদের হাতে গুটি কয়েক ইয়াবা ধরা পড়লেও অধিকাংশ ইয়াবা চালান অনায়সে দেশের বিভিন্ন স্থানে পৌছে যাচ্ছে। গত এ সপ্তাহে কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফ সড়কের মরিচ্যা চেক পোষ্টে বিজিবি’র সদস্যরা একটি বিভিন্ন যাত্রীবাহি গাড়ী তল¬শী চালিয়ে প্রায় কোটি টাকার ইয়াবা আটক করেছে।
সূত্র মতে, প্রতিটি ঈদের পুর্ব মুহুর্তে ইয়াবা মাদক পাচারকারীরা তৎপর হয়ে উঠে। কারণ ঈদের সময় কক্সবাজারে পর্যটকের ঢল নামে। দেশ-বিদেশ থেকে আগত হাজার হাজার পর্যটক আনন্দ ফুর্তির জন্য ইয়াবাকে বেশী ভাগ প্রধান্য দিয়ে থাকে, তাই পর্যটন মৌসুমে ইয়াবা ব্যবসায়ী ও পাচারকারীরা বেশি মুনাফার আশায় তাদের অপতৎপরতা বাড়িয়ে দেয়। আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরাও ইয়াবা পাচারকারীদের ধরতে নানান কৌশল অবলম্বন করার পর ও পাচারকারীরা থাকেন, ধরাছোঁয়ার বাইরে। অনেকে অভিযোগ করে বলেন, প্রায় সময় কক্সবাজারগামী যাত্রীবাহী বাসগুলোতে প্রতিটি যাত্রীকে গাড়ী থেকে নামিয়ে তল্লাশী করা হয়। তবে কেউ কেউ এটাও মন্তব্য করতে শোনা যাচ্ছে, সাধারণ যাত্রীবাহী বাসে চিরুনী অভিযান চালালেও প্রাইভেট গাড়ীগুলোকে কম তল্লাশী করা হয়। যদি বেশী করে প্রাইভেট কার গুলোতে তল¬াশী করা হয় তাহলে, অহরহর গাড়ীতে ঘটবে ইয়াবা সহ বিভিন্ন প্রকার মাদকদ্রব্য পাওয়া যেতো। যেহেতু প্রাইভেট গাড়ীগুলোতে করে ইয়াবা পাচার সাধারাণত বেশি হয়ে থাকে। আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার হাতে গুটি কয়েক পাচারকারীরা আটক হলেও ৩ মাস বা তার চেয়ে কম সময় জেলে থেকে আইনের ফাঁক-ফোকর দিয়ে বেরিয়ে পুনরায় ইয়াবা পাচার করতে পারলেই ক্ষতি পুষিয়ে যায়। তাই জেল তাদের জন্য কিছুই না। এ ধারণা মাথায় এনে উখিয়া-টেকনাফে ইয়াবা ব্যবসা জমজমাট হয়ে উঠেছে সর্বত্র। বিশেষ করে বাংলাদেশ-মিয়ানমারের কয়েকটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট সীমান্তের মাদক, ঔষধ সহ অবৈধপন্য যাতায়াত করছে। এ অবৈধ কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে নারী, কিশোরসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ।
নির্ভরযোগ্য সুত্রে জানা গেছে, উখিয়া-টেকনাফের পালংখালী, বালুখালী, নলবনিয়া, দমদমিয়া, হোয়াইক্যং, হ্নীলা, সদর, সাবরাং সীমান্ত পয়েন্টের অঘোষিত ঘাট, ট্রানজিট পয়েন্ট, স্থল বন্দর ও করিডোরে হাজারো রোহিঙ্গা নাগরিক বৈধ-অবৈধ ভাবে অনুপ্রবেশ করে থাকে। এরা কৌশলে ইয়াবাসহ বিভিন্ন নেশাজাতীয় দ্রব্য নিয়ে আসে। মাদক প্রতিরোধে প্রশাসন যতই কৌশল অবলম্বন করছে, ব্যবসায়িরা ততই পাচারে নিত্য-নতুন কৌশল পাল্টাচ্ছে। মাদক ইয়াবা পাচারে ব্যবহার করা হচেছ সাধারন নারী-পুরুষ, কিশোর, বৃদ্ধ, চালক-হেলপার, বেকার ও রোহিঙ্গা যুবক-যুবতীদের। পাচারের নতুন কৌশল হিসেবে বায়ু পথ, গোপন অঙ্গ, পেঁপে, খোদাই কাঠ, পন্য বোঝাই ট্রাক, জুতা, মিষ্টির প্যাকেট, লাউ-কুমড়া, ভাঙ্গারী ভর্তি গাড়ী, গুরুর মলের ভিতর ও ভিআইপি নামী-দামী গাড়ী ব্যবহার করে থাকে। পবিত্র কোরবানীর ঈদকে সামনে রেখে বর্তমানে দিন দিন ইয়াবা ব্যবসা ও পাচার বাড়লেও সে তুলনায় আটক হচ্ছে খুবই কম। ইয়াবাসহ আটককৃতরা জিজ্ঞাসাবাদে নানান তথ্য দিলেও প্রশাসনের ভূমিকা রহস্যময়। বর্তমানে একের পর এক ইয়াবার ছোট-বড় চালান জব্দ হলেও ইয়াবা ব্যবসা থেমে নেই, বরং পুরোদমে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে পাচারকারী সিন্ডিকেট। এ ইয়াবা ব্যবসা প্রতিরোধে প্রশাসনের ভূমিকা পর্যাপ্ত বলে মনে হচ্ছে না। তার পরও থেমে নেই সীমান্তরক্ষী ব্যাটলিয়ন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ।
অনুসন্ধানে জানাযায়, বর্তমানে সীমান্ত এলাকায় মায়ানমার, ঢাকা, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও টেকনাফের বিশাল সিন্ডিকেট পাচার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। এ সিন্ডিকেট বিভিন্ন ব্যক্তিকে ব্যবহার ও ম্যানেজ করে অবাধে মাদক ইয়াবাসহ বিভিন্ন নেশাজাতীয় দ্রব্য ও ওষুধের ব্যবসা করছে। মিয়ানমারের মংডু সিন্ডিকেট সীমান্তে নিয়োজিত বর্ডার গার্ড পুলিশ (বিজিপি)কে ম্যানেজ করে পিরিকটন, পোস্তার দানা, ইয়াবাসহ বিভিন্ন নেশাজাতীয় দ্রব্যের চালান সরাসরি টেকনাফ শাহপরীর দ্বীপ ঘোলা পাড়া, বাজার পাড়া, জালিয়া পাড়া, নয়াপাড়া, সাবরাং, টেকনাফ মৌলভী পাড়া, নাজির পাড়া, জালিয়া পাড়া, নাইট্যং পাড়া, বরইতলী, বন্দর এলাকা কেরুনতলী, হ্নীলা দমদমিয়া, জাদিমুরা, লেদা, আলী খালী, রঙ্গিখালী, চৌধুরী পাড়া, ফুলের ডেইল, মৌলভী বাজার, হোয়াইক্যং খারাংখালী, ঝিমংখালী, ্মিনাবাজার, উনচিপ্রাং, লম্বাবিল, উলুবনিয়া পয়েন্ট দিয়ে বাংলাদেশী সিন্ডিকেটের হাতে তুলে দেয়। বাংলাদেশ হতে এরা নিয়ে যায় সুখী বড়ি, ডিপো ইন্জেকশন, এরিস্টোভিট, মাদক সরঞ্জাম আইস, গাঁজা, মরফিয়া ও ফেন্সিডেলের বড় চালান। এ চোরাচালানীরা আদান-প্রদানে সীমান্তরক্ষীকে ফাঁকি, না পারলে টহল ম্যানেজ করে নিয়ে যাওয়া হয় বলে জানা যায়। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে চালান আনা-নেওয়া করছে গুটি কয়েক দালাল। বর্তমানে মিয়ানমারের লোকজন সরাসরি বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে যাওয়া-আসার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে দালালদের মাধ্যমে বিভিন্ন পথ ঘাট ম্যানেজ করে ইয়াবা, মাদক ও ওষুধ আনা-নেওয়া করছে। চিহ্নিত কতিপয় ব্যক্তি এ সব পথ ঘাট ম্যানেজ করার দায়িত্ব পালন করে থাকে। এ ম্যানেজের ফলে অবৈধ মালামার সমূহ সহজে পার পেয়ে যায়। ফলে এভাবে কৌশল পরিবর্তন ও ম্যানেজ করে পাচারকারী চক্র ইয়াবাসহ বিভিন্ন চালান ঢাকা, চট্টগ্রাম, সহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পাচার করছে। এরা অনেকেই রাতারাতি আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ বনে নিত্য নতুন গাড়ী, বাড়ী সহ আরাম আয়েশে জীবন যাপন করছে। ইয়াবা ও ওষুধ ব্যবসায়ী এবং দালালদের চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করা না গেলে উখিয়া-টেকনাফ সীমান্তে চোরাচালান ও মাদকের আরো ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে বলে স্থানীয় সচেতন মহল ধারনা করছেন। উখিয়া সীমান্তের ঘুমধুম বেতবুনিয়া এলাকার বাসিন্দা মোহ্ম্মাদ হোসেন বলেন, বর্তমানে ইয়াবা পাচারের একমাত্র নিরাপদ রুট হিসাবে পরিনত হয়েছে ঘুমধুম বেতবুনিয়া সীমান্ত এলাকা। তিনি বলেন, এলাকা জনপ্রতিনিধি সহ বিভিন্ন আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার লোকজন এদের সাথে জড়িত। তিনি প্রশাসনের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে গোপনে তদন্ত পূর্বক ইয়াবা ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহনের দাবী জানান।
উখিয়ার থানার অফিসার ইনচার্জ মোঃ জহিরুল ইসলাম খাঁন বলেন, ইয়াবা পাচার রোধে পুলিশ সার্বক্ষণিক তৎপর রয়েছে। যার প্রমাণ গত বুধবার থানা পুলিশ কুতুপালং বুড়ির ঘর নামক স্থান থেকে সাড়ে ৩২’শ পিস ইয়াবা সহ টেকনাফ কাঞ্জরপাড়া এলাকার মৃত আব্দুস ছবির ছেলে মোঃ সেলিম উদ্দিনকে আটক করেছে। অভিযানের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রয়েছে তিনি জানান।
কক্সবাজার ১৭ ব্যাটলিয়ন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)’র ভারপ্রাপ্ত অধিনায়ক মেজর ইমরান উল্লাহ সরকার জানান, মাদক ও চোরাচালান রোধে সীমান্তে বিজিবির টহল দল সদা তৎপর রয়েছে। যার প্রেক্ষিতে গত বুধবার কক্সবাজার-টেকনাফ সড়কের মরিচ্যা যৌথ চেকপোষ্টে দায়িত্বরত বিজিবি’র সদস্যরা কক্সবাজারগামী একটি যাত্রীবাহি গাড়ীতে তল্লাশী চালিয়ে ৯৯৫পিস ইয়াবা আটক করেছে। তিনি এসময় আরো বলেন, গত এ সপ্তাহে বিজিবি’র সদস্য বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে প্রায় কোটি টাকা ইয়াবা ও মাদকদ্রব্য উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছে।


শেয়ার করুন