বিশেষজ্ঞদের হুঁশিয়ারি

মায়েদের হাতে আরো তিন শিশুর মৃত্যুর অভিযোগ

136553_1সিটিএন ডেস্ক 

রাজধানীর বনশ্রীতে মায়ের হাতে দুই শিশু সন্তানের মৃত্যুর অভিযোগ নিয়ে দেশে যখন তোলপাড় চলছে, তখন গত কয়েক ঘণ্টায় সারাদেশে আরো তিনটি শিশু হত্যার অভিযোগ উঠেছে মায়েদের বিরুদ্ধে।

এর মধ্যে মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলায় ছয় বছরের সন্তানকে বিষপান করিয়ে হত্যার পর পারভীন (২৫) নামের এক গৃহবধূ আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। শনিবার সকালে স্ত্রী পারভীনের বিরুদ্ধে জুড়ী থানায় একটি হত্যা মামলা করেছেন স্বামী জাকির হোসেন। বর্তমানে পারভিন সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পুলিশি পাহারায় চিকিৎসাধীন।

এদিকে কিশোরগঞ্জ সদরে মাহাথির মোহাম্মদ নামে দেড় বছরের ছেলেকে গলা কেটে তার মা হত্যা করেছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। শনিবার সকালে উপজেলার পেয়ারাভাঙ্গা গ্রামে এ ঘটনা ঘটে।

মাহাথির করিমগঞ্জ উপজেলার টাম্মি আখন্দপাড়া গ্রামের আবুল কালামের ছেলে। তার মা সালমা আক্তার (৩০) মানসিক ভারসাম্যহীন বলে জানা গেছে।

এছাড়া বরিশালের উজিরপুরেও এক মায়ের বিরুদ্ধে চার বছরের নিজ কন্যা সন্তানকে হত্যার অভিযোগ উঠেছে। এ ঘটনায় মা নাজমা বেগমের বিরুদ্ধে শুক্রবার থানায় মামলা দায়ের করেছেন নিহত শিশুর পিতা। নিহত শিশু বাক প্রতিবন্ধী স্বপ্না খানম মম ওই উপজেলার কমলাপুর গ্রামের ইমরান হোসেন মিলনের কন্যা।

ক্রমবর্ধমান শিশু হত্যার বিষয়ে দেশবাসীর মনে উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়েছে। দেখা যাচ্ছে অফুরন্ত আনন্দ আর ভালোবাসার ধন শিশুরা এখন আর স্বজনদের কাছেও নিরাপদ নয়।

বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার এক প্রতিবেদন বলছে, চলতি বছরের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে বাংদেশের বিভিন্ন স্থানে ৫০টি শিশুকে হত্যা করা হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘অপরাধীরা নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য নিষ্পাপ শিশুদের সহজ লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করছে। এছাড়া সামাজিক ও পারিবারিক অবক্ষয়, বেকারত্ব, অনৈতিক উচ্চাকাঙ্খা, সংস্কৃতির নেতিবাচক প্রভাব, অনলাইন প্রযুক্তির কু-প্রভাব, পর্নোগ্রাফির প্রসার, অনৈতিক জীবনযাপন, মানবপাচার, বিরোধ বা শত্রুতা, ব্যক্তি স্বার্থপরতা, লোভ, সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতা ক্রমাগত শিশু হত্যাকাণ্ডের কারণ।’

এই সংস্থা আরো মনে করে, ‘শিশুহত্যার মতো ঘৃণিত অপরাধে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়ায় শিশু হত্যার ঘটনা বেড়ে যাচ্ছে।’

তাদের হিসাব মতে, গত এক বছরে ২৯২টি শিশু হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে। আর গত চার বছরে সারাদেশে এক হাজার ৮৫টি শিশুকে হত্যা করা হয়েছে বলে জানিয়এছে সংস্থাটি।

শিশু হত্যার এই ক্রমবর্ধমান হারের সঙ্গে আরো উদ্বেগজনক বিষয় হলো যে, মূলত পরিবারের সদস্য, আত্মীয় এবং পরিচিতদের হাতেই অধিকাংশ শিশু হত্যা বা নৃশংসতার শিকার হচ্ছে।

বাংলাদেশ মানবাধিকার ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী অ্যাডভোটে এলিনা খান বলেন, ‘গত একবছরে শিশু হত্যা ও শিশুর প্রতি সহিংসতা যেভাবে বেড়েছে তাতে আমাদের মূল্যবোধ, নৈতিকতা ও মানবিকতা প্রশ্নের মুখে পড়েছে।’

তার কথায়, ‘এখন ঘরেই শিশুরা নিরাপদ নয়। বাবা-মায়ের হাতেই শিশুদের জীবন দিতে হচ্ছে৷ মূল্যবোধের এরচেয়ে আর চরম অবক্ষয় কী হতে পারে।’

তিনি আরো বলেন, ‘শিশুরা অসহায়৷ তারা প্রতিবাদ করতে পারে না৷ তারা এখন লোভ- লালসা এবং প্রতিশোধের শিকারে পরিণত হচ্ছে। তারা কোনো স্বার্থের সঙ্গে জড়ির না থাকলে স্বার্থেরই বলি হচ্ছে তারা।’

এলিনা খান বলেন, ‘দেশে শিশু নির্যাতনবিরোধী কঠোর আইন আছে। কিন্তু মানসিকতার পরিবর্তন না হলে এই আইনে কাজ হবে না। আইন প্রয়োগকারী সংস্থা শিশুদের গুরুত্ব দেয় না৷ শিশুদের প্রতি যে অপরাধ করা হয়, তা সহজে আমলে নিতে চায় না তারা৷ তাই শিশুদের বিষয় সর্বোচ্চ গুরুত্ব না দেয়া হলে আমরা ভয়াবহ বির্যয়ের মুখে পড়ব।’

তার মতে, ‘পরিস্থিতি যা দাঁড়িয়েছে, তাতে শিশুরা কোথায় নিরাপত্তা পাবে তাই বোঝা মুশকিল। তাই রাষ্ট্র, সমাজ ও ব্যক্তিকে এখনই উদ্যোগ নিতে হবে৷ শিশুদের সুরক্ষা এবং নিরাপত্তাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে।’

মনোবিজ্ঞানী ড. মেহতাব খানম শিশুহত্যার সংবাদ প্রকাশ ও প্রচারে গণমাধ্যমকে আরো দায়িত্বশীল হওয়ার আহবান জানান। এমন ঘটনার ফলাও প্রচার শিশুদের মনে বিরূপ প্রভাব ফেলছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, শিশুরা এখন তাদের বাবা-মাকে বলছে, আমরা কি তোমাদের কাছেও নিরাপদ নই? এ বিষয়ে সংবাদ প্রচার ও প্রকাশে সামাজিক ও মনস্তাত্বিক দিক বিবেচনায় নিতে গণমাধ্যমের প্রতি আহবানও জানান তিনি।


শেয়ার করুন