মাশরাফি: বাংলার বৈরাম খাঁ!

assswসিটিএন ডেস্ক:

মোঘল সাম্রাজ্য যদি আকবরের হাতে প্রতিষ্ঠা লাভ করে, তবে তা রক্ষা পেয়েছিল ওই বৈরাম খাঁ’র জন্য। আকবরকে ১৩ বছরে রেখে তার পিতা হুমায়ুন পরলোক গমন করেন। সময়টা ছিল বড় অস্থির। পাল্টে যেতে পারত ইতিহাস। কিন্তু বৈরাম খাঁ সেটা হতে দেননি। সিংহাসনের মোহ বাদ দিয়ে অভিভাবক হয়ে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কিশোর আকবরের পাশে ছিলেন মহান এই যোদ্ধা। আর তাই আকবরকে রাজমুকুট পরানোর দিনে বলেছিলেন, ‘আমি রাজা হতে আসিনি। শরীরে আমার যোদ্ধার রক্ত। যোদ্ধা হয়েই থাকতে চাই।’ বৈরাম খাঁ’র কথা মনে পড়ে, যখন মাশরাফি বিন মর্তুজা সগর্বে বলেন, ‘আমি নায়ক নই। নায়ক তো তারাই, যারা জীবন দিয়ে দেশকে স্বাধীন করে গেছেন।’

চট্টগ্রামে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ঐতিহাসিক সিরিজ জয় করে ফেরার পথে কথা হয় অন্য এক মাশরাফির সঙ্গে। যিনি পিতা, নড়াইলের ছেলে। দীর্ঘ ব্যস্ততা শেষে ঈদে ঘরে ফিরতে যার মন ব্যকুল হয়ে পড়ে।

অধিনায়কের দায়িত্ব যখন মাশরাফিকে দেয়া হয়, তখন মোঘল সাম্রাজ্যের চেয়ে কম অস্থিরতা ছিল না দলে। মাশরাফি তা সামলান পরম মমতায়। দিনে দিনে কিশোর মুস্তাফিজ, সৌম্যদের লালন করে দলকে করেছেন অপ্রতিরোধ্য। ২০ যুদ্ধের ১৫টিতে হয়েছেন জয়ী! সিংহাসন চ্যুত করেছেন রথী-মহারথীদের। মাশরাফির হাতে এখন অবসর সময়। সহযোদ্ধারা যখন থাকবে চট্টগ্রামে তখন তিনি সময় কাটাবেন প্রিয় আপনজনদের সঙ্গে। নড়াইলে।

টানা ক্রিকেট-ক্লান্তির আভাস পাওয়া যায় মাশরাফির কথায়, ‘জিম্বাবুয়ে সিরিজ থেকেই ক্রিকেটে ডুবে আছি। উৎসব কী, তা যেন ভুলেই গেছি। তৃতীয় ওয়ানডের পর মাথায় আসে ঈদের কথা। রাতে সেহরি খেতে যেয়ে একটা দোকান চোখে পড়ে। হঠাৎ মাথায় আসে দুই বাচ্চার কথা। ওখান থেকেই কেনাকাটা করেছি।’

পরিবার পরিজন ছেড়ে দিনের পর দিন বাইরে থাকতে থাকতে জীবন এক ঘেয়েমি হয়ে গেছে অধিনায়কের কাছে, ‘উফফ, একদম অস্থির জীবন। তৃতীয় ম্যাচের পর অনুভব করি অবশেষে ঈদ আসছে। অবসর কাটানোর জন্য অনেকেই বাইরে যান। কিন্তু আমার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা একদম আলাদা। বাড়ি (নড়াইল) যেয়ে আমি স্বস্তি বোধ করি। এটাই আমাকে সতেজ করে তোলে।’

‘যদি কেউ খেলা বুঝে থাকে, তবে সে বলবে এই কয়েকমাস আমাদের ওপর দিয়ে কী গেছে।’ ব্যস্ততায় বিরক্ত হলেও অর্জনকে তিনি বলছেন ‘বিশাল’ কিছু, ‘এটা আমার এবং বাংলাদেশ ক্রিকেটের জন্য বিশাল এক অর্জন। শেষ আট মাস আমরা স্বপ্নের ভেতর দিয়ে পার করেছি।’

‘সামনে যাওয়ার জন্য এটাই আমাদের উপযুক্ত সময়। আমি জানি না সাধারণ মানুষ কী বলাবলি করছে। যদি তারা সবসময় জয়ই প্রত্যাশা করে, তবে সেটা আমাদের জন্য কঠিন হয়ে যাবে। কারণ এখনো আমাদের অনেক পথ যেতে হবে। সামনে একের পর এক টি-টোয়েন্টি খেলতে হবে। কিন্তু তার আগে দক্ষিণ আফ্রিকা এবং অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে চার টেস্টের চ্যালেঞ্জে নামতে হবে।’ মাশরাফি থামেন না। বলতে থাকেন, ‘বিশ্বকাপের আগে বলেছিলাম, যদি আমরা ভাল করতে পারি, তবে সামনের সিরিজগুলোয় তার প্রভাব পড়বে। কিন্তু কখনোই আশা করিনি বিশ্বকাপ আমাদের এতটা বদলে দেবে।’

মাশরাফি কথায় কথায় বলে ফেলেন তার অভিভাবক গুণের কথা, ‘বিশ্বকাপে তামিমকে নিয়ে অনেকে সমালোচনা করেছিলেন। সৌম্যর অভিজ্ঞতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। কিন্তু আমরা ওদের আগলে রেখেছিলাম। ফলও পেয়েছি। পাচ্ছি।’

‘দেশের ১৬ কোটি মানুষের ৫ কোটি যদি ক্রিকেট দেখেন, তাহলে এক কোটি লোক হয়তো একই মতামত দিবেন। বাকী ৪ কোটি লোকের মতামত হবে আলাদা। আপনি যদি সবার কথা শুনতে যান, তবে সামনে এগুতে পারবেন না।’ যুক্তি দিয়ে মুগ্ধতা ছড়ান অধিনায়ক।

মাশরাফি শোনাতে ভুললেন না তার জীবনদর্শন, ‘জীবনে কোনো কিছুই পরিকল্পনা করে করিনি-এমনকি আমার পরীক্ষার জন্যও নয়, কেনাকাটার জন্যও নয়। সবকিছুই একদম শেষ সময়ে করে ফেলি।’

অধিনায়ক হওয়ার দিনগুলোর কথা স্মরণ করে মাশরাফি বলেন, ‘যখন অধিনায়কত্ব পেয়েছিলাম তখন বরাবরের মতো কিছুই করিনি। সফলতা, ব্যর্থতা, অতীত, ভবিষ্যৎ- কিছুই ভাবিনি। এগুলো একটাও আমাকে বিচলিত করেনি। কখনোই আশা করিনি আমি বাংলাদেশের ক্যাপ্টেন হবো। বাংলাদেশের হয়ে খেলতে পারাই ছিল আমার কাছে অনেক কিছু। ’

তৃতীয় ওয়ানডের একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমি সবসময় তাই করি, যা আমার অবচেতন মন করতে বলে। তৃতীয় ওয়ানডেতে রিয়াদ এসেই যে বলে উইকেট পেল, তার আগে সবাই মুস্তাফিজকে আনতে বলছিল। কিন্তু আমার মন বলে রিয়াদের কথা। আমি সেটাই করি। আর রিয়াদ এসেই উইকেট পায়।’

শেষ ম্যাচে দেশের তৃতীয় ক্রিকেটার হিসেবে ছুঁয়েছেন ২০০ উইকেটের মাইলফলক। আক্ষেপ করলেন, ইনজুরি ক্যারিয়ার থেকে লম্বা একটা সময়ে খেয়ে না ফেললে আরো ভাল কিছু হতো, ‘আমি জানি যদি ৩০০/৩৫০ উইকেট পেতাম তাহলে সবাই বেশি খুশি হতো। আমি বিশ্বাস করি সে ক্ষমতা আমার আছে। ইনজুরির কারণে ৩ থেকে চার বছর নষ্ট না হলে সেটা করতে পারতাম।’

মাশরাফিকে কাছ থেকে কিংবা দূর থেকে যারাই দেখেন, তারা অকপটে বলেন তারকাখ্যতি এই লোকটার ভেতর নেই। এই তো সেদিন, দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে প্রথম টি-টোয়েন্টির দুইদিন আগে মিরপুর স্টেডিয়ামের বিসিবি অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি। তার কিছুক্ষণ আগে ওই পথ দিয়ে হেঁটে যান আরেকজন ক্রিকেটার (নাম প্রকাশ করা হলো না)। তার সঙ্গে কথা বলতে চান এক সাংবাদিক। অনেকটা উদ্ধত মেজাজে সাংবাদিককে এড়িয়ে যান সেই ক্রিকেটার। অথচ মাশরাফি এসে সেখানে এমন ভাবে দাঁড়ালেন যেন সবাই তার চেনা। ওই সাংবাদিকের পিঠে হাত দেন। মেতে ওঠেন খোশগল্পে। হাসতে হাসতে যান লুটিয়ে।

মাশরাফি বললেন, ‘আমাকে মোহভঙ্গ করার সুযোগ দিন। আমরা নায়ক নই। নায়ক তো মুক্তিযোদ্ধারা। আমরা জাতির জন্য এমন কিছু ত্যাগ করিনি, যা তারা করেছেন। আমাকে ভুল বুঝবেন না, ক্রিকেটই সব নয়। আমরা শুধু জাতির জন্য আনন্দ আনতে পারি।’

বাংলাদেশ যে কোনো দলকে হরাতে পারে- মাশরাফি এই কথা তখনই বলবেন, যখন বিদেশে ম্যাচ জিততে পারবে দল, ‘এখনো প্রমাণ করার অনেক কিছু আছে। ইংল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড এবং অস্ট্রেলিয়ায় আমাদের খেলা আছে। সেখানে যদি কিছু ম্যাচ জিততে পারি, তবেই বলব আমরা যে কোনো দলকে হারাতে পারি।’

অবসর নেব-নেব করেও নেননি। শরীরটা আগের মতো বেয়াড়া আচরণ করছে না। বললেন, ‘হয়তো খেলব আরো কিছুদিন। তবে সময়টা অনেক বেশি হবে না বলেই মনে হয়।’

নিজে তিন-চারশো উইকেট না পেলেও মাশরাফি স্বপ্ন দেখেন একদিন তার অনুজরা সেটা করে দেখাবে, ‘আমি আপনাকে এখনই বলে দিতে পারি তামিম একদিন দশ হাজার রান করবে। সাকিব দশ হাজার রানসহ চারশো উইকেট নেবে। মুশফিক, সৌম্যও দশ হাজার রানের মাইলফলক স্পর্শ করবে। মুস্তাফিজ ওয়ানডেতে চারশো উইকেট নেবে।’

মাশরাফি যেন স্বপ্নে দেখছেন অন্ধ তুষারের সবুজরাত্রি। ধীরে ধীরে তিন হয়ে যান সমুদ্রের চোখ। যার পাগল আকাশ খোলা সমুদ্রচারীদের জন্য। বিদায় নেয়ার আগে বলে গেলেন, ‘পরবর্তী দশ বছরে বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি বিশ্বমানের খেলোয়াড় উপহার দিবে। যদি টি-টোয়েন্টির অর্থমোহ এখানে আছড়ে না পড়ে…।’

তথ্যসূত্র: ডেইলি স্টার।


শেয়ার করুন