মার্ক্সবাদ কি নাস্তিক্যবাদ- না অন্য কিছু?

মাহমুদ জাবির

বিশিষ্ট গবেষক ফরহাদ মজহার তার ‘পাশ্চাত্য সভ্যতাই কি একমাত্র সভ্যতা’ নামক প্রবন্ধে উল্লেখ করেন যে, “কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে ধর্মপ্রাণ মানুষদের খেপিয়ে তুলেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। বলেছিল, কমিউনিস্ট মাত্রই নাস্তিক। এখন কমিউনিজম ক্ষমতাহীন হয়ে পড়ায় তার জায়গায় স্থান পেয়েছে ইসলাম।”

 এই প্রবন্ধে আরো উল্লেখ করেন- “অতি উৎসাহী ইসলামপন্থীরা কথায় কথায় বিরোধী পক্ষকে নাস্তিক মুরতাদ গালি দেয়। তারা অবশ্য বুঝতে পারে না এই গালি দেবার গোড়ায় রয়েছে নিউকনি আদর্শ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্নায়ুযুদ্ধের সময়কার প্রচারণা। তাছাড়া নাস্তিক্যবাদ আর কমিউনিজম কখনই সমার্থক নয়। কখনই সমার্থক ছিল না।”

 ফরহাদ মজহার এর বক্তব্যে বুঝা যায়, ধর্মপ্রাণ মানুষেরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রচার প্রোপাগান্ডায় প্রভাবিত হয়ে কমিউনিস্টদের নাস্তিক মুরতাদ বলতে শুরু করেছে।  এর মানে ধর্মপ্রাণ মানুষেরা ইসলাম কি বলছে তার চাইতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রচারণায় অধিক প্রভাবিত হয়। তাহলে ইসলামপন্থীরা কি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোন সহসঙ্গী? নাকি ইসলামপন্থীরা অজ্ঞতার কারণেই এমনটি করছে? ইসলামের মতাদর্শ পর্যালোচনা করে দেখা দরকার- ইসলাম কমিউনিস্টদের সম্পর্কে কি রায় দেয়? এক্ষেত্রে ইসলামের মূল বক্তব্য এবং মার্ক্সবাদের মূল বক্তব্য যাচাই করে দেখতে হবে।

 ইসলাম সর্বপ্রথম যে বিষয়টিকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব প্রদান করে তা হল– গায়েবে বিশ্বাস অর্থাৎ অদৃশ্যে ঈমান আনা। যদিও বাংলায় ‘বিশ্বাস’ আর আরবীতে ‘ঈমান’ এর মধ্যে একটা পার্থক্য রয়েছে। ঈমান বিষয়টি আত্মউপলব্ধির সাথে সম্পর্কিত। বিশ্বাস চাপিয়ে দেয়া হতে পারে, কিন্তু ঈমান চাপিয়ে দেয়া থেকে অনেক ঊর্ধ্বে। বিশ্বাস আরোপিত হতে পারে। পিতামাতা বা সমাজ কর্তৃক আরোপিত বিশ্বাসকে কিছুতেই ঈমান বলা যাবে না। কার্ল মার্ক্স ধর্মে বিশ্বাসকে আরোপিত করে তুলে ধরেন।

“মানুষ দুনিয়ার বাইরে ল্যাপটা মেরে বসে থাকা কোন বিমূর্ত সত্তা নয়। মানুষ মানে হচ্ছে মানুষের এই জগৎ , রাষ্ট্র, সমাজ । এই রাষ্ট্র, এই সমাজই জন্ম দেয় ধর্মের যা গোটা জগৎ সম্পর্কে মাথা নিচে পা ওপরে উল্টানো জগৎ চেতনা।” (মার্ক্স, ১৯৭৫)

 ইমাইল ডুরখেইম এর মতে, ধর্ম সমাজের সৃষ্টি। কার্ল মার্ক্সও একই সুরে বলতে চেষ্টা করেছেন যে, এই জগৎ, এই রাষ্ট্র ও সমাজই ধর্মের জন্ম দিয়েছে, যে ধর্ম মানুষের মধ্যে এক উল্টানো জগৎ চেতনা তৈরি করে। এর মানে ধর্মে বিশ্বাস এক আরোপিত বিষয়, যা সমাজ ও রাষ্ট্র প্রণয়ন করেছে।  ইসলাম অদৃশ্যে যে ঈমান আনতে বলেছে তা মার্ক্সের উপরোক্ত বক্তব্যকে বাতিল করে দেয়। ‘ইসলাম’ স্বতঃস্ফূর্ত ও স্বাধীনভাবে অদৃশ্যে ঈমান আনতে আহ্বান জানায়। কুরআন বিভিন্নভাবে মানুষকে আহ্বান করছে সৃষ্টির সবকিছু নিয়ে চিন্তা করতে, যাতে করে অদৃশ্যে বিশ্বাস হয় স্বতঃস্ফূর্ত ও অর্জিত। অদৃশ্যে ঈমান আনার যে আহ্বান তা মানুষকে স্বাধীনসত্তা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। ঈমান তখনই  অর্জিত হবে যখন মানুষ স্বাধীন সত্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত থাকবে। স্বাধীন সত্তা হিসেবে মানুষ খোদায়ী শক্তি ‘রুহ’ বা আত্মার অধিকারী। এর মানে মানুষ স্বাধীন ইচ্ছাশক্তির ব্যবহারে চিন্তা ও  অনুধাবন এবং বিচারবুদ্ধিকে কাজে লাগিয়ে আত্মপরিচয় লাভ করতে পারে। যখনই মানুষ উপলব্ধি করে যে, এক ‘আল্লাহ’ যিনি অদৃশ্য – তিনিই তার স্রষ্টা ও প্রতিপালক, তখনই মানুষ আল্লাহর সাথে এক যোগসূত্র স্থাপন করে, নিজেকে আল্লাহর প্রতিনিধি মনে করে এক উন্নত আত্মপরিচয় লাভ করে । তখনই অর্জিত হয় ঈমান। কুরআনে আল্লাহ পাক বলেন- “আমি পৃথিবীতে আমার প্রতিনিধি সৃষ্টি করছি।” (২:৩০)

 অর্জিত ঈমান মানুষকে করে সম্মানিত, কেননা সে তখন সৃষ্টিকর্তা ও প্রতিপালক এক আল্লাহর সম্মানিত প্রতিনিধি। এভাবে অর্জিত ঈমান মুমিনকে এক উৎকৃষ্ট আত্মপরিচয়ে ভূষিত করে। অথচ কার্ল মার্ক্স ধর্মপ্রাণ মানুষদের অবজ্ঞা করছে এভাবে- “যে মানুষ এখনো নিজের মধ্যে নিজেকে খুঁজে পায়নি কিংবা পেয়েও নিজেকে হারিয়ে ফেলেছে, ধর্ম হচ্ছে সে মানুষের নিজের সম্পর্কে চৈতন্য। ”  (মার্ক্স, ১৯৭৫)

 মার্ক্স বুঝাতে চেয়েছেন, মানুষ নিজেই যখন নিজেকে হারিয়ে ফেলে তখন ধর্মে আশ্রয় নেয়। অর্থাৎ আত্মপরিচয় হারা মানুষ ধর্মে বিশ্বাস স্থাপন করে। অথচ ইসলামের বক্তব্য ঠিক তাঁর বিপরীত।

ইসলাম যেখানে অদৃশ্যে ঈমান আনাকে গুরুত্ব প্রদান করেছে , কার্ল মার্ক্স সেখানে অদৃশ্যে ঈমান আনার বিরোধিতা করেছে । অদৃশ্যে ঈমান আনা তখনই সম্ভব হবে যখন মানুষ হবে উন্নত আত্মার অধিকারী । মানুষ যদি নিজেকে দেহসর্বস্ব জীব মনে করে তখন সে মানুষ হারিয়ে ফেলে আল্লাহর সাথে সংযোগ। এ অবস্থায় পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের প্রভাব এত বেশি শক্তিশালী থাকে যে, আত্ম উন্নয়ন, আত্ম সংশোধন ও আত্ম সচেতনতা এক গুরুত্বহীন বিষয়ে পরিণত হয়। মানুষ তখন উৎকৃষ্ট সত্তা থেকে নিম্নমানের এক সত্তায় পরিণত হয় । কুরআন তাই বলছে- “আমি তো সৃষ্টি করেছি মানুষকে উৎকৃষ্ট উপাদানে (আত্মা) অতঃপর সে নিজেকে নিম্নতর পর্যায়ে নামিয়ে ফেলেছে।” (৯৫:৪-৫)

 এর মানে মানুষ যখন নিজেকে আত্মিক সত্তা থেকে বস্তুগত সত্তায় পরিণত করে তখন মানুষ ধর্মচ্যুত হয়, হয় আদর্শচ্যুত। কার্ল মার্ক্স মানুষকে বস্তুগত সত্তা হিসেবে তুলে ধরে। তার মতে, মানুষ ইন্দ্রিয় সর্বস্ব বস্তুগত সত্তা, এক বাস্তব সত্তা। মার্ক্স তার ‘ইকনমিক এন্ড ফিলোসফিকেল ম্যানুস্ক্রিপ্ট’ বইতে বলেন –

“Man as an objective, sentient being is therefore a suffering being…. A non-objective being is a non-being… A non-objective being is an unreal, non sensuous being that is only thought of i.e. an imaginary being…”

অর্থাৎ, “মানুষ বস্তুগত, সংবেদনশীল সত্তা, সে কারনে দুঃখপীড়িত সত্তা । যা কিছু অবস্তুগত সত্তা তা অস্তিত্বহীন । যা কিছু অবস্তুগত বা পঞ্চইন্দ্রিয় বহির্ভূত তা অবাস্তব এবং কল্পিত সত্তা।”

 এ বক্তব্যের মধ্য দিয়ে মানুষকে যেমন বস্তুগত ও ইন্দ্রিয় নির্ভর সত্তা হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে, তেমনি যা কিছু বস্তু ও ইন্দ্রিয় বহির্ভূত তাকে অস্বীকার করা হয়েছে।

 ‘আল্লাহ’ এমন এক সত্তা যাকে কোন বস্তুগত ও ইন্দ্রিয় কাঠামোর আওতাধীন আনা সম্ভব নয়। কেননা সমস্ত বস্তু ও ইন্দ্রিয় এক আল্লাহর সৃষ্টি । তাছাড়া বস্তু মাত্রই কাঠামোগত ভাবে দুর্বল ও অস্থায়ী। কার্ল মার্ক্সের মতে যা কিছু বস্তু ও সংবেদনের বাইরে তা অবাস্তব ও কল্পিত। এ কথার মধ্য দিয়ে অদৃশ্যে বিশ্বাস বাতিল করা হয়েছে। মার্ক্স বুঝাতে চেয়েছেন, অদৃশ্যে আল্লাহ, ফেরেশতাকুল এবং  পরকাল- যেহেতু ইন্দ্রিয় ও সংবেদন এর বাইরে, তা কিছুতেই বাস্তব হতে পারে না। তা কিছুতেই অস্তিত্বশীল নয়। এ কথার মধ্য দিয়ে মার্ক্স সরাসরি ইসলামের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে।

 ইসলাম একটি আধ্যাত্মিক  ধর্ম। ইসলাম নাস্তিক্যবাদের পুরোপুরি বিপরীত ।  নাস্তিক্যবাদে মানুষ আল্লাহর সৃষ্টি কোন জীব নয়। নাস্তিক্যবাদে মানুষ প্রাকৃতিক ও বস্তুগত সত্তা। নাস্তিক্যবাদে মানুষ প্রকৃতির অবিচ্ছেদ্য  অংশ আর ‘আল্লাহ’ এক কল্পনার বিষয়, সত্যিকার কোন সত্তা বা অস্তিত্ব নয়। এ মতবাদে মানুষ প্রকৃতির কোলে বড় হয়, প্রকৃতির কাছে বিলীন হয়ে যায়। অর্থাৎ কোন ‘পরকাল’ এর অস্তিত্বে নাস্তিক্যবাদ বিশ্বাস করে না। যদি কেউ বিশ্বাস করে যে মানুষ কোন খোদায়ী সত্তা নয়, মানুষ প্রাকৃতিক সত্তা, তবে বুঝে নিতে হবে সে মানুষ অদৃশ্যে বিশ্বাস করে না। কার্ল মার্ক্স একই বইতে বলেন-

“Man is a natural being….. Man is not only a natural being, he is a human natural being.” (karl Marx, selected writings, P:104)

এভাবে মার্ক্স দেখিয়েছেন- মানুষ আল্লাহর সৃষ্টি কোন জীব নয়, মানুষ প্রাকৃতিক জীব। মার্ক্স দেখিয়েছেন মানুষের রয়েছে প্রকৃতির সাথে বন্ধন । মার্ক্স বলেন-

“Man’s physical and intellectual life depends on nature merely means that nature depends on itself, for man is a part of nature. ”  (karl Marx, selected writings, P: 81)

অর্থাৎ ‘মানুষের শারীরিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিক জীবন প্রকৃতির উপর নির্ভরশীল, এর অর্থ প্রকৃতি ও উহার উপর নির্ভরশীল, এ জন্যে মানুষ প্রকৃতির অংশ । ’

 ইসলামে ‘তাওহীদ’ এর বক্তব্য উপর্যুক্ত বক্তব্য থেকে ভিন্ন । ড. আলী শরীয়তী তাওহীদ বলতে বুঝিয়েছেন- ‘আল্লাহ, মানুষ ও প্রকৃতির মধ্যে যে ঐক্য তা হল তাওহীদ। মানুষ প্রকৃতির সাথে সম্পর্কযুক্ত। কিন্তু মানুষ ও প্রকৃতির মূল উৎস এক আল্লাহ। এক আল্লাহকে বাতিল করলে ‘তাওহীদ’ বাতিল হয়ে কুফরীবাদে পরিণত হয়। মার্ক্সবাদ যেহেতু মানুষকে শুধুমাত্র প্রকৃতির অংশ মনে করে এবং প্রাকৃতিক সত্তা হিসেবে স্বীকার করে, সে কারণে মার্ক্সবাদ তাওহীদ বা আল্লাহর একত্ববাদের বিরোধী। আল্লাহর একত্ববাদ এর বিরোধিতা থেকে কুফরীবাদ প্রতিষ্ঠিত হয় ।

সূরা এখলাসে বলা হয়েছে- বল, আল্লাহ এক। এর মানে মানুষসহ সমস্ত সৃষ্টি ও প্রকৃতি এক আল্লাহে মিশে যায়। ‘বিসমিল্লাহ’ বলতেও বুঝায় সমস্ত নাম বা সৃষ্টি ও প্রকৃতি এক আল্লাহর সাথে অটুট বন্ধনে আবদ্ধ । মার্ক্সবাদ হল প্রকৃতিবাদ। প্রকৃতিবাদ হল বস্তুবাদ। মানুষ ও সমস্ত বস্তুগত উপাদান এবং প্রকৃতির উৎস এক আল্লাহকে অস্বীকার করলে যে মতবাদ তৈরি হয় তা হোল প্রকৃতিবাদ, তা হল বস্তুবাদ । আল্লাহর একত্ববাদ প্রকৃতিবাদ ও বস্তুবাদের বিরোধী। আল্লাহর একত্ববাদ এর বিরোধী হল কুফরীবাদ। অর্থাৎ প্রকৃতিবাদ ও বস্তুবাদ হল কুফরীবাদ।

 ইসলামের আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল পরকাল এর উপর নিশ্চিত বিশ্বাস। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, মুত্তাকীর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল ‘ আখেরাতে নিশ্চিত বিশ্বাস।’ পার্থিব জীবনের পর আর একটি জীবন আছে- সে জীবনের প্রতি বিশ্বাস স্থাপনের মধ্য দিয়ে মুমিন এক খোদায়ী দায়িত্ব পালনে ব্যাপৃত হয়।  মার্ক্স ও এঙ্গেলস কি পরকালে বিশ্বাস করতেন? বিশ্বাস করতেন এমন কোন প্রমাণ কেউ দেখাতে পারবে না। যেহেতু মানুষ প্রকৃতির অংশ, সে কারণে মার্ক্সবাদে অথবা কমিউনিস্ট মতবাদে অদৃশ্যে বিশ্বাস বাতিল হয়ে যায়, সাথে সাথে পরকালও বাতিল হয়ে যায়। কমিউনিজম যে পরকালে বিশ্বাস বিরোধী তা এঙ্গেলস এর বক্ত্যবে বুঝা যায় –“শ্রমিক শ্রেণীর সংগ্রামের মতই ঈসায়ী ধর্ম আদিতে ছিল নির্যাতিত মানুষের সংগ্রাম। ঈসা মসীহর ধর্ম আর শ্রমিকদের সমাজতন্ত্র দাসত্বের শৃঙ্খল আর দুর্দশা থেকে আসন্ন মুক্তির সুসমাচার ঘোষণা করে। ঈসায়ী ধর্ম সেই মুক্তি পাবার কথা বলে মৃত্যুর পরে, পরজীবনে, স্বর্গে। সমাজতন্ত্র সেই মুক্তির প্রতিশ্রুতি দেয় এই পৃথিবীতে, ইহলোকে, সমাজকে বদল করার মধ্যে।”  (এঙ্গেলস, ১৮৯৫)

 তাহলে এঙ্গেলস কি পরকালে বিশ্বাস করতেন? উপর্যুক্ত বক্তব্যে স্পষ্ট যে, সমাজতন্ত্র ইহজাগতিক মুক্তির কথা বললেও পরজগৎ সম্পর্কে উদাসীন ছিল। ইসলাম শুধু ‘আস্তিক’ ‘নাস্তিক’ এ দু’টো বিপরীতার্থক ধারণার মধ্যে বয়ানকে সীমাবদ্ধ রাখেনি। ইসলাম ‘আস্তিক’ শব্দের বদলে ‘মুত্তাকী’ শব্দকে গুরুত্ব প্রদান করেছে। ‘আস্তিক’ হয়েও সেক্যুলার হতে পারে , কেননা আস্তিক মানে আল্লাহ আছে এ ধারণায় বিশ্বাস। একজন সেক্যুলার আল্লাহ আছে এ বিশ্বাস করেও আল্লাহর বিধান বিরোধী হতে পারে। কিন্তু একজন ‘মুত্তাকী’ আল্লাহ আছে- শুধু এ বিশ্বাসের মধ্যে অবস্থান করে না। ‘মুত্তাকী’ সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে-

“ইহা সেই কিতাব, ইহাতে কোন সন্দেহ নাই। মুত্তাকীদের জন্য ইহা পথ নির্দেশ। যারা অদৃশ্যে ঈমান আনে, সালাত কায়েম করে, তাদেরকে যে জীবন উপকরণ দিয়েছি তা হতে মানবকল্যাণে ব্যয় করে এবং যারা ঈমান আনে তোমার প্রতি যা নাযিল করা হয়েছে ও তোমার পূর্বে যা নাযিল করা হয়েছে তার প্রতি ও আখেরাতে  যারা নিশ্চিত বিশ্বাসী ।” (২:২-৪)

পরবর্তীতে বলা হয়েছে- “ যারা কুফরী করেছে…তারা ঈমান আনবে না ” (২:৬)

 উপর্যুক্ত আয়াতগুলোতে বুঝা যায় আস্তিক-নাস্তিক শব্দ ব্যবহার না করে মুত্তাকি-কাফের শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে । কুরআনে মুত্তাকীর বিপরীতে কাফের বলা হয়েছে। আয়াতগুলোতে স্পষ্ট যে- শুধু অদৃশ্যে ঈমান আনলেই মুত্তাকী হয় না। মুত্তাকী হতে হলে ব্যক্তি তার সৃষ্টির উৎস আল্লাহ্‌ এবং তার চূড়ান্ত গন্তব্য পরকালে যেমন ঈমান আনবে- সাথে সাথে পৃথিবীতে দায়িত্ব পালন করে যেতে হবে। দায়িত্ব পালনের দিকনির্দেশনা পবিত্র কুরআনে দেয়া হয়েছে। সে কারণে বলা হয়েছে- তারা সালাত কায়েম করে- যাতে করে ব্যক্তি নিয়মিত আল্লাহর সাথে সম্পর্ক স্থাপনের মধ্য দিয়ে  আত্মসংশোধনের মত গুরুত্বপূর্ণ কর্মে  আত্মনিয়োগ  করে একজন আদর্শবান মানুষে পরিণত হয়। ব্যক্তি যখন সংশোধিত হবে তখনই সে উপার্জিত সম্পদ মানবকল্যাণে ব্যয় করবে।  আল্লাহ যা নাযিল করেছেন- অর্থাৎ কুরআনে ঈমান আনয়নের মধ্য দিয়ে একজন মুমিন কুরআন নির্দেশিত সামাজিক উন্নয়নের দায়িত্বে ব্যাপৃত হবে । তারপরেই রয়েছে আখেরাতে নিশ্চিত বিশ্বাস । এর মানে ব্যক্তির সমস্ত কর্মের বিচার হবে । এই বিশ্বাসে একজন মুমিন দায়িত্ব পালনে সচেতন হয় । এভাবে আত্মসচেতনতা ইসলাম ধর্মের সাথে জড়িত হয়ে আছে । অথচ কার্ল মার্ক্স উল্টোটা বলেছেন-

“Thus I know that the self consciousness that is part of my own self is not confirmed in religion, but rather in the abolition and supersession of religion.” (karl Marx, selected writings, P: 106)

অর্থাৎ ‘আমি জানি যে, আত্ম সচেতনতা যা আমার নিজের অংশ তা ধর্মে বহাল থাকে না। কিন্তু বহাল থাকে ধর্মকে উচ্ছেদ ও বাতিল করার মধ্য দিয়ে।’

 ইসলাম বলছে বিচার দিবসে বিশ্বাসের মধ্য দিয়ে দায়িত্ব পালনে মুমিন আত্ম সচেতন ও সমাজ সচেতন হতে পারে। অথচ কার্ল মার্ক্স বলেছে ব্যক্তি ধর্মকে বাতিল বা উচ্ছেদ করলে আত্ম সচেতন হতে পারবে। এর মানে মার্ক্সবাদ শুধু ধর্মের বিরোধীতাই করছে না, ধর্মের উচ্ছেদ কামনা করছে। মার্ক্সবাদে মানুষের গন্তব্য নেই, গন্তব্য প্রকৃতির সাথে একাকার হয়ে যায়।  এর মানে মানুষের সকল কর্মের বিচার হবে- এমন বিশ্বাস মার্ক্সবাদে নেই। মার্ক্সবাদ নাস্তিক্যবাদকে এমনি সমর্থন  করে যে তা যেন আদর্শিক বিচারে মানবতাবাদ। মার্ক্সের ভাষায় –

“Atheism as the supersesssion of God is the emergence of theoretical humanism, and communism as the supersession of private property is the indication of real human life as man’s property, which is also the emergence of practical humanism. In other words, atheism is humanism mediated with itself through the supersession of religion and communism is humanism mediated with itself through the supersession of private property. ”   (karl Marx, selected writings, P: 108)

অর্থাৎ ‘নাস্তিক্যবাদ হল আল্লাহকে নাকচ করে দেয়া যা তাত্ত্বিক মানবতাবাদ প্রতিষ্ঠা করে এবং কমিউনিজম হল ব্যক্তিগত সম্পত্তিকে বাতিল করে দেয়া যা বাস্তব মানুষ তৈরি করে ব্যবহারিক মানবতাবাদ প্রতিষ্ঠা করে । অন্য অর্থে, নাস্তিক্যবাদ এমন এক মানবতাবাদ যা ধর্মকে নাকচ করে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং কমিউনিজম এমন এক মানবতাবাদ যা ব্যক্তিগত সম্পত্তিকে বাতিল করে প্রতিষ্ঠা পায়। ’

 মার্ক্সের বক্তব্যে স্পষ্ট যে, নাস্তিক্যবাদ সরাসরি মানবতাবাদ। তার মতে, কমিউনিজম যেমন মানবতাবাদ, নাস্তিক্যবাদও তেমনি মানবতাবাদ। কমিউনিজম হল ব্যবহারিক মানবতাবাদ, নাস্তিক্যবাদ হল তাত্ত্বিকভাবে মানবতাবাদ। এর মানে, প্রকারান্তরে মার্ক্স নাস্তিক্যবাদকে মানবতাবাদ বলে স্বীকার করে নেয়। নাস্তিক্যবাদের বিপরীত ‘তাওহীদ’ বা আল্লাহ্‌র একত্ববাদ তাহলে কি মানবতা বিরোধী কোন মতবাদ? মার্ক্সের বক্তব্যে তো তাই বুঝা যায়।  মার্ক্সের দৃষ্টিতে নাস্তিক্যবাদ ও কমিউনিজম উভয়ই মানবতাবাদী মতবাদ। তাহলে মার্ক্স শুধু নাস্তিক্যবাদিই নয় বরং আরও এক ধাপ উপরের পর্যায়ে উন্নীত হয়ে কমিউনিজম প্রতিষ্ঠায় অগ্রসর  হয়। কমিউনিজম নাস্তিক্যবাদকে নাকচ করে না, বরং ধর্ম এবং ধর্মতত্ত্বকে নাকচ করে দেয় । নাস্তিক্যবাদ যদি ধর্মে বিশ্বাসকে নাকচ করে দেয়, কমিউনিজম একই সাথে ধর্মে বিশ্বাস এবং ধর্মতত্ত্বকেও নাকচ করে দেয় । পুঁজিবাদ নাকচ করে ধর্মতত্ত্বকে, মার্ক্সবাদ বা কমিউনিজম একই সাথে ধর্মে বিশ্বাস এবং ধর্মতত্ত্বকেও নাকচ করে দেয়। মার্ক্সবাদ কিভাবে ধর্মে বিশ্বাস এবং ধর্মতত্ত্বকে নাকচ করে দেয়?

 মার্ক্সবাদ বা কমিউনিজমে মানুষ যে এক আল্লাহ্‌র সৃষ্টি তা অস্বীকার করে । মানুষ যে বানর থেকে সৃষ্টি ডারউনের এ মতবাদ স্বীকার করে নেয় মার্ক্সবাদ। আরো এগিয়ে গিয়ে এঙ্গেলস তার ‘Labour in Transition from Ape to Man’ রচনায়   বলেন যে, শ্রমের মধ্য দিয়ে বানর থেকে মানুষের সৃষ্টি।

ফরহাদ মজহার তার ‘মোকাবিলা’ বইয়ে উল্লেখ করেন যে, ‘ পুঁজি প্রাচীন ধর্মতত্ত্বকে কবর দিয়েছে, ধর্মকে নয় ।’ অথচ ‘মার্ক্সবাদ’ নিজেই ধর্মকে কবর দিয়েছে সাথে সাথে ধর্মতত্ত্বকেও। মার্ক্সবাদ কিভাবে ধর্মতত্ত্বকে কবর দিয়েছে?

ইসলাম একই সাথে ধর্ম ও দ্বীন। ইসলাম যেমন মানুষের সাথে আল্লাহ্‌র সম্পর্ক উন্নয়নকে গুরুত্ব দেয় তেমনি মানুষের সাথে সমাজের উন্নয়নকেও। ইসলাম অন্যান্য ধর্মের মত শুধু আল্লাহ্‌র সাথে ব্যক্তির সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে মানুষকে সমাজের প্রতি দায়িত্বশীল হতে বলে এমনকি সমাজের প্রতি দায়িত্ব পালনকে মুত্তাকীর কর্তব্য হিসেবে নির্ধারণ করে। এ কারণে ইসলামের ধর্মতত্ত্বকে বাদ দিলে ইসলামের প্রতি বা আল্লাহ্‌র প্রতি ঈমানই বাতিল হয়ে যায়।  কুরআনে সূরা বাকারায় বলা হয়েছে “কেউ কুরআনের কিছু অংশ গ্রহণ করলে কিছু অংশ বাতিল করলে তার জন্য রয়েছে নিশ্চিত জাহান্নাম।”

সূরা নেসায় বলা হয়েছে- “কেহ ইসলাম ব্যতীত অন্য কোন দ্বীন গ্রহণ করতে চাইলে তা কখনো কবুল করা হবে না। ” (৩ : ৮৫)

 এ আয়াতগুলোতে স্পষ্টভাবে বুঝা যায় আল্লাহ্‌কে বিশ্বাস করে কেউ যদি মার্ক্সবাদ বা পুজিবাদের মত দ্বীনকে গ্রহণ করে তাহলে তা কবুল হবে না এবং সে ব্যক্তি মুত্তাকী হতে পারবে না। পুঁজিবাদে ব্যক্তিগত সম্পত্তির মালিকানাকে গুরুত্ব প্রদান করা হয়, অন্যদিকে কমিউনিজমে ব্যক্তিগত সম্পত্তির উচ্ছেদকে বিশেষ জোর দেয়া হয়। ইসলামের ধর্মতত্ত্বে এ দু’টোর একটিকেও গ্রহণ করা হয় না।  ইসলামে সম্পত্তির চূড়ান্ত মালিক আল্লাহ্‌।  সে কারণে সম্পত্তির ব্যবহার হবে আল্লাহ্‌র নির্দেশমত। ব্যক্তি সাময়িকভাবে সম্পত্তির মালিক হলেও চূড়ান্তভাবে আল্লাহ্‌ মালিক- এ বিশ্বাসে সম্পত্তির বণ্টননীতি আল্লাহ্‌র নির্দেশমত কার্যকর হয়। কুরআন বলছে, ‘তোমরা যা উপার্জন কর, এবং আমি যা ভূমি হতে তোমাদের জন্য উৎপাদন করে দেই তন্মধ্যে যা উৎকৃষ্ট তা ব্যয় কর’- এ আয়াতে বুঝা যায় ব্যক্তি যা উপার্জন করে ব্যক্তি সম্পূর্ণভাবে তার মালিক নয়; তার উপার্জনের মধ্যে মানুষের হক রয়েছে, যা আল্লাহ্‌ নির্দেশ মত বণ্টন করা হবে। এর মানে যদি বলা হয় ব্যক্তি সম্পূর্ণভাবে তার সম্পত্তির মালিক তা প্রকারান্তরে আল্লাহ্‌কে নাকচ করে দেয়। আবার যদি বলা হয় ব্যক্তি কোন সম্পত্তির মালিক নয়, বরং মার্ক্সবাদের দৃষ্টিতে সম্পত্তির মালিক রাষ্ট্র, তাও আল্লাহ্‌কে নাকচ করে দেয়, আল্লাহ্‌র বিধানকে কবর দেয়া হয়। মার্ক্স বলেন-

‘’The positive abolition of private property…..is therefore the positive abolition of all alienation, thus the return of man out of religion, family, state etc. into his human i.e. Social being.’’

(karl Marx, selected writings, P: 89)

উপর্যুক্ত বক্তব্যে মার্ক্স স্পষ্ট করেন যে, ব্যক্তিগত সম্পত্তির উচ্ছেদ হোল সমস্ত বিছিন্নতার উচ্ছেদ, আর তখনই মানুষ ধর্ম, পরিবার, রাষ্ট্র থেকে ফিরে এসে সামাজিক সত্তায় পরিণত হয়।

ইসলাম জনকল্যাণে সম্পত্তি বণ্টনের মধ্য দিয়ে সাময়িক ব্যক্তিগত সম্পত্তিকে পবিত্র ও তাৎপর্যপূর্ণ করে। তখন পরিবারের ভরণপোষণ এবং সামাজিক বন্ধন সুদৃঢ় হয়। অন্য দিকে মার্ক্সবাদ মানুষের সমস্ত ব্যক্তিগত সম্পত্তির উচ্ছেদ করে সাথে সাথে পরিবার ও ধর্মের উচ্ছেদকরণের মধ্য দিয়ে কমিউনিজম প্রতিষ্ঠাকে গুরুত্ব দেয়। এ থেকে বুঝা যায় মার্ক্সবাদ বা কমিনিজম নাস্তিক্যবাদের সমর্থক।

 উৎস : Mclellan, David . ‘ karl Marx : Selected writings ; 1977. Oxford university press.

Karl Marx, Early writings. Tr.Rodney livingstone and Gregor Benton, Vintage books, 1975, Newyork.

 লেখক: বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক


শেয়ার করুন