মাদকমুক্ত সমাজ গঠনে ইসলামের ভূমিকা

Md.Alamgir-ctnমাওলানা মুহাম্মদ আলমগীর :

বর্তমান আধুনিক পৃথিবীতে মানব পাচারের মতই আরেকটি সভ্যতা বিরোধী মানব সমাজের ভয়ংকর শত্র“ হলো মাদক। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মত আমার প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রাম-মহল্লায় মাদকের সয়লাব। বলতে গেলে পুরো দেশ মাদকের উপর ভাসছে। উঠতি বয়সি তরুণ- তরুণীরা দারুনভাবে মাদকে আসক্ত হয়ে পড়ছে। দিনদিন ছাত্র ও যুব সমাজের নৈতিক, চরিত্র চরম অবক্ষয়ের কারণে পরিবারে ও সমাজে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। মানব সভ্যতার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, মানবীয় অপরাধ, পারিবারিক ও সামাজিক অবক্ষয় এবং বিপর্যয়ের অন্যতম কারণ হলো মাদকতা, অশ্লীলতা ও জুয়া।

আধুনিক সভ্যতার সকল অবক্ষয়ের মুল বিষয় ও এগুলি। মদ পান ও মাদকাসক্তি শুধু আক্রান্ত ব্যক্তির ক্ষতি করেনা উপরন্তু তার আশপাশের সকলের ক্ষতি করে। বিশেষত উক্ত ব্যক্তির স্ত্রী ও পরিবার-পরিজন সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্থ হয়। সকল বিবেকবান মানুষেই মদের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন কিন্তু কেউ তা নিয়ন্ত্রণ করতে পারেননি। প্রায় আড়াই শতাব্দী বছর ধরে ইউরোপ ও আমেরিকায় মদ নিষিদ্ধ ও নিয়ন্ত্রণ করার জন্য অনেক আন্দোলন সংগ্রাম হয়েছে। নারীরা এ সকল আন্দোলনে বিশেষ ভূমিকা রেখেছিল। এ সকল আন্দোলনের ভিত্তিতে গত শতাব্দীতে ইউরোপের অনেক দেশে মদ নিষিদ্ধ করার চেষ্টা করা হয়। আমেরিকাতে ১৯২০ সালে মদ নিষিদ্ধ করা হয়। কিন্তু মাদক ব্যবসায়ী ও মাদকাসক্তদের চাপে পড়ে ১৯৩৩ সালে তা আবার বৈধ করা হয়। মদ, মাদকতা, মাদকাসক্তি ও মদ নির্ভরতা আধুনিক সভ্যতার ভয়ংকর ব্যাধিগুলির অন্যতম। এর ফলে নানাবিধ দৈহিক অসুস্থতা, মানসিক অসুস্ততা, লিভার সিরোসিসসহ অন্যান্য মরণ ব্যধিতে আক্রান্ত হয় মানুষ। বিশ্বে অগনিত সফল ব্যবসায়ী, চাকরীজীবি, দক্ষ টেকনেশিয়ান, শ্রমিক ও অনুরূপ সকল মানুষদের জীবন ও পরিবার ধ্বংস হয়েছে মদের কারণে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক পরিসংখ্যান অনুসারে বিশ্বে ৭৬ মিলিয়ন বা প্রায় ৮ কোটি মানুষ মদ পানের কারণে সৃষ্ট বিভিন্ন কঠিন রোগে আক্রান্ত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মোট জনসংখ্যার শতকরা ১৫ ভাগ মদ্যপান জনিত সমস্যাদিতে ভোগছেন। ধর্মীয় অনুভূতিতে একেবারেই নষ্ট করার কারণে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে রাশিয়ার মানুষ। রাশিয়ার মোট জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশ মদ পান জনিত মারাত্মক রোগ ব্যাধিতে ভুগছেন। বর্তমান যুগে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞগণ মদ পান ও মদ নির্ভরতাকে বিশ্বের অন্যতম প্রধান স্বাস্থ্য সমস্যা বলে চিহ্নিত করেছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিসংখ্যান অনুসারে বিশ্বের সকল রোগ ব্যাধির শতকরা ৩৫ ভাগ হলো মদ পান জনিত। মদপান জনিত রোগ-ব্যধি ও সম্পদ ধ্বংসের কারণে প্রতি বৎসর শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই ১৮৫ বিলিয়ন ডলার নষ্ট হয়।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিসংখ্যানই প্রমাণ করে যে, সভ্যতার জন্য বেশী ক্ষতিকর অথচ বর্তমানে পাশ্চত্য বিশ্ব ধুমপান ও ড্রাগ এর বিরুদ্ধে সোচ্ছার হলেও মদের বিরুদ্ধে সোচ্ছার নয়। কারণ মদ পান সরাসরি সমাধান সম্ভব নয় বলেই তারা ধরে নিয়েছে। যদিও এইডস, ক্যান্সার ও অন্যান্য মরণ ব্যাধির চেয়েও মদ মারাত্মক সমস্যা। বাস্তবে বর্তমান বিশ্বে প্রচলিত আইনে মাদক সেবন রোধ করা বা নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। বড় বড় রাষ্ট্রীয় কর্ণধার যারা তারা মাদকের সাথে ভাল সম্পর্ক রাখেন এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কতিপয় ব্যক্তি মাদক ব্যবসার সাথে সরাসরি জড়িত। এটি শুধু আমার বাংলাদেশের ক্ষেত্র প্রযোজ্য নয়, আধুনিক পৃথিবীর সকল দেশেই মাদকের ভয়াবহ কুফল থেকে মুিক্তর একমাত্র ইসলামের অনুশাসন মেনে চলা। ইসলাম মদ পান ও সকল প্রকার মাদক দ্রব্য হারাম করেছে। এবং ভয়ঙ্করতম কবিরাহ্ গুনহ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। ফলে ইমানের চেতনায় অধিকাংশ মুসলিম মদ পান থেকে বিরত থাকেন। অতি সামান্য সংখ্যক মানুষ হয়ত প্রবৃত্তির প্ররোচনায় মদ পান করে ফেলেন।

মদ পান যেন সমাজে প্রশ্রয় না পায় এবং ঘৃণিত ও নি্িদত থাকে এজন্য ইসলামী আইনে মদ পান, মাদক দ্রব্য গ্রহণ বা মাতলামীর জন্য প্রকাশ্য বেত্রাঘাতের শাস্তি নির্ধারিত করা হয়েছে। কেউ প্রকাশ্য মদ পান করলে, মাদক গ্রহণ করলে বা মাতলামী করলে এবং তার অপরাধ প্রমাণিত হলে সে এ শাস্তি পাবে। এভাবে ঈমান, তাক্ওয়া ও আইনের মাধ্যমে মানব সভ্যতার ভয়ঙ্কর ব্যাধি মদ ও মাদকতা ইসলাম সবচেয়ে সফলভাবে নিয়ন্ত্রণ এবং নির্মূল করছে। মহান আল্লাহ বলেন, “তারা তোমাকে মদ এবং জুয়া সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করছে। তুমি বলো, মদও জুয়ার মধ্যে বড় পাপ রয়েছে। এবং মানুষের জন্য কিছু কল্যাণ থাকলেও ক্ষতির পরিমান বেশি। (সুরা বাকারা-২১৯) আল্লাহ আরো বলেন হে ইমানদারগন মদ, জুয়া, পুজার বেদি ও ভাগ্যনির্ধারনী তীর ঘৃণ্য বস্তু।

শয়তানের কর্ম কাজেই তোমরা তা বর্জন কর যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার। শয়তান তো মদ ও জুয়া দ্বারা তোমাদের মধ্যে শত্র“তা ও বিদ্বেষ সঞ্চার করতে চায় এবং তোমাদেরকে আল্লাহর স্মরণ ও সালাতে বাধা দিতে চায় তাহলে কি তোমরা বিরত হবেনা (সুরা মায়েদা ৯০-৯১ আয়াত)। রাসুল (সঃ) বলেন তোমরা মদ-মাদকদ্রব্য বর্জন করবে কারন তা হলো সকল অকল্যাণ ও ক্ষতির উৎস। (সুনানে ইবনে মাজাহ/১১১৯) রাসুল (সঃ) আরো বলেন তিন ব্যক্তির জন্য আল্লাহ জান্নাত হারাম করেছেন ১) মাদকাসক্ত ব্যক্তি ২) পিতামাতার অবাধ্য ব্যক্তি ৩) দাইয়স যে নিজের স্ত্রী ও পরিবারের অশ্লীলতা সমর্থন করে। (মুসনাদ আহামদ২৬৯-১২৮) রাসুল(স:) আরো বলেন ব্যাভিচারী যখন ব্যাভিচার করে তখন তার ইমান থাকেনা মদ পানকারী যখন মদপান করে তখন তার ইমান থাকেনা। চোর যখন চুরি করে তখন তার ইমান থাকেনা সহীহ বোখারী (২/৮৭৫ ও মুসলিম) এরপর হযরত আনাস (রাঃ) বর্ণনা করেন, রাসুল (সঃ) মদের সাথে জড়িত ১০ জনের প্রতি অভিশাপ দিয়েছেন তারা হলেন- ১) মদ প্রস্তুতকারী, ২) পরামর্শদানকারী, ৩) মদ পানকারী, ৪) মদ বহনকারী, ৫) যার কাছে বহন করে নিয়ে যাওয়া হয়, ৬) যে মদ পান করায়, ৭) মদ বিক্রেতা, ৮) মদের মূল্য গ্রহণকারী, ৯) মদ ক্রয়কারী, ১০) যার জন্য মদ ক্রয় করা হয় (আবুদাউদ ও তিরমিযী)।

মাদক দ্রব্য সকল প্রকার যে নামে প্রচার করা হোক না কেন যেমন পানীয় মদ, হেরোইন, ইয়াবা, গাজা, ভাং, আফিম সহ যত রকম মাদক দ্রব্য আছে সকল মাদক হারাম। তামাকও ধুমপান এর অন্তর্ভূক্ত হবে। কেননা রাসুল (সঃ) মুখে দুর্গন্ধ সৃষ্টি করতে পারে এমন খাদ্য ভক্ষণ করে মসজিদে আসতে নিষেধ করেছেন। যেমন তিনি বলেন, যদি কেউ রসুন খায় তবে সে যেন তার দুর্গন্ধ দূর না হওয়া পর্যন্ত মসজিদে না আসে বা আমাদের সাথে সালাত আদায় না করে এবং রসুনের দুর্গন্ধ দিয়ে আমাদের কষ্ট না দেয়। কারণ সালাতে আমাদের সাথে ফিরিস্তারাও থাকে এবং তারাও কষ্ট পাবে (সহীহ্ বোখারী)। তামাকও ধুমপান একদিকে অর্থের অপচয় হয়, খাবার হিসেবে নোংরা এবং নিজ হাতে নিজকে ধ্বংস করার শামিল। মহান আল্লাহ বলেন, তোমরা অপচয় করনা এবং খবিস তথা নোংরা খাদ্যদ্র্য গ্রহণ করনা (সূরা আরাফ ১৫৯ আয়াত) তিনি আরো বলেন, তিনি তাদের জন্য পবিত্র বস্তুগুলি হালাল করেন এবং নোংরা ও খবিস খাদ্য হারাম করেন (সুরা বাকারা ১৯৫ আয়াত) সুতারাং উপরোক্ত আয়াতসমূহ থেকে প্রমাণ হয় যে, ধূমপান, তামাক ও জর্দা সেবনের মাধ্যমে অর্থের অপচয় হয়, নিজ শরীরকে ধাপে ধাপে ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাওয়া এবং খাদ্য দ্রব্য হিসাবে অত্যন্ত নোংরা এবং খবিস। ফকীহ্গণ প্রথম দিকে ধূমপান, তামাক ও জর্দাকে মুকরহ বলে ফতোয়া দিলেও বর্তমান গবেষণা করে ধুমপান, তামাক ও জর্দার ক্ষতি পর্যালোচনা করে ওলামায়ে কেরামগণ হারাম বলেছেন।

ধূমপানের কুফল, তামাক ও জর্দা সেবনের ক্ষতিকর দিক পর্যালোচনা করে অধিকাংশ আলেম ও ফকীহ্গণ মকরুব বলে একমত পোষণ করলেও পরবর্তী কালে বৈজ্ঞানিক গবেষণায় প্রমাণিত হয় যে, ধূমপান, তামাক ও জর্দা মানব দেহের জন্য ভয়ঙ্কর ক্ষতিকর। এজন্য আধুনিক যুগের অকিাংশ (আলিম) ইসলামী স্কলারগণ ধূমপান, তামাক, জর্দাকে হারাম বলেছেন। কারণ তা প্রিয় পাঠক বন্ধুগণ আজকে আমাদের চোখেরসামনে আল্লাহর শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানব মাদক সেবন করে ধ্বংসের দিকে ধাবিত হচ্ছে। আমাদের জাতির আগামী দিনের ভবিষ্যত তরুণ-তরুণীরা মাদকাসক্ত হয়ে পড়েছে। অত্যন্ত বেদনা নিয়ে বলতে হয় দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠগুলোর পবিত্র অংগন কতিপয় ছাত্র শিক্ষক এক সাথে মাদক সেবনে অপবিত্র করা হচ্চে। যুব সমাজের একটি অংশ মনে করছে তথাকথিত চেতনায় বিশ্বাসী হওয়ার জন্য প্রগতিশীল ও মডার্ন হওয়ার জন্য মাদক সেবন করতে হবে। এবং বেনসন সিগারেট পেকেট পকেটে না থাকলে আধুনিক হওয়া যায়না। এবং মাদক নির্ভর এক ধরনের যুব সমাজের চরিত্র তৈরী করে নিয়েছে। দেশের সীমান্ত এলাকাগুলোকে মাদক নির্ভর অর্থনীতি গঠিত হয়েছে। একটি জাতিকে ধ্বংস করার জন্য এর চেয়ে বেশী কিছু প্রয়োজন নাই। মাদকের এই সয়লাব থেকে নিজ, পরিবার, সমাজ ও জাতিকে বাঁচাতে ইসলামের অনুশাসনের দিকে ফিরে আসতে হবে। মাদকের খারাপ দিক এবং কুফল ও ইসলাম নিষিদ্ধ বিষয় জনগণকে বিশেষ করে যুব সমাজকে সচেতন করা সময়ের দাবী। এক্ষেত্রে ইসলামী স্কলারগণ আগে থেকে ভূমিকা পালন করছেন জুমার খোতবায় ওয়াজ, দোয়া মাহফিল ও বিয়ে সহ সামাজিক অনুষ্ঠানে। অতএব আসুন প্রত্যেকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে মাদকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলি।

লেখক: গবেষক ও ইসলামি চিন্তাবিদ, মোবাইলঃ ০১৮১৯-৮২১৭৭০


শেয়ার করুন