মন্ত্রীকে পাশ কাটিয়ে একের পর এক সিদ্ধান্ত নেয়াই কাল হলো শিক্ষাসচিব নজরুল ইসলাম খানের। মঙ্গলবার মন্ত্রী স্বাক্ষরিত এক নির্দেশনায় মন্ত্রণালয়ের সকল সিদ্ধান্ত নেয়ার একক ক্ষমতা নিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। তবে মন্ত্রী সচিবের ক্ষমতা খর্ব করায় রুলস অব বিজনেসের ব্যত্যয় ঘটেছে বলে জানা গেছে। কিন্তু এ বিষয়ে জনপ্রসাশন মন্ত্রণালয় এখন পর্যন্ত আনুষ্ঠানিক কোনো মন্তব্য করেনি। সেই সঙ্গে এ বিষয়ে মন্ত্রীও সরাসরি কোনো মন্তব্য করেননি। আর সচিব ‘অসুস্থতা’র দোহাই দিয়ে গণমাধ্যমের সঙ্গে কোনো কথা বলেননি।
সচিবের ক্ষমতা খর্বের বিষয়ে যে ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে- বুধবার শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইষলাম নাহিদের কাছে জানতে চাইলে সে বিষয়ে তিনি গণমাধ্যমকর্মীদের বলেন, ‘কোনো কিছু নিয়ে ধোঁয়াশা নেই। যা কিছু হচ্ছে, তা আপনারা জানেন।’
মঙ্গলবার কোনো প্রকার স্মারক নম্বর ছাড়া শিক্ষামন্ত্রী মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সাতটি জরুরি নির্দেশনা দিয়েছেন। যার ৬নং পয়েন্টে মন্ত্রণালয়ের সব বিষয়ে মন্ত্রীকে অবহিত না করে সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে না বলে বলা হয়েছে। ওই পয়েন্টের শুরুতেই বন্ধনীতে দুইটি লাইন লেখা রয়েছে। যাতে লেখা রয়েছে, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সাথে আমার সার্বিক বিষয়ে কথা হয়েছে। তিনিই বলে দিয়েছেন।’ প্রধানমন্ত্রীর বরাত দিয়ে শুরু হওয়া ওই পয়েন্টে পরবর্তীতে বলা হয়েছে- ‘মন্ত্রণালয়ের সকল সিদ্ধান্ত মন্ত্রী চূড়ান্ত করবেন। আমাকে না জানিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যাবে না।’
এই নির্দেশনায় মঙ্গলবার মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের গোপনে স্বাক্ষর নেয়া হয়েছে বলে মন্ত্রীর দপ্তরের একটি দায়িত্বশীল সূত্র বাংলামেইলকে নিশ্চিত করেছে।
বুধবার সকাল থেকেই মন্ত্রী মাধ্যমে সচিবের ক্ষমতা খর্ব করার বিষয়টি ছিল সচিবালয়ের অন্যতম আলোচ্য বিষয়। তবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত মুখ খোলেননি। যদিও সরেজমিনে মন্ত্রণালয় ঘুরে দেখা যায়, কর্মকর্তারা নিজেদের মধ্যে বিষয়টি নিয়ে চাপাস্বরে আলোচনা করছেন।
এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বাংলামেইলকে বলেন, ‘কেবিনেট ডিভিশনের রুলস অব বিজনেস অনুযায়ী, সচিবকে রাষ্ট্রপতি নিয়োগ দেন। মন্ত্রী চাইলেই সচিবকে পাশ কাটিয়ে সব সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। এখন কি একজন সহকারী সচিবের শাখা পরিবর্তনের বিষয়টিও মন্ত্রী নির্ধারণ করবেন?’
কর্মকর্তাদের কাছে পাঠানো শিক্ষামন্ত্রীর ওই নির্দেশনার প্রথম পয়েন্টে বুধবার বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের সঙ্গে বৈঠকে শুধু মন্ত্রী উপস্থিত থাকবেন বলে বলা হয়। সে অনুযায়ীই সচিব ওই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন না। অথচ এ ধরনের বৈঠকে এর আগে সচিব সবসময়ই উপস্থিত থাকতেন।
সচিবের দপ্তর থেকে জানা যায়, তিনি বুধবার বেলা ১১টার পর নিজ কার্যালয়ে আসেন। এরপর থেকে তিনি সেখানেই অবস্থান করছিলেন। দুপুর ১টার দিকে তিনি নিজ দপ্তর থেকে মন্ত্রীর দপ্তরের দিকে আসেন। সে সময় সেখানে উপস্থিত গণমাধ্যমকর্মীরা তার সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তিনি ‘ব্যস্ত আছি’ বলে এড়িয়ে নিজ কক্ষে চলে যান। এর কিছুক্ষণ পর বাংলামেইলসহ আরো ১০টি গণমাধ্যমকর্মী নিজেদের ভিজিটিং কার্ড দিয়ে তার সঙ্গে দেখা করতে চাইলে তিনি ‘অসুস্থ’ বলে দেখা করেননি।
তার ব্যক্তিগত কর্মকর্তা মনিরুল ইসলাম মিলন বাংলামেইলকে বলেন, ‘স্যার বিনীতভাবে আপনাদের বলেছেন- তিনি অসুস্থ। তাই আজকে দেখা করতে পারবেন না।’
শিক্ষা সচিবের ‘মাতবরি’ নিয়ে বিরক্ত ছিলেন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তরাও। এর আগে সচিবের জারিকৃত বেশ কয়েকটি পরিপত্র নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হয়। যার মধ্যে রয়েছে- এসএসসি ও এইচএসসি ফলাফলের ভিত্তিতে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি, নির্বাচনী পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ হয়ে শুধুমাত্র ক্লাসে ৭০ শতাংশ উপস্থিতির হার নিয়ে পাবলিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণের মতো বড় বিষয়ও ছিল। এছাড়াও ছাত্রী হোস্টেলে বিউটি পারলারকে বাধ্যতামূলক করা, শিক্ষার্থীদের সাঁতার শেখানো, সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইট তৈরিসহ ‘উদ্ভট’ নানা বিষয়ে পরিপত্র জারি করেন শিক্ষা সচিব। এগুলো নিয়ে শিক্ষামন্ত্রী তার উপর ‘বিরক্ত’ ছিলেন বলে জানা গেছে। এর মধ্যে এসএসসি ও এইচএসসির ফলাফলের ভিত্তিতে শিক্ষার্থী ভর্তি হওয়ার বিষয়ে সচিবের নির্দেশনা বাতিল করেন মন্ত্রী। এছাড়াও বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শিক্ষকদের পদোন্নতি, বদলি ও সংযুক্তির বিষয়েও সচিব নিজের ক্ষমতার প্রয়োগ করতেন বলে জানা গেছে।জানা গেছে, গত বছরের ১ সেপ্টেম্বর নজরুল ইসলাম খান সচিব হিসেবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে যোগদানের পর থেকে নানা বিষয়ে মন্ত্রীর সঙ্গে তার দ্বন্দ্ব চলমান ছিল। মন্ত্রীকে পাশ কাটিয়ে সচিব একের পর এক সিদ্ধান্ত নিতে থাকেন। তিনি প্রধানমন্ত্রীর আস্থাভাজন বলে তার ক্ষমতা বেশি ছিল বলে মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়। কারণ, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে আসার আগে নজরুল ইসলাম খান তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের সচিবের দায়িত্বে ছিলেন। এরও আগে তিনি প্রধানমন্ত্রীর একান্ত সচিব-১ ছিলেন। শেখ হাসিনা বিরোধী দলের নেতা থাকাকালীনও তিনি তার একান্ত সচিব হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।
তবে সম্প্রতি অনলাইনে ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষের একাদশ শ্রেণীর ভর্তি নিয়ে মন্ত্রী ও সচিবের দ্বন্দ্ব চরম আকার ধারণ করে। মন্ত্রীর নির্দেশনাকে ‘বাতিল’ করে তার অনুপস্থিতিতে নিজের একক সিদ্ধান্তে সারাদেশের সকল কলেজে অনলাইন ভর্তির নির্দেশ দেন সচিব। যার ফলে ভোগান্তিতে পরেন প্রায় বারো লাখ শিক্ষার্থী। এখনো সেই ভোগান্তী অব্যাহত রয়েছে।
মূলত, এ কারণেই সচিবের ক্ষমতাকে খর্ব করেছেন মন্ত্রী- এমনটিই জানিয়েছেন তার ঘনিষ্টজনরা। গত শনিবার মন্ত্রীর বাসভবনে মন্ত্রণালয়ের উচ্চপর্যায়ের অনানুষ্ঠানিক বৈঠকে সচিবের এ ধরনের কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করেন মন্ত্রী। তবে পরদিন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে মন্ত্রী বলেন, ‘আমরা সবাই একটি শিক্ষা পরিবার। সেই পরিবারে কোনো ভাঙন নেই। বরং, বন্ধন আরো দৃঢ় হচ্ছে।’
ওই সংবাদ সম্মেলনে একাদশ শ্রেণীর ভর্তির বিষয়ে শিক্ষাসচিব বলেছিলেন, ‘আমি টি-টুয়েন্টি খেলে ছক্কা মারার চেষ্টা করছি। ছক্কা মারতে গেলে অনেক সময় জিরোতে আউট হয়, রানআউট হয়, সেটা হতেও পারে।’ একই সংবাদ সম্মেলনে একাদশ শ্রেণীতে ভর্তির হ-য-ব-র-ল অবস্থা সৃষ্টি হওয়ায় ক্ষমা চেয়ে শিক্ষামন্ত্রী নিজের ওপর এই দায় নেন। যখন শিক্ষামন্ত্রী বিষয়টির দায় নেন তখন পাশে বসা শিক্ষা সচিবকে কখনো বিমর্ষ আবার কখনো অন্যমনস্ক দেখাচ্ছিল। অবশ্য এর আগে গত ২৮ জুন ‘ভোগান্তি’র সব দায় নিজের কাঁধে নিয়েছিলেন শিক্ষা সচিব।