মাকে চমক দেওয়ার ইচ্ছা পূরণ হলো না রূপার

রূপা খাতুন

তিলে তিলে জীবনটা গড়ছিলেন রূপা খাতুন। পড়ালেখার খরচ জোগাতে টিউশনি করেছেন, কাজ করেছেন পোশাক কারখানায়। বাবার মৃত্যুর পর পরিবারের ভরণপোষণের জন্য দিনরাত পরিশ্রম করেছেন। তবে একবারের জন্যও নিজের লক্ষ্য থেকে পিছু হটেননি তিনি। বেতন বাড়ানোর কথা মাকে জানিয়ে চমক দেওয়ার ইচ্ছা ছিল তাঁর।

কিন্তু সেটা আর হলো না রূপার (২৯)। সবকিছু গুছিয়ে আনার আগেই তাঁকে হত্যা করা হলো। চলন্ত বাসে ধর্ষণ করে ঘাড় মটকে তাঁকে হত্যা করে টাঙ্গাইল জেলার মধুপুর বন এলাকায় ফেলে রাখা হয়।

সিরাজগঞ্জের হাটিকুমরুল গোলচত্বর থেকে প্রায় ২৭ কিলোমিটার দূরে তাড়াশ উপজেলার আসানবাড়ি গ্রামে রূপার বাড়ি। বাড়ির ঘর ও আসবাবে দারিদ্র্যের ছাপ।

পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রাথমিকে বৃত্তি পাওয়া রূপা ২০০৪ সালে স্থানীয় জাফর ইকবাল টেকনিক্যাল গার্লস হাইস্কুল থেকে বাণিজ্য বিভাগে এসএসসি পাস করেন। ২০০৬ সালে জেআই টেকনিক্যাল অ্যান্ড বিজনেস ম্যানেজমেন্ট কলেজ থেকে একই বিভাগে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন। এরপর তিনি চলে যান বগুড়ার আজিজুল হক কলেজে। রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করে ঢাকার আইডিয়াল ল কলেজে এলএলবিতে শেষ বর্ষে পড়াশোনা করতেন।

বাবা ছিলেন কৃষক। দুই ভাই ও তিন বোনের মধ্যে রূপা তৃতীয়। বড় ভাই মো. হাফিজুর রহমান পড়েছেন উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত। আর মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরোতে না–পেরোতেই বিয়ে হয়ে যায় বড় বোন জেসমিন খাতুনের। তবে রূপার এই পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া মোটেই সহজ ছিল না।

জেসমিন খাতুন প্রথম আলোকে বলেন, ‘নবম শ্রেণি থেকেই রূপা টিউশনি করত। বগুড়ায় গিয়ে যখন মেয়েদের হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা করত, তখনো টিউশনি করত।’

রূপার ছোট বোন পপি খাতুন উচ্চমাধ্যমিক পাস করার পর ২০০৮ সালে নাটোরে খালার বাসায় চলে যান। সেখান থেকে ব্যবস্থাপনা বিষয়ে স্নাতক পাস করেন। রূপা এবং তিনি একই সঙ্গে একটি বহুজাতিক কোম্পানিতে প্রমোশনাল ডিভিশনে চাকরি করতেন। রূপার সর্বশেষ কর্মস্থল ছিল শেরপুরে আর পপির কর্মস্থল ছিল গাজীপুরে। বুধবার (গতকাল) কোম্পানির বারিধারার অফিস থেকে মাসের বেতন নিয়ে মিরপুর থেকে দুই বোন পরিবারের ঈদের কেনাকাটা করবেন—এমনটাই কথা ছিল।

বোনের মৃত্যুর খবরে পপি মঙ্গলবারই বাড়ি চলে এসেছেন। কাঁদছেন অনবরত। পপি বলছিলেন, পরিবারের আর্থিক অনটন যখন চরমে, তখন দুই বোন মিলে ঢাকায় চলে যান। তত দিনে তাঁর স্নাতক শেষ হয়েছে। রূপার শেষ হয়েছে স্নাতকোত্তর। সাভারের একটি ফ্যাশন হাউসে মান নিয়ন্ত্রকের কাজ নেন দুই বোন। এভাবে চলতে চলতেই একদিন আইন নিয়ে পড়া শুরু করেন রূপা। ২০১৫ সাল থেকে কাজ শুরু করেন বহুজাতিক এই কোম্পানিতে।

পপি বলেন, সর্বশেষ মাসিক ১৮ হাজার টাকা করে বেতন পেতেন দুই বোন। এই মাস থেকেই তাঁদের বেতন বাড়ানোর কথা। রূপার ইচ্ছা ছিল বেতন বাড়লে মাকে চমক দেবেন।

বৃহস্পতিবার দিনের কাজ শেষ করেই শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় অংশ নিতে শেরপুর থেকে বগুড়া গিয়েছিলেন রূপা। রূপার সঙ্গে কাজ করতেন সাবিহা সুলতানা। তাঁরা শেরপুরে একসঙ্গেই থাকতেন। গতকাল মুঠোফোনে প্রথম আলোকে তিনি বলেন, পণ্যের বাজারজাতের জন্য তাঁরা একসঙ্গেই একটি অনুষ্ঠান করেন। এরপর রূপা জানান, তিনি আর বাসায় যাবেন না। এখান থেকেই বগুড়া চলে যাবেন।

রূপা বগুড়ায় গিয়ে উঠেছিলেন তাঁর সেই আগের হোস্টেলের মালিকের বাসায়। হোস্টেলের মালিকের স্ত্রী মঞ্জু আরা গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘রাতে সে এল। সকালে উঠে একটা পরীক্ষা দিতে গেল। দুপুরে এসে বিকেলে বের হয়ে গেল। এরপর আর কিচ্ছু জানি না। পত্রিকায় দেখলাম শেষ খবর।’

গত শুক্রবার দিবাগত রাত ১১টার দিকে টাঙ্গাইল জেলার মধুপুর বন এলাকা থেকে মধুপুর পুলিশ রূপার লাশ উদ্ধার করে। বেওয়ারিশ হিসেবে পুলিশ টাঙ্গাইল কেন্দ্রীয় কবরস্থানে লাশ দাফন সম্পন্ন করে। সোমবার রূপার বড় ভাই হাফিজুর রহমান একটি পত্রিকায় বেওয়ারিশ লাশ দাফনের সংবাদ দেখে মধুপুর থানায় এসে তাঁর লাশ শনাক্ত করেন।

নিখোঁজ হওয়ার পর থেকেই তাঁর মা হাসনাহেনা বেগমের নাওয়াখাওয়া বন্ধ। মূর্ছা যাচ্ছেন বারবার। তাঁকে তাড়াশ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়েছে। গতকাল সেখানে গেলে দেখা যায়, হাসনাহেনা বেগম অনবরত কাঁদছিলেন।

হাসনাহেনা বেগম বলেন, ‘আমি কেবল কইতে গেছি তুই রাতে এমনে যাইস না।’ হাসনাহেনা বেগমের কান্নার শব্দ বাড়তে থাকে। বলেন, ‘আমার দরদি বেটি, কষ্ট করে লেখাপড়া শিখছে। আমার সোনার টুকরাটারে এমনে মারল। আমি বিচার চাই। তাদের ফাঁসি না দিলে মাইনব না।’


শেয়ার করুন