মহান ৭ই মার্চসে: সেই থেকে স্বাধীনতা শব্দটি আমাদের

বাংলামেইল:

7th-march… কবি এসে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন/ গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনালেন তাঁর/ অমর কবিতাখানি: ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম/ এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম/ সেই থেকে স্বাধীনতা শব্দটি আমাদের। (নির্মলেন্দু গুণ)

১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ। পাকিস্তানি শাষকদের ২৩ বছরের শোষণে বিরুদ্ধে অগ্নিস্ফূলিঙ্গের মতো জেগে ওঠা পুরো বাংলাকে এক সুতোয় বাঁধেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টা, রাজনৈতিক কবি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান। তার ডাকে সেদিন সব পিছুটান ফেলে বাংলার মানুষ ছুটে আসে তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে; যা বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান হিসেবে পরিচিত। লাখো জনতার সামনে বজ্রকণ্ঠে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা দেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’

আজ সেই ৭ই মার্চ। কালের প্রবাহমানতায় ঐতিহাসিক সেই ভাষণ পেরিয়ে এসেছে ৪৪ বছর। তবু, তার মাহাত্ম্য একটুও কি কমেছে! সেদিনের সেই ঘোষণার মধ্য দিয়ে শুরু হয় বাঙালির স্বাধীকার আদায়ের চূড়ান্ত লড়াই। ওইদিনের ওই ভাষণের পরে পুরো বাংলা চলতে থাকে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনায়। স্বাধীন বাংলার মূল স্বপ্নদ্রষ্টার ভাষণের প্রতিটি লাইন অক্ষরে অক্ষরে পালন করে প্রতিটি বাঙালির হৃদয়সত্তায় বিপ্লবের নবস্পন্দন জাগিয়ে তোলে। সেই ভাষণের অনুপ্রেরণায় দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শেষ ওই বছরেরই ১৬ ডিসেম্বর পৃথিবী নামক গ্রহে অঙ্কিত হয় ‘বাংলাদেশ’ নামে একটি স্বাধীন, সার্বভৌম ও ‘কভু হার না মানা’ একটি রাষ্ট্রের।

১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ মাত্র ১৯ মিনিট ভাষণ দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। অলিখিত ওই ভাষণ বিশ্ব রাজনীতির ইতিহাসের এক মহামূল্যবান দলিল হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। ভাষণটিতে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য ২৩ বছরের লড়াই সংগ্রামের বর্ণনা, পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর অত্যাচার নির্যাতনের চিত্র, সময়ভেদে বাঙালি জাতির করণীয় নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন। কোমলে-কঠোরে উচ্চারিত এই ভাষণ ছিল মুক্তিযুদ্ধের আলোকবর্তিকা। তার এ ভাষণই সেদিন সংশয়ে থাকা বাঙালির হৃদয়ে জাগিয়ে দিয়েছিল স্বাধীনতার স্বপ্ন। এ ভাষণের পরপরই বাঙালি জাতি মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। মূলত এই ভাষণ ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতারই অনানুষ্ঠানিক ঘোষণা।

বঙ্গবন্ধুর এ ভাষণের আহ্বানেই বাঙালি জাতি মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। পরে ২৫ মার্চ পাকবাহিনীর নৃশংস গণহত্যা শেষে ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে গ্রেপ্তারের আগমুহূর্তে দেশের আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। এরপর শুরু হয় সশস্ত্র সংগ্রাম। ত্রিশ লাখ শহীদের আত্মদান, আড়াই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমহানি এবং গোটা জাতির বিশাল ত্যাগের বিনিময়ে ১৬ ডিসেম্বর অর্জিত হয় চূড়ান্ত বিজয়।

৭ মার্চের উত্তাল দিনটিতে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকা ছিল মিছিলের শহর। ঢাকার এ পথ সে পথ ঘুরে; এ গলি সে গলি সব জায়গা থেকে আসা সব মিছিলই এসে মিশে রেসকোর্স ময়দানের লাখো জনতার মোহনায়। বিকেল ৩টায় সমাবেশ শুরু হওয়ার কথা থাকলেও, দুপুরের অনেক আগেই ময়দানটি রূপ নেয় জনসমুদ্রে। ঢাকাসহ সারাদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে দলে দলে মানুষ আসে প্রাণের নেতার নির্দেশনার প্রত্যাশায়। ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে লাখো মানুষ তখন নির্দেশনার অপেক্ষায়, নেতার ঘোষণার আশায়। ঐতিহাসিক এই ভাষণে সামরিক আইন প্রত্যাহার, সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে প্রত্যাবর্তন, ইতিপূর্বের বিভিন্ন আন্দোলনে শহীদদের জন্য ক্ষতিপূরণ ও জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর সংবলিত চার দফা দাবি উত্থাপন করেন বঙ্গবন্ধু।

এ জনসভায় মওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশের নেতৃত্বে শহীদদের রুহের মাগফেরাত কামনা করে বিশেষ মোনাজাত করা হয়।

ঘড়ির কাঁটায় তখন বিকেল প্রায় ৩টা ২০ মিনিট। সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি আর হাতাকাটা কালো কোট (মুজিব কোট) পরে বাঙালির প্রাণপুরুষ বঙ্গবন্ধু দৃপ্ত পায়ে উঠে এলেন মঞ্চে। দাঁড়ালেন মাইক্রোফোনের সামনে। আকাশ-কাঁপানো স্লোগান আর মুহুর্মূহু করতালির মধ্যে হাত নেড়ে অভিনন্দন জানালেন অপেক্ষমাণ জনসমুদ্রকে। এর জবাবে লাখো জনতা তাকে অভিবাদন জানালেন হৃদয়ের সকল আকুতি দিয়ে। বঙ্গবন্ধু শুরু করলেন তার ঐতিহাসিক ভাষণ। রাজনীতির কবি বঙ্গবন্ধু কবিতার মতো করে উচ্চারণ করলেন জনগণের হৃদয়ের অভিব্যক্তি। বললেন, ‘ভাইয়েরা আমার, আমি প্রধানমন্ত্রীত্ব চাই না, মানুষের অধিকার চাই। প্রধানমন্ত্রীত্বের লোভ দেখিয়ে আমাকে নিতে পারেনি। ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলিয়ে দিতে পারেনি। আপনারা রক্ত দিয়ে আমাকে ষড়যন্ত্র-মামলা থেকে মুক্ত করে এনেছিলেন। সেদিন এই রেসকোর্সে আমি বলেছিলাম, রক্তের ঋণ আমি রক্ত দিয়ে শোধ করবো। আজো আমি রক্ত দিয়েই রক্তের ঋণ শোধ করতে প্রস্তুত।’

বাঙালির হাজার বছরের আরাধ্য পুরুষ বঙ্গবন্ধু সেদিন নির্দেশ দিয়েছিলেন, ‘আজ থেকে কোর্ট-কাচারি, হাইকোর্ট, সুপ্রিম কোর্ট, অফিস-আদালত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সব অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকবে। কোন কর্মচারী অফিসে যাবেন না। এ আমার নির্দেশ।’

সতর্কবাণী উচ্চারণ করে নির্দেশনা দিয়েছিলেন, ‘আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোককে হত্যা করা হয়, তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সবকিছু, আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি তোমরা বন্ধ করে দেবে।’

উত্তাল জনসমুদ্রে দাঁড়িয়ে সবশেষে বঙ্গবন্ধু উচ্চারণ করলেন, ‘তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব, এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাআল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।’

ঐতিহাসিক ৭ মার্চ উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাণী দিয়েছেন। পৃথক পৃথক বাণীতে দিনটিকে বাঙালির ইতিহাসের এক গৌরবময় অধ্যায় হিসেবে অভিহিত করেন তারা।

দিবসটি যথাযথ মর্যাদায় পালনের জন্য আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে ভোর সাড়ে ৬টায় বঙ্গবন্ধু ভবন ও দলীয় কার্যালয়ে জাতীয় ও দলীয় পতাকা উত্তোলন, সকাল ৭টায় বঙ্গবন্ধু ভবন প্রাঙ্গণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হবে রাষ্ট্রীয় ও দলীয়ভাবে। বিকেল ৩টায় বঙ্গবন্ধু আন্তজার্তিক সম্মেলন কেন্দ্রে আলোচনা সভা। সমাবশে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা।

দিবসটি উপলক্ষে বাংলাদেশ বেতার, বাংলাদেশ টেলিভিশন, বেসরকারি বেতার ও টেলিভিশন চ্যানেলগুলো বিশেষ অনুষ্ঠান সম্প্রচার এবং সংবাদপত্রগুলো বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করছে। আওয়ামী লীগের সব শাখা কেন্দ্রীয় কর্মসূচির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ৭ই মার্চ স্মরণ ও পালণ করবে বলে দলের এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে।


শেয়ার করুন