মন্ত্রীদের গরম স্যুট, নরম রাজনীতি

মিজানুর রহমান খান

জাতীয় ফুল আছে, ফল আছে, পাখি আছে। আরও অনেক কিছু আছে। কিন্তু পিন্দনের কাপড় কী হবে তা ঠিক নেই। কথা খাঁটি। কিন্তু কাজটা কি এতই সহজ? স্বাধীনতার পর মুজিবকোট অনেকের জাতীয় পোশাক হয়ে উঠেছিল। কিন্তু কখনো তা ড্রেস কোডে আসেনি। সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার জানালেন, খন্দকার মোশতাক আহমদ প্রথম মন্ত্রিসভা বৈঠকেই পোশাকবিধি তাঁর মন্ত্রীদের ললাটে লটকে দিয়েছিলেন। শেরোয়ানি আর মোশতাকি টুপি হয়ে উঠেছিল ‘জাতীয় আনুষ্ঠানিক পোশাক’।
১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ লাহোর প্রস্তাবের দিনটিতে শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক পরেছিলেন শেরওয়ানি-পাজামা ও জিন্না টুপি। এটা এখনো পাকিস্তানের জাতীয় পোশাক।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পোশাক নিয়ে গত সপ্তাহে আবার অসন্তোষ ব্যক্ত করেছেন। আশা করব, মন্ত্রীরা তাঁর অসন্তোষকে কেবলই গরমের মধ্যে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র ব্যবহারের বিলাসিতার প্রতি সতর্কবার্তা হিসেবে দেখবেন না। আমরা বিশ্বাস করতে চাই, মন্ত্রীদের চালচলনে মিতব্যয়িতার ঘাটতি খুব বেশি ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ার কারণেই প্রধানমন্ত্রী হয়তো এ বিষয়ে অসন্তোষ ব্যক্ত করার কথা স্মরণে এনেছেন। অনেকের কাছে মন্ত্রীদের পরনে গরমে লাউঞ্জ স্যুট বিলাসিতা, অপচয়। এমনকি গ্রামের বিদ্যুৎবঞ্চিত গরিব জনগণের প্রতি তাদের অবিমৃশ্যকারিতার ইঙ্গিতবহ। কিন্তু এটাও সত্য যে অনেক কিছুতেই পরনির্ভর দেশের মন্ত্রিবর্গ যাঁদের হরহামেশা বিদেশিদের সঙ্গে ওঠাবসা করতে হয়, তাঁদের হয়তো কোনো ‘জাতীয় পোশাক’ ধারণ করা সহজ নয়।
প্রিয়াঙ্কা গান্ধী দিল্লির অভিজাতপাড়ায় টি-শার্ট ও জিনস পরেন, কিন্তু আমেথির গ্রামে তিনি কখনো সুতি শাড়ি না পরে যান না। তিনি কেন ইন্দিরা কিংবা হালের মমতা, মায়াবতী ও জয়ললিতার মতো সর্বত্র শাড়ি পরেন না, সে নিয়ে তাঁকে গঞ্জনা শুনতেই হচ্ছে। গোয়া সরকারের শিল্পকলা ও সংস্কৃত বিভাগ কদিন আগেই অফিসে আস্তিনবিহীন কুর্তা, জিনস, টি-শার্ট, বহু পকেটওয়ালা প্যান্ট নিষিদ্ধ করল। গত বছরের আদেশ নতুন করে ঝড় তুলল, যখন তা গত ২৪ মার্চ বিধানসভার বাজেট অধিবেশনে সরকার কড়াকড়ি আরোপে আবার তুলল। স্থানীয়ভাবেই নয়, এই তর্কের ঝড়ে দিল্লিও দুলল। দ্রুত আদেশ বদলে ২৮ মার্চ বলা হলো, না, অফিসে সবাই ‘আধা আনুষ্ঠানিক, আনুষ্ঠানিক কিংবা চৌকস ক্যাজুয়াল পোশাক’ পরবেন। এর সংজ্ঞায় লাউঞ্জ স্যুটসহ দুনিয়ার সব পোশাককেই হয়তো ফেলা যাবে। দিল্লিতে মোদি সরকারের কয়েকজন মন্ত্রী গোয়ার নতুন পোশাক কোডকে ভারতীয় সংস্কৃতির পরিপন্থী বলে সমালোচনা করেছিলেন। গোপা সাবরওয়াল তাঁর ইন্ডিয়া সিন্স নাইনটিন ফোরটি সেভেন: দি ইনডিপেনডেন্ট ইয়ার্স বইয়ে ১৯৭৩ সালের অবস্থা সম্পর্কে লিখেছেন, মন্ত্রীদের ফ্যাশনে বড় পরিবর্তন চোখে পড়ে। এখন কেবল তিন মন্ত্রী (জগজীবন রাম, ওয়াই বি চ্যাবন ও উমা শংকর দীক্ষিত) গান্ধী টুপি পরেন। কিন্তু একটা দিন ছিল, যখন কংগ্রেসদলীয় আলগারাই শাস্ত্রী দাবি করেছিলেন যে যাঁরা গান্ধী টুপি পরতে ব্যর্থ হবেন, কংগ্রেস থেকে তাঁদের সদস্যপদ খোয়া যাবে। আর এটা বলার পরে যিনি ক্রুদ্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছিলেন, তিনি স্বয়ং প-িত নেহরু: ‘আমি টুপিতে নয়, টুপির নিচে কী আছে সেই বিষয়ে কৌতূহলী।’ গান্ধী টুপির সঙ্গে মিল কিস্তে ভিক্টোরিয়া যুগের আগে ভারতে ব্রিটিশরা উলেন হ্যাট পরত।
আমাদের পোশাক সম্পর্কে মন্ত্রীদের কোনো প্রতিক্রিয়া জানা যায়নি। তাঁরা কেউ হয়তো বলবেন না, লাউঞ্জ স্যুটে নয়, স্যুটের ভেতরের মানুষটা কতটা ‘সামাজিক সুবিচার’-এর (স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে বর্ণিত) নীতিতে বিশ্বাসী সেটাই বড় কথা। বিশ্বের প্রথম ইন্দোনেশিয়ার জাভা নারী মন্ত্রী মারিয়া উলফা সান্তোসো। ১৯৪৭ সালে সমাজকল্যাণমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনকালে তিনি বেছে নেন পাশ্চাত্যের ব্লাউজ ও স্কার্ট। কোনো কিছুই রাজনীতিমুক্ত নয়। পোশাকে রাজনীতি আছে, সেটা নরম রাজনীতি। তার প্রমাণ হলো মিনা রোসেসের লেখা বই দ্য পলিটিকস অব ড্রেস ইন এশিয়া অ্যান্ড দি আমেরিকাস। এতে তিনি বলেন, মারিয়া হয়তো মনে রেখেছেন যে পাশ্চাত্যের মন্ত্রীরা যে পোশাক পরেন, তাতে সমতার ঘোষণার প্রতিফলন আছে। ইন্দোনেশীয় জাতীয়তাবাদী নেতা সুকর্ণ দেশটির অভিজাত শ্রেণির জন্য পশ্চিমা স্যুট পরতে উৎসাহিত করেছিলেন। দেশের জাতীয় পোশাক ছিল লুঙ্গির মতো সারং। আমাদের জাতীয় পোশাক কি পাজামা-পাঞ্জাবি, নাকি লুঙ্গি-পাঞ্জাবি, নাকি প্যান্ট-শার্ট তা বলা দুরূহ। কোনো একটা নির্দিষ্ট করে দিলে বিতর্ক আর থাকবে না। তবে জাতীয় পোশাক আর রাষ্ট্রীয় বা সরকারি অনুষ্ঠানের পোশাকবিধি দুটো আলাদা হতে পারে।
বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী গামছা ধরেছেন। অনেকে লুঙ্গিকে জাতীয় পোশাকের অপরিহার্য অনুষঙ্গ মনে করেন। ইদানীং একটি লুঙ্গির বিজ্ঞাপন প্রচুর হাস্যরসের সঞ্চার করেছে। জনপ্রিয় লেখক সৈয়দ আবুল মকসুদ সেলাই ছাড়া সাদা পোশাক পরছেন। কবি ফরহাদ মযহারের লুঙ্গি ফ্যাশন ঢাকা ক্লাবে পরাস্ত হয়েছে। বঙ্গভবনের আমন্ত্রণপত্রে লাউঞ্জ স্যুট লেখা থাকে। কিন্তু সবাই কি তা মানেন বা মানতে পারেন বা মানাটা খুব দরকারি? এর উত্তর বিবিধ ও বিচিত্রই হবে।
পাঞ্জাবি বা লুঙ্গি কি সেকেলে ফ্যাশন, যা পরিত্যক্ত হওয়া উচিত? সুকর্ণ তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন, ‘আমি এমনকি সুপারিশ করলাম যে ঘরোয়াভাবেও যেন সারং পরা না হয়। কারণ, এই স্বদেশি পোশাকটির একটি মর্যাদাহীন বৈশিষ্ট্য রয়েছে।’ প্রায়ই আমরা শুনি, ঔপনিবেশিক প্রভুদের পোশাক আমরা আজও আঁকড়ে ধরে আছি। এসব ছাড়ো। স্বদেশি হও। এই যুক্তি খ-ন করেছেন সুকর্ণ। তাঁর কথায়, প্রভুদের চাপিয়ে দেওয়া ‘দাসসুলভ শৃঙ্খলগুলো’ আমরা অবশ্যই ভাঙব। কিন্তু আসুন আমরা প্রমাণ করি, সাবেক প্রভুদের মতোই আমরা প্রগতিশীল। আমরা সমানতালে চলার যোগ্য। আমাদের আধুনিক পোশাক পরতে হবে।’ সুকর্ণ ইন্দোনেশীয় সংস্কৃতি পেছনে ফেলতে পারেননি।
স্যুট-সমর্থক সুকর্ণ তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রীর প্রেমে কি করে পড়েছিলেন, তাঁর বিবরণ দেন: ‘আমি ওকে পরিশীলিত হলদে বোরকার আড়ালে দেখেছিলাম। সেকেলে ধরনটাই আমার পছন্দ। খাটো স্কার্ট, আঁটসাঁট ব্লাউজ ও অতি উজ্জ্বল লিপস্টিকে শোভিত আধুনিক নারী আমার পছন্দ নয়।’ সুকর্ণের মতো এরশাদ-জিয়াও স্যুট চালু করেন। সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব সাদত হুসেইন স্মরণ করতে পারেন যে এরশাদ আমলে ‘গাঢ় রঙের গলাবদ্ধ প্রিন্স কোট পরতে মন্ত্রীদের প্রতি নির্দেশ জারি হয়েছিল।’
অধ্যাপক মিনা রোসেসের বই পোশাকের রাজনীতিটা কত গভীর ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হতে পরে তারই একটি প্রামাণ্য দলিল। ইউরোপীয়রা জুতা না খুলে গির্জায় যেত, ১৯১৯ সালে মিয়ানমারের মান্ডালাতে এর প্রতিবাদে দাঙ্গা ঘটে, এমনকি তা বর্মি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে উসকে দিয়েছিল। সুকর্ণর ভাবনাটা বর্মি জাতীয়তাবাদীদের আচ্ছন্ন করেছিল। ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীর গোড়ায় বর্মিরা পাশ্চাত্যের পোশাক পরতে শুরু করলে প্রভুরা প্রমাদ গোনেন। তাঁরা দেখেন, আরে এটা তো তাদের শর্তে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন নয়, বরং স্পর্ধা। ইউরোপীয়দের অনেকে বর্মি লুঙ্গি পরতে শুরু করেছিলেন বটে, তবে তা নিতান্ত ‘খামখেয়ালি’ বা ‘ধর্তব্য নয়’। ১৮৮৭ সালে লন্ডনে একমাত্র শুভ্র ধুতি পরিহিত গান্ধী সাহেবদের চমকে দিয়েছিলেন। এর ৩৩ বছর পর গান্ধীতে দীক্ষিত বর্মি ভিক্ষু উত্তমা বিদেশি বস্ত্র বর্জনের আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। এই সময়টায় বর্মি তরুণদের কাছে তাদের পরিহিত নিজস্ব বস্ত্র হয়ে উঠেছিল প্রতিবাদের ভাষা। গবেষক এমা টারলোর মতে, গান্ধী খাদি পরেছিলেন। কারণ, তিনি বার্তা পাঠান যে ‘ভারতের দারিদ্র্য মোচনে তাঁতশিল্প ও ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা দুটোই লাগবে।’ অং সান সু চির দল কিন্তু বার্মা সফরে গান্ধী পরিহিত কৃষক হ্যাটকেই দলীয় প্রতীক করেছে। বর্মি সামরিক সরকারগুলো মনে রাখে, পোশাকে ঢাকা শরীর হলো ভ্রাম্যমাণ জাদুঘর। পোশাকের সঙ্গে জাতীয় সংস্কৃতির যোগসূত্র আছে।
খন্দকার মোশতাককে প্রায় কেউ অনুসরণ করেননি। তাঁর টুপি কম লোকই পরেছেন। সাদত হুসেইনকে বললাম, এই টুপি কি জিন্নাহর নকল? তিনি আমাকে অবাক করলেন। না, এটা বরং সুভাস বোসের টুপির কাছাকাছি। তিনি রাষ্ট্রাচার ক্লাসে প্রবাদপ্রতিম একটি বাক্য আওড়ান: স্যুট ইজ অলসো ইনফরমেশন ট্রান্সমিটার, অর্থাৎ পোশাক তথ্য আদান-প্রদানেরও মাধ্যম। তিনি স্মৃতিচারণা করেন যে স্বাধীনতার পরে লুঙ্গি পরে বঙ্গভবনে ঢুকতে চেয়েছিলাম, দ্রুত বুঝলাম এটা হওয়ার নয়। স্যুট-টাইয়ের কদর আলাদা। তাঁর উপলব্ধি স্মরণ করিয়ে দেয় ‘আগে নজরদারি, তার পরে গুণবিচারি’ কথাটা। ইরানি কবি শেখ সাদির অভিজ্ঞতাও তাই। বিয়ের অনুষ্ঠানে গিয়ে সাধারণ পোশাকে কদর না পেয়ে জাঁকজমকপূর্ণ পোশাক পরে খাতির পেয়েছিলেন। সে কারণে তিনি খাবারগুলো না খেয়ে পকেটে পুরেছিলেন।
আমাদের চিন্তাচেতনায় পোশাক দিয়ে গান্ধীর মতো বার্তা বহনের ইঙ্গিত নেই। প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছায় যদি আদৌ কিঞ্চিৎ বিদ্যুৎ সাশ্রয় ঘটে, সেটুকুই হবে বিরাট প্রাপ্তি। এরশাদ আমলে ‘রবিবাসরীয় মেজাজের’ ড্রেস পরা যাবে না মর্মে হুকুম জারি ছিল। আমার তো মনে হয়, নাশকতাপূর্ণ রাজনীতির গরমে স্যুট পরা মন্ত্রী ও উচ্চপদস্থ অনেকেই রবিবাসরীয়, অর্থাৎ ফুরফুরে মেজাজেই রয়েছেন। প্রথম আলো
মিজানুর রহমান খান : সাংবাদিক
সৎশযধহনফ@মসধরষ.পড়স


শেয়ার করুন