মন্ত্রিসভা থেকে বেরিয়ে আসা সময়ের ব্যাপার মাত্র

NID-0000000000001789-400x218সিটিএন ডেস্ক:
জাতীয় পার্টির নবনিযুক্ত কো-চেয়ারম্যান সাবেক মন্ত্রী জিএম কাদের বলেছেন, মন্ত্রিসভা থেকে বেরিয়ে আসা সময়ের ব্যাপার মাত্র। ইতিমধ্যে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূতের পদ থেকে সরে আসার জন্য পদত্যাগপত্র তৈরি করেছেন পার্টি চেয়ারম্যান সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। পদত্যাগপত্রও তৈরি। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে যে কোনো সময় তিনি তার হাতে এই পদত্যাগপত্র জমা দেবেন। কিন্তু আমরা তাকে বলেছি, আপনি একা পদত্যাগ করে আসলে লাভ হবে না। দলের রাজনীতি স্পষ্ট করার স্বার্থে মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের নিয়ে একযোগে পদত্যাগ করতে হবে। তাহলেই এই পদত্যাগ অর্থবহ হবে। তিনি আরও বলেন, প্রেসিডিয়ামের সর্বশেষ বৈঠকেও মন্ত্রিসভা থেকে বেরিয়ে আসার সিদ্ধান্ত হয়েছে। তবে এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে পার্টি চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের হাতে। তিনি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে এ নিয়ে কথা বলবেন। তাকে বোঝাবেন জাতীয় পার্টি মন্ত্রিসভা থেকে বেরিয়ে এলে আওয়ামী লীগের ক্ষতি হবে না বরং লাভই হবে। আমি মনে করি, প্রধানমন্ত্রীও এটি বুঝবেন।
বুধবার দলের কাকরাইলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে যুগান্তরকে দেয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে জিএম কাদের এসব কথা বলেন। এ সময় তিনি দল নিয়ে তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথাও তুলে ধরেন। কথা বলেন অন্যান্য প্রসঙ্গ নিয়ে। সাক্ষাৎকারের হুবহু নিচে দেয়া হল-
প্রশ্ন : কো-চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পাওয়ার পর আপনার প্রতিক্রিয়া কী?
জিএম কাদের : আমার সারাজীবন ইচ্ছা ছিল জনগণের জন্য কাজ করব। বিশেষ করে গরিব, খেটে খাওয়া, শ্রমজীবী, দিনমজুর ও মেহনতি মানুষের জন্য কাজ করব। আর সেই ইচ্ছা থেকেই এক সময় রাজনীতিতে আসা। নব্বইয়ের পর জাতীয় পার্টির নাম উচ্চারণ করা কঠিন ছিল। সেই দুঃসময়ে দলটিতে সম্পৃক্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে আমার রাজনীতিতে পথচলা শুরু হয়। এই পথ চলতে গিয়ে এ পর্যন্ত তিনবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছি। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের মন্ত্রী ছিলাম। টানা ৫ বছর দুটি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেছি। যখন যে দায়িত্ব পালন করেছি তা সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গেই করেছি। একইভাবে সততা এবং নিষ্ঠা নিয়েই রাজনীতি করার চেষ্টা করেছি। আগে জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য ছিলাম। পার্টি চেয়ারম্যান এরশাদ আমাকে কো-চেয়ারম্যানের নতুন দায়িত্ব দিয়েছেন। এই দায়িত্ব জনগণের জন্য কিছু করার সুযোগ এনে দিয়েছে। আমি এজন্য পার্টি চেয়ারম্যানের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। তিনি যে আস্থা ও বিশ্বাস নিয়ে আমার ওপর এতবড় দায়িত্ব অর্পণ করেছেন তা পালনে ব্যর্থ হব না বলে আমি আশা করি।
প্রশ্ন : অনেকেই বলছেন পার্টি চেয়ারম্যানের এই সিদ্ধান্ত বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ মেনে নেননি। আপনার কী মনে হয়?
জিএম কাদের : যতটুকু জানি তার (রওশন এরশাদ) মতামত নিয়েই আমাকে পার্টি কো-চেয়ারম্যান করা হয়েছে। তিনি নিজেও আমাকে এ দায়িত্ব নিতে বলেছেন। উৎসাহিত করেছেন। আমার জানামতে এখন পর্যন্ত প্রকাশ্যে তিনি আমার বিরুদ্ধে একটি কথাও বলেননি। এর অর্থ তিনি আমাকে মেনে নিয়েছেন। আমাকে কো-চেয়ারম্যান করার সিদ্ধান্ত বিরোধীদলীয় নেতা মেনে নেননি- যারা এমন কথা বলছেন, তারা জাতীয় পার্টির রাজনীতিতে সুযোগ সন্ধানী ও সুবিধাভোগী। তারা নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য রওশন এরশাদের নাম ব্যবহার করছেন।
প্রশ্ন : দলের নেতাকর্মীরা কি আপনাকে মেনে নিয়েছেন?
জিএম কাদের : দু-তিনজন ছাড়া জাতীয় পার্টির সর্বস্তরের নেতাকর্মী আমাকে মেনে নিয়েছেন। তারা আমাকে কো-চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দেয়ার পর খুশি হয়েছেন। এই নিয়োগের পর জাতীয় পার্টিতে নবজাগরণ সৃষ্টি হয়েছে। নেতাকর্মীরা নতুন করে আশার আলো দেখছেন।
প্রশ্ন : এই উপমহাদেশে পারিবারিক রাজনীতির যে প্রথা, আপনাকে কো-চেয়ারম্যান করাও কি সেই রাজনৈতিক প্রথারই অংশ? অনেকে বলছেন, দলে অনেক যোগ্য লোক থাকা সত্ত্বেও কেবল ভাই হওয়ার কারণে আপনাকে কো-চেয়ারম্যান করা হয়েছে। এক্ষেত্রে আপনার মতামত কী?
জিএম কাদের : আমার তা মনে হয় না। আমি সংসদ সদস্য ছিলাম। মন্ত্রী ছিলাম। আমার রাজনৈতিক অতীত আছে। আমার মনে হয় নানা শ্রেণী-পেশার মানুষের কাছেও আমার এক ধরনের গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। সেসব দিক বিবেচনা করেই হয়তো পার্টি চেয়ারম্যান আমাকে এ দায়িত্ব দিয়েছেন। আমার বিশ্বাস, শুধু ভাই হিসেবে নয়, যোগ্য মনে করেই তিনি আমাকে এ দায়িত্ব দিয়েছেন। তবে এটাও ঠিক, আমি যোগ্য কি অযোগ্য তা সময়ই বলে দেবে। নেতাকর্মীরা যেভাবে পাশে দাঁড়িয়েছেন, সাহস ও সমর্থন জুগিয়ে যাচ্ছেন- তাতে আমার বিশ্বাস আমি সফল হব। জাতীয় পার্টিও নতুনভাবে ঘুরে দাঁড়াবে।
প্রশ্ন: কো-চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেয়ার পর পার্টিকে এগিয়ে নিতে নিশ্চয়ই আপনি একটি কর্মপরিকল্পনা তৈরি করেছেন। কী সেই পরিকল্পনা?
জিএম কাদের : দায়িত্ব পাওয়ার পরপরই আমি আমার কাজ শুরু করেছি। প্রতিদিনই নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলছি। ঘরোয়াভাবে বৈঠকে বসছি। ভবিষ্যতে জাতীয় পার্টিকে কিভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায় সেই পরিকল্পনা তৈরি করছি। আপাতত আমার প্রথম চ্যালেঞ্জ কেন্দ্রীয় কাউন্সিল সফলভাবে সম্পন্ন করা। আগামী ১৬ এপ্রিল বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় ত্রিবার্ষিক কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হবে। এর আগে প্রায় ৪০টি জেলায় সম্মেলন হবে। কাউন্সিলের মধ্য দিয়ে জাতীয় পার্টির রাজনীতি স্পষ্ট করা হবে আমার দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জ। আমরা চাই এর আগেই মন্ত্রিসভা থেকে বেরিয়ে এসে জনগণের সামনে জাতীয় পার্টির রাজনীতি স্পষ্ট করতে। যে যাই বলুক জাতীয় পার্টিকে বাঁচাতে হলে দলের রাজনীতি স্পষ্ট করতে হবে। এর জন্য সবার আগে সরকার থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। আমার তৃতীয় চ্যালেঞ্জ দলে শৃংখলা, ঐক্য এবং সংহতি প্রতিষ্ঠা করা। দল করতে চাইলে শৃংখলা মানতে হবে। শৃংখলা না মানতে চাইলে দল ছাড়তে হবে। একটি রাজনৈতিক দলকে এগিয়ে নিতে চাইলে সবার আগে দলটিতে শৃংখলা, ঐক্য এবং সংহতি প্রতিষ্ঠা করা জরুরি। আমার চতুর্থ চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, দলে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নেতা নির্বাচন করা। আগে কেন্দ্র থেকে নেতা বানানো হতো। এখন থেকে তৃণমূলের মতামতের ভিত্তিতে নেতা নির্বাচন করা হবে। আমার পঞ্চম চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, মানুষের মধ্যে জাতীয় পার্টিকে নিয়ে যে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ও সন্দেহ-অবিশ্বাস কাজ করছে তা দূর করা। এই পাঁচটি কাজ করতে পারলে জাতীয় পার্টির অগ্রযাত্রা কেউ ঠেকাতে পারবে না।
প্রশ্ন : জাতীয় পার্টির এখন সেই সাংগাঠনিক শক্তি নেই। অনেক শীর্ষ নেতা নানা সময়ে দল ছেড়ে চলে গেছেন। বলা হচ্ছে, জাতীয় পার্টি এখন সবচেয়ে খারাপ অবস্থার মধ্য দিয়ে সময় পার করছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে কি উদ্যোগ নেবেন?
জিএম কাদের : এটা ঠিক, জাতীয় পার্টি এখন আর সেই আগের জাতীয় পার্টি নেই। সুযোগ সন্ধানীরা নানা সময়ে দল ভাঙার চেষ্টা করেছেন। জাতীয় পার্টিকে অনেকে ব্রাকেট বন্দি করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু তারা কেউই সফল হননি। এরশাদের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টি এখনও টিকে আছে। তাকে ঘিরেই দলে নেতাকর্মীরা ঐক্যবদ্ধ। তবে এটাও ঠিক দলের বর্তমান ভূমিকায় নেতাকর্মীদের মধ্যে হতাশা কাজ করছে। অনেকে মান-অভিমান করে দূরে সরে গেছেন। অনেকে নিষ্ক্রিয় রয়েছেন, দল ছেড়ে চলেও গেছেন। বেশ কিছুসংখ্যককে বহিষ্কার করা হয়েছে। সবমিলিয়ে এক নাজুক অবস্থার মধ্য দিয়ে চলছে জাতীয় পার্টির রাজনীতি। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে আমার কাজ হবে হতাশা দূর করে নিষ্ক্রিয় নেতাকর্মীদের সক্রিয় করা। বিভিন্ন সময় যাদের দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে সেসব বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করা। দলছুটদের সম্ভব হলে দলে ফিরিয়ে আনা। পাশাপাশি দলকে এগিয়ে নিতে নতুন করে সদস্য সংগ্রহ অভিযান শুরু করা হবে। এখন তথ্যপ্রযুক্তির যুগ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ সব ধরনের ডিজিটাল সুযোগ-সুবিধা কাজে লাগিয়ে জাতীয় পার্টির রাজনীতি, লক্ষ্য, আদর্শ ও উদ্দেশ্য জনগণের মাঝে প্রচার করে দলকে শক্তিশালী করা।
প্রশ্ন : অভিযোগ রয়েছে জাতীয় পার্টিতে এখন সবচেয়ে বড় অভাব শৃংখলার। নেতাদের অনেকে যেন কেউ কাউকে মানেন না। একজন একেক রকম কথা বলেন। ফলে নেতাকর্মীরা বিভ্রান্তির মধ্যে পড়েন। শৃংখলা ফিরিয়ে আনতে আপনি কোনো উদ্যোগ নেবেন কিনা?
জিএম কাদের : আমিও মনে করি, এ মুহূর্তে জাতীয় পার্টির যেমন নিজস্ব কোনো রাজনীতি নেই, তেমনি শৃংখলারও বড় অভাব। আমার মতে, রাজনীতি স্পষ্ট করার পাশাপাশি দলে যে কোনো মূল্যে শৃংখলা বজায় রাখতে হবে। নেতৃত্বের প্রতি অবিচল আস্থা রাখতে হবে। ঐক্য ধরে রাখতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। তবে এটাও ঠিক, ওপর থেকে মতামত চাপিয়ে দিলেও চলবে না। মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীদের মতামত নিয়ে দল চালাতে হবে। কর্মীরা নেতা তৈরি করবেন এই সংস্কৃতির সূচনা করতে হবে। আমি সবার মতামত নিয়ে ঐকমত্যের ভিত্তিতে জাতীয় পার্টিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাই।
প্রশ্ন : কি মনে হয় আপনার? জাতীয় পার্টি কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবে?
জিএম কাদের : দল চলবে এরশাদের নেতৃত্বেই। তিনি জাতীয় পার্টির প্রাণ। তিনিই জাতীয় পার্টির মূল শক্তি। এই যে এত বছরেও জাতীয় পার্টি টিকে আছে তা এরশাদের কারণেই। তার জনপ্রিয়তার ধারে-কাছেও কেউ নেই। আমি তার নির্দেশনা অনুযায়ী পথ চলছি কেবল। আমি মনে করি, বড় দুটি রাজনৈতিক দল মানুষের আশা-আকাক্সক্ষা এবং প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। তাই তারা এই দুই দলকে আর চায় না। তারা দুই দলের হাত থেকে পরিত্রাণ চায়। তারা চায় নতুন কাউকে। জাতীয় পার্টিই হতে পারে সেই নতুন কেউ। আমরা আগামী দিনে মানুষের আশা-আকাক্সক্ষা পূরণের লক্ষ্য নির্ধারণ করে পথ চলব।
প্রশ্ন : আপনি বারবার বলছেন জাতীয় পার্টির রাজনীতি স্পষ্ট করতে হবে? এর মধ্য দিয়ে আসলে আপনি কি বোঝাতে চাইছেন?
জিএম কাদের : ‘জাতীয় পার্টি’ ‘না সরকারি দল’, ‘না বিরোধী দল’। আমরা কোথাও গেলে মানুষ আমাদের কথা শুনতে চায় না। আমাদের আমলে নেয় না। ভালো চোখে দেখে না। অনেকে তিরস্কার করে। আমাদের নিয়ে নানাভাবে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করে। অনেকে বলে ‘আমরা গাছের উপরেরটাও খাই, তলারটাও কুড়াই।’ অনেকে আমাদের ‘দালাল’ বলে। আবার অনেকে এও বলেন, ‘আমরা গৃহপালিত বিরোধী দল।’ এসব কারণে আমাদের কথা কেউ বিশ্বাস করে না। এ কারণে জাতীয় পার্টির জনপ্রিয়তা দিন দিন তলানিতে এসে ঠেকেছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্যই আমি বারবার বলছি জাতীয় পার্টির রাজনীতি অস্পষ্ট। অস্পষ্ট রাজনীতি দিয়ে মানুষের প্রত্যাশা পূরণ করা যায় না। তাই সবার আগে দলের রাজনীতি স্পষ্ট করতে হবে। এজন্য প্রথমেই সরকার থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। জাতীয় পার্টিকে সংসদে এবং সংসদের বাইরে কার্যকর বিরোধী দলের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হবে। বাস্তবতা হচ্ছে, দেশে এখন কার্যত কোনো বিরোধী দল নেই। সরকার ও বিরোধী দল একাকার হয়ে গেছে। বিএনপির ওপরও মানুষের আস্থা নেই। এর ফলে রাজনীতিতে একটি শূন্যস্থান তৈরি হয়েছে। জাতীয় পার্টিই পারে সেই শূন্য স্থান পূরণ করতে। আর তা করতে হলে আমাদের রাজনীতি স্পষ্ট করতে হবে। যে যাই বলুক দেশের রাজনীতির গতিধারা নিয়ে এক ধরনের অনিশ্চয়তা বিরাজ করছে। জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদ জেঁকে বসতে শুরু করেছে। সামনে কি হবে? গণতন্ত্রের কি হবে? এ ধরনের নানা প্রশ্ন জনমনে বিরাজ করছে। এ অবস্থায় জাতীয় পার্টিই হতে পারে মানুষের আশা-আকাক্সক্ষার একমাত্র ভরসার জায়গা।
প্রশ্ন: আপনি মন্ত্রিসভা থেকে বেরিয়ে আসার কথা বলছেন, পার্টি চেয়ারম্যান এরশাদও বলছেন পদত্যাগ করার কথা। এ সব কি সে ফ কথার কথা? নাকি সত্যিই সরকার থেকে বেরিয়ে আসতে চান?
জিএম কাদের : আমরা সত্যিই চাই সরকার থেকে বেরিয়ে আসতে। দু-তিনজন ছাড়া দলের সবাই তাই চান। জনগণও তাই চায়। জাতীয় পার্টিকে রাজনীতির মাঠে টিকে থাকতে হলে যত দ্রুত সম্ভব মন্ত্রিসভা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। পার্টি চেয়ারম্যানও এ সত্য উপলব্ধি করছেন।
প্রশ্ন: তাহলে পার্টি চেয়ারম্যান এরশাদ কেন পদত্যাগ করছেন না। তিনি তো আগ বাড়িয়ে পদত্যাগ করতে পারেন। এ বিষয়ে আপনার মন্তব্য কী?
জিএম কাদের : যে কোনো সময় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূতের পদ থেকে পদত্যাগের জন্য তিনি (এরশাদ) প্রস্তুত। পদত্যাগপত্র লেখাও হয়ে গেছে। আমাকে তিনি তা দেখিয়েছেন। তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, যে কোনো দিন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে তার হাতে পদত্যাগপত্র তুলে দেবেন। তবে আমরা দলের প্রেসিডিয়ামের সভায় বলেছি, তিনি একা পদত্যাগ করলে লাভ হবে না। বাকি মন্ত্রী এবং প্রতিমন্ত্রীদেরও একযোগে পদত্যাগ করতে হবে। তাহলেই মানুষ জাতীয় পার্টিকে বিশ্বাস করতে শুরু করবে। জাতীয় পার্টিকে সত্যিকারের বিরোধী দল হিসেবে ভাববে।
প্রশ্ন : আপনি কি নিশ্চিত সরকার থেকে বেরিয়ে আসলে জাতীয় পার্টি রাজনৈতিকভাবে লাভবান হবে। কী মনে হয়?
জিএম কাদের : অবশ্যই।
যুগান্তর : মহাজোট সরকারের সময় আপনি জাতীয় পার্টি থেকে মন্ত্রী ছিলেন। তখনও পার্টি চেয়ারম্যান এরশাদ যে কোনো সময় মন্ত্রিসভা থেকে বেরিয়ে আসার কথা বলতেন। কিন্তু দেখা গেছে শেষদিন পর্যন্ত জাতীয় পার্টি (আপনি) মহাজোট সরকারের মন্ত্রিসভায় ছিল। এবারো কি একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটবে? কি মনে হয় আপনার?
জিএম কাদের : আমি জাতীয় পার্টির নেতা হিসেবেই মহাজোট সরকারের মন্ত্রিসভায় যোগ দিই। পার্টি চেয়ারম্যান একদিন আমাকে ডেকে বললেন, ‘আমরা মন্ত্রিসভা থেকে বেরিয়ে আসব।’ তিনি আমাকে তার কাছে পদত্যাগপত্র জমা দিতে বললেন। যথারীতি আমি তাই করি। যদিও শেষদিন পর্যন্ত আমরা মহাজোট সরকারে ছিলাম। তবে তখনকার প্রেক্ষাপট আর এখনকার প্রেক্ষাপট এক নয়। এখনকার প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ ভিন্ন। একই সঙ্গে সরকারে এবং বিরোধী দলে থাকায় জাতীয় পার্টির রাজনীতি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এই প্রশ্ন দূর করতেই জাতীয় পার্টিকে সরকার থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
প্রশ্ন : দল সিদ্ধান্ত নিল পদত্যাগের, কিন্তু কেউ কেউ এই সিদ্ধান্ত অমান্য করলেন। কী ব্যবস্থা নেবেন তাদের বিরুদ্ধে?
জিএম কাদের : দলের সিদ্ধান্ত সবাইকে মানতে হবে। সিদ্ধান্ত যিনি মানবেন না তার বিরুদ্ধে গঠনতন্ত্র অনুযায়ী সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়া হবে। মনে রাখতে হবে ব্যক্তির চাইতে দল বড়। দলের চাইতে বড় দেশ।
প্রশ্ন : এর মধ্য দিয়ে কি জাতীয় পার্টি আবারও ভাঙনের মুখে পড়বে?
জিএম কাদের : না, সে সম্ভাবনা নেই।
প্রশ্ন : এখন মন্ত্রিসভা থেকে বেরিয়ে আসার কথা বলছেন, এরপর কি সংসদ থেকেও বেরিয়ে আসার কথা বলবেন?
জিএম কাদের : না, আমরা মন্ত্রিসভা থেকে বেরিয়ে আসতে চাইলেও পুরো মেয়াদ সংসদে থাকব। সরকারকে স্থিতিশীল রাখতে বিরোধী দলে থেকেই সব ধরনের সহায়তা করব। নানা কারণেই জাতীয় পার্টি এখন দিকভ্রান্ত। রাজনীতি স্পষ্ট করার মধ্য দিয়ে দল গোছাতে চাই। এজন্য আমাদের আরও সময় প্রয়োজন। এই সংসদের দুই বছর পূর্ণ হয়েছে। আরও তিন বছর হাতে রয়েছে। আমরা শেষদিন পর্যন্ত সংসদে থাকব। আর এর আগেই দলকে সুসংগঠিত করব।
প্রশ্ন : দলে আপনার বিরুদ্ধপক্ষ বলছেন আপনি সংসদ সদস্য হতে পারেননি, নিজের স্ত্রী দলের ভাইস চেয়ারম্যান শেরিফা কাদেরকে সংরক্ষিত আসনে সংসদ সদস্য বানাতে পারেননি বলেই সরকার থেকে বেরিয়ে আসার কথা বলছেন। এই অভিযোগ কতটা সত্য?
জিএম কাদের : এটা ঠিক নয়। আমি নিজেও ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের পক্ষে ছিলাম। নির্বাচনে অংশ নিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু পার্টি চেয়ারম্যান নির্বাচনে যেতে চাননি। আমি তার সিদ্ধান্তের প্রতি সম্মান জানিয়ে নির্বাচনে যাইনি। নির্বাচনে গেলে হয়তো আমিও সংসদ সদস্য থাকতাম। এর সঙ্গে সরকার থেকে বেরিয়ে আসার কোনো সম্পর্ক নেই। সরকার থেকে বেরিয়ে আসতে চাই দলের স্বার্থে। আমার স্ত্রী শেরিফা কাদের নিয়ে যা বলা হচ্ছে তাও ঠিক নয়। নেতাকর্মীরা চেয়েছিলেন তাকে (শেরিফা কাদের) সংরক্ষিত আসনে সদস্য করা হোক। তিনিও চেয়েছিলেন, কিন্তু আমার মধ্যে এ নিয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ছিল।
প্রশ্ন : অনেকে বলেন, জাতীয় পার্টিতে যোগ্য প্রার্থীরও সংকট রয়েছে। সর্বশেষ সিটি কর্পোরেশন এবং পৌরসভা নির্বাচনে এ সত্যটি আরও একদফা প্রমাণিত হয়েছে। এই সংকট কিভাবে কাটিয়ে উঠবেন?
জিএম কাদের : আসলে জাতীয় পার্টির মূল সংকট রাজনীতি নিয়ে। জাতীয় পার্টির নিজস্ব কোনো রাজনীতি না থাকায় নেতাকর্মীরা হতাশ। রাজনীতি না থাকায় দিন দিন দলটির জনসমর্থন কমে যাচ্ছে। এসব কারণেই অনেকে এখন নির্বাচনে প্রার্থী হতে চান না। রাজনীতি স্পষ্ট হলে, দল ঘুরে দাঁড়ালে, মানুষের মধ্যে আস্থার জায়গা সৃষ্টি করতে পারলে, জনমত পক্ষে থাকলে নির্বাচনে প্রার্থী সংকট হবে না।-সাক্ষাতকারটি দৈনিক যুগান্তর থেকে নেয়া।


শেয়ার করুন