ভোটের রাজনীতি ও ইসলামে ভোট

women-lineup-2_1212925i-400x258সিটিএন ডেস্ক:
মাস গড়ালেই পৌরসভা নির্বাচন। চারদিকে বইছে নির্বাচনী হাওয়া। আগামী মাসেই পৌরসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে ইঙ্গিত দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। এদিকে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ নির্বাচন পেছানোর দাবি জানিয়েছে। সোমবার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে নির্বাচন কমিশন। প্রার্থী বাছাইয়েও চলছে দলীয় নেতাদের তোড়জোড়। মনোনয়ন পেতে দৌড়ঝাঁপ চলছে দলীয় কা-ারীদের কাছে।
ভোট হবে, তৃণমূল পর্যায়ের নেতৃত্ব নির্ধারণ হবে। মানুষের সামাজিক উন্নয়ন ও শহরবাসীর সমস্যার সমাধান দেবেন পৌর-মেয়র ও কাউন্সিলররা। এটা নাগরিকদের জাতীয় দায়িত্ব যে তাদের ভোট দিয়ে গণপ্রতিনিধি তৈরি করতে হবে। নগর উন্নয়নের ধারক বাহকদের কাছে থাকবে মানুষের স্বপ্ন ও প্রত্যাশা। প্রার্থীরা সৎ ও যোগ্য হলেই সেই স্বপ্ন ও প্রত্যাশা পূরণ সম্ভব। জনগণও সেই প্রার্থী নির্বাচনে দিতে হবে সঠিক সিদ্ধান্ত ও দায়িত্বের পরিচয়। এ জন্য ভোটার ও প্রার্থী সকলেরই থাকতে হবে সজাগ চোখ। ইসলামে প্রার্থী নির্বাচন ও ভোট প্রদানে রয়েছে সঠিক দিকনির্দেশনা। সেই দিকনির্দেশনা মেনে ভোট প্রদান ও প্রার্থীদের জনগণের দায়িত্ব নিলে নগর উন্নয়নে আসবে গতিশীলতা।
ভোট হলেও অনেক মানুষ ইসলামের দোহাই দিয়ে ভোট প্রদান থেকে বিরত থাকেন। অপরদিকে প্রার্থীরাও ক্ষমতা ও লুটতরাজের লক্ষ্যে নির্বাচন করে থাকেন। ফলে উন্নয়নের বদলে বিশৃঙ্খলা ও রাজনৈতিক দলাললি হয়ে থাকে বেশি। সমাজ ও মানুষের দায়বদ্ধতা থেকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলে এ সঙ্কট থেকে কিছুটা হলেও উত্তোলন সম্ভব। নির্বাচন হবে, মানুষকে ভোট দেবে মানুষ। ইসলামের আলোকে প্রার্থী বাছাই ও ভোট প্রদান পদ্ধতি তুলে ধরা হল :
ভোট কি?
ভোট হল, মত প্রকাশ করা, পছন্দ বা অপছন্দ প্রকাশ করা, ব্যক্তির পক্ষে বা বিপক্ষে মত প্রদান করা। এবং এভাবে নেতা নির্বাচন করা।
ইসলামের দৃষ্টিতে ভোট ও জনমতের গুরুত্ব
ইসলামে সৎ পাত্রে ভোট প্রদানে কোন সমস্যা নেই। যে দেশে মুসলিমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ সে দেশে অনৈসলামিক নেতৃত্বের পরিবর্তে ইসলামী নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করার ব্যাপারে ভোট অনুষ্ঠান ইসলামবিরোধী হওয়ার প্রশ্নই আসে না। আধুনিককালে গণতান্ত্রিক উপায়ে ইসলাম কায়েমের সুন্দর পদ্ধতি হচ্ছে নির্বাচন। তাই, ভোট হচ্ছে আধুনিক যুগের এক ধরণের জিহাদ। কোন নবী সশস্ত্র আন্দোলন করে কোন দেশেই বল প্রয়োগে ইসলামি হুকুমত কায়েম করেননি। নবীগণ মানুষের মন জয় করার চেষ্টা করেছেন; তবে, লক্ষ্য ছিল কেবল আল্লাহর সন্তোষ।
খোলাফায়ে রাশেদা’র সবাই নির্বাচিত হয়ছিলেন। হযরত আলীর (রা.) পর অনির্বাচিতরা ক্ষমতায় এলেন। সে সময়কার শাসক সাহাবি হলেও তাদের খলিফা বলা হয়নি। কিন্তু সাহাবী না হওয়া সত্ত্বেও উমর ইবনে আব্দুল আজীজকে (রহ.) পঞ্চম খলিফা বলা হয়।
ইসলামে জনমতের গুরুত্ব রয়েছে। আল্লাহ বলেন, “কাজের ব্যাপারে এদের সঙ্গে পরামর্শ কর। তারপর (সে পরামর্শের ভিত্তিতে) সংকল্প একবার যখন তুমি করে নেবে তখন (তার সফলতার জন্য) আল্লাহর ওপর ভরসা কর।” (সূরা আলে ইমরান : ১৫৯)।
ভোটকে নিছক ছেলে-খেলা বা ঝুট-ঝামেলা মনে করা ঠিক নয়। ভোটদানের সময় ভাবতে হবে কোন প্রার্থী বা দলকে ভোট দিলে কল্যাণ হবে। আপনি গাড়ির ড্রাইভার নিয়োগের জন্য অবশ্যই কোন মাতাল, নেশাখোর নিয়োগ দেবেন না। যিনি আমাদের নেতা হবেন বা আইন প্রয়োগে মুখ্য ভূমিকা পালন করবেন তিনি যদি নেশাখোর ড্রাইভারের মত অসৎ, আল্লাহবিমুখ, অদক্ষ, ও অযোগ্য হন তাহলে শুধু সে নিজেই ক্ষতিগ্রস্ত হবে না, শুধু আমাদেরই ক্ষতি করবে না, ক্ষতিগ্রস্ত করবে পুরো সমাজ, রাষ্ট্র ও জাতিসত্তাকে।
ভোটপ্রদানে করণীয়
কোনো নির্বাচনী এলাকায় ভালো, সৎ ও দ্বীনদার লোককে প্রার্থী করা হলে তাকে ভোট না দিয়ে বিরত থাকা শরীয়তের দৃষ্টিতে অন্যায় এবং পুরো জাতির উপর জুলুম করার শামিল (কবীরা গুনাহ)। কিন্তু কোনো নির্বাচনী এলাকায় যদি নিতান্ত সৎ, যোগ্য ও দ্বীনদার লোক প্রার্থী না হয় তারপরও সেখানে ভোট দেওয়া থেকে বিরত থাকা উচিত নয়। বরং তুলনামূলকভাবে যিনি ভালো তাকেই ভোট দেওয়া প্রয়োজন। কেননা অন্যায় ও অপরাধ যার মাধ্যমে বেশি হবে তার তুলনায় যার মাধ্যমে অন্তত কম হবে তাকে গ্রহণ করা না হলে বেশির জন্য অধিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে যা শরীয়তের দৃষ্টিভঙ্গির পরিপন্থী। যেমন- কোনো নাপাক পূর্ণভাবে দূর করা সম্ভব না হলেও অন্তত কিছুটা কমানোর চেষ্টা শরীয়ত ও যুক্তিসম্মত।
নির্বাচনে অংশগ্রহণের প্রয়োজনীয়ত
যদিও বর্তমান নির্বাচন পদ্ধতি ইসলাম সম্মত নয় তথাপি ইসলামি রাষ্ট্রে ইসলামি মূল্যবোধের ভিত্তিতে নির্বাচন পদ্ধতি প্রবর্তনের পূর্ব পর্যন্ত বর্তমান অবস্থায় এই নির্বাচন পদ্ধতিকে অন্তবর্তিকালীন বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে গ্রহণ করা ছাড়া উপায় নেই। আল্লাহ বলেন, “তোমরা আল্লাহর জন্য সত্যের সাক্ষ্য প্রতিষ্ঠা করো।” (৬৫/সূরা আত তালাক:২) আল্লাহ আরও বলেন, “হে ঈমানদারগণ! তোমরা ইনসাফের সাথে আল্লাহর জন্য সাক্ষী হয়ে দাঁড়াও।” (৪/সূরা আন নিসা:১৩৫) আল্লাহ আরও বলেন, “তোমরা কখনই সাক্ষ্য গোপন করবে না, যে সাক্ষ্য গোপন করে তার মন পাপের কালিমাযুক্ত।” (২/সূরা আল বাকারাহ:২৮৩)
নির্বাচনে অংশ না নিলে
এ যুগে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যে বিশৃঙ্খলা তার দিকে তাকিয়ে অনেক দ্বীনদার ব্যক্তিও না বুঝে ভোট দেওয়াকে অহেতুক বিষয় মনে করে এ থেকে বিরত থাকেন। এতে আখিরাতমুখী লোকেরা প্রার্থী হবার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয় এবং দুনিয়ামুখী ব্যক্তিরা গোজামিলের ভোটাভুটিতে বিজয়ী হয়। ভোট না দেওয়া বা সামান্য লোভ ও অর্থের বিনিময়ে (ইসলামি মানদ-ে) অযোগ্য ব্যক্তিকে ভোট দেওয়ার ফলে মানবতা বিসর্জিত হয়।
মাথার উপর নাপাক জিনিস রেখে যতো পরিষ্কার ও পবিত্র পানি দিয়ে অযু-গোসল করা হোক না কেন এতে শরীর পাক হবে না। অনুরূপভাবে, যারা হবে জাতির কর্ণধার, যাদের হাতে থাকলে হালাল-হারামের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা, যারা আইন রচনা করবে ও বিভিন্ন বিল পাশ করাবে তারা যদি আল্লাহবিমুখ হয় তাহলে জাতির উন্নতি কখনো হতে পারে না।
ইসলামের দৃষ্টিতে প্রার্থী হওয়া
যে ব্যক্তি মনোনয়ন চায় সে দাবি করে সে যোগ্য, সৎ ও নিষ্ঠাবান। কিন্তু নিজেকে ভালো মনে করা ইসলামের বিধান নয়। রাসূল (সা.) বলেন, “ যে ব্যক্তি পদ চায় আমাদের কাছে সে-ই সবচেয়ে বেশি খিয়ানাতকারী।” (আবু দাউদ)
এক হাদীসে নবী করীম (সা.) আবদুর রহমান ইবনে সামুরা (রা.) কে বলেন- সরকারি পদ দাবি করো না। কেননা চেষ্টা তদবির করার পর যদি তা তোমাকে দেওয়া হয়, তাহলে তোমাকে তোমার পদের উপর সঁপে দেওয়া হবে (অর্থাৎ সে দায়িত্ব তোমাকে নিজে সামলাতে হবে) আর চেষ্টা তদবির ছাড়াই যদি কোনো পদ লাভ করো, তাহলে তার হক আদায় করার ব্যাপারে আল্লাহর পক্ষ থেকে সাহায্য করা হবে। (কানযুল উম্মাল)
রাসূল (সা.) আরও বলেন, যে দায়িত্বশীল মুসলিম জনপ্রতিনিধি সে যদি তাদের সাথে প্রতারণা এবং খিয়ানাতকারী অবস্থায় মারা যায়, তাহলে আল্লাহ তার জান্নাতে প্রবেশ করা হারাম করে দেবেন। (বুখারী, মুসলিম)
ভোট একটি আমানত
আল্লাহ বলেন, “(হে ঈমান ব্যক্তিরা) আল্লাহ তোমাদেরকে নির্দেশ দিচ্ছেন, তোমরা আমানতসমূহ তাদের (যথার্থ) মালিকের কাছে সোপর্দ করে দেবে।” (৪/সূরা আন নিসা:৫৮)
অপাত্রে বা অযোগ্য লোককে ভোট দেওয়া আমানতের সুস্পষ্ট খিয়ানাত ও বিশ্বাসঘাতকতা। আল্লাহ বলেছেন, “হে ঈমানদার বান্দারা, তোমরা আল্লাহ তাআলা ও (তাঁর) রাসূলের সাথে কখনো বিশ্বাসঘাতকতা করো না এবং জেনে-শুনে নিজেদের আমানাতেরও খিয়ানাত করো না।” (৮/সূরা আল আনফাল:২৭)
অসৎ লোককে ভোট দেয়া অন্যায়
কুরআনে বলা হয়েছে, “যার কাছে আল্লাহর পক্ষ থেকে যে সাক্ষ্য (সৎ লোক) বর্তমান রয়েছে তা যদি সে গোপন করে (অসৎ লোককে ভোট দেয়) তবে তার চেয়ে বড় জালেম আর কে হতে পারে? জেনে রেখ, তোমাদের কাজকর্ম সম্পর্কে আল্লাহ মোটেই বেখবর নন।” (২/সূরা আল বাকারাহ:১৪০)
ভোট দেয়ার ব্যাপারেও জবাবদিহি
হাদীসে আছে, “সাবধান! তোমরা প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল এবং প্রত্যেককেই তার দায়িত্বের সম্পর্কে জবাবদিহি করতে হবে।” (বুখারী ও মুসলিম)
কোনো সংসদ বা পরিষদের সদস্যকে প্রতিনিধি বানানোর সময় শুধু ভোটারের সাথে সম্পর্ক সীমিত থাকে না। বরং পুরো জাতির সাথে তার সম্পর্ক হয়ে যায়। সুতরাং কোনো অসৎ বা ইসলামবিরোধী লোককে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করলে সে পুরো জাতির অধিকার খর্ব করলো এবং ঐ গুনাহের বোঝা তাকেও বইতে হবে। আল্লাহ বলেন, বস্তুত যে লোক বিন্দু পরিমাণও ভালো কাজ করবে, সে তা পরকালে দেখতে পাবে। (৯৯/সূরা যিলযাল:৭-৮)
ভোট কেনা-বেচা
টাকা বা সম্পদ দিয়ে ভোট আদায় কিংবা টাকা বা সম্পদের পাওয়ার কারণে ভোট দেয়া ঘুষ দেয়া ও নেয়ার মতই হারাম। এটা ইসলাম, দেশ ও জাতির সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করার সমতুল্য। অন্যের বিলাসিতা ও খ্যাতির জন্য নিজের ঈমানকে বিসর্জন দেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ নয়- তাতে যতই স্বার্থ (বা সম্পদ) লাভ হহোক না কেন। মহানবী (সা:) বলেন, “ঐ ব্যক্তি সবচেয়ে বেশি ধ্বংসের মধ্যে আছে যে অন্যের দুনিয়া সাজানোর জন্য নিজের দ্বীনকে নষ্ট করে দেয়।”
আমাদের করণীয়:
(হে নবী) আপনি উপদেশ দিতে থাকুন। কারণ উপদেশ মুমিনের জন্য ফলপ্রসূ হবে ও কল্যাণ বয়ে আনবে। (৫১/সূরা আয যারিয়াত:৫৫)
মানুষ আল্লাহর প্রতিনিধি। আল্লাহ বলেন, “আমি যমীনে আমার প্রতিনিধি পাঠাবো।” (২/সূরা আল বাকারাহ:৩০) আল্লাহর প্রতিনিধিত্বের দায়িত্ব বলতে বুঝায় আল্লাহর সামগ্রিক আদেশ, নিষেধ, নীতিমালা তাঁর যমীনে বাস্তবায়ন করা। এর জন্য ন্যায়ানুগ যত পথ-পদ্ধতি গ্রহণ করা দরকার তার সবই আমাদের গ্রহণ করতে হবে। জান-মালের কুরবানী, সংগ্রাম-আন্দোলন, কলমের যুদ্ধ, ভোট প্রদান সবই এক একটি জরুরি অনুষঙ্গ। ইসলাম বিজয়ের দ্বীন। বিশ্বব্যাপী ইসলামের বিজয় কেতন উড়ানোই মুসলমানদের সর্বশেষ (ইহকালীন) লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। বর্তমান সময়ে এ লক্ষ্যে পৌঁছতে খুবই গুরুত্বের সাথে ভোট প্রদানকে সামনে রাখতে হবে ও এ লক্ষ্যে কাজ করে যেতে হবে।


শেয়ার করুন