ভোজ্যতেলে মেশানো হচ্ছে পাটে ব্যবহৃত বিষাক্ত জেবিও

ভোজ্যতেলে মেশানো হচ্ছে পাটে ব্যবহৃত বিষাক্ত জেবিও

পাট উজ্জ্বল করার কাজে ব্যবহৃত জুট ব্যাচিং অয়েল (জেবিও) এখন ভোজ্যতেলে মেশানো হচ্ছে। জেবিও মেশানো তেল খেয়ে মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়ছেন সাধারণ মানুষ। বিষাক্ত জেবিও’র প্রভাবে মানবদেহে পেটে পীড়া, চর্মরোগ, এমনকি মরণব্যাধি ক্যান্সারও হতে পারে বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন।

জেবিও’র রং ও ঘনত্ব সয়াবিন তেলের মতো। এ ছাড়া এ তেলের কোনো স্বাদ নেই। ফলে জেবিও’র সঙ্গে সয়াবিন মিশিয়ে বাজারজাত করতে কোনো অসুবিধা হয় না।

জেবিও মেশানোর বড় কারণ এর বাজার দর। প্রতি কেজি জেবিও’র মূল্য ৬৭ টাকা ৭০ পয়সা। অন্যদিকে সয়াবিন তেল বিক্রি হয় ১১০ টাকায়। অধিক লাভের আশায় খুলনার তেল ডিপোগুলো থেকে জেবিও কিনে তা মেশানো হচ্ছে সয়াবিন তেলে। যা সারাদেশে সরবরাহ করা হচ্ছে। ঢাকা ও খুলনার অসাধু ব্যবসায়ীরা এ কাজে লিপ্ত রয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি)-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০০৯-১০ অর্থবছরে দেশে জেবিও বিক্রির পরিমাণ ছিল ১৯ হাজার ১৬৫ টন। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে তা দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩০ হাজার টনে। অথচ বাংলাদেশ জুট এ্যাসোসিয়েশনের সূত্র অনুযায়ী, ২০০৯-১০ অর্থবছরে যে পরিমাণ পাটজাত দ্রব্য রফতানি হয়েছে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে তা কমে প্রায় অর্ধেকের কাছাকাছি নেমে এসেছে। সংশ্লিষ্টদের মতে, পাটে ব্যবহৃত জেবিও ভোজ্যতেলে ব্যবহৃত হচ্ছে বলেই পাটজাত দ্রব্যের রফতানি কমলেও জেবিও’র বিক্রি বেড়ে গেছে। সয়াবিন তেলের সঙ্গে জেবিও মিশ্রণ রোধে ২০১৪ সালে অক্টোবর মাসে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে জেবিও দাম বৃদ্ধি করে সয়াবিন তেলের সমান করার প্রস্তাব দেয়। কিন্তু ওই প্রস্তাব এখনো আলোর মুখ দেখেনি।

২০১৪ সালের জানুয়ারি থেকে জুন মাস পর্যন্ত মেঘনা পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের খুলনা ডিপো থেকে রাজবাড়ী জুট মিলস লিমিটেড, আলতু খান জুট মিলস লিমিটেড মধুখালী, ফরিদপুর; রাজ্জাক জুট ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড চর নওয়াপাড়া, আশাপুর, মধুখালী, ফরিদপুর; প্রইড জুট মিলস লিমিটেড আড়পাড়া, কামারখালী, ফরিদপুর এবং গোল্ডেন জুট ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড মাঝিবাড়ী, কামারখালী, মধুখালী, ফরিদপুরের নামে বিপুল পরিমাণ জেবিও সরবরাহ করা হয়। ওই সময় খুলনা মেঘনা পেট্রোলিয়ামের প্রধান ছিলেন সহকারী জেনারেল ম্যানেজার আখতার কামাল চৌধুরী।

ওই সময় (গত বছর জুলাই মাস) খুলনা বিভাগীয় জ্বালানী তেল পরিবেশক সমিতির সাধারণ সম্পাদক শেখ হাফিজুর রহমান খুলনার জেলা প্রশাসক ও মেঘনা পেট্রোলিয়ামের প্রধান কার্যালয়ে অভিযোগ করেন যে, বিপুল পরিমাণ জেবিও পাটকলের নামে বরাদ্দ নিয়ে মূলত তা সয়াবিন মিল মালিকদের কাছে সরবরাহ করা হয়েছে। ওই অভিযোগের ভিত্তিতে জেলা প্রশাসক ও মেঘনা পেট্রোলিয়াম কর্তৃপক্ষ পৃথক দু’টি তদন্ত কমিটি গঠন করে। মেঘনা পেট্রোলিয়াম তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ না করলেও তৎক্ষণিকভাবে সহকারী জেনারেল ম্যানেজার আখতার কামাল চৌধুরীকে খুলনার প্রধান পদ থেকে প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়।

অপরদিকে, খুলনা জেলা প্রশাসকের গঠিত তদন্ত টিম তদন্ত করে দেখতে পায় যে, উল্লিখিত পাটকলগুলোর নামে বরাদ্দ করা জেবিও কোনো পাটকলে যায়নি। জেবিও বহনকারী ট্যাঙ্কারগুলো দৌলদিয়া ফেরি পার হয়ে আরিচা হয়ে ঢাকায় চলে গেছে।

খুলনার সদ্য বিদায়ী জেলা প্রশাসক আনিস মাহমুদ এ অনিয়ম প্রসঙ্গে দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘সংশ্লিষ্ট দোষী কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য তদন্ত রিপোর্ট মেঘনার প্রধান কার্যালয়ে পাঠানো হয়েছে।’ তিনি স্বীকার করেন, ওই জেবিও প্রকৃত পাটকলের জন্য ব্যবহৃত হয়নি। তিনি মেঘনা পেট্রোলিয়ামের খুলনাস্থ ডিপোর অনিয়মের কথাও স্বীকার করেন।

জেবিও ও সয়াবিন পাশাপাশি রাখলে কেউ বুঝতে পারবে না যে কোনটি জেবিও আর কোনটি সয়াবিন তেল। জেবিও’র কোনো রঙ ও স্বাদ না থাকায় এটি যে কোনো তেলের সঙ্গে মিশিয়ে ব্যবহার করা যায়। সয়াবিনসহ লুব অয়েল বা অকটেনের মতো অপেক্ষাকৃত দামী তেলের সঙ্গে মিশিয়েও এটি ব্যবহার করা যায়।

খুলনা বিভাগীয় জ্বালানী তেল পরিবেশক সমিতির সাধারণ সম্পাদক শেখ হাফিজুর রহমান দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘জেবিও সর্বত্র পাওয়ার কথা না। তবে খালিশপুরের ডিপোর পাশে যেকোনো ডিলারের কাছে জেবিও পাওয়া যায়। কৌশলে যে কেউ জেবিও ডিপো থেকে এ তেল উত্তোলন করতে পারেন। যেকোনো পাটকলের প্যাডে খুলনার তিনটি ডিপোর প্রধানের কাছে আবেদন এবং এর মূল্যবাবদ ব্যাংকের পে-অর্ডার দিলেই হবে।’

তিনি অভিযোগ করেন, ‘কোন পাটকল মাসে কত টন জেবিও পাবে এর কোনো নীতিমালা নেই। অসাধু কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগসাজশে অসাধু ব্যবসায়ীরা জেবিও উত্তোলন করে সয়াবিন তেলের সঙ্গে মিশিয়ে বাজারে বিক্রি করছে।’

শেখ হাফিজুর রহমান উদাহরণ দিয়ে বলেন, ‘দুই ট্যাঙ্কারের (১৮ হাজার লিটার) সয়াবিনের সঙ্গে দুই ট্যাঙ্কার জেবিও মেশালে প্রায় সাত লাখ টাকার অধিক মুনাফা করা সম্ভব। অতিরিক্ত মুনাফার জন্য বড় একটি চক্র এ অবৈধ কাজে জড়িত।’

মানবদেহে জেবিও’র ক্ষতিকর দিক প্রসঙ্গে খুলনা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের গ্যাস্ট্রোএন্ট্রোলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. মো. আব্দুল আহাদ বলেন, ‘এ দেশে বিষয়টি নিয়ে কোনো গবেষণা নেই। তবে সুইডেনে ইঁদুরের ওপর জেবিও প্রয়োগের গবেষণায় দেখা গেছে, এক মাসের মধ্যে ওই ইঁদুরের দেহে ক্যান্সারসহ চর্মরোগের লক্ষণ দেখা গেছে। সেই হিসেবে মানবদেহে জেবিও প্রবেশ করলে পেটের পীড়াসহ নানা ধরনের রোগবালাই, এমনকি ক্যান্সারও দেখা দিতে পারে।’ তিনি বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে গবেষণার দরকার আছে।’

সরেজমিন খালিশপুরের দৌলতপুর পাইকারী ডিলারদের কাছে জেবিও কিনতে চাওয়া হলে তারা যেকোনো পরিমাণ জেবিও সরবরাহ করতে পারেন বলে জানান। তারা জানান, জেবিও কাঠের পোকা মারার কাজেও ব্যবহার করা হয়।

বাংলাদেশ জুট মিলস কর্পোরেশন (বিজেএমসি) খুলনা জোন সূত্রে জানা গেছে, পাটকলগুলোতে পণ্য উৎপাদনের বিভিন্ন মৌলিক উপাদানের একটি জেবিও। পাট নরম করতে এটি ব্যবহার করা হয়। তবে দেশের পাটকলগুলোতে বছরে কি পরিমাণ জেবিও ব্যবহৃত হয় এর কোনো হিসাব নেই সংস্থাটির কাছে।

বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি) সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশের একমাত্র রাষ্ট্রীয় তেল শোধনাগার ইস্টার্ন রিফাইনারিতে অপরিশোধিত জ্বালানী তেল পরিশোধন করে উপজাত হিসেবে পাওয়া যায় জেবিও। দেশে বছরে গড়ে ২৪-২৫ হাজার টন জেবিও উৎপাদিত হয়। জেবিও’র রঙ অনেকটা সয়াবিন তেলের মতো। দামও সস্তা। এ কারণে অসাধু ব্যবসায়ীরা পাটকলের নামে জেবিও কিনে সয়াবিন তেলের সঙ্গে মিশিয়ে বাজারজাত করছে।

জানা গেছে, জেবিও’র অপব্যবহার রোধে ২০১২ সালের ১০ জুলাই একটি সরবরাহ নীতিমালা করেছিল বিপিসি। এতে পাটকলগুলোতে তেল বিক্রিতে কড়াকড়ি আরোপের জন্য ১৫টি শর্ত আরোপ করা হয়। নীতিমালায় বলা হয়েছিল, দেশের বিভিন্ন পাটকলে জেবিও সরবরাহের ক্ষেত্রে বিপণন কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের অনুমোদনক্রমে একটি কমিটি গঠনসহ সব বিভাগীয়/আঞ্চলিক কার্যালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে তদারকি দল (ভিজিল্যান্স টিম) গঠন করতে হবে। বিভিন্ন পাটকলে সরবরাহ করা জেবিও সঠিক ব্যবহার হচ্ছে কিনা—সেটি বিপণন কোম্পানি ও ভিজিল্যান্স টিমের মাধ্যমে যাচাই করা হবে। কিন্তু বাস্তবে ওই নীতিমালা কোথাও মানা হচ্ছে না।

বিপিসির হিসাব মতে, ২০০৯-১০ অর্থবছরে দেশে জেবিও বিক্রির পরিমাণ ছিল ১৯ হাজার ১৬৫ টন। যা ২০১৩-১৪ অর্থবছরে দাঁড়ায় প্রায় ত্রিশ হাজার টনে। অথচ বাংলাদেশ জুট এ্যাসোসিয়েশন সূত্রে জানা গেছে, ২০০৯-১০ অর্থবছরে যে পরিমাণ পাটজাত দ্রব্য রফতানি হয়েছে, গত অর্থবছরে সেই রফতানি কমে প্রায় অর্ধেকের কাছাকাছি চলে এসেছে। অথচ জেবিও’র ব্যবহারের পরিমাণ বেড়েছে।

জেবিও’র অপব্যবহার রোধে জ্বালানী ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের কাছে ২০১৪ সালের ২ অক্টোবর বিপিসির চেয়ারম্যান মো. ইউনুসুর রহমান স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে জেবিও’র বর্তমান মূল্য লিটারপ্রতি ৬৭.৭০ টাকা থেকে ৪২ টাকা ৩০ পয়সা বাড়িয়ে ১১০ টাকা করার প্রস্তাব করা হয়। অভিযোগ রয়েছে, ভেজাল সিন্ডিকেটের বিরোধিতার কারণে ওই প্রস্তাব ধামাচাপা দেওয়া হয়েছে।

 


শেয়ার করুন