বড়লোকের বিচারটা করবে কে?

বাংলামেইল:

‘সরকারের আইন মানা যেমন জনগণের জন্য ফরজ, আর প্রভাবশালীদের নির্দেশ মানাও গরিবের জন্য ফরজ! যেখানে সোহাগী জাহান তনু, দেশের আলোচিত সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি, এসপি বাবুল আক্তারের স্ত্রীসহ অনেক খুনের ঘটনার মূলহোতারা ধরা-ছোঁয়ার বাইরে সেখানে তো গৃহকর্মী জনিয়া (১৫) একজন রিকশাচালকের মেয়ে মাত্র। আমার মতো একজন রিকশাচালকের পক্ষে মেয়ে হত্যার বিচার পাবো, এটা আশা করা বোকামি ছাড়া আর কিছুই নয়।’ কান্নাজড়িত কণ্ঠে কথাগুলো বলছিলেন গৃহকর্মী জনিয়ার বাবা ওসমান গনি।

ওসমান গনি জানান, মিরপুর-১৩ নম্বর কাফরুল থানার ন্যাম গার্ডেনের ৩ নম্বর ভবনের ৪০৩ বি-ফ্লাটে গৃহকর্মী হিসেবে মায়ের পরিবর্তে কাজ করতো জনিয়া। গত ৬ মার্চ সকালে ওই বাসায় কাজে যায় সে। সকাল সাড়ে ৯টায় ফ্ল্যাটের সামনে তার লাশ পাওয়া যায়।

তিনি জানান, চার মাসের বেশি হলেও পুলিশ তার মৃত্যুর প্রকৃত কোনো কারণ উদ্ঘাটন করতে পারেনি। পুলিশ শুধু একটি ইউডি মামলা করেছে। পরে ঢাকা মহানগর আদালতে একটি মামলা করেন তিনি। এ বিষয়ে ওসমান বলেন, ‘আমি জানি না প্রকৃত বিচার পাব কি না? তারপরও আমি আশায় বুক বেঁধে আছি, জনিয়ার মৃত্যুর সুষ্ঠু বিচার পাবো বলে।’

ওসমান গনির কথার সঙ্গে সুর মিলিয়ে ন্যাম ভবনের পার্শ্ববর্তী মজিবুর রহমান নামের এক বাসিন্দা বলেন, ‘শুনেছি অতিসম্প্রতি গৃহশ্রমিক সুরক্ষা আইন পাস হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে নেই। আইনের সঠিক প্রয়োগ হলে, এতো গৃহশ্রমিক নির্যাতন ও মৃত্যুর মতো ঘটনা ঘটতো না। আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে অপরাধীরা পার পেয়ে যাচ্ছে। যার ফলে গৃহশ্রমিক খুন ও ধর্ষণের মতো ঘটনা দিনের পর দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।’

তিনি বলেন, ‘সরকার যদি আইন করে, জনগণ সেই আইন মানতে বাধ্য। তাছাড়া আইন হয়েছে, তার কোনো প্রচার প্রচারণা নেই, সচেতনতাও নেই। যার ফলে গৃহশ্রমিক খুনের মতো ঘটনার প্রকৃত বিচার হচ্ছে না।’

কে এই জনিয়া : 
জনিয়ার মা ফুলবানু গৃহকর্মীর কাজ করেন, বাবা ওসমান গনি রিকশাচালক। তাদের গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জের ইটনায়। পাঁচ বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে জনিয়া ছিল দ্বিতীয়। ঘটনার (৬ মার্চ) দিন জনিয়া তার মায়ের পরিবর্তে ওই ফ্ল্যাটে কাজ করতে যায়। ফ্ল্যাটটিতে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের পরিচালক আহসান হাবিব তার পরিবার নিয়ে বসবাস করেন। ওই ফ্ল্যাটে বছর খানেক ধরে জনিয়ার মা কাজ করে আসছিলেন। হঠাৎ করে মা অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাই জনিয়া মা’র অনুপস্থিতিতে ঘটনার দিন থেকে সপ্তাহখানেক ধরে সেখানে কাজ করছিল।

ওইদিনের ঘটনা : 
ঘটনার দিন যথারীতি সকালে জনিয়া কাজ করতে যায়। কিন্তু সকাল সাড়ে ৯টায় কয়েকজন ড্রাইভার ফ্ল্যাটের সামনে তার লাশ দেখতে পায়। সকাল ১০টায় কাফরুল থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে এসে লাশের সুরতহাল করে ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজে পাঠায় এবং জনিয়ার পরিবারকে খবর দেয়া হয়। ময়নাতদন্ত শেষে জনিয়ার মৃতদেহ ঘটনার একদিন পর ৭ মার্চ দুপুর ১২টায় বাবা ওসমান গনির কাছে হস্তান্তর করে পুলিশ।

স্থানীয়দের বক্তব্য : 
স্থানীয় বাসিন্দা মো. রমজান মিয়া জানান, ঘটনার পর দিন থেকে কোনো মিডিয়া কর্মীদের ঢুকতে দেয়া হয়নি ওই বাড়িতে। ভবননে ভিতরে ও বাইরে পুলিশ মোতায়েন ছিল। জনিয়ার মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে মিরপুরের ইব্রাহীবপুর এলাকাবাসী সুষ্ঠু বিচারে দাবিতে বিক্ষোভও করে।

অপর এক বাসিন্দা আশরাফ আলী বলেন, ‘খবর শুনেই আমরা ঘটনাস্থলে যাই এবং দেখি জনিয়া মাটিতে পড়ে আছে। মুখ কাপড় দিয়ে বাঁধা, হাত কুনইয়ের কাছে ভাঙা, মুখ রক্তে ভরা। দেখে মনে হলো কেউ উপর থেকে ফেলে দিয়ে মেরে ফেলেছে।’

তিনি বলেন, ‘জনিয়া দেখতে সুন্দর ছিল। আগেও কয়েকদিন ওই বাসায় আসতে দেখেছি।’

জনিয়ার মায়ের বক্তব্য : 
গত ২৮, ২৯ ও ৩০ জুন পরপর তিনদিন ঘুরে শেষদিনে জনিয়ার মা ফুলবানু’র সাক্ষাত পাওয়া যায়। তিনি বলেন, ‘প্রায় চার মাস হয়ে গেছে, কোনো সুরাহ করতে পারে নাই পুলিশ। কোনো আসামিও গ্রেপ্তার করতে পারে নাই। এ পর্যন্ত আমাদের কেউ দেখার নাই, কী বলবো আর। সবাই খালি কয় দেখতেছি দেখতেছি, এখন আল্লাহ জানে আর তারা জানে, কী দেখতেছে। আমি আমার মেয়ের হত্যার সঠিক বিচার চাই।’ কথাগুলো বলেই কেঁদে ফেলেন তিনি। আর কিছু বলতে চান না।

পুলিশের বক্তব্য : 
কাফরুল থানার তদন্ত কর্মকর্তা কামরুলজ্জামান। তিনি বলেন, ‘ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন পাওয়া গেছে। সেখানে জনিয়াকে খুন করার কোনো আলামত নেই। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- জনিয়া আত্মহত্যা করেছে। সে কারণেই গৃহকর্তাকে শুধু শুধু হয়রানি করার কোনো যুক্তি নেই।’

মামলা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘মেয়ের বাবা বাদি হয়ে মো. আহসান হাবীব, মো. রুম্মান বিন আহসান, মোছা. নাজনীন আক্তারসহ অজ্ঞান আরো ৩/৪ জনকে আসামি করে ৩০২/৩৪/৫০৬ ধারায় (হত্যা ও হত্যার সহযোগিতা ও ভয়-ভীতির অপরাধে) ঢাকা মহানগর আদালতে মামলা দায়ের করেছেন। মামলা নং-২৭/১৩৬।’

পুলিশ কর্তার এই বক্তব্যের বিরোধিতা করে স্থানীয় বাসিন্দা মো. জব্বার মিয়া বলেন, ‘মেয়েটি যদি আত্মহত্যা করে, তাহলে তার মুখ কাপড় দিয়ে বাঁধা থাকবে কেন? হাত কনুইয়ের কাছে ভাঙা, মুখ রক্তে ভরা। দেখে মনে হলো কেউ উপর থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘মেয়েটি দেখতে খুব সুন্দর ছিল। তাকে পরিকল্পিতভাবে খুন করা হয়েছে।’

এদিকে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনের আগেও জনিয়ার লাশের সুরতহাল রিপোর্ট তৈরির সময় তদন্ত কর্মকর্তা বলেছিলেন, ‘আমরা ধারণা করছি মেয়েটিকে কেউ ছাদ থেকে ফেলে দিয়েছে। মেয়েটির স্যান্ডেল ছাদে পাওয়া গেছে। মেয়েটির ডানহাত থেঁতলানো ও রক্তাক্ত ছিল। পায়ের হাঁটুতে আঘাতের চিহ্ন, মুখ ছিল রক্তাক্ত ও ওড়না দিয়ে বাঁধা, নাক রক্তাক্ত ও বুকে আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে।’

জনিয়ার স্বজনের বক্তব্য : 
জনিয়ার খালা বলেন, মালিকের ছেলের স্বভাব চরিত্র ভালো ছিল না। গৃহকর্তার ছেলে রুম্মন বিন আহসানই জনিয়াকে ধর্ষণ করে ছাদ থেকে ফেলে দিয়ে আত্মহত্যা বলে চালাচ্ছে। সে সময় পুলিশকে বারবার বলার পরও পুলিশ কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। মামলাও নেয়নি। সব জেনেশুনে পুলিশ কিছুই করছে না বলেও অভিযোগ করেন তিনি।

জনিয়ার খালার সঙ্গে সুর মিলিয়ে মো. ইমরুল নামের এক স্থানীয় বাসিন্দা বলেন, ‘মেয়েটাকে ধর্ষণ করে হাত-মুখ বেঁধে ছাদ থেকে নীচে ফেলে দিয়েছে। পুলিশ ঘটনার সবকিছুই জানে কিন্তু বড় লোকের ছেলে বলে তারা কিছুই করছে না। উপরে আল্লাহ্ আছে। তার চোখ কানা নয়, তিনি ঠিকই বিচার করবেন। পুলিশ শুধু একটি ইউডি মামলা করেছে।’

আইনজীবীর বক্তব্য : 
অ্যাডভোকেট আমিরুল ইসলাম বলেন, গৃহশ্রমিক আইন হয়েছে। আইনটি যথাযথ প্রয়োগ না থাকায় আজকে শুধু গৃহকর্মী নয়, নিরিহ সকল পেশার মানুষ সুষ্ঠু বিচার পাচ্ছে না। যার ফলে এ রকম ঘটনা প্রায়ই ঘটছে। আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে বেড়িয়ে যাচ্ছে মূল অপরাধীরা। গৃহশ্রমিকদের আইনগত সুরক্ষা প্রতিষ্ঠিত করতে প্রয়োজন রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক উদ্যোগ। সারাদেশে সকল পেশার মানুষকে জানাতে হবে। সবাই সচেতন হলেই গৃহশ্রমিক আইনটি সফলতার মুখ দেখবে।

আসামি আহসান হাবিবের বক্তব্য : 
জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের পরিচালক আহসান হাবিবের সঙ্গে যোগাযোগ করার পর তিনি মোবাইলে বলেন, ‘এখন আমার বক্তব্য নেয়ার কোনো যুক্তি নাই। যেহেতু কোর্টে মামলা হয়েছে। মামলায় যা হয়, দেখবেন।’ এর বাইরে তিনি কোনো কথা বলতে চান না।

শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় কর্মকর্তার বক্তব্য : 
শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম-সচিব মো. খন্দকার মোস্তান হুসাইন বলেছেন, ‘শিশুদের শ্রমে বা গৃহশ্রমে নিয়োগ করা যে একটা লজ্জার বিষয় সেটি আমরা যতোদিন অনুধাবন করতে না পারবো ততোদিন পর্যন্ত এ দেশে শিশুশ্রম নিরসন সম্ভব নয়।’


শেয়ার করুন