বেতন বাড়ে, দুর্নীতি কমে না

reza_up1-400x325সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা 

 সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। এক চ্যানেলে টক-শোতে আমাকে সরাসরি প্রশ্ন করা হলো এতে করে কি দুর্নীতি কমবে? এক কথায় বলেছি কমবে না।
সরকারি লোকজন বলছেন, মানুষের মৌলিক চাহিদা মেটানোর জন্য পর্যাপ্ত অর্থ পেলে, তার স্বাভাবিক চাওয়াগুলো পূরণ হলে দুর্নীতি কমে। নতুন পে-স্কেল সে ভূমিকা রাখতে পারে। তবে বাস্তবতা আর ইতিহাস বলে ভিন্ন কথা। দুর্নীতি কমাতে শুধু বেতনবৃদ্ধির যেটুকু ভূমিকা থাকে তার চেয়ে বেশি থাকতো দুর্নীতিবাজদের শাস্তির ব্যবস্থা করলে। কিন্তু এ সমাজেতো দুর্নীতিবাজদেরই জয়জয়কার। তারাই ক্ষমতাবান।
সরকারি-আধা সরকারি চাকরি পেতে (বিসিএস পরীক্ষা ছাড়া) যে পরিমাণ টাকা ঘুষ দিতে হয় সেটা তুলে আনার প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা থাকে এসব চাকরিজীবীর।
আর্থিক দুর্নীতির কথাই বেশি আলোচিত হয় সবসময়। আসলে দুর্নীতি শব্দটাই ধোঁয়াটে। কাকে দুর্নীতি বলবো? রাস্তায় দাঁড়িয়ে ট্রাফিক পুলিশ ট্রাক থেকে, গাড়ি থেকে, রিকশা থেকে যে টাকা নেয়, তা কি কোনও সভ্য সমাজে দেখা যাবে? আবার সরকারি পরিদপ্তরের ছোট বা মাঝারি মানের কর্মী বা কর্মকর্তারা কাজের বিনিময়ে (তা সে দরিদ্র স্কুল মাস্টারের পেনশনের টাকা পেতেও) যে টাকা ঘুষ নেয় তাও দুর্নীতি। কিন্তু বড় মন্ত্রী-আমলাদের দফতরে বন্ধ দরজার ভেতরে যেসব লেনদেন হয়, তাদের কারণে বিভিন্ন প্রকল্পে কোটি কোটি টাকা গচ্চা যায় রাষ্ট্রের, তাকে কি নামে আখ্যায়িত করা যায়? শুধু দুর্নীতি বললেতো একে কম বলা হবে।
মানুষ ঘুষ দিয়ে প্রথম যে কাজটি করে তা হলো আইন ভঙ্গ করা। সে ধরেই নেয় টাকা দিয়েছি, টাকা দিয়েছি, এখন আমি আমার সুবিধেমতো আইন ভাঙবো। দুর্নীতি মানেই শুধু টাকার নয়ছয় নয়। একজন সরকারি চাকুরে সময়মতো অফিস করেন না, দেরিতে আসেন আগে চলে যান, অকারণে কোনও সাধারণ নাগরিককে দিনের পর দিন ঘোরায়, সেটা কম দুর্নীতি নয়। পে-স্কেল বৃদ্ধি কি সেই সংস্কৃতির পরিবর্তন আনবে?
নব্বইয়ের দশকে যখন আমরা ট্রেড লিবারালাইজেশনে গেলাম, বাজার অর্থনীতিকে আলিঙ্গন করলাম, তখন একটা ধারণা হয়েছিল, এই মুক্তবাজার নীতি লাইসেন্স-পারমিট এর রাজত্ব শেষ করবে। সরকারি নিয়ন্ত্রণ কমবে, তাই দুর্নীতিও কমবে। কিন্তু তা হয়নি। বাজার অর্থনীতি যা করেছে তা হলো ব্যক্তিখাতের রাঘব বোয়ালদের সাথে রাজনীতিক আর আমলাদের এমন সম্পর্ক তৈরি করেছে যে, বাজারকেই তারা খেয়ে ফেলছে।
ব্যক্তিখাতের সব ব্যবসায়ী আবার এমন সুবিধা পাচ্ছেন তা নয়। সরকার যতই বলুক বিনিয়োগের জন্য নিয়মকানুনের ফিতা এখন আলগা করে দেওয়া হয়েছে, বাস্তবতা হলো একটা ছোটখাট ব্যবসা খুলতেও নানা দপ্তরে ঘুষ দিতে হয় এক একটি অনুমোদনের জন্য। তবে সব আমলা, সব কর্মচারী বা কর্মকর্তা ঘুষ খান, বা সব নেতাই দুর্নীতি করেন, এমনটা বলা যাচ্ছে না। কিন্তু একথা অবশ্যই বলা যায় যে এই সংস্কৃতিকে প্রবল প্রতাপে প্রতিষ্ঠিত করেছে ক্ষমতাবান চক্র।
সরকারি কাজে আর্থিক দুর্নীতির প্রচলিত ধারা না কমার বড় কারণ রাজনৈতিক অনাচার। দলীয় রাজনীতির রেষারেষি সেই অনাচারে অবিরত ইন্ধন যুগিয়ে যাচ্ছে। রাজনৈতিকভাবে এমন বিভাজিত প্রশাসন আর কোন দেশে আছে তা বের করা কঠিন।
নজরদারি এবং কঠিন শাস্তি দিলে দুর্নীতি কমবে। কিন্তু যিনি এই দায়িত্ব পালন করবেন তিনি যখন এপথে হাঁটবেন তাকে থামাবে কে? প্রশাসনিক ব্যবস্থায় এমন পরিবর্তন আনতে হবে, যাতে ঘুষ খাওয়ার সুযোগটাই কমে যায়। সিঙ্গাপুর ষাটের দশকে অত্যন্ত দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ ছিল। প্রশাসনিক ব্যবস্থায় সংস্কার আনায় দুর্নীতি কমেছে। দেশটির শুল্ক বিভাগ খুব ঘুষখোর ছিল বলে কয়েক বছরের জন্য গোটা দফতরের কাজটাই ‘আউটসোর্স’ করে দেওয়া হয় একটি সুইস সংস্থাকে। পরে তা আবার ফিরে আসে শুল্ক বিভাগের কাছেই। কোনও বিভাগ বা কর্মকর্তার ডিসক্রিশনারি ক্ষমতা দুর্নীতির বিস্তারে বড় ভূমিকা রাখে। তাই সরকারি সেবা-পরিষেবায় কোনও একটি সংস্থার একক আধিপত্য বন্ধ করা দরকার, তাতে দুর্নীতির সুযোগ কমে।
তাই মাইনেও যেমন বাড়াতে হয়, যাতে ঘুষ খাওয়ার প্রয়োজন কমে। সেইসঙ্গে কর্মীদের ওপর কঠিন নজরদারি, এবং শাস্তির ব্যবস্থাও চালু হয়। কিন্তু তার চেয়ে বেশি দরকার হয়ে পড়ে প্রশাসনিক সংস্কার। আর এই সংস্কারের আরেকটি দিক হলো প্রযুক্তির ব্যবহার। বর্তমান সরকারি জনসেবার অনেক কাজ অনলাইনে করার সুযোগ হয়েছে। মানুষকে সরকারি কর্মীদের কাছে যেতে হচ্ছে না। ফলে ঘুষ খাওয়ার সুযোগ কমেছে। জমির দলিল, পাসপোর্ট-এর মতো নানা নথি পাওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে। হতে হবে আরও অনেক কিছু।
সরকারি কর্মীদের বদলি এবং পদোন্নতির নীতিতেও পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। সাফল্য ব্যর্থতার ভিত্তিতে বদলি, পদোন্নতির সিস্টেম চালু না করলে দুষ্টচক্র তার আসন পাকা করে নেয়। সৎ ও সাহসী সরকারি অফিসাররা কোণঠাসা হয়ে পড়েন।
তবে সব কথার উপরে হলে রাজনৈতিক অঙ্গীকার। দুর্নীতিগ্রস্তদের প্রতি যথাসময়ে কঠোর ব্যবস্থা নিতে সরকারকেই ব্যর্থই হতে দেখি বেশি। আর ব্যর্থতার মাঝে মানুষ খুঁজে পায় দুর্নীতির প্রতি প্রশ্রয়। যে দেশে এমন ধারণা পাকাপোক্ত হয় যে, দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে ভাল থাকা যায়, ধরা পড়ার ঝুঁকি কম, ধরা পড়লেও কিছু হয় না, সেদেশে এই রোগের চিকিৎসা সহজ নয়। দুর্নীতির সম্ভাব্য শাস্তির ‘খরচ’ যদি প্রত্যাশিত ‘আয়’-এর চেয়ে বেশি হয়, তবেই দুর্নীতি নিবারণের একটা সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু এ দেশে প্রত্যাশিত আয় বিপুল। সম্ভাব্য খরচ নেই বললেই চলে। ফৌজদারি অপরাধের বিচার ব্যবস্থায় ত্রুটির কারণে সাধারণভাবে দুর্নীতির মাত্রা আর কমে না। বাংলাট্রিবিউন
লেখক: পরিচালক বার্তা, একাত্তর টেলিভিশন


শেয়ার করুন