বিশ্বের সবচেয়ে বড় নারী সম্মেলনে স্বর্ণকিশোরী আনিকা

copen hegen conference venueমো. মনির হোসেন :

শাহ্জিয়া শাহ্রিন আনিকা। চ্যানেল আই বর্ষ সেরা স্বর্ণকিশোরী। ছোট বেলা থেকেই উপস্থিত বক্তৃতা, বিতর্ক, প্রকৃতি, পরিবেশ ও মানবিক উদ্যোগে ছিল সদা সরব। ২০১৫ সাল। চ্যানেল আইয়ের মাতৃস্বাস্থ্য, কিশোরী স্বাস্থ্য ও বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ ক্যাম্পেইন ভিত্তিক প্রোগ্রাম স্বর্ণকিশোরীর জেলা পর্যায়ের শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট অলংকৃত করে। তার স্বীয় দক্ষতা, অভিজ্ঞতা ও কর্মতৎপরতা দিয়ে অর্জন করে বর্ষসেরা স্বর্ণকিশোরীর খেতাব। সারা দেশের ৬৪ জেলা থেকে আগত জেলা সেরা ৬৪ জন স্বর্ণকিশোরীর মধ্যে প্রথম স্থান অর্জন করে নেয়। পুরুস্কার হিসেবে পেয়েছেন মেডেল, শিক্ষা বৃত্তি ও বিদেশ সফর। গত বছরের ২৩ নভেম্বর চূড়ান্ত পর্ব অনুষ্ঠিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ভবনে। উক্ত অনুষ্ঠানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক তাকে মেডেল পড়িয়ে দেন। আনিকার মা সংগঠক ও শিক্ষক মাহ্বুবা সুলতানা। তিনি গাজীপুরের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, পরিবেশবাদী ও সেবামূলক বিভিন্ন সংগঠনের সাথে জড়িত। তিনি বলেন, ‘আমি চেয়েছি মেয়েকে সামাজিক সচেতনতাবোধ ও মানবিকবোধ শিক্ষা দিতে। সকল বাবা-মায়ের চাওয়া তার সন্তান যেন মানুষের মত মানুষ হয়। আর আমি চেয়েছি আমার সন্তান শুধু মানুষ নয়, হবে দেশের সম্পদ। নিজের যোগ্যতা বলে নিজের অবস্থান তৈরী করবে এই সমাজের, এই দেশের কোথাও না কোথাও। চিন্তায়-চেতনায় সৎ থেকে দাঁড়াবে মানুষের পাশে। একজন মা হয়ে এই স্বপ্নগুলোকে লালন করি প্রতিনিয়ত। প্রায় প্রতিটি ক্লাসে সরকারি বেসরকারি বৃত্তি নিয়ে ছোটবেলায় থেকেই সে তার মেধার পরিচয় দিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। এ বছর মাধ্যমিক পরীক্ষায় বিজ্ঞান বিভাগ থেকে জিপিএ-৫পেয়ে রেখেছে কৃতিত্বের স্বাক্ষর। জাতীয় দিবসগুলোতে বিতর্ক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ, জেলা শিশু দিবসে জেলা প্রশাসক আয়োজিত অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করা, আরও নানান কার্যক্রমে নিজেকে নিজের মধ্যেই প্রতিযোগী করে তৈরি করছিল। আমার সেই ছোট্ট মেয়েটি আজ কিশোরী। নির্বাচিত হয়েছে জাতীয় পর্যায়ে স্বর্ণ-কিশোরী হিসেবে। অংশগ্রহণ করেছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় নারী সম্মেলন কেন্দ্রে।’

Denmark

সম্প্রতি আনিকা ঘুরে এসেছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় নারী সম্মেলন থেকে। যেটি ডেনমার্কের কোপেন হেগেনে অনুষ্ঠিত হয়েছে। বিশ্বের ১৬৯টি দেশ থেকে ছয় সহ¯্রাধিকেরও অধিক মানুষের সমাগম হয়েছিল এ সম্মেলনে। স্বর্ণকিশোরী নেটওয়ার্কের ৮ জন সদস্যের একটি দল গিয়েছিল সুদূর ডেনমার্কে নিজের দেশের প্রতিনিধিত্ব করতে। আনিকা গাজীপুর জেলা সেরা ও ২০১৫ সালে বাংলাদেশের বর্ষসেরা স্বর্ণকিশোরী। বর্ষসেরা হওয়ার পুরস্কারস্বরূপ এই ইউরোপ ট্যুর আনিকার পুরুস্কার স্বরুপ ছিল। আনিকার সাথে ছিল আরো ৩ জন স্বর্ণকিশোরী, ২০১৪ সালের বর্ষসেরা মনামী, প্রিফেক্ট ঐশী এবং ২০১৫ সালের প্রিফেক্ট নোশিন। স্বর্ণকিশোরী নেটওয়ার্ক ফাউন্ডেশনের পরিচালক মো. রফিকুল ইসলাম, ইফতেখারুল চিশতী এবং অপু মাহফুজকে নিয়ে ছিল চ্যানেল আইয়ের বিশেষজ্ঞ টিম। পুরো দলটিকে নেতৃত্ব দিয়েছেন নেটওয়ার্কের প্রধান নির্বাহী ফারজানা ব্রাউনিয়া।

final round DU1223

এ সম্পর্কে অনিকা বলেন, ‘জীবনের প্রথম বিদেশ ভ্রমণ। তাও আবার ইউরোপ। উত্তেজনার পারদ যে কতখানি উঁচু ছিল তা বলে বোঝানো সম্ভব নয়। কিছু ভয়, কিছু উত্তেজনা, কিছু আনন্দ সব মিলিয়ে মিশ্র এক অনুভূতি কাজ করছিল। প্লেন টেক অফের সময় প্রথমবার কেন জানি না একটু কষ্ট হলো। পরে বুঝতে পারলাম দেশের মাটি ছেড়ে, নিজের মাকে ছেড়ে দূরে চলে যাওয়ার অনুভূতি ছিল সেটা। পুরো ভ্রমণের মধ্যে টেক অফের সময়টুকুই সবচেয়ে আকর্ষণীয়। এরপর ঘন্টার পর ঘন্টা একই দৃশ্য। জানালা দিয়ে বাইরে তাকালে দেখা যায় উপরে আকাশ, নিচে মেঘ। মনে হচ্ছিল মস্ত বড় এক পাখির পেটের ভিতর বসে আছি। কোপেনহেগেন এয়ারপোর্টে নামতেই বিশাল বড় এক বিলবোর্ড লেখা ছিল ‘হোয়েন দ্যা ওর্য়াল্ড ইনভেস্টস ইন গার্লস এ্যান্ড উইমেন এভরিডেস উইনস (When the world invests in girls’ and women everyday wins)’ রাস্তায় নেমে আরো বেশি অবাক হলাম। আশেপাশে বিভিন্ন জায়গায় এ ধরনের বিলবোর্ড উইমেন ডেলিভার কনফারেন্স-২০১৬ 2016 (Women deliver conference-2016) এর প্রতিপাদ্য এটি। পুরো শহর যেন নারীদের জন্য বিশ্বের সবচেয়ে বড় এই সম্মেলনের আয়োজন করতে মুখিয়ে আছে। কনকনে ঠান্ডা বাতাসের মধ্য দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মনে হচ্ছিল এই তাহলে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী দেশ। কথা হয়েছে ভারতের নোবেল জয়ী অর্থনীতিবিদ কৈলাস সত্যার্থীর সঙ্গে। তিনি বলেছিলেন, সারাবিশ্ব তোমাদের থেকে শিখতে পারে।’ খুবই অবাক হয়েছি যখন আমাদের কার্যক্রমের বিবরণ শুনে বিভিন্ন দেশ থেকে আসা প্রায় সব দর্শনার্থী এই একই কথা বলেছেন।’

আনিকা আরো জানায়, সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো ১৬৯টি দেশ থেকে আসা প্রতিনিধিদলের মধ্যে বাংলাদেশের দলটিই সবচেয়ে বড়। সরকারি, বেসরকারি সংস্থা ও স্বর্ণকিশোরী মিলে প্রায় অর্ধশতাধিক। এ দলে যাদেরকে দেখে আমারা আরো বেশি অণুপ্রাণিত হয়েছি তারা হলেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ও সংসদ সদস্য এম এ মান্নান, সংসদ সদস্য অধ্যাপক ডা. হাবিবে মিল্লাত, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম। সেখানে পতাকা নিয়ে এতজন বাঙালিকে এক সাথে দেখে মনে হচ্ছিল এক টুকরো বাংলাদেশ যেন জায়গা করে নিয়েছে ডেনমার্কের বুকে। সেদিন ৬ হাজার মানুষের ১২ হাজার চোখ অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল একদল স্বপ্নবাজ মানুষের দিকে। যাদের স্বপ্ন বাংলার প্রতিটি মেয়ের নিরাপদ মাতৃত্ব এবং সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করা। একদিন শুধু ডেনমার্ক নয়, গোটা বিশ্ব তাকিয়ে থাকবে সুস্বাস্থ্যে বলিষ্ঠ বাংলাদেশের দিকে এই আকাক্সক্ষাই এখন আমাদের চিন্তা চেতনায়। যখনই সময় পেয়েছি, ঘুরে দেখেছি ওমেন ডেলিভারের প্রতিটি স্টল। নারীর ক্ষমতায়ন, নারীর অধিকার, নিরাপদ মাতৃত্ব কিশোরীর স্বাস্থ্য, শিক্ষা এসব নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন সংগঠন এসেছিল তাদের দৃষ্টিভঙ্গি সবার সামনে তুলে ধরতে। মূল উদ্দেশ্য পরিষ্কার নিরাপদ মাতৃত্ব। বোধ করি এ কারণেই এ কনফারেন্সের নাম ওমেন ডেলিভার।
আনিকা ৬ষ্ঠ শ্রেণী থেকে মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়াশোনা করেছে গাজীপুরের জয়দেবপুর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে। বিদ্যালয়ে শিক্ষকবৃন্দ ও সহপাঠীরা আনিকাকে নিয়ে গর্ববোধ করে। প্রধান শিক্ষক হাবিবুর রহমান বলেন, ‘আনিকা লেখাপড়ার পাশাপাশি সামাজিক সচেতনতা কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করে ও বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হয়ে আমাদের জন্য, বিদ্যালয়ের জন্য সম্মান বয়ে এনেছে। তাই তাকে নিয়ে আমরা গর্ববোধ করি।
আনিকার মা মাহ্বুবা সুলতানা আরো বলেন, খুবই সাধারণ একজন মা আমি। আর আমার একমাত্র সন্তান আমার মেয়ে কতইনা অসাধারণ। এই এক জীবনে এই পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী একজন মা আমি। যে রতœ আছে আমার ছোট্ট ঘরে সৃষ্টিকর্তার কাছে কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। এই জীবনে কত চড়াই উতরাই, কত সুখ-দুঃখ, কষ্ট, হাসি-কান্না। কত কত পরিচয়, বন্ধুত্ব, শুভাকাক্সক্ষী। অথচ কেউ এই একজনের চেয়ে প্রিয় নয়। ¯েœহ-মায়া-মমতা আর দায়িত্ববোধ নিয়ে অবিচ্ছেদ্য এক সম্পর্ক আমার আর আমার মেয়ের মধ্যে।
আনিকা খুবই কমিটেড। তিনি বলিষ্ঠ কণ্ঠে বলেন, ‘অনেক অভিজ্ঞতা, আনন্দ, জ্ঞান, দায়িত্ব, কর্তব্য এবং স্মৃতি নিয়ে ফিরে এলাম প্রিয় দেশে। যা কিছু অর্জন করেছি, ছড়িয়ে দেবো ভবিষ্যৎ মায়েদের মাঝে। আমরা ইয়ূথ লিডাররা নেতৃত্ব দেবো জাতিকে মাতৃমৃত্যুমুক্ত করার মহাসংগ্রামে।’


শেয়ার করুন