বিশ্বের প্রতিটি দেশকে আত্মনির্ভর হতে হবে!

বিশ্বের প্রতিটি দেশকে কি এখন আত্মনির্ভর হতে হবে – ছবি : সংগৃহীত

ডেস্ক নিউজঃ

কোনো দেশ যদি তার সব প্রয়োজন নিজের সীমান্তের ভেতরেই উৎপাদন করতে পারে, কিছুই যদি বাইরে থেকে আমদানি না করতে হয়, সেটা কি ভালো হবে? ওই দেশটি কি তখন আরো নিরাপদ হবে? সমৃদ্ধ হবে?

এ ধরনের আশা বর্তমানে প্রায় অসম্ভব মনে হয়।

কিন্তু সাম্প্রতিক কয়েক বছরে বিশ্বের অত্যন্ত ক্ষমতাধর কিছু রাজনৈতিক নেতা এ ধরনের শতভাগ আত্মনির্ভরতার ইচ্ছা জোরেশোরে বলতে শুরু করেছেন।

আমাদের শিল্পোৎপাদনের ভবিষ্যৎ, আমাদের অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ জলবায়ু সঙ্কটের নিরসন সবকিছুই হবে ‘মেড ইন আমেরিকা’ অর্থাৎ ‘আমেরিকার ভেতরে তৈরি,’ এ বছরের শুরুর দিকে সদর্পে ঘোষণা দেন প্রেসিডেন্ট বাইডেন।

একইভাবে, বেশ অনেক দিন ধরেই চীনের বর্তমান নেতা শি জিনপিংয়ের মূলমন্ত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে ‘জিলি জেংসেং’ ইংরেজিতে যার অর্থ স্বনির্ভরতা।

‘আত্মনির্ভর ভারত’ এখন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীরও প্রধান একটি স্লোগান।

ইউরোপেও এখন এ ধরনের কথা শোনা যাচ্ছে। বিভিন্ন দেশ অতি প্রয়োজনীয় সব পণ্য আমদানি না করে দেশের ভেতর উৎপাদনের কথা বলতে শুরু করেছে।

ইউক্রেন যুদ্ধের জেরে ইউরোপীয় ইউনিয়ন জোট রাশিয়ার গ্যাসের ওপর নির্ভরতা শেষ করার পথ নিয়েছে। অবশ্য তার ফলে, ইউরোপ জুড়ে জ্বালানির দাম ধাঁই ধাঁই করে বেড়ে গেছে। পরিস্থিতি এতটাই নাজুক হয়ে পড়েছে যে বহুদিন পর ইউরোপের দেশগুলো এই শীতে লোডশেডিংয়ের আশঙ্কা উড়িয়ে দিচ্ছে না।

ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক ব্রিটেনকে ‘জ্বালানি স্বনির্ভর’ করার অঙ্গীকার করেছেন। ব্রিটেনের ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ পার্টি এবং বিরোধী লেবার পার্টি উভয়েই ‘জ্বালানিতে স্বাধীন’ হওয়ার কথা বলছে।

ইউক্রেন গম এবং অন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ খাদ্যশস্যের প্রধান একটি উৎপাদনকারী দেশ। ফলে সেদেশে রুশ হামলার পরপর সারা পৃথিবীতেই খাদ্যের দাম বেড়ে গেছে।

পরিণতিতে, বহু দেশ এখন নিজেদের প্রশ্ন করতে শুরু করেছে খাদ্য আমদানির ওপর ভরসা করে কি টেকা সম্ভব?

ব্রিটেনকে অনেক খাদ্য আমদানি করতে হয়। সেদেশের যেসব রাজনীতিক মুক্ত বাণিজ্যের কট্টর সমর্থক তারাও এখন দেশের ভেতর খাদ্য উৎপাদন বাড়ানোর তাগিদ দিচ্ছেন। গত ৪০ বছর ধরে যে মুক্ত বাণিজ্যকে সমৃদ্ধির মূলমন্ত্র হিসাবে অনুসরণ করা হয়েছে তা নিয়ে এখন তীব্র সন্দেহ তৈরি হবার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।

দেশে দেশে জোরদার হচ্ছে আত্মনির্ভরতার স্লোগান। প্রাচীন গ্রীসে এ ধরনের স্বনির্ভরতাকে বলা হতো ‘অটার্ক’। অনেক বিশ্লেষক এখন বলছেন, বিশ্বের রাজনীতি এবং অর্থনীতিতে সাম্প্রতিক কয়েক বছরের প্রবণতা থেকে মনে হচ্ছে বিশ্বের সব দেশ এখন কম-বেশি সেই অটার্কির পথে অগ্রসর হচ্ছে।

কিন্তু এ ধরনের স্বনির্ভরতার পথে গিয়ে কি প্রত্যাশিত নিরাপত্তা বাড়বে? সমৃদ্ধি বাড়বে?

জ্বালানির প্রসঙ্গে অধিকাংশ বিশেষজ্ঞ মনে করেন, এ লক্ষ্যে দেশের ভেতর সম্ভাব্য সবকিছু করা প্রয়োজন। এটা শুধু নির্ভরতা কমানো বা নিরাপত্তার বিষয় নয়, তারা বলছেন বিদেশ থেকে তেল-গ্যাস কয়লা এনে তা না পুড়িয়ে স্থানীয়ভাবে সোলার বা বাতাস থেকে বিকল্প জ্বালানি উৎপাদনের চেষ্টা বাড়িয়ে পরিবেশ রক্ষাও নিশ্চিত করা যাবে।

খাদ্যে আত্মনির্ভরতার ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ ব্রিটেনের সিটি ইউনিভার্সিটির শিক্ষক টিম ল্যাং বহুদিন ধরে বলছেন, বিদেশ থেকে খাবার আমদানি না করে দেশের ভেতরে উৎপাদন করলে জাতির স্বাস্থ্য এবং দেশের পরিবেশের জন্য অনেক মঙ্গল হবে।

টিম ল্যাং বলেন, এই অটার্কির ধারণা এবং খাদ্য নিরাপত্তা এখন দেশে দেশে জাতীয় নীতিনির্ধারণী প্রক্রিয়ায় এক নম্বর বিবেচ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার পেছনে আরেকটি বড় যুক্তি হলো, আবহাওয়া, যুদ্ধ বা দুর্ঘটনার কারণে আন্তর্জাতিক সরবরাহ চেইনে বিপত্তি দেখা দিলে দেশ রাতারাতি হুমকিতে পড়বে না। তবে ব্রিটেনের মতো ইউরোপীয় দেশগুলো যদি শুধুমাত্র দেশের ভেতর উৎপাদিত খাদ্য খাওয়ার পথ নেয় তাহলে খাদ্যাভ্যাসে বিশাল পরিবর্তন আনতে হবে।

কলা বা আনারসের মতো ফল আমদানি বন্ধ করা কি সম্ভব?
তাছাড়া, খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে গেলে বাড়তি জমির ব্যবস্থা করতে হবে। তার অর্থ, গোশত খাওয়া কমাতে হবে যাতে অনেক পশুচারণভূমিতে শস্য উৎপাদন করা যায়।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের নীতি-কৌশল বিভাগের পরিচালক সিরা পাজারবাসুগলু একমত যে জ্বালানি এবং খাদ্য সরবরাহে ঝুঁকি কমাতে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া উচিৎ।

কিন্তু সিরা পাজারবাসুগলুর মতে, উন্নত বিশ্বের দেশগুলোতে এ ধরনের খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার প্রবণতা জোরদার হলে দরিদ্র এবং উন্নয়নশীল দেশগুলো সঙ্কটে পড়বে।

তিনি বলেন, ইউক্রেনে রুশ হামলার পর আমরা দেখলাম ৩০টির মতো দেশ তাদের রফতানির ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করলো। অনেক দেশের জন্য বিশেষ করে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর ওপর এর সাংঘাতিক নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। কারণ এসব দেশে অন্যান্য জিনিসের চেয়ে খাদ্যসামগ্রীর প্রয়োজন অনেক বেশি।

কিন্তু খাদ্য এবং জ্বালানির বাইরে অন্য অনেক পণ্যে কি এই আত্মনির্ভরতা অর্জন সম্ভব?

আধুনিক প্রযুক্তিতে সিলিকন মাইক্রোচিপ অতি অবশ্য একটি উপাদান। স্মার্ট ফোন থেকে শুরু করে কম্পিউটার, মেডিক্যাল যন্ত্রপাতি, গাড়ি, বিমান এবং অস্ত্র তৈরিতে মাইক্রোচিপ প্রয়োজন।

এবং সবচেয়ে আধুনিক এসব চিপের প্রধান উৎপাদক দেশ তাইওয়ান যে দেশটিকে চীন তাদের অংশ বলে বিবেচনা করে। যদিও তাইওয়ান যাতে স্বাধীন সত্ত্বা নিয়ে টিকে থাকতে পারে তার জন্য তাদের নিরাপত্তা দিচ্ছে আমেরিকা।

তাইওয়ান নিয়ে কখনো সংঘাত শুরু হলে মাইক্রোচিপের সরবরাহ হুমকিতে পড়ার ভয় রয়েছে। সে কারণে আমেরিকা এবং চীনও মাইক্রোচিপ তৈরি বাড়াতে জোর চেষ্টা শুরু করেছে।

কিন্তু চিপ তৈরির প্রক্রিয়া খুবই জটিল। সারাবিশ্ব থেকে কাঁচামাল জোগাড় করতে হয়। সেইসাথে প্রয়োজন অত্যন্ত দক্ষ প্রকৌশলী এবং কর্মী। ফলে, একসাথে এতকিছু নিশ্চিত করা আমেরিকার মতো দেশের জন্যও কঠিন কাজ হতে পারে।

তাহলে বিশ্বে কি এখন নতুন এক আত্মনির্ভর যুগের সূচনা হচ্ছে? নাকি রাজনৈতিক নেতারা একসময় অনুধাবন করবেন যে বিশ্ব অর্থনীতির মধ্যে এখন যোগসূত্র এতটাই বেশি যে অসহনীয় কষ্ট এবং ত্যাগ স্বীকার না করে তা ভাঙা অসম্ভব।

সবকিছু নির্ভর করবে প্রথমত, অর্থনীতির কোনো কোনো ক্ষেত্রে তারা আত্মনির্ভরতা অর্জনে জোর দেবেন এবং দ্বিতীয়ত, কতটা আত্মনির্ভর তারা হতে চাইবেন।
সূত্র : বিবিসি


শেয়ার করুন