জাতীয় শোক দিবসে সিটিএন'র আয়োজন

বিশেষ ক্রোড়পত্র : পিতার জন্য শোকগাথা

kalam
baby-maudud1611211 (1) শেখ মুজিবের ছাত্রজীবন : আদর্শ ও দেশপ্রেমের প্রতিকৃতি

                                                                                          বেবী মওদুদ

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আজীবনের স্বপ্ন ছিল বাংলার স্বাধীনতা ও বাঙালির জাতিসত্তার প্রতিষ্ঠা। শৈশব কৈশোর থেকে তিনি এই আদর্শ নিয়েই বড় হয়ে ওঠেন। নিজেই নিজেকে প্রস্তুত করে তোলেন। তাঁর এই চারিত্রিক দৃঢ়তার পেছনে ছিল গভীর অধ্যয়ন, জানা-চেনা-শোনা ও দেখার গভীর অন্তর্দৃষ্টি। তিনি হৃদয়ের আবেগকে যথেষ্টভাবে ধারণ করতে সমর্থ হন। এর পেছনে ছিল মানুষকে ভালোবাসা ও সাহায্য করার জন্য তাঁর দরদী মন। এই শিক্ষাটা তিনি অর্জন করেন তাঁর পরিবারের মানুষদের দেখে, তাঁর গৃহশিক্ষকের কাছে এবং দারিদ্র অভাবগ্রস্থ গ্রামের মানুষকে দেখে। তাঁর হৃদয়ে যা কিছু ছাপ রেখেছে বা প্রভাব ফেলেছে সেটা তিনি গভীরভাবে বিশ্লেষণ করেছেন। এই ক্ষমতা অল্প বয়স থেকেই তাঁর আয়ত্তে ছিল। তাঁকে চিন্তাচ্ছন্ন করে তুলতো, তাঁকে আবেগতাড়িত করতো। তাঁর জাতির পিতা বা বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠার পেছনে তাঁর গ্রাম টুঙ্গিপাড়ার মানুষের একটা বড় ভূমিকা রয়েছে। এই ছোট্ট অনুন্নত গ্রাম ও মানুষের মধ্যে তিনি লক্ষাধিক গ্রাম ও কয়েক কোটি মানুষকেও দেখেছেন। আর সেজন্যই বাঙালি জাতির ভাগ্যকে তিনি জয় করতে গিয়ে তিনি নিজের জীবনের প্রতি তাকিয়ে দেখার সুযোগ পান নি। জেল-জুলুম, রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র, শাসকগোষ্টীর অত্যাচার– সবকিছু সহ্য করেছেন। কিন্তু বাংলার মানুষের সঙ্গে কখনও বিশ্বাসঘাতকতা করেননি। তাঁর লক্ষ্য ছিল বাংলার মানুষের মুক্তি। বাঙালি উন্নত জীবনের অধিকারী হোক। বিশ্বে মাথা উচু করে দাঁড়াক। বাঙালি জাতিসত্তাকে প্রতিষ্ঠা করুক। একজন মহান নেতা হবার সবকটি গুণই আমরা তার মধ্যে খুঁজে পাই।
১৯২০ সালের ১৭ মার্চ টুঙ্গিপাড়ায় শেখ মুজিবের জন্ম হয়। মা-বাবার চোখের মণি, ভাই-বোনের আদর ভালোবাসা, আত্মীয়-স্বজন পাড়া-প্রতিবেশি সকলের কাছেই ছিল তার সমাদর। গ্রামের মাটি-আলো-বাতাসের স্পর্শ নিয়ে প্রকৃতির শান্ত শীতল সবুজ ছবিটি দেখে তিনি বড় হয়ে উঠলেন। গিমাডাঙ্গা প্রাইমারি স্কুলে লেখাপড়া করেন। বাড়িতে লেখাপড়ার জন্য শিক্ষক, মৌলভী ও পণ্ডিত ছিলেন। গ্রাম থেকে গোপালগঞ্জ শহরে এসে মিশন স্কুলে ভর্তি হন। পিতা ছিলেন গোপালগঞ্জ দেওয়ানী কোর্টের সেরেস্তাদার। স্কুল ছাত্রজীবনেই তাঁর চোখে বেরিবেরি রোগ হওয়ায় কলকাতায় গিয়ে ডা. টি. আহমদের কাছে অস্ত্রপচার করতে হয়। দুই বছর লেখাপড়া বন্ধ ছিল।

এ সময়টায় তিনি ঘুরে বেড়াতেন, সভায় গিয়ে বক্তৃতা শুনতেন, গৃহশিক্ষকের কাছে অনেক কথা কাহিনী ও খবরাখবর শুনতেন। সুস্থ হওয়ার পর তিনি আবার স্কুলে ভর্তি হন, খেলাধুলায়ও মনোযোগী হন। ফুটবল ছিল প্রিয়। স্কুলের দলের হয়ে খেলতেন। লেখাপড়া করতেন ঠিক মত, কেননা তাঁর মা-বাবার প্রচন্ড উৎসাহ ছিল এবং তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ছিল, শাসনও ছিল। তাঁর গৃহশিক্ষক কাজী আবদুল হামিদ ছিলেন একজন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের কর্মী যিনি আত্মগোপন করতে তাদের বাসায় আশ্রয় নেন। সেই শিক্ষকই শেখ মুজিবের জীবনকে আলোকিত করার প্রথম প্রদীপটি জ্বালান। তিনি তাঁকে ইতিহাসের শাসকদের গল্প শোনান। বিপ্লব-বিদ্রোহের কাহিনী শোনান। বাংলার ইতিহাস কিশোর মুজিবের কাছে ছিল এক আদর্শময় পাঠ। বাঙালির কৃতিত্ব, শিল্প–সাহিত্য-সংস্কৃতির জ্ঞানও তিনি ধীরে ধীরে গ্রহণ করেন। এই শিক্ষা গ্রহণ করার পাশাপাশি সেই সময়ের বৃটিশ শাসকদের শাসন ও শোষণ, গান্ধিজীর আন্দোলন, হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক, রাজনৈতিক আন্দোলন, সামাজিক সমস্যাবলী, বন্যা-দুর্ভিক্ষ, খাদ্যাভাব – সবই তিনি তাঁর গভীর পর্যবেক্ষণ শক্তি দিয়ে বিশ্লেষণ করেছেন।

স্কুল ছাত্র জীবনেই তিনি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। যারা রাজনীতি করতেন তাদের খুব কাছাকাছি চলে যান। ঐ সময়ে বাংলার প্রধানমন্ত্রী এ. কে. ফজলুল হক ও মন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী গোপালগঞ্জে রাজনৈতিক সফরে এলে তিনি তাঁদের সামনে গিয়ে স্কুলের ছাদ দিয়ে পানি পড়ার অভিযোগ তুলে ধরেন এবং মেরামতের দাবি জানান। তাঁর কথা বলার ভঙ্গি দেখে দুই নেতাই মুগ্ধ হন। সোহরাওয়ার্দী তাঁকে কাছে ডেকে কথা বলেন এবং এলাকার রাজনৈতিক খবরাখবর নেন। তিনি ঠিকানা দিয়ে চিঠি লিখতেও বলেন। শেখ মুজিবের সঙ্গে সেই প্রথম সম্পর্ক গড়ে ওঠে যা আজীবন ছিল। সোহরাওয়ার্দীর রাজনৈতিক আদর্শ শিষ্য হিসেবে শেখ মুজিব গড়ে উঠতে থাকেন। সেই সফরে সম্বর্ধনা জানাতে একটি কমিটি গঠিত হয়। পরবর্তীতে সেই কমিটির একটি গোলমালের ঘটনায় শেখ মুজিবসহ চার পাঁচজনকে আসামী করে বিরোধীরা থানায় একটি মামলা করে। গোপালগঞ্জ থানা হাজতে সাতদিন বন্দি থেকে জামিনে মুক্তিলাভ করেন। পরবর্তীতে ১৫০০ টাকা ক্ষতিপূরণ দিলে মামলা প্রত্যাহার করে নেয়া হয়। সেই তাঁর প্রথম কারাজীবন এবং এটাও তাঁর জীবনে গভীরভাবে প্রভাব ফেলে।

১৯৪২ সালে এন্ট্রান্স পাশ করে শেখ মুজিব কলকাতায় ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হন। বৃটিশ শাসিত দুই বাংলা একত্রে বাংলা বা বেঙ্গল হিসেবে পরিচিত ছিল। বাংলার মেধাবী, মননশীল ছাত্ররা ইসলামিয়া কলেজে লেখাপড়া করতো এবং বেকার হোস্টেলে থাকতো। ১৯২৬ সালে ইসলামিয়া কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৪৭ সালে এর নামকরণ হয় সেন্ট্রাল কলকাতা কলেজ। ১৯৬০ সালে উপমহাদেশের প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ মাওলানা আবুল কালাম আজাদের নামে রাখা হয়। বর্তমানে মাওলানা আজাদ কলেজ নামে পরিচিত। শেখ মুজিব এখান থেকে ১৯৪৪ সালে আই.এ. এবং ১৯৪৭ সালে বি.এ. পাশ করেন।

কলেজের পাশের রাস্তায় তালতলা থানার কাছেই বেকার হোস্টেল। তিনতলা বিরাট ভবন। শেখ মুজিব তিনতলার বাঁদিকের সামনের সারির কোনায় ২৪নং কক্ষে থাকতেন। ছোট্ট কক্ষ, কোন ফ্যান ছিল না তখন। একটি ছোট্ট খাট। পাশেই কাঠের তৈরি পড়ার টেবিল ও চেয়ার। একটি ছোট্ট আলমারীও আছে। বর্তমানে এটি বঙ্গবন্ধু স্মৃতি কক্ষ নামে পরিচিত। তাঁর ছবি ও তাঁর সম্পর্কিত লেখা বইয়ের একটি আলমারিও আছে। পাশের ২৫ নম্বর কক্ষটিও এর সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর একটি ভাস্কর্য রাখা হয়েছে। দরোজার পাশে দেয়ালে বঙ্গবন্ধুর একটি সংক্ষিপ্ত জীবনীও রাখা হয়েছে।

পাশাপাশি এই দুটি কক্ষে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ও তাঁর সঙ্গীসাথীরাও থাকতেন। সারাদেশ থেকে তাঁর ছাত্র রাজনীতির কর্মী, ভক্ত ও অনুরাগীরা এসে দেখা করতো এখানেই। অনেক সভা করেছেন হোস্টেলে। হোস্টেল সুপার ছিলেন অধ্যাপক সাঈদুর রহমান। ছাত্র-কর্মীদের থাকার জন্য শেখ মুজিব খালি রুম বা বড় হলঘর চাইলেই তিনি কখনও না করতেন না। শেখ মুজিবের প্রতি তাঁর একটা আলাদা স্নেহ-ভালোবাসা ছিল। ইসলামিয়া কলেজের প্রিন্সিপ্যাল ছিলেন ড. এইচ. আর. জুবিরী। শেখ মুজিবের প্রতি তাঁর ছিল অপার স্নেহ। বিশেষ করে বি.এ. পরীক্ষায় বসার জন্য তিনি তাঁকে সবরকম সহযোগিতা করেছিলেন। কেননা দাঙ্গা-হাঙ্গামা, পুনর্বাসন ইত্যাদি কর্মকান্ডে শেখ মুজিব তখন ব্যস্ত থাকতেন। মুসলিম লীগের রাজনীতির সঙ্গেও ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। একদিকে ছাত্রনেতা হিসেবে বলিষ্ঠ সংগঠক ছিলেন, অপরদিকে মুসলিম লীগের ড্রইংরুম রাজনীতিকে সাধারণের মাঝে নিয়ে আসার কাজে তিনি সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশেমের যোগ্য শিষ্য ছিলেন। বেকার হোস্টেলের ছাত্র সংসদের নেতৃত্বও তিনি নিয়ন্ত্রণ করতেন এবং একবার সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন। শিক্ষক ও ছাত্র সকলের প্রিয় ছিলেন শেখ মুজিব। তাঁর আদর্শ, সাহস ও চিন্তা-ভাবনার প্রতি সকলের শ্রদ্ধা ছিল।

স্কুল ছাত্রজীবন থেকেই শেখ মুজিব দেশের রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৩৮ সালে মুসলিম লীগের ফরিদপুর জেলা প্রতিনিধি হিসেবে সিরাজগঞ্জে প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সম্মেলনে যোগদান করে যথেষ্ট অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। এ সম্মেলনে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহসহ ভারতের বড় বড় নেতৃবৃন্দ যোগদান করেন। এছাড়াও দিল্লীতে ভারতীয় মুসলিম লীগের সাধারণ সম্মেলনে তিনি দুইবার যোগদান করেন। সেখানেও নেতাদের ভাষণ শুনে তিনি অনুপ্রাণিত হন। কলকাতায় ছাত্রাবস্থায় তিনি দাঙ্গা দেখেছেন ও রুখেছেন। ১৯৪৬ সালের সাধারণ নির্বাচনেও তাঁর ভূমিকা ছিল। ছাত্রজীবন থেকেই দেশপ্রেম ও দেশের জন্য কাজ করা তাঁর স্বভাবের অংশ হয়ে ওঠে। ছাত্রজীবনে তাঁর কর্মকাণ্ড, বিচক্ষণতা ও ভাষণ শুনে সবাই আকৃষ্ট হতো।

১৯৪৭ সালের ডিসেম্বরে শেখ মুজিব ঢাকায় এসে ১৪০নং মোগলটুলীর ‘কর্মী-ক্যাম্পে’ ওঠেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি হন এবং সলিমুল্লাহ হলে মাঝে মাঝে থাকতেন। ঢাকায় এসে ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন এবং মুসলিম ছাত্রলীগের স্বেচ্ছাচারিতা ও বাংলা বিরোধী ভূমিকার জন্য তাদের সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করেন। তিনি পূর্ব বাংলা মুসলিম ছাত্রলীগ গঠন করেন। যুবলীগেরও একজন প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন। খাজা নাজিমুদ্দিনের বাংলাভাষাবিরোধী ভূমিকা এবং উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার হুমকির বিরুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সমাজ যখন গর্জে ওঠে, তিনিও তাদের সঙ্গে নেতৃত্ব দেন। ১৯৪৮ সালে প্রথম প্রতিবাদ ও হরতাল পালিত হলে শেখ মুজিবও সবার সঙ্গে গ্রেফতার হন। পরে পূর্ব বাংলার মূখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন ছাত্রদের দাবি মেনে নিয়ে সবাইকে মুক্তি দেন। এরপর শেখ মুজিব কৃষকদের দাবি নিয়ে আন্দোলন করেন। তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর দাবি দাওয়া নিয়ে আন্দোলন করেন। এসময় উপাচার্যের বাড়ি ঘেরাও কালে তাঁকেও পুলিশ গ্রেফতার করে এবং অনেকগুলো মামলা দায়ের করে। কারাগারে থাকার সময় তিনি আওয়ামী মুসলিম লীগের যুগ্ম-সম্পাদক নির্বাচিত হন। জেল থেকে বের হয়ে এক ছাত্রসভায় বক্তৃতা দিয়ে তিনি ছাত্র রাজনীতি থেকে বিদায় নেন এবং জাতীয় রাজনীতিতে যোগদান করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাঁকে বহিস্কার করা হয়েছিল। জেলে থাকাকালে সরকার তাঁকে জরিমানা ও মুচলেকার প্রস্তাব দেয় এবং জানায় তিনি যদি রাজনীতি না করেন, তাহলে ছাত্রত্ব ফিরিয়ে দেয়া হবে। তিনি সরকারি প্রস্তাব প্রত্যাখান করেছিলেন। কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে শেখ মুজিব টুঙ্গিপাড়ায় গ্রামের বাড়িতে কিছুদিন অবস্থান করেন। তাঁর পিতা শেখ লুৎফর রহমান তাঁকে লন্ডনে গিয়ে ব্যারিস্টারি পড়তে বলেন। কিন্তু শেখ মুজিব ততদিনে পাকিস্তানের শাসকদের ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তকে অনুধাবন করে ফেলেন। তিনি তাঁর প্রিয় বাংলার জনগণকে পাকিস্তানের শোষণের মধ্যে ফেলে রেখে লন্ডনে গিয়ে আর পড়তে চাইলেন না। তিনি রাজনীতি করার সদিচ্ছা প্রকাশ করে বাংলার মানুষের আদায়ের দাবিতে আবার ঢাকা চলে এলেন। তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা জীবনের ইতি ঘটে। কিন্তু ঘরে বসে বই পড়ার অভ্যাস থাকায় তিনি একটি লাইব্রেরি গড়ে তোলেন। স্বচ্ছ মনের মানুষ ছিলেন, রাজনৈতিক চিন্তার দিক থেকে দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ছিলেন, সাহসী, সৎ ও দৃঢ় চারিত্রিক আদর্শের অধিকারী ছিলেন। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর আতঙ্ক ছিলেন একমাত্র শেখ মুজিব। মন্ত্রীত্বের লোভ, লাইসেন্সের টোপ এবং ব্যবসা-বানিজ্যের নানা সুযোগ সুবিধা দিয়ে তখন অনেক নেতাকে ক্রয় করা যেত। কিন্তু শেখ মুজিব তাঁর লক্ষ্যে দৃঢ় ছিলেন। জেল-জুলুম মামলা–ফাঁসির ভয় তাঁর মাথা নত করতে দেয়নি। বাংলার মানুষের মুক্তির দাবিতে, অধিকার আদায়ে, শোষণের বিরুদ্ধে তিনিই ছিলেন সোচ্চার প্রতিবাদী। তাঁর বজ্রকন্ঠ পাকিস্তানের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিল।

দেশ ও মানুষকে তিনি তাঁর হৃদয়ের আধেয় করে একজন আত্মত্যাগী দেশপ্রেমিক নেতা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে সমর্থ হন। ছাত্রজীবন থেকে যে শিক্ষা ও দীক্ষা তাঁর জীবনকে আলোকিত করে তোলে, তার শিখা চিরন্তন করে রেখে গেছেন তিনি।

(সংকলিত)

                                                                                                            বেবী মওদুদ  : প্রয়াত লেখক ও সাংবাদিক



Copy of mohammad ali ex mp১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস ও স্মৃতি বিজড়িত কিছু কথা

                                                                                  অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী

১৯৭৫ সালের ১০ আগস্ট রবিবার, তখন আমি কক্সবাজার কলেজের অধ্যাপক ছিলাম, সারা বাংলাদেশে চলছিল উন্নয়ন কর্মকা-, যাকে বলতে হবে দুর্ভিক্ষ কবলিত দেশকে যেন নতুন করে প্রাণ করে প্রাণ ফিরে দেয়ার চেষ্টা। দেশের প্রত্যেকটি মহকুমায় গভর্নর নিয়োগ হচ্ছে সাথে গভর্নরদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। কক্সবাজারের আমার শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি জহিরুল ইসলাম সাহেব তখন গভর্নর পদে প্রশিক্ষণ এর জন্য ঢাকায় অবস্থান করছেন। ওই দিন খবর খবর পেলাম মহকুমার পরে উপজেলা ভিত্তিক প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হবে, কয়েকদিনের মধ্যে ঢাকা যেতে হবে। বিকেল বেলা বেশ কয়েক জন আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীর সাথে দেখা হলো একে অন্যের সাথে মতামত আদান প্রদান করলাম, সর্বশেষ সিদ্ধান্ত হলো ১২/০৮/১৯৭৫, ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিবো। এরমধ্যে আমার সাথে টেকনাফ বাহারছড়ার পরম শ্রদ্ধেয় নেতা মরহুম শামসুদ্দিন (চেয়ারম্যান) সাহেবের সাথে দেখা হয়, ওনিও এই বিষয়ে অবগত আছেন, উনাকে আমাদের সাথে ঢাকা যাওয়ার কথা বললাম, উনি যাবেন বলে সম্মতি প্রকাশ করলেন। প্রত্যেক উপজেলা থেকে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ঢাকা যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে, টেকনাফ উপজেলা থেকে শুধু আমি আর শামসুদ্দিন সাহেব ছিলাম। ১৯৭৫ সালের ১২ আগস্ট মঙ্গলবার সবার মাঝে যেন উৎসবের আমেজ কারণ বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা হবে, কথা হবে, নেতাকর্মীরা ৪/৫ জন করে কয়েকটা দলে ভাগ হয়ে গেলেন। আমার সাথে ছিলেন চকরিয়ার গোলাম রব্বান সাহেব, রামুর বদি আলম সাহেব আর কক্সবাজারের কামাল হোসেন চৌধুরী সাহেব। অবশেষে ঢাকার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু, বাহন ছিল তৎকালিন কাঠ আর সিটের তৈরি বড়ির চেয়ারকোচ, তাও আবার একটি নয়, কয়েকটি পরিবর্তন করে পৌছাতে হবে। অনেকটা পথচলা কিন্তু কারো মাঝে যেন সেই ক্লান্তির চাপ নেই, গল্প আর রাজনৈতিক আলাপ চলছে সবার মাঝে। ১৩/০৮/১৯৭৫ বুধবার ঢাকায় পৌঁছে. তৎকালিন হোটেল সালিমারে উঠলাম আমরা। অনেক কেন্দ্রিয় নেতাদের সাথে দেখা হল একে অপরের খোঁজ খবর নিচ্ছিলেন, তখন বঙ্গবন্ধু বাসায় ছিলেন না একটি মিটিং ছিলেন। রাতে হোটেলে ফিরি আসি, কক্সবাজারের আরো কিছু নেতাকর্মী ছিলেন হোটেল স¤্রাটে। বৃহস্পতিবার দুপুর বেলা হোটেল থেকে বের হয়ে হোটেল স¤্রাটের দিকে গেলাম, তখনো বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করার সিডিউল ঠিক হয় নি। ঢাকায় অবস্থানরত কক্সবাজারের নেতাকর্মী সবাই আছেন, সিডিউল এর ব্যাপারে কে কি শুনছে তা একে অপরকে বলতেছেন, হঠাৎ দেখতে পেলাম তৎকালিন মুসলিম লীগের দুজন অন্যতম নেতা হ্নীলার আবদুল গফুর চৌধুরী আর কুতুবদিয়ার জালাল আহমদ চৌধুরীকে, উনাদের দেখার পর আমাদের সবার মাঝে যেন কৌতুহল বেড়ে গেল, কি জন্য বা কি কারণে ঢাকায় আসলো ? আবদুল গফুর চৌধুরীর সাথেই সেইদিন আমার কথা হয়নি, তবে জানতে পেলাম কক্সবাজারের একজন সিনিয়র নেতার মাধ্যমে বাকশালে যোগদান করতে এসেছে। রাতে হোটেলে ফিরে এলাম, ঘুমানোর আগে অনেকটা দু:খ ভরা মন নিয়ে একজন বলে উঠলো দেখেছ মানুষ স্বার্থের জন্য কতকিছু করতে পারে, যারা মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী ছিল, যারা এই দেশের স্বাধীনতা বিরোধী ছিল, যারা বঙ্গবন্ধুর বিরোধী ছিল, তারা আজ আবার বঙ্গবন্ধুর বাকশালে যোগদান করতে এসেছে। শুক্রবার, যে রাত্রি আমার অতিবাহিত করে আসলাম সেটি ছিল ভয়ানক, কলঙ্কিত ঘুটঘুটে আধারে ঢাকা একটি কাল রাত। সকাল ৭টা কি ৮টা হোটেল সালিমারে একজন বয় রুমের দরজায় এসে চিৎকার দিতে দিতে বললেন, সাহেবরা উঠেন, সাহেবরা ওঠেন, বাংলাদেশ কে শেষ করে ফেলছে ওরা, বঙ্গবন্ধুকে মেরে ফেলেছে। আমরা সবাই তাড়াতাড়ি রুম থেকে বের হয়ে রিসিপশনের দিকে আসলাম সিলেটের এক ভদ্রলোক রেডিও নিয়ে খবর শুনছেন আর চোখ দিয়ে অবিরত পানি পড়ছিল। তখনো আমাদের বিশ্বাস হচ্ছিল না যে বঙ্গবন্ধু আমাদের মাঝে আর নেই, কতক্ষণ আর আবেগকে দমিয়ে রাখবো, সেই দিনের সেই কঠিন বাস্তবতা আমাদের হার মানিয়েছিল, তবে আমরা মেনে নিতে পারি নি যে বঙ্গবন্ধু আমাদের মাঝে নেই। হোটেল থেকে বের হলাম কিন্তু কোথাও যাওয়া যাচ্ছে না রাস্তায় যানবাহন নেই শুধু সেনাবাহিনীর গাড়ি আর কামানবাহী টেংকার সমস্ত জায়গায় কারফিউ। নিস্তব্ধ ঢাকা শহর আর রক্তে রঞ্জিত সেই ধানমণ্ডির ৩২ নং বাড়ি, শ্রাবণের বৃষ্টিতে যেন বঙ্গবন্ধুর রক্ত রাজপথে গড়িয়ে যাচ্ছে। ভাবতে পারি নি আমাদের আনন্দ রক্তস্রোত ভেসে যাবে, ভাবতে পারি নি আমরা অভিভাবকহীন হবো। আমাদের একটি মিনিট পার হচ্ছে যেন বিভিষীকাময় কয়েকটি বছরের মতো থামানো যাচ্ছে না অশ্রুজল। পরের দিনই কারফিউ, বের হতে পারছি না। ৪/৫ জনের জমায়েত পেলে সেনাবাহিনীর লাঠিপেটা আর বেপরোয়া নির্যাতন মনে হচ্ছে যেন একটি স্বাধীন দেশ হায়েনার রাজ্যে পরিণত হলো। হোটেলের লবিতে পায়চারি আর নতুন কাউকে দেখলে জিজ্ঞাসা করি কোন কিছু জানেন কি না বা কোনো কিছু শুনছেন কীনা ? দিন গড়িয়ে যেন রাত আসতেছে না, আমরা দিশেহারা, মনে হচ্ছে মধ্য সাগরে নাবিকহীন একটি তরীতে আমরা ভাসছি। ১৯৭৫ সালের ১৭ই আগস্ট রবিবার সকালে আমরা সাহস করে দুই জন বের হলাম বাকী দুজন একটি পরে বের হলেন, প্রথমে গেলাম হোটেল স¤্রাটে, হোটেলে ঢুকতে দেখলাম আবদুল গফুর চৌধুরী রিসিপশনের সামনে বসে আছে, আমাকে দেখা মাত্র একটা অট্টহাসি দিয়ে বললেন মোহাম্মদ আলী আমরা যা চেয়েছিলাম তা পেয়েছি আর ইংরেজিতে বললেন Right time, Right Step. শুনে খুব খারাপ লাগলো। আমি কিছু না বলে হোটেল থেকে বের হয়ে গেলাম, সাথে বাকী তিন জন। কে কোথায় আছে কিছুই জানি না। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম কক্সবাজার ফিরে আসবো তবে কীভাবে? আমরা দুজন করে হাটতে থাকলাম নিজেকে তখন অনেক বেশি কাপুরুষ মনে হচ্ছিলো কারণ বঙ্গবন্ধুকে ওরা শেষ করে ফেললো আর আমাদের চোখের সামনে হায়েনারা উল্লাস করছে। হাটতে হাঁটতে দাউদকা-ি পর্যন্ত এলাম চারদিকে নিরবতা কয়েক ঘণ্টা পর দুই একটি গাড়ি দেখা যাচ্ছে, কখনো হাঁটছি আবর কখনো রিক্সা বা ভ্যান আবার কখনো চান্দের গাড়ি, এমন করতে করতে দুই দিন পর কক্সবাজারে এসে পৌছলাম। কক্সবাজার কলেজ ক্যাম্পাসে এসে প্রতিবাদ মিছিল করেছিলাম। দেখলাম স্বাধীনতার পক্ষ শক্তি কাঁদছে আর সেই দিনের কুলাঙ্গার বিপক্ষ শক্তি উল্লাসে মেতে উঠেছে। ১৯৭৬, তৎকালিন মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান একটি জেনারেল অর্ডার জারি করলেন যাতে লিখা ছিল Secure Arrest at least two Awami Gonda Element in Every Thana. আর এই অর্ডারে আমাকে দোষী সাবস্ত করা হয়। বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে মিছিল আর আওয়ামী লীগ গুন্ডা আখ্যায়িত করে আওয়ামী রাজনীতি করার অপরাধে আমাকে কলেজ থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। তবে গর্ববোধ করি রাজনীতি আর প্রতিবাদ করার জন্য চাকুরিচ্যুত হলাম। সেই দিনের খুনীদের উদ্দেশ্যে বলছি তোমরা পেরেছো বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করতে, কিন্তু তোমরা পারো নি তার আদর্শ এই দেশ থেকে মুছে দিতে আজও আছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দীর্ঘ দেহ, সফেদপাজামা-পাঞ্জাবি, কালো মুজিব কোর্ট, পেছনে আচড়ানো কাঁচা পাকা চুল, কালো মোটা ফ্রেমের চশমা, হাতে পাইপ, শুধু সে পাইপ থেকে এডিনমুরস তামাকের সুবাস বের হয় না যতদিন রবে পদ্মা, মেঘনা, গৌরি, যমুনা আবহমান ততদিন রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান। খোদা হাফেজ।

লেখক  : রাজনীতিবিদ ও সাবেক সংসদ সদস্য



MONIR e          বঙ্গোপসাগরীয় সভ্যতায় সাত-ই মার্চের ভাষণ

                                             মনির ইউসুফ

হাজার বছরের বঙ্গোপসাগরীয় সভ্যতায় বঙ্গদেশে যে কয়জন শনাক্তযোগ্য বীর ও লোকবীরের জন্ম হয়েছে তার মধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক অবিস্মরণীয় লোকপুরুষ। যার মনোকথার প্রকাশ ভঙ্গিতেই একটি জাতি একসঙ্গে বেঁধে ছিল বুক। এই গাঙ্গেয় বদ্বীপের হরিকেল, সমতট, বঙ্গ, পুণ্ড, রম্যভূমির সাধারণ ও সরল মানুষগুলো জেগে উঠেছিল স্বপ্নের আত্ম-চেতনায়। যে চেতনা ধারণ করেছিল অনমনীয় বোধ এবং একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের পটভূমি। পৃথিবীর ইতিহাসে রাশিয়ার গ্রেট সাহিত্যিক নিকুলাই গোগল ইউক্রেনের ভূমিদাসদের নিয়ে ‘তারাস বুলবা’ নামে যে উপাখ্যান বা আধুনিক উপন্যাস রচনা করেছিলেন শেখ মুুজিব ছিলেন সেই ঘরানার একজন সামন্তীয় মানসিকতার লোকবীর। যিনি সাধারণ সামন্তীয় পরিবার থেকে ওঠে এসে একটি জাতির কণ্ঠস্বর ও জাতিস্বর হয়ে উঠেছিলেন। সাধারণ মানুষের প্রতি যাদের মমতা থাকে, হৃদয়ভাঙ্গা দরদ থাকে তারাই পৃথিবীতে মহৎ হয়ে ওঠে। বিশ্ব-ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে স্বাধীনসত্তার সেই মানুষগুলোই তার জাতির জন্য উপহার দিতে পেরেছে নূতন কোন সুন্দর, নূতন কোন স্বপ্ন। সেই স্বপ্ন বুকে নিয়ে হাজার হাজার মানুষ নিজেদের অধিকার আদায়ের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছে নিজ নিজ অঞ্চলে। হাজার বছরের বাঁক পেরিয়ে বঙ্গ নামের এই গাঙেয় দ্বীপে যে জাতিসত্তা গঠিত হয়েছে তার ইতিহাসও এমন রক্তাক্ত, এমন অবাধ্য অনমনীয়। ক্রমে ক্রমে বাঙালি শব্দটিই হয়ে ওঠে একটি মানবিক সাম্যের অসাধারণ অভিব্যক্তি। জাতীয়তার বোধ তৈরি করতে এই অভিব্যক্তি এমন এক তুমুল উচ্ছ্বাসে মানুষকে টেনে নিয়েছে; একটি স্বাধীন দেশের রাষ্ট্রবীজ তখনই রোপিত হয়ে পড়ে। সেই রাষ্ট্রের জন্য অনেক অনেক রক্তশ্রম, অনেক অনেক রক্তের নাজরানা দিতে হয়েছে জেলে, জোলা, কৃষক, শ্রমিক, রিক্সাওয়ালা, ছাত্র-ছাত্রী, সাধারণ লোকনাগরিক, মধ্যবিত্ত ক্লীন ইমেজেধারি, স্কুল মাষ্টার, কলেজ শিক্ষক, বেকার যুবক-যুবতী, বিশ্ববিদ্যালয় পড়–য়া টগবগে তরুণ, এবং সর্বোপরি এদেশের পুষ্টিহীন গণ ও লোকমানুষকে। শেখ মুজিব ছিলেন এদেশের লোক ও গণমানুষের শেখ সাহেব, সেই শেখ সাহেবের দেওয়া ঐতিহাসিক রাজনৈতিক লোকভাষণটিই জাগিয়ে দিয়েছিল লোকবাঙালির স্বাধীনসত্তা । আঞ্চলিক টানে উচ্চারিত ঐতিহাসিক এই ভাষণের গুরুত্ব পৃথিবীতে তাই তুলনা রহিত এক ঘোরলাগা বাস্তবতা। যে ঘোর ছড়িয়ে দিয়েছিল এই দেশেরই একজন পীরকৃষকের লোকসন্তান। এদেশের কাদা, ধূলি, ধানক্ষেত, ঘাসে ঢাকা মেঠোপথ, পাটক্ষেত, নদী, খাল, ঝিল, শাপলা ফুটা জলাশয়, দিগন্ত বিস্তারি ধমকা বিল, চলন বিল, উদাসী বাউল, আউল, সবুজ ক্ষেত, গরু, ছাগল, গোয়াল ঘর, ষড়ঋতুর বৃষ্টি, আখবাগান, মসজিদ, মন্দির, গির্জা, প্যাগোডা, কিয়াঙ, গণানুষ ও লোকমানুষের মুখের ভঙ্গি, সরলতা ও কোমলতায় গড়া দৃঢ়তা, পাহাড়, টিলা উপত্যকা এবং বঙ্গোপসাগরীয় অবাধ আকাশ ও সাগরের সঙ্গে এই লোকবাঙালির মানে শেখ সাহেবের নিবিড় পরিচয় ঘটেছিল। মনোরঙে ও বহিরঙে বহুবর্ণে হাজার বছরের ক্ষত ও দাগ নিয়ে একজন পাতার বাঁশিওয়ালা শৈশব বুকে নিয়ে বাজিয়ে দেয় বাঙালাপুরানের বাঁশি। বঙ্গউপনিষদের সেই কালের পুরান যখন কণ্ঠে কণ্ঠে তুমুল ঢেউ তুলল তা হয়ে গেল বাঙালির জন্মসনদ।

হাজার বছরের সাগরের গর্জন গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনেছিল এই লোকসন্তান। সেই গর্জনই বাঙালির জন্য অর্জনের এক স্বাধীন ভূমি ও ভূমার পথ প্রশস্ত করে দেয়। বাঙালি অর্জন করে স্বাধীন সার্বভৌম একটি ভূখ-। সাত মার্চের ভাষণ একটি স্বাধীন জাতির সূচনা করে। ভূমি ও ভূ-মার জন্য আকুল হয়ে উঠে বাঙালির প্রাণসত্তা। সাত মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ বাঙালির সব বৈশিষ্টে বিশিষ্ট মানবিক লোকসন্তানের বোধাশ্রিত কথামালা, যার দর্শনগত গুরুত্ব জাতির অনেক গভীরে প্রোথিত। হাজার বছরের লোকমানুষের হাহাকার, শ্রম, রক্ত, সংসার, সঙ্গম, স্বপ্ন, স্বাধীনতা সব এই ভাষণে একাকার হয়ে পড়ে। প্রতিটি মানুষের মনোকথা হয়ে ওঠে এই ভাষণ। হাজার বছর ধরে বাঙালির বুকে গুঞ্জরিত মনোবেদনার এই আরক্তিম উচ্ছ্বাস যেন ছলকে উঠে মানবিক বিজলির চমকে। মনে মনে ঘর্ষণ লাগে। সেই ঘর্ষণ বোধের মনোজমিতে এমন এক ধাক্কা দেয়, বাঙালিকে আর কেউ দাবায়ে রাখতে পারেনি। এই ভাষণ-মানব জাতির দশর্নে এমন এক তুঙ্গীয়ও তুরীয় নূতন সংজ্ঞা তৈরি করে পৃথিবীর ইতিহাসে যা অনন্ত অনন্যতায় ভাস্বর। শেখ সাহেব সাধারণ একজন গ্রামের পীরের সন্তান ছিলেন বলেই কি বাঙলার ভবিতব্যকে বুঝতে পেরেছিলেন। না, তা নয় কিন্তু। এ ছিল তার দীর্ঘ দিনের রাজনৈতিক চর্চার মনোজাত বোধ। বাঙলার হাজার বছরের স্বাধীন সত্তার অনমনীয় মনোভাব তার মধ্যে বিরাজ করেছিল। শিরায় শিরায় চলাচল করেছিল হাজার বছরের লোকপুরুষ, আলপুরুষ, রাজপুরুষ ও রাজপুতনার রক্ত। অলস বাঙালির আধ্যাত্মিক ভূষণ। ভারতবর্ষীয় ধর্মীয় রাজপুত্র গৌতমবুদ্ধ, পরাক্রমশালী স¤্রাট অশোক, হর্ষবর্ধন, ভারত বর্ষের মোগল সা¤্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা বাবর, তুঙ্গীয় স্বাপ্নিক আকবর, শেরশাহ, মহাত্মা গান্ধী, মওলানা আবুল কালাম আজাদ, কমরেড মোজাফ্ফর আহমদ, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী,নেতাজী সুভাষ বসু, মওলানা ভাসানী, জহরুল লাল নেহরু, ক্ষুধিরাম, দেশবন্ধু চিত্তরজ্ঞন দাশ, মাষ্টার দা সূর্য সেন, প্রীতিলতা, রবীন্দ্র নাথের মানবিকতা, নজরুলের বিদ্রোহীসত্তাসহ সবার চিন্তা সবার বীরত্ব, সাহস, ধ্যান, মানবতা উত্তর সমাবেশ ঘটেছিল বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের সেই ভাষণে। বঙ্গবন্ধু সেই মহাপুরুষদের চিন্তা, প্রজ্ঞা, সাহসের সমান উত্তরাধিকারি হয়ে উঠেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর সাত মার্চের ভাষণকে সেই গভীর চোখে দেখতে হবে। এটা একটি জাতির স্বাধীনতার জন্ম-সনদ নয় শুধু ভারতবর্ষের হাজার বছর ধরে গুমরে মরা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মুক্তিরও মনোদিশা। ভারতবর্ষের অন্যান্য জাতিসত্তাগুলো যদি এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারে, তাহলে তাদেরও মুক্তির পথ খুলে যেতে পারে এই ভাষণের তাৎপর্যের ভেতর দিয়ে। কেননা, বঙ্গোপসাগরীয় সভ্যতা পৃথিবীকে যদি কোন ঋণে আবদ্ধ করতে পারে তা একমাত্র বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণ। প্রাচীন বঙ্গ সভ্যতার নূতন দান। একদিকে চর্যাপদ তার হাজার বছর পর বঙ্গবন্ধুর ভাষণ। চর্যাপদ লেখা হয়েছিল হাজার বছরের প্রাচীন বাঙালির মনোবোধের একান্ত আধ্যাত্মিক নির্যাস নিয়ে। আর বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি লেখা হয় আধুনিকতার পথ পেরিয়ে উত্তরাধুনিকতার নব পর্যায় ও উত্তর ঔপনিবেশিক মনন গাথায়; সব মানুষের অধিকারের ভাষাবোধে। বঙ্গবন্ধুর ভাষণই থেকেই বুঝে নিতে হবে বাঙালি স্বতঃস্ফুর্ত স্বভাবজাত লোকবীর। যাদের রক্তে নাচে বঙ্গোপসাগরের হাজার বছরের গর্জন, অরণ্যের ভেতর বাস করা বাঘের সাহস, আলপুরুষের কৃষকীয় ধৈর্য, কৃষকীয় প্রকৃিতবোধ, জেলের সাহস ও ধৈর্য; অরণ্যচারি নুড়ি পাথরের ঘর্ষণে পাথুরে মুখ, পাহাড়ি দৃঢ়তায় ভরা সাহসী বাঙালি। সেইসব দৃঢ়তা সেইসব বৈশিষ্টে ভরপুর বঙ্গবন্ধুর ভাষণ। বঙ্গোপসাগরীয় সভ্যতার হাজার বছরের দান বঙ্গবন্ধু এবং বঙ্গবন্ধুর হাজার বছরের দান তাঁর অনমনীয় মুখের ভাষা সাত মার্চের ভাষণ।

আমি যদি হুকুম দেবার নওা পারি, যার যা আছে তা নিয়ে প্রস্তুত থাক
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম মুক্তিরসংগ্রাম।
জয় বাংলা।
বঙ্গবন্ধু স্টাডিসার্কেলের ‘পিতা’ সংকলনের জন্য লিখিত।

লেখক  : কবি, সম্পাদক- কবিতার রাজপথ



11096582_869426433093054_3824885486387005086_n               ইতিহাসের এক হিরন্ময় নাম শেখ মুজিব

                                                                                                    কালাম আজাদ

কালের পরিক্রমায় আবার ফিরে এসেছে বেদনাবিধুর ১৫ আগস্ট। বাঙালি জাতির ইতিহাসে স্বাধীনতার মাস মার্চ, বিজয়ের মাস ডিসেম্বর এবং শোকের মাস হচ্ছে আগস্ট। একাত্তরের ২৫ মার্চ বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার পূর্বে বাঙালি জাতির মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন দেশ হিসেবে ঘোষণা দেন। এর আগে ওই বছর ৭ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে প্রায় ১০ লক্ষাধিক লোকের বিশাল সমাবেশে বঙ্গবন্ধু বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেন। ‘তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা কর। রক্ত যখন দিয়েছি’ রক্ত আরও দেব, এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল¬াহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’’ একাত্তরের ১ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন অসহযোগ আন্দোলন নয়া ইতিহাস সৃষ্টি করে। প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবী রেহমান সোবহান বলেছেন, ‘ছাব্বিশে মার্চের আগেই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে যায়।’ ৯ মাস সশস্ত্র যুদ্ধের পর একাত্তরের ডিসেম্বরে বাংলার মানুষ বিজয় অর্জন করে। প্রায় ৯৩ হাজার পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সদস্য ওই বছর ১৬ ডিসেম্বর রেসকোর্স ময়দানে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। তাছাড়া সত্তরের ৭ ও ১৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে পূর্ব বাংলা তথা পুর্ব পাকিস্তানের শতকরা ৯৮ জন মানুষ বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগকে ভোট দেয়। পাকিস্তানি হানাদাররা ২৫ মার্চ রাতে গণহত্যা শুরু করলে শেখ মুজিব স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। নির্বাচনে এককভাবে বিজয়ী দলের নেতা হিসেবে একমাত্র শেখ মুজিবেরই স্বাধীনতা ঘোষণা করার এখতিয়ার ছিল। আর আগস্ট হচ্ছে বাংলাদেশ ও বাংলাদেশী বাঙালি জাতির জন্য শোকের মাস। স্বাধীনতা লাভের তিন বছর আট মাসের মাথায় ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট সেনাবাহিনীর একটি ক্ষুদ্র অংশের কতিপয় কুলাঙ্গার স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে সপরিবারে হত্যা করে। বিগত ৩৭ বছরে এটা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে, একাত্তরের পরাজয়ের প্রতিশোধ এবং স্বাধীন বাংলাদেশকে পাকিস্তানি ভাবধারায় ফিরিয়ে নেয়ার জন্যই ১৫ আগস্টের বর্বর হত্যাকান্ড ঘটানো হয়েছিল। দুই স্বৈরসামরিক শাসক জেনারেল জিয়াউর রহমান ও জেনারেল এরশাদ এবং বেগম খালেদা জিয়া তাদের আড়াই দশকের শাসনামলে স্বাধীন বাংলাদেশকে ‘মিনি পাকিস্তান’-এ পরিণত করতে সর্বশক্তি নিয়োগ করেন। মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা যুদ্ধের গৌরবগাথা, মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বের কাহিনী এবং মুক্তির মহানায়ক বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় নেতাদের অবদান মুছে ফেলতে জিয়া, এরশাদ, খালেদারা কতই না অপচেষ্টা চালিয়েছেন। ইতিহাসের অমোঘ নিয়মে ইতিহাস বিকৃতকারীরা চরমভাবে পরাজিত হয়েছেন। ইতিহাস তো কোন স্বৈরশাসকের দাসানুদাস নয়। ইতিহাস তার আপনগতিতেই চলে। বাংলা, বাঙালি, বাংলা ভাষা ও বঙ্গবন্ধু একে অপরের পরিপূরক। ড. আতিউর রহমান যথার্থই বলেছেন, ‘বাংলাদেশের আরেক নাম, শেখ মুজিবুর রহমান।’
বাঙালির শতবর্ষের ইতিহাসে গৌরবময় অর্জন হচ্ছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা। ভারত-পাকিস্তানের মতো আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয় নি। এ স্বাধীনতার জন্য শত বছর পূর্বে মাস্টারদা সূর্যসেন, প্রীতিলতা, ক্ষুদিরামসহ আরও অনেকে ফাঁসিতে জীবন দান করে গেছেন। অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে গিয়েই ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহ হয়েছিল। ২৩ জুন পলাশীর যুদ্ধে মীরজাফর গংদের বিশ্বাসঘাতকতায় নবাব সিরাজউদ্দৌলা পরাজিত হলে বাংলার স্বাধীনতা সূর্য অস্তমিত হয়। পলাশীর পরাজয়ের ২১৪ বছর পর ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আমাদের স্বাধীন আবাসভূমি স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত ২৩ বছরের আন্দোলন-সংগ্রামেও শত শত মানুষ মৃত্যুবরণ করেছেন। তবে ১৯৭১ সালে শুধু ৯ মাসের সশস্ত্র স্বাধীনতা যুদ্ধে ৩০ লাখ মানুষ শহীদ হয়েছেন এবং ৪ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমহানি ঘটেছে। ওই সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এবং তাদের এদেশীয় গোলাম আজম, সাকা-নিজামী চক্র হাজার হাজার বাড়িঘর জ্বালিয়ে ছাই করে দিয়েছে। তবে দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে চার দশকেও স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদদের সঠিক সংখ্যা নিরূপণ করা হয় নি।
স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ইতিহাস গৌরবের। ‘৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর বিশ্বের মধ্যে দুর্ধর্ষ সামরিক বাহিনী হিসেবে পরিচিত প্রবল পরাক্রমশালী পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ৯৩ হাজার সেনা সদস্য বাংলার দামাল মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। মুক্তিযোদ্ধারা জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু বলে সম্মুখ সমরে হাসতে হাসতে জীবন দিয়েছেন। একাত্তর বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে এক গৌরবময় হিরণ্ময় সময়। সে সময় সাড়ে সাত কোটি বাঙালি শেখ মুজিবের নেতৃত্বে যেভাবে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলেন, এ ধরনের ঐক্যের কোনো দ্বিতীয় উদাহরণ হাজার বছরের ইতিহাসে খুঁজে পাওয়া যাবে না। ২৭ বছরের যুবক শেখ মুজিব ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় অ্ন্যদের সঙ্গে নেতৃত্ব দেন। আর সেই মুজিব আমেরিকা, চীনসহ বহু রাষ্ট্রের বিরোধিতা সত্ত্বেও মাত্র ২৪ বছরের মাথায় পাকিস্তান ভেঙে চুরমার করে দিলেন। মুজিবের নেতৃত্ব বাঙালি জাতিকে শুধু ঐক্যবদ্ধ করেনি, বাঙালিকে বীরের জাতিতে পরিণত করে।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে কথা বলার মতো দেশে কোন বিরোধীদল ছিল না। এই পরিস্থিতিতে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার ৪ মাস পর ১৯৪৮-এর ৪ জানুয়ারি ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা করা হয়। তার অন্যতম কেন্দ্রিয় সদস্য ছিলেন শেখ মুজিব। ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে ছাত্রলীগের মাধ্যমে মুজিব বাংলার স্বাধিকার আন্দোলনকে ধীরে ধীরে কীভাবে চূড়ান্ত পরিণতির দিকে নিয়ে গেছেন। এই বাঙালি নেতা পূর্ব পাকিস্তানকে সব সময় পূর্ববাংলা নামে উল্লেখ করেছেন। পাকিস্তান পার্লামেন্ট এমএলএ হিসেবে তিনি সবসময় পূর্ব বাংলার বঞ্চিত মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন। পূর্ব পাকিস্তানকে (পূর্ব বাংলা) সময়মতো তিনি যে স্বাধীন করতে চান, তা আকারে ইঙ্গিতে সবসময় বুঝিয়ে দিয়েছেন। উল্লেখ্য, প্রথিতযশা দেশপ্রেমিক সাংবাদিক তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার মৃত্যুর পর তাকে ৩ নেতার কবরের পাশে দাফনের জন্য জায়গা দিতে পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক শাসককে টেলিফোনে শেখ মুজিব অনুরোধ করেছিলেন। গাফফার চৌধুরীর লেখা থেকে জানা যায়, কবরের জায়গা দিতে অস্বীকার করায় উত্তেজিত মুজিব পাকিস্তানি সামরিক কর্তৃপক্ষকে পরোক্ষভাবে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, ‘বুঝলাম পূর্ব বাংলা স্বাধীন দেশ নয়। এ দেশকে স্বাধীন দেশে পরিণত করতে হবে।’ ড. এমএ ওয়াজেদ মিয়ার লেখা থেকে জানা যায়, খাবার টেবিলে বঙ্গবন্ধু একবার বলেছিলেন, ‘কোনদিন সুযোগ হলে কবিগুরুর আমার সোনার বাংলা গানকে স্বাধীন দেশের জাতীয় সংগীত করব।’ একাত্তরের ৩ মার্চ পল্টনে ছাত্রলীগের জনসভায় বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতিতে সুপরিকল্পিত পূর্ব সিদ্ধান্ত থেকেই কবিগুরুর গানকে জাতীয় সংগীত নির্ধারণ করা হয়েছিল। ১৯৬৯ সালের ৫ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের নামকরণ করেন বঙ্গবন্ধু মুজিব। তিন নেতার মাজার প্রাঙ্গণে সোহরাওয়ার্দীর স্মরণসভায় মুজিব বলেন, ‘এক সময় এ দেশের বুক হতে মানচিত্রের পৃষ্ঠা হতে ‘বাংলা’ কথার সর্বশেষ চিহ্নটুকু চিরতরে মুছে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে। একমাত্র বঙ্গোপসাগর ছাড়া কোন কিছুর নামের সঙ্গে বাংলা কথাটির অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। বাংলা বা বাঙালির অবিসংবাদিত গণনায়ক শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও শেরে বাংলার প্রতিও অমার্জনীয় অবজ্ঞা প্রদর্শিত হয়েছে। বাংলার এই দুই কৃতীসন্তান আজ অসহায়ের মতো আমাদের মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন। এই দুই নেতার মাজারের পাশে দাঁড়িয়ে জনগণের পক্ষ থেকে আমি ঘোষণা করছি, ‘আজ থেকে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশটির নাম হবে পূর্ব পাকিস্তানের পরিবর্তে শুধুমাত্র বাংলাদেশ।’
‘৭০-এর ডিসেম্বরে নির্বাচনের আগে ১২ নভেম্বর ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে দক্ষিণাঞ্চলে লাখ লাখ মানুষের প্রাণহানি ঘটে। সপ্তাহব্যাপী ঘূর্ণিদুর্গত অঞ্চল ঘুরে ২৬ নভেম্বর ঢাকায় এক জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে বিদ্রোহী বাংলার বিদ্রোহী মুজিব একপর্যায়ে স্পষ্ট ভাষায় বলেন, ‘বাংলাদেশ আজ জেগেছে। বানচাল করা না হলে বাংলার মানুষ নির্বাচনের মাধ্যমে তাদের রায় ঘোষণা করবে। আর যদি নির্বাচন বানচাল করা হয়, ঘূর্ণিঝড় ও সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসে নিহত ১০ লাখ লোক আমাদের ওপর যে দায়িত্ব অর্পণ করে গেছে, তা সম্পাদনের জন্য স্বাধীন দেশের নাগরিকের মতো বাঁচার জন্য এবং আমরা যাতে নিজেরাই নিজেদের ভাগ্যনিয়ন্তা হতে পারি, এর জন্য প্রয়োজনবোধে আরও ১০ লাখ বাঙালি প্রাণবিসর্জন দেবে।” এ সময় একজন বিদেশি সাংবাদিক জানতে চান, এ উক্তির মাধ্যমে কি আপনি পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশ সৃষ্টির কথা বলছেন? ত্বরিত উত্তরে সাহসী জাতীয় নেতা মুজিব বলেন, ”Not yet’  (এখনই নয়)। অর্থাৎ এ বক্তব্যের মাধ্যমে শেখ মুজিব বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দিলেন, উপযুক্ত সময়ে তিনি স্বাধীনতার ডাক দেবেন। ‘৭১-এর ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে শেখ মুজিব ‘৬৯-এর ২৬ নভেম্বরের রেশ ধরেই আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে বলেছিলেন, ”বাংলার মানুষকে আর দাবায়া রাখতে পারবা না। রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব, এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ। এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।”
রাজনৈতিক বিশে¬ষকদের মতে, স্বাধীনতা সংগ্রামকে ত্বরান্বিত করার জন্যই ‘৬৬ সালে শেখ মুজিব ৬ দফা দিয়েছিলেন। আইয়ুব-ভুট্টোসহ পশ্চিমা সামরিক চক্র ৬ দফার অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য বুঝেই মুজিবকে বিচ্ছিন্নতাবাদী বলে আখ্যায়িত করেছিল। আর শেখ মুজিবও জানতেন, ‘ওরা ৬ দফা মানবে না আর তখনই ৬ দফা এক দফায় পরিণত হবে।’ একইভাবে সামরিক বিধির বেড়াজালে ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের অনেকেই নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিপক্ষে ছিলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু নির্বাচনে অংশগ্রহণের প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করে বলেছিলেন, ‘নির্বাচনে অংশ না নিলে বাংলার মানুষের পক্ষে কথা বলার অধিকার অর্জন করা যাবে না।’ তিনি এও জানতেন, ‘নির্বাচনে বাংলার মানুষ তাকে ও তার দলের পক্ষে রায় দেবেন। নির্বাচনী ফলাফল মেনে না নিলে বাঙালি জাতি ব্যালটের রায় রক্ষার জন্য বুলেট হাতে নেবে।’ পরবর্তীকালে মুজিবের ভবিষ্যদ্বাণী অক্ষরে অক্ষরে সঠিক প্রমাণিত হয়েছিল।
মার্কিন কূটনৈতিক অ্যার্চার ব্লাড তার গ্রন্থে লিখেছেন- শেখ মুজিব ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের ‘মুকুটহীন সম্রাট’। মুজিব ১৯৬৯-এর জুনেই বস্নাডকে বলেছিলেন, ‘সামরিক বাহিনী যদি আমাকে বাধা দেয় তাহলে আমি স্বাধীনতা ঘোষণা করে গেরিলা যুদ্ধের ডাক দেব।’ ঐতিহাসিকদের মতে, সত্তরের নির্বাচনই হচ্ছে বাংলাদেশের স্বাধীনতার মূল ভিত্তি। এ নির্বাচনে পূর্ব বাংলার ১৬৯ আসনের মধ্যে ১৬৭টি পেয়ে মুজিবের দল পাকিস্তান পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। তাছাড়া প্রাদেশিক নির্বাচনে পূর্ব বাংলায় ৩০০ আসনের মধ্যে তার দল ২৮৮ আসন পায়। এমনিভাবে ৭ ও ১৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত জাতীয় ও প্রাদেশিক নির্বাচনে পূর্ব বাংলার জনগণের শতকরা ৯৮ ভাগ মানুষের সমর্থন পেয়ে আওয়ামী লীগ ও শেখ মুজিব পূর্ব বাংলার জনগণের একমাত্র মুখপাত্র হয়ে গেলেন।
‘৭১-এর ১ মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান যখন ৩ মার্চ ঢাকায় অনুষ্ঠেয় জাতীয় পরিষদের উদ্বোধনী অধিবেশন স্থগিত করেন, মূলত পাকিস্তান সেদিনই ভেঙে যায়। এরপর ১ থেকে ২৫ মার্চ শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগ স্বাধীন বাংলাদেশ পরিচালনা করেন। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ডাক দেন। তিনি বলেন, ‘আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি, তোমরা রাস্তাঘাট বন্ধ করে দিও।’ ‘আমরা ভাতে মারবো, পানিতে মারবো’ বলে তিনি গেরিলা যুদ্ধের দিকনির্দেশনা দেন। ১৫ মার্চ স্বাধীন দেশের সরকারপ্রধানের মতো বঙ্গবন্ধু ৩৫টি নির্দেশ জারি করেন। ২৩ মার্চ ৩২ নম্বরের বাসভবনে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন করেন। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী সশস্ত্র যুদ্ধ শুরু করলে ২৫ মার্চ রাতে গ্রেপ্তার হওয়ার আগে তিনি স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। তিনি ৯ মাস অনুস্থিত থাকলেও তার নামেই মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়। মনীষী আবুল ফজল বলেছেন, ‘অনুপস্থিত সেনাপতির এমন সেনাপতিত্ব সত্যিই অভিনব, ইতিহাসে এমন নজির বিরল।’
স্বাধীনতাবিরোধী চক্র এবং তাদের দোসররা যাই বলুক, ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে, ‘শেখ মুজিব ঘুমন্ত জাতির জাগরণের জন্য জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত ব্যয় করেছেন। দেশ ও জাতিকে তিনি আত্মশক্তিতে বীর্যবান করে স্বাধীনতার দিকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। শেখ মুজিবের অপরিসীম আত্মত্যাগের ফসলই হচ্ছে স্বাধীন বাংলাদেশ। শেখ মুজিব ও বাংলাদেশ একে অপরের অবিচ্ছেদ্য অংশ। একটিকে বাদ দিয়ে অপরটিকে কল্পনা করা যায় না।’ প্রফেসর মো. আবু নসর লিখেছেন, ‘বঙ্গবন্ধু ছিলেন স্বাধীনতার প্রতীক ও জাতীয় বীর। তিনি ছিলেন খাঁটি দেশ প্রেমিক। তিনি বাংলার জন্য, বাংলার মাটির জন্য, বাংলার মানুষের জন্য অকাতরে নিজের জীবন বিলিয়ে দিয়েছিলেন। বাংলার জনগণের ভাগ্যোন্নয়নের জন্য তার আত্মার অস্তিত্ব ছিল সর্বদা নিবেদিত ও উৎসর্গকৃত। রাজনীতিতে আদর্শ ও মূল্যবোধের চর্চায় এক অসাধারণ ব্যক্তিত্ব বঙ্গবন্ধু। অন্য রাজনীতিবিদদের তিনি রোল মডেল। তাই ইতিহাসে বঙ্গবন্ধু একটি হিরন্ময় নাম।’

লেখক  : কবি ও গবেষক



নিবেদিত কবিতা 



  11797994_1120477011300460_850202405_nস্বাধীনতা, এই শব্দটি কীভাবে আমাদের হলো

                                                             নির্মলেন্দু গুণ

একটি কবিতা লেখা হবে তার জন্য অপেক্ষার উত্তেজনা নিয়ে
লক্ষ লক্ষ উন্মত্ত অধীর ব্যাকুল বিদ্রোহী শ্রোতা বসে আছে
ভোর থেকে জনসমুদ্রের উদ্যান সৈকতে: ‘কখন আসবে কবি?’

এই বৃক্ষে ফুলে শোভিত উদ্যান সেদিন ছিল না,
এই তন্দ্রাচ্ছন্ন বিবর্ণ বিকেল সেদিন ছিল না।
তাহলে কেমন ছিল সেদিনের সেই বিকেল বেলাটি?
তা হলে কেমন ছিল শিশু পার্কে, বেঞ্চে, বৃক্ষে, ফুলের বাগানে
ঢেকে দেয়া এই ঢাকার হৃদয় মাঠখানি?

জানি, সেদিনের সব স্মৃতি, মুছে দিতে হয়েছে উদ্যত
কালো হাত। তাই দেখি কবিহীন এই বিমুখ প্রান্তরে আজ
কবির বিরুদ্ধে কবি,
মাঠের বিরুদ্ধে মাঠ,
বিকেলের বিরুদ্ধে বিকেল,
উদ্যানের বিরুদ্ধে উদ্যান,
মার্চের বিরুদ্ধে মার্চৃ।

হে অনাগত শিশু, হে আগামী দিনের কবি,
শিশু পার্কের রঙিন দোলনায় দোল খেতে খেতে তুমি
একদিন সব জানতে পারবে; আমি তোমাদের কথা ভেবে
লিখে রেখে যাচ্ছি সেই শ্রেষ্ঠ বিকেলের গল্প।
সেদিন এই উদ্যানের রূপ ছিল ভিন্নতর।
না পার্ক না ফুলের বাগান, – এসবের কিছুই ছিল না,
শুধু একখন্ড অখন্ড আকাশ যেরকম, সে রকম দিগন্ত প্লাবিত
ধু-ধু মাঠ ছিল দুর্বাদলে ঢাকা, সবুজে সবুজময়।
আমাদের স্বাধীনতাপ্রিয় প্রাণের সবুজ এসে মিশেছিল
এই ধু-ধু মাঠের সবুজে।

কপালে কব্জিতে লালসালু বেঁধে
এই মাঠে ছুটে এসেছিল কারখানা থেকে লোহার শ্রমিক,
লাঙল জোয়াল কাঁধে এসেছিল ঝাঁক বেঁধে উলঙ্গ কৃষক,
পুলিশের অস্ত্র কেড়ে নিয়ে এসেছিল প্রদীপ্ত যুবক।

হাতের মুঠোয় মৃত্যু, চোখে স্বপ্ন নিয়ে এসেছিল মধ্যবিত্ত,
নিম্ন মধ্যবিত্ত, করুণ কেরানী, নারী, বৃদ্ধ, বেশ্যা, ভবঘুরে
আর তোমাদের মত শিশু পাতা-কুড়ানীরা দল বেঁধে।

একটি কবিতা পড়া হবে, তার জন্য কী ব্যাকুল
প্রতীক্ষা মানুষের: ‘কখন আসবে কবি?, ‘কখন আসবে কবি?’

শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে,
রবীন্দ্রনাথের মতো দৃপ্ত পায়ে হেঁটে
অত:পর কবি এসে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন।
তখন পলকে দারুণ ঝলকে তরীতে উঠিল জল,
হৃদয়ে লাগিল দোলা, জনসমুদ্রে জাগিল জোয়ার
সকল দুয়ার খোলা। কে রোধে তাঁহার বজ্রকন্ঠ বাণী?
গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনালেন তাঁর অমর-কবিতাখানি:
‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম,
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’

সেই থেকে স্বাধীনতা শব্দটি আমাদের।


 

  11830948_1120476951300466_309991447_n           পনেরো আগস্ট

                                     মুহম্মদ নূরুল হুদা
আজ পনোরো আগস্ট, আজ বাঙালির শোক।
অনার্য পতাকা হয়ে বাংলার আকাশটাও আজ নত হোক।
আজ খা খা, আজ ধুধু, আজ ছিন্নভিন্ন মানুষ অশোক
রাঢ়ে হরিকেল সমতটে
বাঙালির বজ্রবুকে আজ ঘোর বারিপাত হোক।

বজ্রবুক মাটিও পাথর।
মানুষ পাথর নয়, যদিও পাথর।
অনার্য পাথর নয়, যদিও পাথর।
দ্যাখো, ত্রিকালজ্ঞ শুয়ে আছে ত্রিকাল পাথর।

নাকি শুয়ে নেই? নাকি শুয়ে নেই? নাকি শুয়ে নেই?
নাকি ধাবমান গঙ্গাপদ্মাব্রহ্মপুত্র তার সহচার?
ক্রোক সে করেছে নাকি এ মহাজীবন? নাকি খন্ড খন্ড
বালুচর খেলাঘর, পলকেই লন্ডভন্ড
তৃণকম্পে, জলকম্পে ? সদুত্তরে
মানবিক জ্ঞান বারংবার উপহাস করে
যায় তোমাকে আমাকে। বলে,
একা কোনো প্রাণী তো বাঁচে না।
সে যায় নিজের মতো ঘোর বরিষায়
শালিক দোয়েল আর খইরঙা হাঁসেদের কাছে,
ডাকে আর হাসে, সে যায় নিজের মতো ঘোর বরিষায়
নিজর অন্দরে, চরাচর পার হয়ে দূর চরাচরে
সে যায়, ফেরে না।
সম্মুখে বিশাল বিশ্ব, কিছুই দেখে না।

যে দেখে সে দেখে।
আপন দৃষ্টির রঙে দৃশ্যাবলি যায় শুধু এঁকে।
চক্ষুস্মান ত্রিকালজ্ঞ দেখে, সবই দেখে।

দেখে, সবুজ রঙের এক ভূমিখন্ড।
হিমালয় চূড়া থেকে নেমে এসে সমুদ্রে দাঁড়ায়।
হাঁটুজল পার হয়ে নেমে যায় কোমর অবধি।
দমকা টানে ডুবে যায় ঢেউয়ের গহীনে।
যখন সে ভেসে ওঠে সুজল সুফলা
কে তাকে সনাক্ত করে, কে?
কে একজন পাট করে জন্মের ঠিকুজি,

কে একজন ‘ইতিহাস, ইতিহাস’ ডাক ছাড়ে গঙ্গাপার থেকে,

কে এক ভূখন্ড এসে স্বত্বভাগ দাবি করে কালেমামহাকালে।
মানুষের পক্ষ থেকে একজন সুদীর্ঘ মানুষ
তর্জনী উঁচিয়ে তার ন্যায্য হিস্সা চায়।
মহাকাল খানিক দাঁড়ায়, হাসে,
তারপর দুলকি দুলকি চালে
গন্তবে হারায়। হারায় না উদ্যত তর্জনী।
হারায় না ভূমি আর ভূমির সন্তান।

কালবন্দি দেশবন্দি হয়ে যায়,
ওরা সেই তর্জনীর চারপাশে গোল হয়ে বসে,
নাচে যার গায়,
ওরা হাসে, ওরা কাঁদে
উৎসবে ও বেদনায়,
জন্মসঙ্গী মৃত্যুসঙ্গী ওরা সঙ্গে সঙ্গে যায়,
আজন্ম অনাথ ওরা, যেতে যেতে বলে সমস্বরে,

বলো নাথ, প্রাণনাথ
ডাকে আর কাঁদে
তারপর চুপ হয়ে যায়,
আগুনে চন্দনকাঠ যখন উজ্জ্বল
কে একজন বলে নিচুস্বরে, পিতা
অন্য জন বলে, পিতা
পাশের কে যেন বলে গাঢ়স্বরে, পিতা
তখন সবাই বলে, পিতা
পিতা পিতা
পিতা
আজন্ম অনাথ এই প্রাণসীমা জিহ্বার লাঙ্গলে
চাষ করে পিতা
হৃদয়ের ভূমি নবনীতা
ইহকাল পরকাল পার হয়ে যায় ওরা যায়,
জন্মজ্ঞাতি ওরা সব পিতৃত্বের কাছে চলে যায়,
হারে জেতে বাঘবন্দী ত্রিভঙ্গ খেলায়,
উড়ে যায় বিলে ঝিলে সরোবরে পাখির ডানায়…
তারপর? –তারপর উড়ে-উড়ে ঘুরে-ঘুরে
বুক তার শোণিতে ভাসায়

আজ পনোরো আগস্ট, আজ বাঙালির শোক।
অনার্য পতাকা হয়ে বাংলার আকাশটাও আজ নত হোক।
আজ খা খা, আজ ধু ধু, আজ ছিন্নভিন্ন মানুষ অশোক
রাঢ়ে বঙ্গে হরিকেলে সমতটে
বাঙালির বজ্রবুকে আজ ঘোর বারিপাত হোক।


 

 

  11798115_1120476921300469_1173394911_nকালো ব্যাজ খুলে ফেলো

                                আসিফ নূর

কালো ব্যাজ খুলে ফেলো
পারলে উড়াও কিছু রঙিন বেলুন
কোন শোক নয় আজ, জনকের পুর্নজন্মদিন।
শাক দিয়ে মাছ ঢাকা যায় না কখনো
ছাইচাপা থাকে না তো আগুনের সত্য
দু’দশকের পাপ, ইতিহাস বিকৃতির জাল,
পাশবের নৌকার পালে দোল খেলে সুজানি বৈয়ার।
যুধিষ্ঠির সন্তানেরা ফিরে যায় পিতার লুণ্ঠিত শিরস্ত্রাণ
মাতা মেরীর আঁচলে দ্যুতিমান যীশুর মতোই
শান্তিশিশু হাসে আজ বাংলা মায়ের কোলে ।

যীশুকে যায় না মারা ক্রশবিদ্ধ করে,
দেখো বেথেলহেমের পথে পথে পবিত্র যীশুর নামে
আজো নামে স্বর্গশান্তি, অন্ধে খুঁজে আলো
কালো ব্যাজ খুলে ফেলো, ছুঁড়ে ফেলো শোক
দু’হাতে উড়াও শুধু লাল নীল বর্ণিল বেলুন;
বঙ্গপিতা মুজিবের নামে লাখকোটি তোপধ্বনি
গর্জে ওঠো, গর্জে ওঠো বজ্রহুংকারে।


 

 

   11797978_1120477271300434_1083685685_nযে ধ্বনির মৃত্যু নাই

                       আসোয়াদ লোদি

আমরা পেরিয়ে গেছি অমরাবতী,
আরো দূরে, তুষারের মুকুট পরে যে শৃঙ্গ
আকাশ ছোঁয়ার অহংকার পুষে ছিল মনে
আমরা অতিক্রম করেছি তাকেও।

তিরিশ লক্ষ রক্তের দায় কাঁধে নিয়ে অনিশ্চিত গন্তব্যে
আমরা সেই প্রার্থিত মাইলস্টোনের দেখা পেয়েছি।
সেই সব বিদেহী আত্মার অনলবর্ষী অভিসম্পাত হতে
অবশেষে শাপমুক্তি হয়েছে আমাদের।

এখন বাংলাদেশের ভূ-মানচিত্র পরিপূর্ণ এক রাখিবন্ধন
সেখানে ছিটমহল নামক পরাধীন যন্ত্রণা আর নেই।
যারা তোমাকে অতিক্রম করতে চেয়েছিল
হয়ত একদিন তারা বলবে-
কোন কোন স্ফুলিঙ্গ ধ্বনিকে অতিক্রম করতে পারে না;
কারণ স্ফুলিঙ্গের মৃত্যু হয়, ধ্বনি ইতারে ভেসে থাকে


 

 

      11805765_1120477394633755_309374938_n        বঙ্গপিতার লণ্ঠন

                                            মানিক বৈরাগী

আদি পিতা এসে আঁধারে লণ্ঠন জ্বালিয়েছে
ঘোর অমানিশায় যুগান্তরে মরু বুকে
এশিয়ার সর্ব প্রান্তরে

আমাদের দেশ উপমহাদেশে স্বাধিকার স্বাধীনতা আন্দোলনে
জাতিপিতা মুজিবের উদ্যত্ত তর্জনী দেখে
হিমালয় থেকে বহমান গঙ্গা-পদ্মা
স্বাধীন দেশে কালরাত পঁচাত্তরের পনের আগস্ট
রক্তের ধারায় নদীমাতৃক দেশটা লাল
বেদনার জ্বালা সহে অন্তরালে
টুঙ্গিপাড়ার লন্ঠন হাতে এগিয়ে আসেন
মৃত নয় অমৃত মুজিব কীর্তিমান পৌরুষে…

গনতন্ত্রে জনতাতন্ত্রের মহানায়ক জাতির জনক
বলে যায় বাংলা আমার ভাষা, আমি বাঙালি
দেশ আমার স্বাধীন বাংলাদেশ।


 

 11801971_1120477331300428_1118396228_n                 রক্তক্ষরণ

                                      নিধু ঋষি

 

কালক্রমে স্মৃতির পাণ্ডুলিপিতে পনের আগস্ট
গেঁথে আছে শোকের যন্ত্রণায়
স্মৃতিরা জেগে উঠলে ক্ষতবিক্ষত হৃদয়ে
রক্তক্ষরণ হয় আজও


 

         11797994_1120477011300460_850202405_nমুজিব তুমি

           আবদুল আলীম নোবলে

 

মুজিব তুমি হাজার বছরের হিমালয়
মুজিব তুমি বাঙালির প্রাণের প্রলয়
মুজিব তুমি জাতির আশার আলো
মুজিব তুমি মরেও অমর হলো
মুজিব তুমি কালো রাত্রীর অন্ধকার
মুজিব তুমি সকলের আমার তোমার
মুজিব তুমি বাঙালির লড়াই সংগ্রাম
মুজিব তুমি বিনম্র শ্রদ্ধা চির প্রণাম
মুজিব তুমি বাংলার বলিষ্ঠ কন্ঠস্বর
মুজিব তুমি সত্যের জাতিস্বর

 



ক্রোড়পত্র সম্পাদক :  কালাম আজাদ 



 

 


শেয়ার করুন