বিদেশী আদালতে বাংলাদেশী বিচারক নিয়োগ ও আমাদের প্রত্যাশা

ad-mohammad-shajahanমোহাম্মদ শাহজাহান, এডভোকেট :
এই প্রথম বারের মতো নেদারল্যান্ডসের হেগের পীস প্যালেসে অবস্থিত আন্তর্জাতিক স্থায়ী সালিশি আদালতের সদস্য পদ লাভ করেছেন বাংলাদেশী দুই বিচারপতি। এঁরা হলেন বাংলাদেশের সাবেক প্রধান বিচারপতি মো: তোফাজ্জল ইসলাম ও হাইকোর্ট বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মো: আওলাদ আলী। এদিকে ব্রিটেনেও প্রথম বারের মতো বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত এক নারী সার্কিট জজ হিসেবে নিয়োগ লাভ করেছেন। নানা সমস্যায় জর্জরিত এদেশের আইনাঙ্গানের হতাশাব্যঞ্জক চিত্রের বিপরীতে এটি সুখকর এক সুসংবাদই বটে।
বিচারপতি মো: তোফাজ্জল ইসলাম বাংলাদেশের প্রচার-বিমুখ ও অবিতর্কিত একজন সাবেক প্রধান বিচারপতি। তত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনের পরে ওই সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী সাবেক প্রধান বিচারপতিরা দুর্ভাগ্যজনকভাবে কোন না কোন বৃহৎ রাজনৈতিক দলের রোষানলের শিকার হয়েছেন। অনাকাংখিত সমালোচনার তোপের মুখে তাঁদের ভুমিকা নিয়ে বিতর্কও কম করা হয়নি। সেদিক থেকে আমাদের এই সাবেক প্রধান বিচারপতির ভাগ্য ভালোই বলতে হবে। প্রধান উপদেষ্টা হতে হয়নি বলে তিনি রাজনৈতিক দলের আক্রমণ থেকে নিরাপদ থাকতে ও নিজস্ব ভাবমূর্তি অক্ষুন্ন রাখতে পেরেছেন। তা না হলে আন্তর্জাতিক সালিশি আদালতে তাঁর নিয়োগ পাওয়া সম্ভব হতো কিনা সন্দেহ। বিখ্যাত পঞ্চম সংশোধনী মামলা ও বহুল আলোচিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যা মামলার বিচারের চুড়ান্ত রায়ের সময় সুপ্রীম কোর্টের প্রধান বিচারপতির দায়িত্বে ছিলেন তিনি। আন্তর্জাতিক সালিশি আদালতে নিয়োগ প্রাপ্ত অপর বিচারপতি মো: আওলাদ আলী বিরোধ নিষ্পত্তি বিষয়ে সবিশেষ পারদর্শী বলে জানা যায়। বিশেষত: হাইকোর্টের বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ প্রাপ্তির আগে আইনজীবী থাকাকালে বাণিজ্যিক বিরোধে দায়েরকৃত বহু মামলা সাফল্যের সঙ্গে পিরিচালনা করে নিষ্পত্তিতে সহায়তার সুনাম রয়েছে তাঁর। ১৮৯৯ সালে প্রতিষ্ঠিত ও বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে বিরাজমান বিবাদ-নিষ্পত্তিতে নিয়োজিত ১১৭ সদস্য-বিশিষ্ট এই আন্তর্জাতিক আদালতের অন্যতম সদস্য হিসেবে আগামী ৬ বছর যাবত দায়িত্ব পালন করবেন তাঁরা। প্রসঙ্গত: উল্লেখ্য, ২০১৪ সালে বাংলাদেশ ও ভারতের সমুদ্রসীমা বিরোধের বিচার ও নিষ্পত্তি এই আদালতেই সম্পন্ন হয়েছিলো।
ব্রিটেনের সার্কিট জজ হিসেবে সদ্য-নিযুক্ত স্বপ্নারা খাতুনের আদি নিবাস সিলেটের বিয়াণীবাজার উপজেলার মোল্লাপুর ইউনিয়নের মোল্লাগ্রামে। তিনি ওই গ্রামের নিম্বর আলীর কন্যা। বার-এট-ল ডিগ্রী অর্জনের পর লন্ডনের পারিবারিক আদালতে বিচারকের দায়িত্ব পালনের পরে যুক্তরাজ্যের সার্কিট জজ পদ অলংকৃত করতে যাচ্ছেন তিনি। সার্কিট জজের এই পদবী জেলা জজের উর্ধ্বে। ফলে ভবিষ্যতে পদোন্নতি সাপেক্ষে ওই দেশের হাইকোর্টেও নিয়োগ প্রাপ্তির সম্ভাবনা রয়েছে তাঁর।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্রে দাবী করা হয়েছে, আন্তর্জাতিক সালিশি আদালতে ওই দুজন বিচারপতির নিয়োগ বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশের অব্যাহত প্রচেষ্টারই অংশ। জাতিসংঘ শান্তি মিশনে আমাদের সেনাবাহিনীর ও পুলিশ বিভাগের চৌকষ সদস্যরা কাজ করে দেশের জন্যে সুনাম বয়ে এনেছেন।পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বসবাসকারী অসংখ্য বাংলাদেশী প্রবাসীর মতো জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে তাঁদেরও।
আন্তর্জাতিক আদালতে এই দুই বিচারপতির নিয়োগ লাভের মধ্য দিয়ে ভবিষ্যতে অদক্ষ, প্রশিক্ষণবিহীন জন-সম্পদ রপ্তানির পাশাপাশি বিভিন্ন সংস্থায় পদ-পদবী লাভ করে যথাযথ দায়িত্ব পালনে দেশের মুখ উজ্জ্বল করার সুযোগ উন্মুক্ত হলো বলে মনে করছেন অনেকে।
সুযোগ-সুবিধার অভাব, রাজনৈতিক দুর্বৃত্তপনা, সুশাসনের অনুপস্থিতি ইত্যাদি কারণে দেশের অভ্যন্তরে মেধাবীরা বিকশিত হবার বা দেশের উন্নয়নে অনুকূল ভুমিকা পালনের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হন। এ কারণেই দেখা যায়, বাংলাদেশের দুর্নীতির মচ্ছবে আকন্ঠ নিমজ্জিত পুলিশ বাহিনীর সদস্যরাও দেশের বাইরে সঠিক দায়িত্ব পালনে কৃতিত্বের সাক্ষর রাখেন। এখানে অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি পর্যাপ্ত বেতন-ভাতার একটি ইতিবাচক ভুমিকাও ক্রিয়াশীল নি:সন্দেহে।
বিশ্ব-শান্তি প্রতিষ্ঠার কাজে বাংলাদেশীদের নিয়োগ ও ভুমিকা পালনে সহায়তার পাশাপাশি সুশাসন প্রতিষ্ঠা করে দেশের অভ্যন্তরেও কাংখিত শান্তি ও সমৃদ্ধির বাতাবরণ তৈরিতে সরকার সচেষ্ট হবেন বলেই আমাদের প্রত্যাশা।
মোহাম্মদ শাহজাহান: এডভোকেট, জেলা ও দায়রা জজ আদালত, কক্সবাজার।


শেয়ার করুন