বিএনপির ভূমিকায় অসন্তুষ্ট ছিলেন কামারুজ্জামান ‘জামায়াতে অন্ধ আনুগত্য থাকায় সংস্কার বাস্তবায়িত হয়নি’

দ্য রিপোর্ট:  মানবতাবিরোধী অপরাধে ফাঁসির দণ্ডাদেশ কার্যকর হওয়া জামায়াতে ইসলামীর সিনিয়র সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামান দীর্ঘদিন দলের সংস্কারে কাজ করেছেন। বর্তমান সঙ্কট থেকে উত্তরণের জন্য যুদ্ধাপরাধীদের বাদ দিয়ে নতুন প্রজন্মের হাতে জামায়াতের নেতৃত্ব ছেড়ে দেওয়া এবং পেছন থেকে সংবিধানের আলোকে আরও একটি বিকল্প দল গঠনসহ বেশ কিছু পরামর্শ দিয়েছেন। অন্যান্য দলের চেয়ে জামায়াতে বেশি গণতন্ত্র থাকলেও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও কিছুটা অন্ধ আনুগত্যের কারণে কামারুজ্জামানের সংস্কার প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়িত হয়নি।কামারুজ্জমানের বড় ছেলে হাসান ইকবাল ওয়ামী তার বাবার রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনার নানা দিক নিয়ে রবিবার বিকেলে দ্য রিপোর্টের সঙ্গে ফোনে একান্ত আলাপকালে এ সব কথা বলেন।
তিনি বলেন, আব্বা বিশ্বাস করতেন দলে যারা নতুন প্রজন্ম আছেন তারা গতানুগতিক ধারা থেকে বেরিয়ে এসে পরিবেশ পরিস্থিতির আলোকে দলকে বাস্তবতার দিকে নিয়ে যাবেন।
এ ছাড়া মানবতাবিরোধী অপরাধে জামায়াতের শীর্ষ নেতারা গ্রেফতার হওয়ার পর বিএনপির ভূমিকা নিয়ে কামারুজ্জামান অসন্তুষ্ট ছিলেন বলে জানান হাসান ইকবাল ওয়ামী।

এর আগে ২০১০ সালে জেল থেকে জামায়াতের বর্তমান নেতৃত্বের উদ্দেশে লেখা একটি চিঠির আলোকে গত ৭ এপ্রিল ‘কামারুজ্জামান নতুন দল গড়ার সিদ্ধান্তে এখনও অটল’ শিরোনামে দ্য রিপোর্টে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়। এ প্রসঙ্গে ওয়ামী বলেন, গণমাধ্যমে যে চিঠি প্রকাশ হয়েছে তা আমাদের মাধ্যমে যায়নি। তবে চিঠিতে যা কিছু এসেছে তা ঠিকই আছে।
বেশকিছু প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন ওয়ামী। দ্য রিপোর্টের পাঠকদের জন্য সে সব প্রশ্নোত্তর তুলে ধরা হল—

জামায়াত নেতৃবৃন্দের কাছে কামারুজ্জামান মোট কয়টি চিঠি লিখেছেন?
উনি আমাদের মাধ্যম ছাড়াও বিভিন্নভাবে তাদের কাছে চিঠি পাঠিয়েছেন। শুধু জামায়াত নেতাদের কাছে নন, অন্যদের কাছেও। তাই সঠিকভাবে বলতে পারব না ঠিক কতটি চিঠি দিয়েছেন।

নেতাদের দৃষ্টিভঙ্গি আপনার বাবাকে কে জানিয়েছেন?
আমরা যখনই বাবার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছি, নেতৃবৃন্দের কথাগুলো শেয়ার করেছি।

তারা আপনার বাবার প্রস্তাবকে কীভাবে দেখেছেন?
গণমাধ্যমে প্রকাশিত চিঠিই যে প্রথম তা নয়। বাবা অনেক আগে থেকেই জামায়াতকে সংস্কারের জন্য চেষ্টা করছিলেন। চিঠি তো প্রকাশ হয়েছে ২০১০ সালে। তিনি এর অনেক আগে থেকেই চেষ্টা করছিলেন দলের সংস্কারে। ২০০১ সালে চারদলীয় জোট ক্ষমতায় আসার পর থেকেই তিনি দলের সংস্কারে বিভিন্ন প্রস্তাব দিয়ে আসছিলেন। তার প্রস্তাব নিয়ে সংগঠনে দুই রকম চিন্তা করা হয়েছিল। অনেকেই ভালভাবে নেয়নি। কেউ মনে করেছেন যে তিনি হয়তো দল ভাঙার জন্য এ সব বলছেন বা করছেন। আবার যারা নতুন প্রজন্মের তারা কিন্তু এটাকে পজিটিভ হিসেবে নিয়েছে। তারা মনে করেছেন— আব্বা যে সব প্রস্তাব দিয়েছেন তা ফলো করলে উদ্দেশ্য সফল হবে, ভাল হবে। এই রকম মিশ্র প্রতিক্রিয়া আছে। এটা যে ভাঙনের জন্য তিনি করেননি তা তিনি চিঠিতে স্পষ্টভাবে বলেছেন। যদি তাই হতো তাহলে তিনি নিজেই উদ্যোগ নিয়ে দল বানাতেন। দল যদি ভাঙতেই চাইতেন তাহলে তো ১/১১-এর সময় জামায়াত থেকে নেতাকর্মী নিয়ে নতুন দল করতে পারতেন, করেননি। আব্বু কিন্তু বলেছেন, জামায়াতকে সিদ্ধান্ত নিয়ে পিছন থেকে একটি দল বানাতে হবে। এটা তো ভাঙন না, এটা কৌশলগত। যেমনটি মিসরে মুসলিম ব্রাদারহুড বা তুরস্কে হয়েছে। কিন্তু অনেকেরই তো বর্তমান বিশ্ব রাজনীতি-পরিস্থিতির সাথে জানা-শোনা নেই, পরিচিত না। তারা মনে করেছেন এটা মনে হয় দল ভাঙার চেষ্টা।
তবে আব্বা সংগঠনের প্রতিক্রিয়ায় আক্ষেপ প্রকাশ করেননি। কারণ ওই সময় থেকে বর্তমানে জামায়াত যে চাপের মধ্যে আছে, এ অবস্থায় তার প্ল্যানগুলো বাস্তবায়ন হয়তো সম্ভব না। গণতান্ত্রিক বা সুস্থ রাজনৈতিক পরিস্থিতি আসলে হয়তো জামায়াত নেতৃবৃন্দ তার প্ল্যানগুলো বাস্তবায়ন করবেন।

সর্বশেষ দলের ক্রান্তিকালে তার কোনো পরামর্শ ছিল কী।
উনি দলের বতর্মান ক্রান্তিকালে নেতাকর্মীদের ধর্য ধরার কথা বলেছেন। বর্তমান বাংলাদেশে ‘ইসলামী আন্দোলনকে’ তিনি প্রসব বেদনার সঙ্গে তুলনা করেছেন। এই বেদনা শেষ হওয়ার পর যে ফল আসবে, কর্মীরা তার সুফল ভোগ করতে পারবে।

তিনি কী শুধু দলের পিছনে আরও একটি দল গড়ার চিন্তাই করেছিলেন?
শুধু তা নয়, যে সব নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ আছে, তারা সবাই নিজ পদ থেকে অবসর যাতে নেন, দলে এ্যাক্টিভ অন্যরা থাকবেন। যেমন গোলাম আযম সাহেব সাধারণ রোকন হিসেবে ছিলেন। আব্বা চেয়েছিলেন, তিনিসহ শীর্ষ নেতারা পদ ছেড়ে দিয়ে সাধারণ রোকন হয়ে থাকবেন। নতুন নেতৃত্বের (প্রজম্ম) হাতে দায়িত্ব ছেড়ে দিতে চেয়েছিলেন। তাহলে ব্যক্তি হিসেবে কাউকে কাউকে দোষী বানানো গেলেও দল হিসেবে জামায়াতকে দোষী বানানো কঠিন হতো।
এখন নতুন প্রজন্ম বিশেষ করে ছাত্রশিবির তো তাদের দাওয়াতি কাজ করতে গিয়ে নানা প্রশ্নের সম্মুখীন হন যে, তোমার দল তো যুদ্ধাপরাধী দল। ১৯৭১ সালে তারা (জামায়াতের শীর্ষ নেতারা) কোনো অপরাধের সঙ্গে জড়িত না হলেও পাকিস্তানের অখণ্ডতা চেয়েছেন। তারা ভেবেছিলেন মুসলিম দেশ হিসেবে পাকিস্তান ঐক্যবদ্ধ থাক। যদি নতুন নামে কোনো দল হয় বা জামায়াতের নেতৃত্ব নতুন প্রজন্মের হাতে থাকে তাহলে হয়তো এটা বলা যাবে না যে এটা যুদ্ধাপরাধীদের দল, পাকিস্তানপন্থী দল। ইসলামী আন্দোলন এগিয়ে যেত।
বর্তমান নেতৃত্বের অধিকাংশই তরুণ, যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ নেই, তারা কেন সংস্কারের পক্ষে যাচ্ছে না?
এর কারণ হল, জামায়াত তো আমলাতান্ত্রিক দল। নেতৃত্বের যে চেইন অব কমান্ড আছে, নেতৃত্বের বিভিন্ন পর্যায়ে যারা আছেন, তারা যদি না সরেন তাহলে ভাঙা খু্বই কঠিন, অসম্ভবই বলা যায়। গোলাম আযম সাহেবের বিরুদ্ধে যতই যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ থাকুক, তার সমর্থকরাই পরবর্তী সময়ে কিন্তু জামায়াতের কর্তৃত্বে এসেছেন। উনার বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের নানা অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও দলীয় পদ থেকে সরানো যায়নি। নেতৃত্বের প্রতি আনুগত্য এবং আমলাতান্ত্রিক দল হওয়ার কারণেই এটা সম্ভব হয়নি।
জামায়াত অন্যান্য রাজনৈতিক দলের চেয়ে অবশ্যই বেশি গণতান্ত্রিক দল। তবে দেখা যায় বৈঠকে বড় নেতা যে কথা বলছেন অন্যরা কোনো রকম চিন্তা-ভাবনা না করেই তার মতের সঙ্গে একমত পোষণ করেন। বলা চলে কিছুটা অন্ধ আনুগত্যও আছে। এ জন্য নেতৃত্বের পরিবর্তন আনা কঠিন।
আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি এবং আব্বা বিশ্বাস করতেন নতুন প্রজন্ম যারা আসবেন তারা অনেকেই চিন্তাশীল। নিজের চিন্তা-ভাবনা করার ক্ষমতা আছে তাদের।

আপনার বাবার সাথে এ সব বিষয় নিয়ে কখনো আলোচনা হয়েছে? কারাগারে যাওয়ার পরে নাকি আগেও?
কারাগারে যাওয়ার আগেও হয়েছে। ২০০১ সালের নির্বাচনের পরে তিনি নতুন আঙ্গিকে দলের সংস্কার করতে শুরু করেছিলেন।
বিএনপির সঙ্গে জোটে থাকা না থাকা নিয়ে আপনার বাবা কোনো মতামত দিয়েছেন কিনা?
জোটে থাকা নিয়ে তিনি কিছু বলেননি। কিন্তু বিএনপি যে এ্যাক্টিভভাবে জামায়াতের পক্ষে কথা বলেনি এ নিয়ে বাবা সমালোচনা করেছেন। আমরা কিংবা বাবা এটা চাইনি যে, তারা বলুক বিচার মানি না। বিচারটা যে ‘ত্রুটিপূর্ণ’ হয়েছে, এটাই তারা সব জায়গায় বলতো। কিন্তু জোরালভাবে বলেনি তারা। শুরুর দিকে বেগম খালেদা জিয়াসহ বিএনপির কয়েকজন নেতা এ বিষয়ে কথা বললেও পরবর্তী সময়ে কারা কী বুদ্ধি দিয়েছে জানি না। তারা চুপচাপ থেকেছেন।
বিচারটা যে ‘ত্রুটিপূর্ণ’ তা কিন্তু জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলে আসছে। এই কথাটাও তো তারা বলতে পারতো। তারা দাবি করতে পারতো আমরা সুষ্ঠু বিচার চাই। বিচারের নামে প্রহসন চাই না। কিন্তু বিষয়টা নিয়ে তারা এড়িয়ে গেছে। এটা নিয়ে তার অসন্তোষ ছিল। এ নিয়ে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ কয়েকজনকে তিনি চিঠিও দিয়েছেন।

ব্যারিস্টার রাজ্জাকসহ কেউ কেউ তো আপনার বাবার প্রস্তাবের সমর্থনও দিয়েছিলেন?
হ্যাঁ, তবে সরাসরি কাউকে এভাবে আলাদা করতে চাই না। অনেকেই বাবার প্ল্যানের সাথে সহমত পোষণ করেছেন।

বর্তমানে যে সব শীর্ষ তরুণ নেতৃত্বে আছেন, যারা দল চালাচ্ছেন, তাদের কাছেও কি আপনার বাবা চিঠি দিয়েছেন?
হ্যাঁ, অনেকের কাছেই তিনি চিঠি দিয়েছেন।

তাদের দৃষ্টিভঙ্গি কী।
তাদের দৃষ্টিভঙ্গি তো আর আমার বলে দেওয়া ঠিক হবে না। আব্বা নতুন প্রজন্মের নেতৃবৃন্দের প্রতি আস্থাশীল। তিনি মনে করতেন যে, নতুন প্রজন্মের নেতৃবৃন্দ নিজের থেকেই চিন্তা করতে পারবে গতানুগতিক ধারা থেকে বাইরে এসে বাস্তবতার আলোকে সিদ্ধান্ত নেবে। এ বিশ্বাস তাদের প্রতি আব্বার ছিল।

আপনি আপনার বাবার রাজনীতিতে আসবেন কিনা?
না, ব্যক্তিগতভাবে আমার রাজনীতি করার ইচ্ছে নেই।
মানবতাবিরোধী মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত মুহাম্মদ কামারুজ্জামানকে শনিবার রাত ১০টা ৩০ মিনিটে ফাঁসি দেওয়া হয়। রবিবার ভোরে তাকে শেরপুরে নিজ গ্রামে দাফন করা হয়। কামারুজ্জামানের পাঁচ ছেলে ও এক মেয়ের মধ্যে হাসান ইকবাল সবার বড়। রাজধানীর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স-মাস্টার্স সম্পন্ন করার পর তার মামার সঙ্গে একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করছেন। তার অপর চার ভাইয়ের মধ্যে দুইজন দেশে এবং একজন সুইডেনে ও একজন মালয়েশিয়ায় রয়েছেন।


শেয়ার করুন