বিএনপির বিপদ বিশেষ ক্ষমতা আইন

bus-fire-বাসে-আগুনবাংলামেইল: 

দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঠেকাতে ও পরে সরকার পতনের উদ্দেশ্য নিয়ে দুই দফা আন্দোলন করেছে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট। দুই আন্দোলনই পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। দুই দফায় আন্দোলনে চরম সহিংসতার প্রেক্ষাপটে এই জোটের, বিশেষ করে বিএনপির কেন্দ্রীয় থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যন্ত প্রতিটি পর্যায়ের নেতাকর্মীরাই জর্জরিত হয়েছেন মামলা-মোকদ্দমায়। যদিও বিএনপির দাবি সহিংসতার ঘটনার সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্ক ছিল না।

দাবি আদায়ে বিএনপি হরতাল-অবরোধের পথ বেছে নেয়ার পর এবং ওইসব কর্মসূচি চলাকালে হামলা ও নাশকতার অভিযোগে বিশেষ ক্ষমতা আইনে যে মামলাগুলো হয়েছে মূলত সেই মামলাগুলোতেই ফেঁসে যাচ্ছেন দলটির নেতাকর্মীরা। কারণ, হামলা-নাশকতার অভিযোগে অন্য সব আইনের মামলায় আসামির জামিন মিললেও বিশেষ ক্ষমতা আইনে জামিন ব্যবস্থা খুব কঠিন করা হয়েছে। আর এ আইনে দায়ের করা মামলায় অভিযোগ প্রমাণিত হলে আসামিকে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডেও দণ্ডিত করতে পারেন আদালত। ফলে এই আইনে দায়ের হওয়া মামলাগুলোর আসামিরা আইনি লড়াই না চালিয়ে পালিয়ে বাঁচার পথ খুঁজছেন।

১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে বলা আছে, সরকারি-বেসরকারি যেকোন ধরনের গাড়ি, স্থাপনা, রাস্তাঘাট ইত্যাদির ওপর হামলা অথবা নাশকতা কিংবা অন্তর্ঘাতমূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে কোনো ব্যক্তি জড়িত থাকলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বিরুদ্ধে এই আইনে মামলা দায়ের করা যাবে। আর এই আইনের ১৫ ধারার ৩ উপধারা অনুসারে, অপরাধ প্রমাণিত হলে আদালত অভিযুক্ত ব্যক্তিকে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড কিংবা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করতে পারবেন।

বিশেষ ক্ষমতা আইনটি আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ১৯৭৪ সালে করা হয়েছিল। এই আইনকে দেশের বুদ্ধিজীবী সমাজ ‘কালো আইন’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। কেননা এই আইনে কোনো অভিযোগ ছাড়াই মানুষকে আটকে রাখার বিধান রয়েছে; যা কি না বিচার ব্যবস্থাকে বিভিন্ন সময় প্রশ্নের সম্মুখীন করে থাকে।

ক্ষমতার পালাবদলে এই আইনটি সরকার কর্তৃক বিরোধীদলকে নাজেহাল করার সর্বোচ্চ ‘আইনি হাতিয়ার’ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে এসেছে। আওয়ামী সরকার আইনটির প্রণয়ন করলেও বিএনপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর এই আইনে তাদের নিজেদেরই নাজেহাল হতে হয়েছে। অর্থাৎ বিএনপি সরকারও আইনটির ব্যবহার-অপব্যবহার দুই-ই করে গেছে। এসবের ধারাবাহিকতায় বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী সরকার আগের দেখানো পথ অনুসারে বিএনপিকে চাপে রাখতেই আইনটির ব্যবহার করছে। এই আইনটিকে ‘গণতন্ত্র দমনের হাতিয়ার’ বলে উল্লেখ করেছেন সুপ্রিমকোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন।

বিএনপিপন্থি আইনজীবীদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য মতে, বিগত আড়াই বছরে সারা দেশে বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে সহিংসতার অভিযোগে বিশেষ ক্ষমতা আইনসহ বিভিন্ন আইনে ১৫ হাজারের বেশি মামলা করা হয়েছে। এরমধ্যে কেবল ঢাকাতেই হয়েছে সাড়ে ৪ হাজার মামলা। যার বেশকটিতে আসামি হয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া, সিনিয়র ভাইস-চেয়ারম্যান তারেক রহমান, ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, রুহুল কবির রিজভী, বরকতউল্লাহ বুলু, সালাহ উদ্দিন আহমেদসহ বিএনপির বিপুলসংখ্যক কেন্দ্রীয় নেতা।

২০১৩ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৪ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ঢাকা মহানগরে ৬৫৯টি মামলায় আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয় পুলিশ। আর ২০১৪ সালের ১ জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের ৩০ মে পর্যন্ত বিশেষ ক্ষমতা আইনসহ অন্য আইনের মামলায় কমপক্ষে এক হাজার ৫০০টি অভিযোগত্র আদালতে জমা দিয়েছে পুলিশ। এর মধ্যে গত ৮ মাসেই ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে খালেদা জিয়াসহ বিএনপির ১১শ নেতাকর্মীর নামে বিশেষ ক্ষমতা আইনসহ শতাধিক মামলায় অভিযোগপত্র জমা দেয়া হয়েছে। তবে এসব অভিযোগপত্র ভিত্তিহীন এবং ক্ষমতার জোর দিয়ে সাজানো হচ্ছে বলে বিএনপির আইনজীবীদের অভিযোগ।

পুলিশের বর্ণনা আর বিএনপি আইনজীবীদের দেয়া তথ্য মতে, বর্তমানে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে বিশেষ ক্ষমতা আইনেসহ অন্য আইনে অন্তত ১৩টি মামলার বিচার চলছে। তার ছেলে তারেক রহমানের বিরুদ্ধে ৭৬টি, ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বিরুদ্ধে ৭৮টি, যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর বিরুদ্ধে ৪৪টি, বরকতউল্লাহ বুলুর বিরুদ্ধে ৫০টি এবং সালাউদ্দিন আহমেদের বিরুদ্ধে অন্তত ২৭টি মামলার বিচার প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।

যাত্রাবাড়ীতে বাসে আগুন দিয়ে মানুষ হত্যা মামলায় গত ৬ মে খালেদাসহ ৩৮ জনের বিরুদ্ধে পৃথক তিনটি অভিযোগপত্র দিয়েছে ডিবি পুলিশ। আবার ২০ মে বিশেষ ক্ষমতা আইনের আরেকটি মামলাতে খালেদাসহ ৩৮ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয়া হয়।

গেল জানুয়ারিতে বিএনপির যুগ্ম-মহাসচিব আমানউল্লাহ আমান, অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী ও চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা শামসুজ্জামান দুদুসহ কমপক্ষে ৬শ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে বিশেষ ক্ষমতা আইনে ৩৩টি মামলা হয়। এছাড়াও মওদুদ আহমদের বিরুদ্ধে ১৪টি, খালেদা জিয়ার বিশেষ সহকারী অ্যাড. শিমুল বিশ্বাসের নামে ৪৭টি, বিএনপির সহ-সভাপতি সাদেক হোসেন খোকার বিরুদ্ধে ১৪টি, বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা শামসুজ্জামান দুদুর বিরুদ্ধে ১৭টি, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) হান্নান শাহর বিরুদ্ধে আটটি, আবদুল আউয়াল মিন্টুর বিরুদ্ধে পাঁচটিসহ দলটির কেন্দ্রীয় ও পদস্থ প্রায় সব নেতাকর্মীর নামে লক্ষাধিক মামলা দায়ের ও তার বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।

বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও সুপ্রিমকোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন বাংলামেইলকে বলেন, ‘বিশেষ ক্ষমতা আইন কীভাবে কার্যকর হবে সে বিষয়েও আইনগত দ্বিমত রয়েছে। যা আমরা পরবর্তী পর্যায়ে (ক্ষমতায় এলে) খতিয়ে দেখবো। বিএনপি একটি গণতান্ত্রিক দল। সরকার যদি চায় এই গণতান্ত্রিক শক্তিকে মামলা-মোকদ্দমা, হামলা করে বিচ্ছিন্ন করে দেবে তবে দেশে অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সৃষ্টি হবে। যা বাংলাদেশের জন্য খুবই ভয়াবহ অবস্থা হবে বলে আমি মনে করি। বিশেষ ক্ষমতা আইনে দ্রুত বিচার করে বিএনপিকে দামন-পীড়ন করতে প্রবল ইচ্ছা-বাসনা সরকারের আছে।’

খন্দকার মাহবুব হোসেন মনে করছেন, সরকারের এখনকার ভাবমূর্তি হচ্ছে জিয়া অরফানেজ ট্রাষ্ট ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাষ্ট মামলায় দ্রুত বিচার শেষ করে খন্দকার মাহবুব হোসেনখালেদা জিয়াকে জনসমক্ষে হেয়-প্রতিপন্ন করতে সাজা দেয়া। এভাবে দেশে একদলীয় শাসন ব্যবস্থার প্রচলন করা। এতে বহির্বিশ্বে সরকারের মানসম্মান ক্ষুণ্ণ হবে, দেশের জনগণ বিক্ষুব্ধ হয়ে পড়বে এবং দেশ একটি গণআন্দোলনের দিকে ধাবিত হবে।

বিএনপি চেয়ারপারসনের এই উপদেষ্টা বলেন, ‘বিশেষ ক্ষমতা আইন একটি কালো আইন। সরকার বদলালেই এটি তখনকার বিরোধীদলের জন্য অশুভ হয়ে উঠবে।’

তবে এই আইনকে কালো আইন মানতে নারাজ ঢাকা মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) আব্দুল্লাহ আবু। তিনি বলেন, ‘বিশেষ ক্ষমতা আইন কোনো কালো আইন নয়। এর কোনো ধারার পরিমার্জন বা পরিবর্ধন প্রয়োজন আছে বলেও মনে করি না।’

তিনি আরো বলেন, ‘কখনোই এই আইন বিরোধীদলকে হয়রানি করার জন্য ব্যবহার করা হয় না। নাশকতার অভিযোগের বিচারে এই আইনের ধারা-উপধারা ঠিকই আছে। দেশে বোমাবাজি, ভাঙচুর, পেট্রোল বোমায় মানুষ হত্যাসহ বিএনপির সকল অপরাধ দৃশ্যমান। তাই নাশকতার অভিযোগ এনে এই আইনে বিএনপির বিরুদ্ধে যে মামলাগুলো করা হয়েছে তা প্রতিহিংসা পরায়ণ বা তাদের দমন-পীড়নের জন্য নয়। প্রকৃত অভিযোগের উপর নির্ভর করেই তাদের বিরুদ্ধে মামলাগুলো করা হয়েছে।’


শেয়ার করুন