বার্ডস আই: হায়রে অভাগা মুসলমান

mahfuzমাহ্ফুজুল হক

(২য় কিস্তি)

আজ পৃথিবীর যেদিকে রক্তপাত তার প্রায় সবক’টিই কোন না কোন মুসলিম জনগোষ্ঠীর রক্ত এবং বেজে চলা যুদ্ধের দামামা তা-ও মুসলিমের বিরুদ্ধে। এশিয়া, আফ্রিকা, ইউরোপ তিনটি মহাদেশব্যাপী চলছে মুসলিমদের রক্ত নিয়ে হোলি খেলা। চলছে মুসলিম নিধন। ভিন্ন নামে, বিভিন্ন দেশে এই ব্যাপক মুসলিম নিধনযজ্ঞ চললেও সর্বত্রই ওই মুসলমানরা সন্ত্রাসী, জঙ্গী নামে নিন্দিত হচ্ছেন। অর্থাৎ তারা মারও খেয়ে চলেছেন আবার সমানে বদনামও বয়ে বেড়াচ্ছেন। আসুন, আমরা ঘটনার মূলে গিয়ে দেখি আসলেই কী ঘটছে, কেন ঘটছে, কে ঘটাচ্ছে।
গণচীনের সর্ববৃহৎ প্রদেশ শিনঝিয়াং বা উইঘুরিস্তান বা তুর্কমেনিস্তান। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় এই রাজ্যের ৮০ শতাংশ চরম ভাগ্যাহত চৈনিক চেহারার তামাটে বর্ণের মানুষগুলো উইঘুর সুন্নি মুসলমান। তাঁদের সংখ্যা এক থেকে দেড় কোটি। ওয়ার্ল্ড উইঘুর কংগ্রেস বলছে, ওই এলাকায় বাস করা উইঘুরদের রয়েছে চার হাজার বছরের ইতিহাস। তাঁরা ওই এলাকার আদি বাসিন্দা হলেও চীনারা সরকারিভাবে স্বীকার করে যে, উইঘুররা সেখানে এসেছেন ৯ম শতকে। খ্রীস্টীয় ১০ম শতকে এঁরা ইসলাম গ্রহন করেন। ইতিহাস খ্যাত তুঘলক তৈমুর খান (লঙ) ১৪০০ শতকে ইসলাম গ্রহন করেন। তাঁর ছেলে খিজর খোজা তুরফান জয় করেন। ১৬০০ শতকে প্রায় পুরো উইঘুর জনগোষ্ঠী মুসলমান হয়ে যান। রাজ্য জয় ও ইসলাম প্রচারে শাহগাতাই খান মনসুর বিশেষ ভূমিকা রাখেন। ১৪০০-১৭০০ শতকে কাশগড়, তারিম বেসিন, তুরফান এলাকা তুঘলক ও খোজাদের নিয়ন্ত্রনে চলে আসে। এঁদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও বন্ধন পুরোপুরি মধ্য এশিয় মুসলিম দেশগুলোর সাথে। চীনাদের সাথে যার সামান্যতম মিলও নেই। এখানকার অর্থনীতি কৃষি ও ব্যবসা কেন্দ্রিক। বিখ্যাত ‘সিল্ক রোড’ ঐতিহাসিক নগরী কাশগড়’কে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছিলো। উইঘুরিস্তানের পার্শ্ববর্তী মধ্য এশিয়ার প্রায় সকল দেশ মুসলিম এবং স্বাধীন। একদা এরা সবাই কম্যুনিস্ট সোভিয়েত ইউনিয়নের করায়ত্ব ছিলো। ১৯৯০ সনে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাবার পর এরা স্বাধীনতা লাভ করে। শিনঝিয়াংয়েও স্বাধীনতার জোরালো দাবী ওঠে। কিন্তু কম্যুনিস্ট শাসিত চীনের নাগপাশ থেকে মুক্তি পায়নি মুক্তিপাগল উইঘুর মুসলমানেরা। তারা এখন চীনাদের বর্বর নির্যাতন ও নিগ্রহের শিকার। পার্শ্ববর্তী বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী হান সম্প্রদায়ের লোকজনকে শিনঝিয়াংয়ে ব্যাপক হারে ঢুকিয়ে দিয়ে উইঘুরদের ঘরেই তাঁদের সংখ্যালঘু করে জবরদস্তি শাসন চালাতে চায় চৈনিকরা। হান সম্প্রদায়ের লোকদের শিনঝিয়াং এর বড় বড় পদে চাকুরি দিয়ে ও বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দিয়ে প্রতিষ্ঠিত করা হচ্ছে। সেনাবাহিনী ও নিরাপত্তা রক্ষিদের বিশাল বাহিনী এবং অপরিচিত অভিবাসীদেরও ব্যাপক হারে এতদাঞ্চলে বসতি গড়ে দিয়ে মুসলমানদের সংখ্যালঘু শ্রেণিতে পরিণত করা হচ্ছে। ২০০০ সালের আদম শুমারি অনুযায়ী সেখানে হান সম্প্রদায়ের লোকসংখ্যা ৪০ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। উইঘুরদের সাথে হানদের প্রায় নিয়মিত ও পরিকল্পিত দাঙ্গা বাঁধিয়ে অতঃপর হানদের সাথে মিলে চীনা বাহিনী মুসলিমদের খুন করছে, দেশান্তরী হতে বাধ্য করছে। চীনাদের মুসলমান দমন-পীড়ন অত্যন্ত নৃশংস ও চরম মানবতা বিরুদ্ধ। শিনঝিয়াং -এ মুসলমানদের অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রম কমিয়ে দেয়া হচ্ছে, সন্তানদের মুসলিম নামকরণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে, কর্মকর্তা-কর্মচারিদের পবিত্র রমযান মাসের রোযা পালনে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে, গুটিকয়েক সরকার নিয়ন্ত্রিত মসজিদ ও মাদ্রাসা বাদে বাদবাকিগুলোতে সকল ধরণের তৎপরতা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। প্রতিবাদী সমাবেশ-মিছিল দেখামাত্রই নির্বিচারে গুলি চালানো হয়। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এর ২০১৩ সনের এক রিপোর্টে দেখা যায়, শিনঝিয়াং -এ ধর্র্মীয় ও বিচ্ছিন্নতাবাদী কর্মকান্ডকে ‘অপরাধ’ বলে ঘোষণা করা হয়েছে। সরকারের উদ্যোগে দাঙ্গা-হাঙ্গামা বাঁধানো, তাতে মুসলমান বিরোধি পক্ষকে সমর্থন দান করতঃ প্রকাশ্যে গুলি করে মুসলমান হত্যা, লাশ গুম, ব্যাপক হারে ও নিয়মিত এবং হঠাৎ পরিচালিত ক্র্যাক-ডাউন চালিয়ে গণ-গ্রেফতার, বন্দিদের উপর নৃশংস নির্যাতন, নির্যাতনের ভয়ে পালিয়ে বেড়ানো লোকজনের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত ইত্যাদি যাবতীয় পন্থায় সেখানে মুসলমানদের উপর দমন-পীড়ন চলছে। ‘ইয়ার লং ক্যাম্পেইন এগেইন্সট টেররিজম’ নামীয় সেনাবাহিনী ও নিরাপত্তা বাহিনীর বিশাল বহর নিয়ে স্বাধীনতাকামীদের উপর সাঁড়াশি ও ভীতিকর অভিযান চালানো হয়। ‘জনগন কর্তৃক চরমপন্থীদের মৃত্যুদন্ড দান’ জাতীয় সংবাদও রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত সংবাদ মাধ্যমে প্রচার হতে শোনা যায়। ভিতরের খবর যাতে প্রকাশ না পায় সে লক্ষ্যে বিদেশি সকল সাংবাদিক ও সংবাদ মাধ্যমের উপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে রাখা হয়েছে। এরপরও ছিটেফোঁটা যা খবর জানা যায় তাতে দেখা যায়, ২০১৩-১৪ সময়েই রাজধানী উরুমকি, তুরফান, কাশগড়, হোতান, আকসু প্রভৃতি স্থানে সাত শতাধিক মানুষকে হত্যা করা হয়েছে।
মালয়েশিয় সীমান্ত সংলগ্ন মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চল দক্ষিণ থাইল্যান্ডের পাত্তানি। এখানে বসবাস আর একটি ভাগ্যাহত মুসলিম জনগোষ্ঠীর। ১৯০০ শতকে এখানে ‘পাত্তানি কিংডম’ প্রতিষ্ঠিত ছিলো যার নেতৃত্ব দিতেন স্বাধীন সুলতানরা। ১৯০৯ সালে এ্যাংলো-সিরামিজ ট্রিটির অধীনে অত্র এলাকায় থাই সিভিল ল স্থগিত ছিলো এবং মুসলিম ল কায়েম ছিলো। কিন্তু ১৯৩৪ সনে মার্শাল প্লিক ফিবানসংক্রম মুসলমানদের কর্তৃত্ব খতম করে পাত্তানিকে থাইকরণ (থাইফিকেশন) করেন। তিনি ইসলামি আইন ও প্রশাসনের ইসলামি ব্যবস্থা বাতিল, স্কুলের কারিকুলাম সংশোধন করে থাইকেন্দ্রিক শিক্ষা পদ্ধতি প্রবর্তন, থাই ভাষা চালু এবং ঐতিহ্যবাহী মুসলিম কোর্ট বাতিল করেন। বৌদ্ধ কালচার নৃতাত্ত্বিক মালয়-পাত্তানি মুসলমানদের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়। ১৯৪৭ সনে হাজী সুলঙ ‘পাত্তানি পিপল্স মুভমেন্ট’ প্রতিষ্ঠা করে মুসলমানদের স্বশাসন, সাংস্কৃতিক অধিকার এবং ইসলামি শরিয়াহ আইন প্রতিষ্ঠার দাবীতে আন্দোলন শুরু করেন। ১৯৪৮ সনের জানুয়ারীতে থাই সরকার তাঁকে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ আখ্যা দিয়ে গ্রেফতার করে। ১৯৫২ সনে তিনি মুক্তি লাভ করেন। কিন্তু ১৯৫৪ সনে তিনি রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হয়ে যান। তাঁর অবর্তমানে কিন্তু মুসলমানদের অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন থেমে যায়নি। ১৯৫৯ সনে টেংকু জালাল নাসির ‘পাত্তানি ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট’ প্রতিষ্ঠা করে পাত্তানির স্বাধীনতার দাবীতে জোরদার আন্দোলন অব্যাহত রাখেন। ২০১১ সনে পাত্তানি গেরিলা গ্রুপ তাঁদের তৎপরতা বেগবান করে। বর্তমানে মুসলিম জনসংখ্যা অধ্যুষিত এই অঞ্চলটি বৃহত্তর থাইল্যান্ডের সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধ জনগোষ্ঠী কর্তৃক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শোষণ আর বঞ্চণার শিকার। মুসলমানেরা এই বঞ্চণা ও নির্যাতন থেকে মুক্তি পেতে চায়। বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ সরকারের ‘জিহাদী’ দমন-পীড়নের ফলশ্রুতিতে ছয় সহ¯্রাধিক মুসলমান নিহত এবং দশ হাজারেরও অধিক মানুষ আহত হয়েছেন। নিজ দেশে স্বীয় ঈমান আকিদা নিয়ে বেঁচে থাকার অধিকার চান বলেই আজ পাত্তানি মুসলমান জনগোষ্ঠী সন্ত্রাসী, জিহাদী।
পৃথিবীর অপর একটি নিপীড়িত জনগোষ্ঠী হচ্ছেন কুর্দী মুসলমান। সম্মিলিত ইউরোপীয় খ্রীস্টানদের পরিচালিত ক্রুসেডের কাহিনীর কথা নিশ্চয়ই বিদগ্ধ পাঠকের মনে থাকার কথা। এবং আরো বিশেষভাবে মনে থাকার কথা বীর সেনাপতি সালাহউদ্দীন আইয়ুবী’র কথা যাঁর সুদক্ষ নেতৃত্বে খ্রীস্টান বাহিনী পরাজয় বরণ করে ফিলিস্তিন থেকে পাততাড়ি গুটাতে বাধ্য হয়। সেই মহাবীর সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর কুর্দী বংশধরদের কথাই বলছি। কয়লা, কপার, স্বর্ণ, লোহা, লাইমস্টোন, মার্বেল, জিংক এবং পৃথিবীর সর্ববৃহৎ রক সালফার ও ষষ্ঠ বৃহৎ পেট্রোলিয়ামের মজুত সম্বলিত খনিজ সম্পদে ভরপুর এই কুর্দিস্তান। বর্তমান তুরস্ক, সিরিয়া, ইরান ও ইরাকে বিভক্ত হয়ে পড়া কুর্দীরা স্বদেশভূমি কুর্দিস্তান প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করছেন কয়েক শতাব্দীকাল ধরে। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস হচ্ছে, কথিত মুসলমানের দ্বারা মুসলমান নিধন ও নির্যাতন। কুর্দিস্তান, নাইজেরিয়া, শাদ, মিসর, লিবিয়া, আলজেরিয়া, ইয়েমেন, ইরাক, সিরিয়া, আফগানিস্তান, পাকিস্তান প্রভৃতি দেশ ও অঞ্চলে মুসলমানের হাতেই মুসলমান হতাহত হচ্ছেন। দেশবিহীন কুর্দিরা নিজ দেশেও উদ্বাস্তুর জীবন যাপন করছেন। ৩৯২,০০০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এক বিরাট অঞ্চলের জনগোষ্ঠী হওয়া সত্ত্বেও তাঁরা তুর্কি, সিরীয়, ইরানী ও ইরাকিদের দয়ার উপর নির্ভরশীল। বিশ্বযুদ্ধে ওসমানিয়া সা¤্রাজ্যের (অটোমান) পতনের পর কুর্দিরা ‘কিংডম অব কুর্দিস্তান’ নামে সেপ্টেম্বর ১৯২২ থেকে জুলাই ১৯২৪ পর্যন্ত সময়ে একটি সেমি স্বাধীন দেশ গঠনে সক্ষম হয়েছিলো। ঠান্ডা আবহাওয়ার পাহাড়ি এই দেশের প্রায় ৩৭ মিলিয়ন কুর্দী স্বাধীকারের লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। কুর্দিরা তুরস্কে তার্কিশ কুর্দিস্তান, ইরানে ইরানিয়ান কুর্দিস্তান বা মাহাবাদ, ইরাকে ইরাকি কুর্দিস্তান এবং সিরিয়ায় রোজাভা নামীয় স্বীয় স্বাধীন দেশের জন্য লড়ে চলেছেন। স্বাধীকার ইস্যুতে ইরাকে দুই দুইটি ব্যাপক ভিত্তিক ইরাক-কুর্দি যুদ্ধ সংঘটিত হয় যাতে কম করে হলেও তিন লক্ষাধিক মানুষ হতাহত হন। তুরস্কে তুর্কি বাহিনীর সাথে কুর্দি ‘পিকেকে’ এর লড়াই এখন নিত্য নৈমিত্তিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এতে ১৯৮৪-২০০৮ সময়ে ৩২ হাজার মানুষ নিহত, লক্ষাধিক মানুষ আহত এবং দশ লক্ষেরও অধিক কুর্দি বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। যুদ্ধে ক্ষত-বিক্ষত সিরিয়ার পশ্চিমাঞ্চলে কুর্দিরা ‘রোজাভা’ নামে একটি স্বাধীন জনগনতান্ত্রিক দেশ প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হয়েছেন। যদিও এর স্থায়িত্ত্ব নিয়ে অনেকেই সন্দিহান। ইরানে ‘রিপাবলিক অব মাহাবাদ’ নামে স্বায়ত্ত্বশাসন কায়েমের লক্ষ্যে কুর্দিরা আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। তবে অপরাপর দেশের তুলনায় ইরানে এঁদের আন্দোলন কম সহিংস।
সেল নং : ০১৮৬৯-৮৬৬৯০০


শেয়ার করুন