বার্ডস আই: শিক্ষা সংকোচন

mahfuj মাহ্ফুজুল হক

বাড়ছে মানুষ। বাড়তি মানুষের বসতির প্রয়োজনে বাড়ছে ঘরবাড়ি। তৈরি হচ্ছে বহুতল ভবন। নির্মিত হচ্ছে আকাশ ছোঁয়া দালান (স্কাই স্ক্রেপারস)। চাহিদা বাড়ছে ঘরবাড়ি তৈরির সরঞ্জাম ও ইঞ্জিনিয়ার-মিস্ত্রি-যোগালির। প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে রড-সিমেন্ট-ইট তৈরির নতুন নতুন কারখানা। বাড়ছে এসব মালামাল বিক্রির দোকান। বাড়ছে মানুষের চলাচল ও যোগাযোগ। বাড়ছে রাস্তাঘাট। সড়কের উপর হচ্ছে উড়াল সড়ক (ফ্লাইওভার)। এক লেনের সড়ক হচ্ছে বহু লেন বিশিষ্ট। বাড়ছে গাড়ির পরিমান। আমদানি বাড়ছে নতুন বা রিকন্ডিশন গাড়ির। চালু হয়েছে ইজি বাইক, ভটভটি, নছিমন ইত্যাদি বহু ধরণের গাড়ি। মানুষ বাড়ছে আর সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে অসুখ-বিসুখ। চাহিদা বাড়ছে ডাক্তারের, ঔষধের, চিকিৎসা সামগ্রীর ও হাসপাতালের। বাড়ছে ডাক্তার তৈরির কলেজ। স্থাপিত হচ্ছে নতুন নতুন হাসপাতাল। বাড়ছে ঔষধ তৈরির ফ্যাক্টরি আর বাড়ছে ঔষধের দোকান। বাড়ছে মানুষ আর বাড়ছে তাদের খাবারের চাহিদাও। এক ফসলা জমিতে দুই এমনকি তিন ফসলেরও চাষ হচ্ছে। অনাবাদি জমিকেও চাষের আওতায় আনা হচ্ছে। বাড়ছে ফসল প্রক্রিয়াজাতকরণ ফ্যাক্টরি। বাড়ছে বাড়তি ফসলের পরিবহণ ও বিপনন। উদ্ভাবিত হচ্ছে নিত্য নতুন রেসিপি। রান্না-বান্না এখন আলাদা একটি শিল্প হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে। টিভি চ্যানেলগুলোতে রান্না বিষয়ক অনুষ্ঠান না থাকলে চলে না। শুধু রান্না বিষয়ক টিভি চ্যানেলও চালু হয়ে গেছে। প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে বাড়তি খাবারের দোকান। ম্যাকডোলান্ডস, কেএফসি’র মতো খাবারের দোকানগুলোর ব্যবসা রমরমা। বাড়তি মানুষ হন্যে হয়ে খুঁজছে রুজি-রোজগার। আর তা যখন সোনার হরিণ তখন পাড়ি দিচ্ছে বিদেশে। বৈধ পথে সম্ভব না হলে অবৈধ পথে। ফলে সৃষ্টি হচ্ছে অভিবাসী সমস্যা। আয় রোজগারের প্রয়োজনে এক দেশের মানুষ আরেক দেশ ও বহু দেশে ছড়িয়ে পড়ছে। তাদের সাথে যোগাযোগের জন্য স্থাপিত হচ্ছে মোবাইল, ইন্টারনেট ব্যবস্থা। বাড়ছে এসব প্রযুক্তি তৈরির কারখানা, বিপনন, মেরামত-রক্ষণাবেক্ষণ প্রভৃতিও। বিদেশে কর্মরতদের রেমিটেন্স দেশে পাঠানোর প্রয়োজন দেখা দেয়ায় ব্যাংক, মানি এক্সচেঞ্জ, মানি ট্রান্সফার, হুন্ডি ইত্যাদি নামীয় কারবার ও প্রতিষ্ঠানও বাড়ছে। বাড়ছে বিমানের ফ্লাইট সংখ্যাও। বাড়ছে মানুষ আর প্রয়োজন দেখা দিচ্ছে বাড়তি পোষাক-পরিচ্ছদের। দরকার হচ্ছে বাড়তি কাপড়ের, সূতার, তুলার। গড়ে উঠছে বড় বড় টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রি, গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি। তৈরি কাপড় বিপননে বিশ্বময় প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে ওয়ালমার্ট, ওলওয়ার্থ, টম টেইলর এর মতো নামকরা সব কোম্পানি। এতোসব কাজ-কারবারে কী পরিমাণ মানুষের কর্মসংস্থান হচ্ছে সে কথা নাইবা বললাম।

বাড়ছে মানুষ। তার অনুষঙ্গ হিসেবে কতো কিছুই না বাড়ছে। বলা হয়, মানুষের মৌলিক চাহিদা পাঁচটি- অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা ও বাসস্থান। উপরের আলোচনায় আমরা দেখলাম শিক্ষা বাদে আর চারটি বিষয়েই বেশ হৈহৈ রৈরৈ অবস্থা। শিক্ষা বিষয়ে আমরা একটু পেছন ফিরে তাকাই। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে আজ চুয়াল্লিশ বছর। স্বাধীনতার পূর্বে কক্সবাজার জেলা শহরে মাধ্যমিক বিদ্যালয় ছিলো মেয়েদের একটি আর ছেলেদের দু’টি তন্মধ্যে একটি বেসরকারি। আর পরবর্তীতে বেড়েছে মেয়েদের দু’টি এবং ছেলেদের চারটি তা-ও আবার সহশিক্ষা প্রতিষ্ঠান। সবক’টিই বেসরকারি। অবশ্য পূর্বের স্কুলগুলোতে আসন সংখ্যা বাড়িয়ে দ্বিগুণ করা হয়েছে। শহরের বাইরে হলেও ছেলে মেয়ে উভয়ের জন্যই কলেজ ছিলো একটি যা পরবর্তীতে সরকারি হয়েছে। স্বাধীনতা উত্তরকালে মেয়েদের জন্য একটি কলেজ স্থাপিত হয় যা বর্তমানে সরকারি। তদুপরি সম্পূর্ণ বেসরকারি উদ্যোগে ইদানীং আরো দু’টি কলেজ হয়েছে। আগে একটি সরকারি ভোকেশনাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউট ছিলো। পরবর্তীতে শহরের বাইরে একটি সরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট স্থাপিত হয়েছে। সম্প্রতি একটি বেসরকারি পলিটেকনিকও হয়েছে। স্বাধীনতার পূর্বে মাদ্রাসা ছিলো একটি। পরে দু’টি মাদ্রাসা হয়েছে এবং দু’টিই মেয়েদের। অবশ্য কয়েকটি কওমী মাদ্রাসাও রয়েছে। সবক’টি মাদ্রাসাই বেসরকারি। একটি সরকারি মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যদিও এর মূল ভবন এখনো নির্মাণাধীন। অতি সম্প্রতি বড় লোকের সন্তানদের জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। হালে সব ক’টি বিদ্যালয়ের ও কলেজের আসন সংখ্যা হিসাব করলে দাঁড়ায় মাধ্যমিক স্তরে প্রায় দশ হাজার এবং উচ্চ স্তরে ছয় থেকে সাত হাজার বাড়তি ছাত্র-ছাত্রী লেখাপড়া করছে। এই হলো মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মোটামুটি বিবরণ।
উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের মতে সারা দেশে এখনো ১৫ থেকে ৪৫ বছর বয়সী ৩ কোটি ৭৩ লাখ মানুষ নিরক্ষর (পৌনে ৪ কোটি)। মানে ৩৯ শতাংশ মানুষ এখনো নিরক্ষর। বর্তমানে বাংলাদেশে সাক্ষরতার হার ৬১ শতাংশ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিসিএস) এর জরিপ অনুযায়ী ২০১২ সালে ১৫ বছরের বেশি বয়সীদের সাক্ষরতার হার ছিল ৬০.৭ শতাংশ, ২০১১ সালে ৫৮.৮ শতাংশ, ২০১০ সালে ৫৮.৬ শতাংশ, ২০০৯ সালে ৫৮.৪ শতাংশ। অর্থাৎ গত পাঁচ বছরে সাক্ষরতার হার বেড়েছে মাত্র ৩ শতাংশ। ইউনিসেফের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার বছরে দেশে সাক্ষরতার হার ছিল ১৬.৮ শতাংশ। ১৯৭৪ সালে তা দাঁড়ায় ২৫.৯ শতাংশে। ১৯৯১ ও ২০০১ সালে সেই হার ছিল যথাক্রমে ৩৫.৩ ও ৪৭.৯ শতাংশ। ২০১০ সালে সাক্ষরতার জরিপে ৫৯.৮২ শতাংশে পৌঁছানোর কথা বলা হয়েছিল। বলে রাখা ভাল, মৌলিক সাক্ষরতা বলতে মাতৃভাষায় পড়তে, লিখতে, গণনা করে হিসাব করতে পারা ও লিখিতভাবে যোগাযোগ করার সক্ষমতাকে বোঝানো হয়। বাংলাদেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার হলো ১.৬ শতাংশ, জন্মহার ২১.১৪ শতাংশ/১,০০০ জনে আর প্রতি কিলোমিটারে বাস করেন ১,১৫৪.৭৪ জন মানুষ। তার মানে বর্তমান ৩% লিটারেসি রেট অনুযায়ী বাংলাদেশকে নিরক্ষরতামুক্ত করতে একুশ শতক পেরিয়ে যাবে। সম্প্রতি প্রকাশিত ওয়ার্ল্ড লিটারেসি ফাউন্ডেশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, নিরক্ষরতার জন্য বাংলাদেশকে যে আর্থিক ও সামাজিক মূল্য দিতে হচ্ছে তার পরিমাণ প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা। নিরক্ষর ব্যক্তিরা সাক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তিদের চেয়ে ৩০ থেকে ৪২ শতাংশ কম আয় করেন। উন্নয়নশীল দেশে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) শূণ্য দশমিক পাঁচ শতাংশ ক্ষতি হয় নিরক্ষরতার জন্য। প্রতিবেদনে বলা হয়, নিরক্ষরতার প্রভাবে সমাজে অপরাধ প্রবণতাও বাড়ছে।

শিক্ষা খাতে বরাদ্দ আগের চেয়ে আরো কমেছে। ২০০৯-১০ অর্থ বছরে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ ছিল বাজেটের ১৪.৬৭ শতাংশ। সেখান থেকে পরের বছর কমে হলো ১৩.৬১, তারপর ক্রমান্বয়ে ১৩.১৩, ১২.৩২, ১১.৫৮, ১১.৭ এবং সর্বশেষ এবছর মানে ২০১৫-১৬ সালে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বাজেটের মাত্র ১০.৭ শতাংশ যা জিডিপির ২ শতাংশ। জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞদের মতে, একটি দেশের জনশক্তিকে পুরোপুরি কাজে লাগাতে চাইলে তার জিডিপির ৬ শতাংশ বা বার্ষিক বাজেটের ২০ শতাংশ শিক্ষায় ব্যয় করা উচিত।
শিক্ষার তথা উচ্চ শিক্ষার মান নিয়ে উদ্বেগ আরো প্রকট। লন্ডন ভিত্তিক সাপ্তাহিক টাইমস হায়ার এডুকেশন শিক্ষার মান, গবেষণাসহ বিভিন্ন মানদন্ডে ২০১৫ সালে এশিয়ার ১০০টি মর্যাদাপূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকা প্রকাশ করেছে, তার কোথাও বাংলাদেশের নাম নেই। আবার সাংহাই ভিত্তিক একাডেমিক র‌্যাংকিং অব ওয়ার্ল্ড ইউনিভারসিটি বিশ্বের ১ হাজার ২০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের মান যাচাই করে ৫০০টি মান সম্পন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকা দিয়েছে, তাতেও বাংলাদেশের কোন বিশ্ববিদ্যালয় ঠাঁই পায়নি। ’উপযুক্ত শিক্ষকের অভাব শিখন-শেখানোর পদ্ধতিতে বিরূপ প্রভাব ফেলছে। শিক্ষকেরা ক্লাসে পড়াতে পারছেন না, এমনকি ঠিকমতো প্রশ্নও করতে পারছেন না। ফলে দায় এড়ানোর জন্য পরিক্ষার খাতায় বেশি বেশি নম্বর দিয়ে ছাত্রদের খুশি করে নিজেরা নিরাপদে থাকছেন।’ ’কম বেতনে, বিনা পুরষ্কারে এবং নামমাত্র প্রশিক্ষণ নিয়ে ক্লাসে উপচে পড়া ছাত্রছাত্রীদের আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করা অপ্রণোদিত শিক্ষকদের পক্ষে একেবারে অসম্ভব না হলেও দুরূহ তো বটেই।’ অধ্যাপক গোলাম ফারুক আরো বলেন, ‘দারিদ্র্য ও অবহেলায় পীড়িত, কুন্ঠিত, ন্যুজদেহ এই শিক্ষকদের পক্ষে সরকার-পরিকল্পিত আধুনিক শিক্ষার গুরুভার বহন করা সম্ভব নয়।’ শিক্ষা প্রসারের লক্ষ্যে যেমন বিনিয়োগ বাড়াতে হবে পাশাপাশি শিক্ষার মান উন্নয়নেও নিতে হবে পদক্ষেপ। আর শিক্ষার মানোন্নয়নের পূর্বশর্তই হলো উপযুক্ত ও দক্ষ শিক্ষকের পর্যাপ্ততা।
ঝরে পড়া’র বিষয়টি অত্যন্ত উদ্বেগজনক রূপ নিয়েছে। প্রাথমিক শিক্ষা সমাপণী (পিইসি) পরিক্ষায় কোন ছাত্র/ছাত্রী পাশ না করলে ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে, জেএসসি-তে পাশ না করলে ৯ম শ্রেণিতে, এসএসসি-তে পাশ না করলে একাদশ শ্রেণিতে আর এইচএসসি-তে পাশ না করলে উপরের ক্লাসে পড়ার সুযোগ তার জন্য চিরতরে রুদ্ধ হয়ে যায়। তার মানে, বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থা ছাত্র-ছাত্রীদের ’বাধ্যতামূলকভাবে ঝরে পড়তে’ (অবলিগেটরি ড্রপ আউট) বলছে। গরীব এই দেশে এমনিতেই পিতার পক্ষে তার সন্তানকে রুজি রোজগারের কাজে না লাগিয়ে পড়াশোনা করানো যেখানে এক প্রকারের বিলাসিতা সে অবস্থায় দুঃখ কষ্ট সয়ে হলেও যে পিতা তার সন্তানকে শিক্ষাদানে আগ্রহী, তাকেও যদি সিস্টেমের কারণে অনিচ্ছাকৃতভাবে ড্রপ আউট হতে হয় তবে এই দুঃখ কোথায় রাখা যাবে? আর এর দায়-ই বা কে নেবে? অতি পরিক্ষা নির্ভর বর্তমান ব্যবস্থা শিক্ষার্থীদের উপর মারাতœক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করছে। খেলাধুলা, আড্ডা, ভ্রমণ, পর্যাপ্ত বিশ্রাম প্রভৃতি শিকেয় তুলে দিবানিশী অহর্নিশ পরিক্ষার জন্য প্রস্তুতি শিক্ষার্থীদের হাঁফিয়ে তোলে। শিশু অবস্থাতেই (১৮ বছর বয়স সীমার মধ্যেই) চার চারটি বোর্ড পরিক্ষা, প্রতিমাসে এক বা একাধিক অন্যান্য পরিক্ষা নামক বোঝা বহন করতে করতে ছাত্র-ছাত্রীদের এখন পড়ি-কি-মরি দশা। একজন মানুষ কি সারাক্ষণ টেনশন বা মানসিক চাপ ও উদ্বেগ নিয়ে স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারে? না, পারে না। শিশুদের বেলায় এই কথাটি আরো বেশি সত্য। হর হামেশা পরিক্ষা পরিক্ষা নামক প্রচারণা, পরিক্ষা জ্বর (এক্সাম ফিভার) বা ভীতি, পরিক্ষা চাপ (এক্সাম স্ট্রেস), পরিক্ষা উদ্বেগ (এক্সাম এংজাইটি) শিশু মনে পরিক্ষার প্রতি এক ধরণের অনাগ্রহের জন্ম দেয়। বার বার পরিক্ষার জন্য প্রস্তুতি নেবার তোড়জোড় দীর্ঘমেয়াদে তার মাঝে বিতৃষ্ণা সৃষ্টি করে যা প্রকারান্তরে লেখাপড়ার প্রতি ভীতিরূপে আবির্ভূত হয়। ফলশ্রুতিতে প্রাথমিকভাবে লেখাপড়ায় অমনযোগী এবং পর্যায়ক্রমে তা অনীহা ও আতংকে পর্যবসিত হয়। একসময় শিশু লেখাপড়ার প্রতি তার আগ্রহ পুরোপুরি হারিয়ে ফেলে।
শিক্ষা দীক্ষার ব্যাপারে এদেশে এক্সপেরিমেন্টের অন্ত নেই। আজ অমুক কমিশন তো কাল তমুক কমিশন। এক্সপেরিমেন্ট হয় আবার তা বিফলেও যায়, শিক্ষানীতি হয় আবার তার কার্যকারিতা স্থগিত হয়ে যায়, সরকার আসে সরকার যায়। এ ধরণের পরিক্ষা-নিরীক্ষা পরিক্ষা পদ্ধতির বেলায় যেমনি হয়, তেমনি পাঠ্যসূচি প্রণয়ন, পাঠ্যপুস্তক ছাপানো, শিক্ষক নিয়োগ প্রভৃতি ক্ষেত্রেও সতত পরিদৃশ্যমান। বলা হয়েছিলো, প্রাইমারি শিক্ষাকে ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত এবং মাধ্যমিক শিক্ষাকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত করে পিইসি ও এসএসসি এই দুইটি মাত্র বোর্ড পরিক্ষা নেওয়া হবে। কিন্তু তা অদ্যাবধি আলোর মুখ দেখেনি। কোমলমতি ছাত্র-ছাত্রীদের মহামূল্যবান জীবন নিয়ে এহেন এক্সপেরিমেন্টের তামাশা বন্ধ হওয়া সঙ্গত। বর্তমানে আমাদের অবস্থা হয়েছে ওই বেওকুবের মতো যার মল নাকি শুধু মলদ্বারেই সীমাবদ্ধ থাকে না, তা শরীরের আরো একাধিক স্থানে ছড়িয়ে পড়ে। অসাবধানতা বশতঃ বেরিয়ে যাওয়া পায়খানাকে সে ওটা কী তা সনাক্ত করতে প্রথমে হাত দিয়ে ধরে দেখে, তারপর তা নাকে নিয়ে শুঁকে দেখে। এক্সপেরিমেন্টের অংশ হিসেবে পরিক্ষা তো অনেকগুলো নেওয়ার আয়োজন হলো এবং তার ফল প্রকাশের কারবারও হলো এলাহী। কিন্তু যখনি নজরে এলো দলে দলে ফেল, ড্রপ আউট, গন-শিক্ষাভীতি তখনই শুরু হয়ে গেলো যেন-তেনভাবে পরিক্ষায় পাশ করিয়ে দেবার তোড়জোড়। পরিক্ষার উত্তরপত্র যারা যাচাই করেন মানে শিক্ষকেরা, তাদের ডেকে নিয়ে কড়া নির্দেশ দেয়া হলো – পরিক্ষায় কাউকে ফেল করানো যাবে না। কোন শিক্ষক কড়া জবাবদিহির একপর্যায়ে যখন ফেল করা ছাত্রের খাতা একদম সাদা পাওয়ার কথা উল্লেখ করেন তখন বোর্ডের ঊর্ধতন কর্মকর্তা ধমকের সুরে বলেন, আপনাকে খাতা দেখতে বললো কে? আপনার কাজ হলো চোখ বুঁজে নম্বর দেওয়া। তিনি যুক্তি দেখালেন, পিইসি, জেএসসি ইত্যাদি পরিক্ষা যখন ছিলো না, তখন কি ফেল করা ছাত্র-ছাত্রীদেরকে বিভিন্নজনের সুপারিশের ভিত্তিতে উপরের ক্লাসে প্রমোশন দেওয়া হতো না? এখন সার্টিফিকেট পরিক্ষার ব্যবস্থা করাটা কি অপরাধের কাজ হয়েছে? এহেন উপদেশ বাণী শিক্ষকদের যৌথভাবে ডেকে নিয়ে প্রকাশ্যে দেয়া হয় যাতে কোন রাখঢাক করা হয় না। এমন ঘটনাও ঘটছে যে, শিক্ষক কোন ছাত্রকে নম্বর দিতে না পারায় সে ফেল করলো আর সেই শিক্ষককে কর্তৃপক্ষ ডেকে পাঠালেন এবং কৈফিয়ত চাইলেন তা-ও লিখিতভাবে। বোর্ডে যাওয়া আসার খরচ ওই ছাপোষা শিক্ষককেই বইতে হলো।
নতুন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন বা পুরাতন প্রতিষ্ঠানে নতুন শাখা খোলা ইত্যাদি হালে এমন কঠিন শর্তের ঘেরাটোপে পড়েছে যে, এক কথায় তা অসম্ভব বললে সম্ভবতঃ অত্ত্যুক্তি হবে না। নতুনভাবে সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তো হচ্ছেই না, ব্যক্তিগতভাবে কেউ গাঁটের পয়সা খরচ করে প্রতিষ্ঠান গড়তে চাইলে সে ক্ষেত্রেও শত শর্ত ও ফরমালিটির খপ্পড়ে পড়তে হয়।
এখন প্রশ্ন, সরকারের এই নীতি শিক্ষা সম্প্রসারণের লক্ষ্যে নাকি শিক্ষা সংকোচনের লক্ষ্যে নিবেদিত? ঘটনা প্রবাহ দেখে মনে হয় যেন পরবর্তী প্রজন্ম যতো বেশি সংখ্যায় অশিক্ষিত থাকে ততো বেশি পরিমাণে সরকার খুশি। কর্তা ব্যক্তিরা হয়তো ভেবেছেন, এর মাধ্যমে তারা ব্যয় সংকোচনে সক্ষম হবেন, সরকারের রাজস্ব বাঁচাবেন। কিন্তু দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে অশিক্ষিত রেখে, অজ্ঞানতার অন্ধকারে ঢেকে রেখে টাকা বাঁচিয়ে তারা কোন্ লক্ষ্য হাসিল করতে চান – বোধগম্য নয়।


শেয়ার করুন