বার্ডস আই : আইএস জুজু

mahfuz-e1444194134568মাহ্ফুজুল হক

সবচাইতে ভীতিকর, ত্রাস উদ্রেককারী এবং সংহারক কোন কিছুর নাম যদি কেউ জিজ্ঞেস করেন তবে যে কেউ সম্ভবতঃ প্রথম চোটেই এবং বিনা দ্বিধায় যে নামটি হালে উচ্চারণ করবেন সেটি হলো আইএস। টেররিস্ট, এক্সট্রিমিজ, ভায়োলেন্ট, থ্রেট, বার্বারিয়াস, ফেরোসিয়াস ইত্যাদি বিভিন্ন সুপারলেটিভ ডিগ্রীর শব্দাবলী এদের ব্যাপারে ব্যবহৃত হতে দেখা যায়। এই যে ভয়ংকর গোষ্ঠিটির কথা বলা হচ্ছে -এরা আসলে কারা ? আরব বিশ্বে শিয়া-সুন্নী বিরোধ দীর্ঘদিনের। আক্বিদাগত কারণে বেশির ভাগ সুন্নি তো শিয়াদের মুসলমানই মানতে রাজী নন। আরব আমিরাতে দেখেছি, শিয়াদের মসজিদকে আরবরা অন্যান্য ধর্মের মন্দির, গির্জা ইত্যাদির মতোই মনে করে এবং কখনো সেখানে নামাজ পড়তে যায় না। ইতিহাস অবগত লোক মাত্রই জানেন যে, সাদ্দাম হোসেনের সময়ে বিরাজমান শিয়া-সুন্নি ভারসাম্য সাদ্দাম পরবর্তী ইরাকে হারিয়ে যায় এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা শিয়াদের দিকে হেলে পড়ে। যুগের পর যুগ ধরে ইরাকের শাসন ক্ষমতা সুন্নিদের হাতেই ছিলো যদিও সেদেশে শিয়ারাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। ইরাকের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল সুিন্ন এবং দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল শিয়া সংখ্যাগরিষ্ঠ যেখানে রাজধানী বাগদাদ শহরও রয়েছে। সাদ্দাম হোসেনের কাছে ব্যাপক বিধ্বংসী মারণাস্ত্র রয়েছে অভিযোগ তুলে ইরাকে ইঙ্গ-মার্কিন নেতৃত্বাধীন বহুজাতিক বাহিনী পরিচালিত আগ্রাসনের পর তারাই শিয়াদেরকে ক্ষমতার লাইম লাইটে নিয়ে আসে। সাদ্দাম হোসেনের বিরাট সৈন্যবাহিনীর চাকুরিচ্যুত হতাশ সুন্নি সৈনিকদের দলে ভিড়িয়ে সুন্নি এক্সট্রিমিজরা আইএস নামে মাঠে নেমে পড়ে।

এখানে আসলে চলছে ‘পাওয়ার গেম’। ‘ইসলাম’ একটি উপলক্ষ মাত্র। খেলায় জেতার কৌশল হিসাবে ইসলাম নামটিকে ব্যবহার করা হচ্ছে। একে তো মুসলমানরা ধর্মভীরু তার উপর শিয়া শাসনের উপর বিরক্ত এবং সুন্নিরা ক্ষেত্র বিশেষে বৈষম্যের শিকারও বটে। সুযোগ সন্ধানীরা সবসময় এইসব বিষয়গুলোকে পুঁজি করে তাদের স্বার্থ হাসিলে তৎপর থাকে। অন্যদিকে সিরিয়াতে ক্ষমতাসীন বাশার আল আসাদ শুধু শিয়া-ই নন বরং শিয়াদের একেবারে চরমপন্থী গ্রুপ নুসাইরি সম্প্রদায়ভূক্ত। অথচ সিরিয়া হচ্ছে সংখ্যাগরিষ্ঠ সুন্নি মুসলমানের দেশ। জনাব বাশার এবং তার পিতা হাফেজ আল আসাদ উভয়ই চরমভাবে সুন্নি বিরোধী এবং আশির দশকে হামা শহরে অনুষ্ঠানরত সুন্নিদের এক সমাবেশে কামান দাগিয়ে দশ সহ¯্রাধিক সুন্নি মুসলমানকে হত্যা করেন হাফেজ আল আসাদ। হঠাৎ করে আবির্ভূত আইএস এর মতো ভয়ংকর এক বাহিনীকে কেউ কেউ পবিত্র আবার কোরআন শরীফে বর্ণিত ‘ইয়াজুজ মা’জুজ’ এর সাথেও তুলনা করে থাকেন। ইসলামি খেলাফত প্রতিষ্ঠার ঘোষণা এমন একটি কৌশল যার মাধ্যমে আরব বিশ্ব ও পশ্চিমা দেশগুলোতে বেড়ে ওঠা সরলমনা মুসলিম তরুন-তরুণীদেরকে দলে ভেড়াতে কাজে লাগছে। এক তথ্য অনুযায়ী প্রায় ৩১ হাজার বিদেশী যোদ্ধা এখন আইএস এর হয়ে রণাঙ্গণে রয়েছেন। নিউ স্টেসম্যান পত্রিকায় প্রকাশিত প্রবন্ধে বৃটেনের প্রখ্যাত রাজনৈতিক বিশ্লেষক মেহেদী হাসান লেখেন, কী সুন্নি অথবা শিয়া, সালাফি বা সুফি, রক্ষণশীল বা উদার মুসলিম এবং মুসলিম নেতৃবৃন্দ সবাই একযোগে আইএসআইএল -এর নিন্দা ও এটিকে প্রত্যাখান করেন এই ভাষায় যে, এরা শুধুমাত্র অনৈসলামি-ই নয় পুরোপুরি ইসলাম বিরোধীও।

আইএস এর নামগুলো এ রকম – দ্যা ইসলামিক স্টেট অব ইরাক এন্ড লেভেন্ট (আইএসআইএল), দ্যা ইসলামিক স্টেট অব ইরাক এন্ড সিরিয়া (আইএসআইএস), দ্যা ইসলামিক স্টেট অব ইরাক এন্ড আশ্-শাম, ইসলামিক স্টেট গ্রুপ ; আরবিতে আদ-দাউলাহ আল ইসলামিয়াহ ফিল ইরাক ওয়াশ্ শাম (দাইশ বা দায়েশ)। ২০১৪ সনের ২৯ জুন এরা বিশ্বব্যাপী ইসলামি রাষ্ট্র ও খেলাফতের ঘোষণা দেয়। আর আবু বকর আল বোগদাদী এর খলিফা ঘোষিত হন। ‘জামাত আল তাওহীদ ওয়াল জিহাদ’ নামে ১৯৯৯ সনে এরা যাত্রা শুরু করে এবং ২০০৪ সনে ‘আল কায়েদা’র সাথে সম্পৃক্ত হয়। ২০০৩ সনে পশ্চিমা শক্তি কর্তৃক ইরাকে আগ্রাসনের সময় এরা সক্রিয় থাকে। ২০০৬ সালের জানুয়ারীতে অপর গ্রুপ ‘মুজাহিদীন শরীয়াহ কাউন্সিল’ এর সাথে যুক্ত হয় এবং ‘ইসলামিক স্টেট অব ইরাক’ এর ঘোষণা দেয়। এরা সমগ্র মুসলিম দুনিয়ার উপর ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও সামরিক কর্তৃত্ব দাবী করে। এদের দাবী অনুযায়ী সকল আমিরাত, গ্রুপ, দেশ ও সংগঠন প্রভৃতির কোন আইনগত ভিত্তি নাই এবং খেলাফত কর্তৃপক্ষ ও তার সৈন্যবাহিনী তা দখলে নিতে পারে। মার্চ ২০১১ সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। ২০১১ সালের অগাস্ট মাসে আল বোগদাদী তথায় প্রতিনিধি পাঠান। ২০১৩ সনের এপ্রিল মাসে সিরিয়ার ‘আল নুসরা ফ্রন্ট’ এবং আইএসআইএস একীভূত বলে ঘোষণা করা হয় এবং তারা সিরিয়ার রাক্কা, ইদলিব, দাইর আজ জওর, আলেপ্পো দখল করে শক্তি বৃদ্ধি করতে থাকে। ‘আল কায়েদা’ নেতা আইমান আল জওয়াহিরি, আবু মুহাম্মদ আল জুলানী এই একীভূত হওয়া প্রত্যাখান করেন। ৮ মাস ব্যাপী ‘পাওয়ার স্ট্রাগলের’ পর ৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ তে আল কায়েদা আইএসআইএল এর সাথে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করে। এরা ২০১৪ সনের শুরুতে ইরাকে দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর মসূল সহ পশ্চিম ইরাকের প্রধান শহরগুলো থেকে ইরাকি বাহিনীকে হঠিয়ে দিয়ে তার দখল নিতে সক্ষম হয়। এরা বর্তমানে ইরাক ও সিরিয়ায় গ্রেট বৃটেনের চেয়ে বড় এলাকা শাসন করছে।

আমরা দেখেছি, আল কায়েদা এবং আইএস মূলতঃ একই আদর্শে অনুপ্রাণিত এবং একই উৎস থেকে উৎসারিত। গোড়ায় উভয় সংগঠন এক ছিলো। পরবর্তীতে নেতৃত্বের কোন্দলের ফলে বিভক্ত হয়েছে। এবং একটু খেয়াল করলেই স্পষ্ট হবে যে, আইএস সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগে সংঘঠিত সন্ত্রাসী ঘটনাগুলোর দায় স্বীকার করে বক্তব্য-বিবৃতি দিতো আল কায়েদা আর এখন দেয় আইএস। আল কায়েদা এখন অনেকটা পর্দার অন্তরালে (ব্যাকফুটে) চলে গেছে। বুঝা গেলো, আল কায়েদা আর আইএস একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ মাত্র, তফাৎ শুধু নামে। এবার দেখি, এদের ¯্রষ্টা কে ? হু ক্রিয়েটেড আল কায়েদা অর আইএস ? বৃটিশ সংবাদপত্র ইন্ডিপেন্ডেন্ট ১৯৯৩ সনের এক সংখ্যায় একটি প্রবন্ধ ছাপে যার শিরোনাম ছিলো ‘এন্টি সোভিয়েত ওয়ারিয়র পুট্স হিজ আর্মি অন দ্যা রোড টু পীচ’। পত্রিকাটি ওসামা বিন লাদেনের এক বড় ছবি ছাপে যিনি তখন ছিলেন পশ্চিমাদের বিশ্বস্ত বন্ধু। প্রবন্ধে বলা হয়, বিন লাদেন মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা থেকে সংগ্রহ করেছেন হাজার হাজার বিদেশী যোদ্ধাদের এবং তাদেরকে অস্ত্র ও স্বীয় নির্মান সরঞ্জমাদি দিয়ে সজ্জিত করেছেন ১৯৮০ সনে সোভিয়েত রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য। বিন লাদেন বলেন, ‘আমরা সোভিয়েত ইউনিয়নকে মেরেছি।’ পরবর্তীতে সাদ্দাম হোসেন এর পতনের পরও যখন আমেরিকার সৈন্যরা পবিত্র মক্কা শরীফ যাবার পথের পাশে তাদের ঘাঁটি গেড়ে থেকে যায়, তখন বিন লাদেন জিজ্ঞেস করেন, ‘তোমরা এখানে কেন ? বেরিয়ে যাও।’ তখন থেকেই বিন লাদেনের জিহাদ আরম্ভ হয় দখলদারদের বিরুদ্ধে। বিন লাদেন রাশিয়ানদের তাড়ানোর জন্য আফগানিস্তানে যান, সৈনিকদের একত্রিত করেন ‘মুজাহিদীন’ নামে। এর পরই আল কায়েদার পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে ওঠে ‘তালেবান’।

১৯৮৩ সনে ওভাল অফিসে আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যানের সাথে মুজাহিদীন নেতাদের সেই বিখ্যাত বৈঠকের খবর নিউজ পোর্টালগুলোতে এখনও চাওর হয়ে আছে। (প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান ফেইমাসলি মেট উইথ দ্যা মুজাহিদীন ইন দ্যা ওভাল অফিস ইন ১৯৮৩)। সাবেক বৃটিশ পররাষ্ট্র সচিব রবিন কুক ‘হাউজ অব কমন্স’কে জানান যে, আল কায়েদা প্রশ্নাতীতভাবে পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর একটি প্রোডাক্ট। মি. কুক ব্যাখ্যা করেন যে, আল কায়েদা যা শাব্দিক অর্থে আরবিতে একটি ডাটাবেইজ এর সংক্ষিপ্ত রূপ। এটি মূলতঃ হাজার হাজার ইসলামি উগ্রপন্থীদের একটি ডাটাবেইজ যারা সিআইএ দ্বারা প্রশিক্ষিত এবং সৌদিদের অর্থে লালিত এবং এদের সংগঠিত করা হয়েছে আফগানিস্তানে রাশিয়ানদের পরাজিত করতে।
ঘটনা যাই হোক না কেন এবং আল কায়েদা, আইএস, সুন্নি, শিয়া প্রভৃতি যে নামেই ডাকি না কেন- মরছে কিন্তু ওই মুসলমানই। জুনিয়র বুশ আমলে আমেরিকা ‘ওয়ার অন টেরর’ নামে মুসলমান বিরোধী যে যুদ্ধের সূচনা করেছিলেন এবং আফগানিস্তান, ইরাক এই দুটি দেশকে তছনছ করে ছেড়েছিলেন, সেই ভয়ংকর এক তরফা যুদ্ধেরই এখন আমরা অন্য রূপ দেখছি আইএস বিরোধী লড়াই-এ। নিজেদেরই সৃষ্ট একটি সশস্ত্র গ্রুপকে শায়েস্তা করতে যেয়ে আজ সমগ্র ইউরোপ-আমেরিকা-অষ্ট্রেলিয়া-মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সম্মিলিত হামলায় ইরাক-সিরিয়ার মাটি অসহায় মুসলমান নর-নারী-শিশু-বৃদ্ধের রক্তে লালে লাল হয়ে গেছে। ওপিনিয়ন রিসার্চ বিজনেস সার্ভে জানাচ্ছে, ইরাক আগ্রাসনের পর থেকে অদ্যাবধি দশ লক্ষের অধিক মানুষ নিহত হয়েছেন। নিউইয়র্ক পত্রিকার রিপোর্ট অনুযায়ী, সাড়ে চার বছরের যুদ্ধে সিরিয়াতে দুই লক্ষাধিক মানুষ মারা গেছেন আর চল্লিশ লাখেরও বেশি মানুষ দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। সৃষ্টি হয়েছে এযাবৎকালের সবচেয়ে বিপর্যয়কর শরণার্থী সমস্যা। পক্ষান্তরে সিরিয়ান অবজারভেটরি ফর হিউম্যান রাইটস এর তথ্য অনুযায়ী সম্মিলিত পশ্চিমা বাহিনীর সদস্য ও অন্যান্য মিলে ইরাক ও সিরিয়া উভয় দেশে মারা গেছেন দশ সহ¯্রাধিক মানুষ। লস এঞ্জেলেস, প্যারিসসহ অন্যান্য স্থানে হামলা এবং নিরপরাধ মানুষের জানমালের ক্ষতিতে আমরা যেমন বিবেকের দংশনে আহত হই এবং ঘটনার নিন্দা জানাই তদ্রুপ আফগানিস্তানের গারানি গ্রাম, দিহবালা ও ওয়েক বাগ্তু গ্রামের বিবাহ অনুষ্ঠানে, নারাং গ্রামে ঘুমন্ত স্কুল ছাত্রদের উপর আমেরিকা-ইউরোপের সম্মিলিত বাহিনী কর্তৃক বিমান হামলা চালিয়ে শত শত নিরীহ নিরপরাধ মানুষ হত্যা করার বেলায়ও আমরা বিবেকের তাড়নায় তীব্র ঘৃণা ও ক্ষোভ প্রকাশ না করে পারি না। সাদ্দাম হোসেন ব্যাপক বিধ্বংসী মারণাস্ত্র জমা করে রেখেছেন- এই অজুহাতে ইরাককে ধ্বংস্তুপে পরিণত করা হলো। (ওই অজুহাতে ইরাকে হামলা করা ভুল ছিলো মর্মে ঘটনার অন্যতম খলনায়ক টনি ব্লেয়ার এই সেদিন স্বীকার করেছেন।) টুইন টাওয়ার ধ্বংসকারী আল কায়েদা আছে এই অজুহাতে আফগানিস্তানে হামলা চালিয়ে সে দেশটিকে ধ্বংস করে দেয়া হলো। আইএস আছে এই জুজু দেখিয়ে সিরিয়া ও ইরাকে এখন চলছে সম্মিলিত পশ্চিমা বাহিনী ও রাশিয়ার উপর্যপুরি বিমান ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা যাতে প্রতিদিনই রক্ত ঝরছে শত সহ¯্র মুসলমানের। প্যারিস, লস এঞ্জেলেস এর মতো মানবতা বিরোধী হামলা যেমন বন্ধ হওয়া উচিত তদ্রƒপ বিবিধ অজুহাত তৈরি করে বিভিন্ন দেশে নৃশংস কায়দায় মুসলমান নিধনের মতো দানবীয় ধ্বংসযজ্ঞও অবিলম্বে থামা উচিত। আশা, সর্বত্র শুভ বুদ্ধির উদয় হবে।


শেয়ার করুন