বাবুল ইস্যুতে প্রশ্নবিদ্ধ সাংবাদিকতা

image-1পুলিশ কর্মকর্তা (এসপি) বাবুল আক্তারকে ঢাকায় গোয়েন্দা পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদ নিয়ে প্রকাশিত বিভিন্ন সংবাদে ফের প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে সাংবাদিকতা। এ ঘটনায় বিশ্বস্ত বা নির্ভরযোগ্য সূত্রের বরাত দিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের সমালোচনা করতে গিয়ে বিভিন্ন শ্রেণীপেশার মানুষ এ অভিমত জানিয়েছেন। জনপ্রিয় সামাজিক গণযোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকে মতামত প্রকাশ করেছেন তারা। খোদ সাংবাদিকরাওএকাধিক গণমাধ্যমের সমালোচনা করছেন ।

জানা গেছে, চট্টগ্রামে নিহত মাহমুদা আক্তার মিতুর স্বামী এসপি বাবুল আক্তারকে নিয়ে শুক্রবার দিবাগত রাত থেকে শনিবার বিকেল অবধি নানা মুখরোচক খবর পরিবেশন করে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম। ‘এসপি বাবুলকে নিয়ে গেছে পুলিশ’, ‘এসপি বাবুলকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে: স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী’, ‘স্ত্রী হত্যার ছক নিজেই কেটেছিলেন এসপি বাবুল আক্তার’, ‘নতুন মোড় মিতু-হত্যা ঘটনায়, এসপি বাবুল পুলিশ হেফাজতে!’ বা ‘গুঞ্জন: এসপি বাবুলই স্ত্রী মিতু হত্যার পরিকল্পনাকারী!’, ‘চাচাত ভাই সাইফুলকে নিয়ে স্ত্রী খুনের ছক বাবুল আক্তারের!’, ‘কে বলল আমি গ্রেপ্তার: বাবুল আক্তার’ – এমন অজস্র শিরোনামের ছায়ায় লেখা হয়েছে বাবুলের প্রয়াত স্ত্রীর পরকীয়া প্রেমের কেচ্ছা।

ফেসবুক প্রকাশনায় রবীন আহসান বলেছেন, ‘তিনটা বড় বড় অনলাইন নিউজ ব্লক করলাম! ইওলো+সাদা+লাল+কালা সংবাদ মুক্ত থাকার চেষ্টার প্রথম ধাপ এটা…।’ তিনি আরো বলেন, ‘সংবাদ কি হইবে কি ভাবে হইবে এইসব পড়াইয়া এখন আর লাভ নাই বরং পড়ান সংবাদ কিভাবে অল্প সময়ের মধ্যে একটা মানুষকে অমানুষ হিসেবে দেখাতে পারে এবং কতদ্রুত তা অনলাইনে শেয়ার ও লাইক আদায় করতে পারে তার সূত্র…।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সোনিয়া ইসলাম নিশা লিখেছেন, ‘কয়টা নিউজ বেশ কয়েকবার পড়লাম। মিথ্যে মামলায় নির্দোষকে ফাঁসানো এবং পারিবারিক কলহের জের ধরে অহরহ হত্যাকাণ্ড- দুই সংস্কৃতিই বিদ্যমান আমাদের বাংলাদেশে। কোনটা সঠিক ? যদি বাবুল আক্তার দোষী হয় তবে সাধারণ মানুষের বিশ্বাসে কষে এক লাথি মেরেছে লোকটা। সেই সাথে জঙ্গি নাম করে ব্যক্তিগত আক্রোশের বসে যে নানা হত্যাকাণ্ড হচ্ছে তাও আবার প্রমাণিত হবে। আর তাকে ফাঁসানো হলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই। পলিটিক্সে সব সম্ভব, নৈতিকতা তো কবেই হারিয়েছি! এইসব নানা ঘোরপ্যাচের মধ্যেই চাই- মিতু হত্যার বিচার হোক, সত্য বেড়িয়ে আসুক।’ নিশা আরো লিখেছেন, ‘এই স্টাটাসে হলুদ সাংবাদিকতার বিষয়টাও অ্যাড করা উচিত ছিলো। যাহোক পুরো বিষয়টি যদি হলুদ সাংবাদিকতা হয়, তাহলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই।’

পরে এ সংক্রান্ত একটি সংবাদের সংযোগ শেয়ার করতে গিয়ে নিশা বলেন, ‘কিছুক্ষণ আগেই প্রথম আলো এটা শেয়ার দিয়েছে। সকাল থেকে বাংলানিউজের কী হয়েছিলো, এমন একটা সেনসিটিভ বিষয় নিয়ে কিভাবে ভালোভাবে গবেষণা না করে নিউজ ছেপেছে। এদের পেশাদারিত্বের যায়গাটা কোথায় ! অনেকেই বাবুল আক্তারকে দোষারোপ করে, ধিক্কার জানিয়ে পোস্ট দিয়ে এখন সেটা ডিলিট করেছেন। আমি বাবুল আক্তারকে কোনো দোষারোপ বা কিছুই করিনি। নিউজগুলো দেখে কেবল কিছু আশংকার কথা উল্লেখ করেছি। মনে প্রাণে চাই সত্য বেড়িয়ে আসুক।’

জেষ্ঠ্য সাংবাদিক ও টিভি অঞ্জন রায় বলেছেন, ‘Kite flying journalism শুধু ব্যাক্তি বা গোষ্ঠিকে অপমান করে না- সাংবাদিকতা পেশাটিকেও সার্কাসের জোকারের যায়গায় নিয়ে যায়। লজ্জিত হই সংবাদকর্মী হিসাবে। যারা সাংবাদিকতার নামে মিথ্যা গল্প লেখেন- তারা কি সেই মানুষটির বেদনা আর অপমানের মূল্য দিতে পারবেন কখনো?’

জেষ্ঠ্য সাংবাদিক সালেহ আকন লিখেছেন, ‘কতিপয় মিডিয়া এবং তাদের আতেল কতিপয় সাংবাদিক। পাঠকের বুঝতে কোনভাবেই বাকি রইলো না যে, তারা তিলকে তাল বানান। এসপি বাবুল আক্তারের মতো চৌকস অফিসারের উপর স্ত্রী হত্যার দায় চাপিয়ে দিতেও তারা কুন্ঠিত হলেন না। হবেন-ইবা কেমনে? তারাতো এই কাজ করেই অভ্যস্ত। লিখে দিলেন স্ত্রী হত্যার দায়ে বাবুল আক্তার গ্রেফতার! কই তাকে তো পুলিশ আবার বাসায় দিয়ে এসেছে? বাবুল আক্তারকে ফাঁসাতে কেউ কেউ চেষ্টা করে যাচ্ছেন শুরু থেকেই। তারা চাইছেন এই সুযোগে যদি তাকে সাইজ করা যায়। অনেকে তার শরীরে রাজনৈতিক তকমা লেপে দেয়ার চেষ্টাও করেছেন। কিন্তু কাজ হয়নি। বাবুল আক্তারের মতো মেধাবী অফিসারের জন্য সবার দোয়া আছে।’

সাংবাদিক সন্দীপন বসু লিখেছেন, “অনলাইন নিউজ পোর্টাল বাংলানিউজ এবং তাঁদের সাংবাদিকতার ‘বিশ্বস্ত সূত্র’ এর প্রতি একরাশ ঘৃণা জমিয়ে রাখলাম আমার দিনলিপিতে।” তার এ লেখায় মন্তব্য করতে গিয়ে আরেক সাংবাদিক বলেছেন, শুধু আজকের নিউজের রেফারেন্স দিলেই চলবে না, গত এক বছরে এমন অসংখ্য প্রতিবেদন আছে বাংলানিউজে যেখানে কাউকে ব্যক্তিগতভাবে/কুরুচিপূর্ণ ভাষায় আক্রমণ করা হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে অভিযুক্তকে আত্মপক্ষ সমর্থনেরও সুযোগ দেওয়া হয়নি।

সাংবাদিক তৌহিদুল আলম বলেছেন, ‘ভাইরে দেশে উন্নতমানের স্ক্রিপ্ট রাইটারের অভাব পড়ছে। সাংবাদিকতা ছাইড়া সাসপেন্সের স্ক্রিপ্ট লেখেন, এসব বাদ দেন। সারাদিন ধরে যেভাবে একটা পরিবারের প্রাইভেসী নষ্ট করছেন এরপর আর সাংবাদিকতা ছেড়ে দেয়া ভালো। রাস্তার লোকজনই সাংবাদিক হয়… অযোগ্যরাই এখন ডমিনেট করে …।’ তিনি আরো বলেন, ‘আমি একটা রিট করতে চাই। কেউ কি হেল্প করবেন? আমার পেশার মান সম্মানের জন্যে এটা করা উচিত। ব্রেকিং নিউজ, এক্সক্লুসিভ এসবতো পরের কথা … আমার রিটের বিষয়বস্তু হবে কারা সাংবাদিকতায় আসতে পারবে আর কারা পারবে না। সম্পাদকের যোগ্যতা কি হওয়া উচিত? প্রেস কাউন্সিলতো ঠুটো জ¹নাথ? এসব নিয়ে রিট করতে চাই। কেউ কি সাহায্য করবেন? দেখি কার বুকের ছাতি কত বড়?’

সাংবাদিক রানা হানিফ বলেন, ‘বাবুল আক্তারকে নিয়ে দেশের বেশ কয়েকটি শীর্ষস্থানীয় (এলেক্স রেটিংয়ের ভিত্তিতে, অনেকে আবার ভিডিওসহ নিউজ দেন) অনলাইন নিউজ পোর্টালের মারমার কাটকাট নিউজ। এরপর আগের নিউজ সরিয়ে নতুন নিউজ। এরপর সে অবস্থানেরও পতন দেখে মনে হচ্ছে রোজায় ভালোই ধরেছে।’ একই পেশার আরিফুল ইসলাম আরমান বলেন, ‘বিশ্বস্ত সূত্রের বরাত দিয়ে যে সব অনলাইন সাংবাদিক ভুয়া নিউজ দিয়ে পোর্টালের হিট বাড়াতে ব্যস্ত সে সব সাংবাদিককে কারওয়ান বাজারে সার্ক ফোয়ারাতে ঝুলিয়ে রাখা উচিত। যাতে অন্যরা এ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে।’

সাংবাদিক মাহমুদ মনি বলেছেন, ‘যেসব বলদ সাংবাদিক, পুলিশকে উদ্ধৃত করে মৃত একজন নারীর গায়ে কালিমা লেপন করছেন, ব্রেকিং নিউজ লিখছেন, তার আগে নিজে একটুও অনুসন্ধান করার চেষ্টা করলেন না? এখানে কোনো নাটক আছে কি-না? সেইসব সাংবাদিকদের জন্য সত্যিই আমার করুণা হয়! আপনাদের মনে কি একবারও মনে হলো না, বাবুল আক্তার তো এমন দু-চারজন ব্যবসায়ীকে ক্রসফায়ারের নামে অনায়াসেহত্যা করতে পারতেন! তিনি কেন তার দুটি অবুঝ শিশুকে এভাবে মাতৃহীন করবেন? নিজের স্ত্রীকে কেন এতো সুন্দর নাটকের নায়িকাবানাবেন?’


শেয়ার করুন