বাবুলকে নিয়ে ষড়যন্ত্রতত্ত্ব : তার শ্বশুর-শ্যালিকা কী বলছেন

mitu-_118230

পুলিশের অত্যন্ত সৎ ও চৌকস কর্মকর্তা বাবুল আক্তারকে খুনের সাথে জড়িয়ে যে কথাবার্তা চাউড় হচ্ছে তাকে উড়িয়ে দিয়েছে তার শ্বশুরপক্ষ। বাবুল আক্তার নিজেই এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত বলে তদন্তসংশ্লিষ্টদের বরাত দিয়ে কোনো কোনো সংবাদমাধ্যম প্রচার করেছে। তবে স্ত্রীকে সরিয়ে দিলে বাবুলের কী লাভ হবে সে বিষয়টিও পরিষ্কার নয়। তদন্তের কোন পর্যায় থেকে এমন তথ্য উঠে এসেছে—এ প্রশ্নের উত্তরও মিলছে না।”মিতুর বাবা সাবেক ওসি মোশাররফ হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি না বাবুল আমার মেয়ে হত্যায় জড়িত। ১২ বছর আমার মেয়ের সঙ্গে বাবুলের ঘরসংসার। বাবুলকে ছাড়া মিতু ১২ দিনও আমার বাসায় একা থাকেনি। তাদের মাঝে কোনো বিষয় নিয়ে সমস্যা হলে সেটা আমরা অবশ্যই জানতাম।’এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাবুলের শ্যালিকা বলেন, ‘আমরা কী করে বিশ্বাস করি আপার সঙ্গে দুলাভাইয়ের সম্পর্ক খারাপ ছিল। কোনো দিনও শুনিনি। আর যদি আমরা বিশ্বাসই করতাম যে দুলাভাই আমার আপাকে খুন করেছে তাহলে কি আমরা তাকে এখানে আশ্রয় দিতাম? রেঁধে-বেড়ে খাওয়াতাম?’ বাবুল আক্তারের শ্বশুর মোশাররফ হোসেন দৃঢ়তার সঙ্গে সমকালকে বলেন, ‘পুলিশের চাকরিতে শুধু ভালো কাজ করলে চলে না, পাশাপাশি পরিবেশ-পরিস্থিতি বুঝে পা ফেলতে হয়। বাবুল কখনও ব্যাক গিয়ারে পা ফেলেনি। এটাই তার জন্য বিপদ ডেকে এনেছে। তাই এত কথা হচ্ছে। এখন সে বন্ধুহীন, এখন সে বিপদে আছে। হয়তো সময় পেরোলে অনেক কথা বলা যাবে, অনেক সত্য বেরিয়ে আসবে।’ ;”বাবুল চাকরি থেকে ইস্তফা দিয়েছেন কি-না বা এ নিয়ে মেয়ের জামাইয়ের সঙ্গে তার কথা হয়েছে কি-না। তিনি বলেন, ‘এমন প্রশ্ন আমাদের অনেকেই করছে। শ্বশুর হিসেবে বাবুলের কাছে এ ব্যাপারে জানতেও চেয়েছি। উত্তরে সে শুধু বলেছে, যারা এই কথা বলছেন, পুলিশ কর্তৃপক্ষের কাছে থেকে তারাই জানুক, আসল সত্য কী। স্ত্রীকে হারিয়েছি, এরপর আবার চাকরি থেকে ইস্তফা দেওয়ার প্রশ্নও আসছে?’” বাবুল আক্তার কেন গণমাধ্যমকে এড়িয়ে চলছেন, এটা কি কোনো চাপে, নাকি মানসিকভাবে স্থির না হওয়া- এ প্রশ্নের জবাবে মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘জিজ্ঞাসাবাদ শেষে বাসায় আসার ঠিক আগে বাবুল ফোন করে আমাদের জানায়, সে রিলিজড। তবে এসব বিষয়ে কারও সঙ্গে কথা বলার ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ রয়েছে। মিতু হত্যার পর বাবুলকে পুলিশ সদর দপ্তর আবার চট্টগ্রামে যাওয়ার প্রস্তাবও দেয়। কিন্তু মানসিক অবস্থা ভালো না থাকায় সে রাজি হয়নি। আর এখন তো সব পরিস্থিতিই যেন বদলে যাচ্ছে। মিতুর কবরস্থানেও পুলিশ পাহারা ছিল। কয়েক দিন আগে তা সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।’

মোশাররফ হোসেনের কাছে জানতে চাওয়া হয়, বাবুল আক্তারের সরকারি গাড়ি প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে কি-না। উত্তরে তিনি বলেন, ‘সত্যি কথা বলতে গেলে, বাবুল এখন পুলিশ সদর দপ্তরের সঙ্গে যুক্ত। বাবুল ঢাকায় আসার পর থেকে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন থেকে একটি ভাড়া করা গাড়ি বাবুলকে দেওয়া হতো। ওই গাড়ির চালক প্রায় প্রতিদিনই ফোন করে কখন আসবে জানতে চাইত। কয়েক দিন ধরে গাড়ির চালক কোনো খোঁজখবর নিচ্ছে না। বাবুলও অবশ্য বাইরে যাচ্ছে না।’বাবুল আক্তারের শ্বশুর মোশাররফ হোসেন মোশাররফ হোসেন বলেন, বাবুল সাহসী কর্মকর্তা। প্রফেশনাল জেলাসিও থাকতে পারে। ৬০ জনের বেশি কর্মকর্তা একসঙ্গে এসপি হিসেবে পদোন্নতি পেয়েছে। তবে পদায়ন হয়েছিল শুধু বাবুলের। বাবুলের দুই শিশুর দিনরাত্রি কেমন কাটছে জানতে চাইলে তার শ্বশুর বলেন, ‘মাহির মানসিক অবস্থা সবচেয়ে খারাপ। ওর সামনে মিতুকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। আর চার বছরের তাবাসসুম তাপুও বুঝতে পারছে, মা আর কোনোদিন আসবে না। সোমবার বাসা গোছগাছ করার সময় তাপু এর কারণ জানতে চায়। বাসার একজন বলে, তাপু আজ তো তোমার জন্মদিন। উত্তরে তাপু বলে, আম্মু নেই। আর কোনোদিন আমার জন্মদিন হবে না। হঠাৎ গভীর রাতে উঠে বাসায় হেঁটে হেঁটে মাকে খুঁজে বেড়ায় সে। ওদের মানসিক চিকিৎসা করতে চিকিৎসকের অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেওয়া হয়েছে। যদিও আতঙ্কে ঘরের বাইরেও এখন যাওয়া যায় না।’বাবুল আক্তারের দুই সন্তানকে জড়িয়ে তার এক আত্মীয় জানা গেছে, বাবুল আক্তারের শ্যালিকা বোনের দুই সন্তানকে যত্ন করছেন। তাদের হাসিখুশি রাখার চেষ্টা করছেন। তিনি একটি মেডিকেল কলেজের চতুর্থ বর্ষের ছাত্রী। তার স্বামীও একজন ডাক্তার। পরিবারের সবাই মিলে বাবুল আক্তার ও তার দুই সন্তানকে মানসিকভাবে শক্ত রাখার চেষ্টা করছে।

এদিকে বাবুল আক্তারের ঘনিষ্ঠ এক আত্মীয় কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বাবুল যদি তার স্ত্রীকে হত্যাই করে তাহলে এত পরিকল্পনা করে করতে হতো? চট্টগ্রামের পুলিশ অফিসার হিসেবে তার জানার কথা ঘটনাস্থলে ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরা আছে। তাহলে কেন আসামিদের দিয়ে স্বীকারোক্তি আদায় করা হচ্ছে যে বাবুলই এর সঙ্গে জড়িত?’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমরা শুনেছি তাকে চাকরি থেকে পদত্যাগের চাপ দেওয়া হচ্ছে। এটাই নানা রহস্যের জন্ম দিচ্ছে। সে যদি দোষী প্রমাণিত হয় তাহলে তার চাকরি তো এমনিতেই চলে যাবে। তাকে চাকরি ছাড়ার চাপ দিতে হবে কেন? আর যদি সে দোষী না হয় তাহলে কেন এত কথা হচ্ছে? কেন তাকে চাকরিতে ফিরিয়ে নেওয়া হচ্ছে না। এর পেছনে নিশ্চয়ই কোনো বড় ধরনের ষড়যন্ত্র কাজ করছে।’ তিনি আরো বলেন, ‘আমার বিশ্বাস, বাবুল আক্তারের কোনো অভিযানের কারণে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাখোশ হয়েছেন।

এ কারণে বাবুলকে শায়েস্তা করতে এত বড় প্ল্যান।’ তিনি আরো বলেন, ‘বাবুল আক্তারের রাজনৈতিক বিশ্বাস নিয়েও মিডিয়াতে আলোচনা দেখছি। আমার প্রশ্ন হলো, সে ১১ বছর আগে পুলিশ বাহিনীতে যোগ দেওয়ার পর শুধু আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেই সাড়ে সাত বছর চাকরি করছে। এই সময়ের মধ্যে তার ভূমিকা কী ছিল? এই সময়ের মধ্যেই সে এএসপি থেকে অতিরিক্ত এসপি ও এসপি পদে পদোন্নতি পেয়েছে। সে তার কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ গত তিন বছরে বিপিএম, পিপিএম পদক পেয়েছে।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমার ধারণা, একের পর এক পুরস্কার পাওয়া, অভিযানে কাউকে ছাড় না দেওয়া—এসব কারণেই বউকে মেরে বাবুলকে শিক্ষা দিতে চাইছে কোনো মহল।’ জানা গেছে, ১৫ ঘণ্টা ‘জিজ্ঞাসাবাদের’ জন্য বসিয়ে রাখা হলেও মূলত বাবুল আক্তারকে শুক্রবার রাতে ১৫ মিনিট ও শনিবার বিকেলে ১৫ মিনিটের মতো ‘জিজ্ঞাসাবাদ’ করা হয়েছে। চট্টগ্রামের পুলিশ কমিশনার ইকবাল বাহারের নেতৃত্বে কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তা তাঁকে ‘জিজ্ঞাসাবাদ’ করেছেন। এ সময় মামলাসংক্রান্ত বিষয় নিয়ে কথা বলার চেয়ে বাবুল আক্তারকে পুলিশের চাকরি ছেড়ে দেওয়ার জন্য চাপ দেওয়া হয়েছে বেশি। তাকে জানানো হয়, ‘ওপরের সিদ্ধান্ত’ অনুযায়ী তাকে চাকরি ছেড়ে দিতে হবে। তা না হলে বিপদে পড়তে হবে। বাবুল আক্তারকে দ্রুত তার সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য বলে সেখান থেকে চলে যান ওই কর্মকর্তারা।


শেয়ার করুন