বাংলাদেশে মাদক দ্রব্যের বিস্তার ও প্রতিরোধের উপায়

মোজাম্মেল হকঃ

মাদক কি: মাদকের অভিধানিক অর্থ- ঔষধ। যে সমস্ত প্রাকৃতিক দ্রব্য বা রাসায়নিক দ্রব্য গ্রহণ করার ফলে একজন মানুষের মনের অনুভুতি ও চিন্তা চেতনা স্বাভিক অবস্থা থেকে অস্বভাবিক অবস্থায় রূপান্তরিত হয় অর্থাৎ মনের মানসিকতার পরিবর্তন ঘটে তাকেই মাদক বলে।
মাদকাসক্তি কি: কোন বিশেষ মাদক দ্রব্যের উপর মানস্তাত্ত্বিক ও শারীরিক ভাবে অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা ও সেই মাদক গ্রহণের তীব্র আকাঙ্খাই হচ্ছে মাদকাসক্তি। মাদক ব্যবহার হঠাৎ বন্ধ করলে শরীরের উপর উক্ত মাদক প্রত্যাহারের কারণে মারাত্নক প্রতিক্রিয়া দেখা যায়।
মাদকাসক্তির কারণ সমূহ: মূলত তিনটি কারণে মাদকাসক্তি ঘটে-
১. শারীরিক গঠনগত বা জৈবিক।
২. ব্যক্তি ভিত্তিক
৩. পারিপার্শ্বিক বা পরিবেশগত যেমন
ক) বন্ধু বান্ধবের প্রভাব
খ) কৌতুহল/ নতুন অভিজ্ঞতা গ্রহনের ইচ্ছা।
গ) নৈতিক ও ধর্মীয় শিক্ষার অভাব।
ঘ) হতাশা ক্ষোভ এবং মূল্যবোধের অভাব।
ঙ) পরিবারের অন্যদের মাদক দ্রব্য গ্রহণ।
চ) বেকারত্ব/ অবসর কাটানোর সুযোগ না থাকা।
ছ) মাদকের কুফল সমম্পর্কে জ্ঞান না থাকা।
জ) সন্তানের প্রতি সঠিক ভাবে লক্ষ না রাখা।
ঝ) হাতের কাছে সহজেই মাদক দ্রব্য পাওয়া।
ঞ) খারাপ দৃষ্টিভঙ্গি ও যৌনশক্তি বৃদ্ধির ইচ্ছা।
মাদকের ক্ষতির দিক সমূহ: মাদক ও মাদকাসক্তি বর্তমানে এক জাতীয় সমস্যায় পরিণত হয়েছে। দেশের অধিকাংশ মাদকসেবী কিশোর-কিশোরী এবং যুবক- যুবতী। যে যুব সমাজের উপর দেশের শিক্ষা-দীক্ষা, উন্নতী, অগ্রগতি ও ভবিষ্যৎ নির্ভরশীল, তাদের উল্লেযোগ্য একটি অংশ যদি মাদকাসক্তিতে পথভ্রষ্ট হয়ে পড়ে তবে সে দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত হওয়ায় যথেষ্ট কারণ রয়েছে। এ ভয়ঙ্কর অভিশাপ থেকে যুব সমাজকে রক্ষা করা জরুরী হয়ে পড়েছে। ফেন্সিডিল, মদ, হুইস্কি, ইয়াবাসহ সকল প্রকার মাদক দ্রব্য যা নেশা সৃষ্টি করে সুস্থ মস্তিস্ক বিকৃতি ঘটায় এবং জ্ঞান ও স্মৃতি শক্তি লোপ করে দেয় তা ইসলামের দৃষ্টিতে যেমন হারাম এবং রাষ্ট্রীয় ভাবে তা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। মাদক মানুষের শরীরে বিভিন্ন ক্ষতি সাধন করে থাকে। নেশাদ্রব্য গ্রহণের ফলে ধীরে ধীরে মানুষের হজম শক্তি বিনষ্ট হয়ে যায়, খাদ্যস্পৃহা কমে যায়, চেহারা বিকৃত হয়ে পড়ে, স্নায়ু দূর্বল হয়ে পড়ে এবং শারীরিক ক্ষমতা লোপ পায়। আবার অনেক মাদকদ্রব্য এমন আছে যা সম্পূর্ণরূপে কিডনী বিনষ্ট করে দেয়। মস্তিস্কের লক্ষ লক্ষ সেল ধ্বংস করে ফেলে, যেটা কোন চিকিৎসার মাধ্যমেই সারানো সম্ভব নয়।
বাংলাদেশে মাদকরে ভয়াবহতা: মাদকদাসিক্ত নিয়ে বিভিন্ন গবেষণা থেকে জানা যায়, মাদক দ্রব্যের সবচেয়ে বিপদ জনক দিক হচ্ছে এটি সমাজের তরুণ ও যুবকদের আকৃষ্ট করে। ফলে জাতির সূল্যবান সম্পদ তরুণ ও যুবকরা মাদকদ্রব্যের বেড়াজালে আটকা পড়ে তাদের সুন্দর ভীবষ্যৎকে পতই দাড়িয়ে পড়েছে। মাদকদ্রব্য দাবানলের মতই ছড়িয়ে পড়েছে দেশের বিবিন্ন শহরে বন্দরে, গ্রামে-গঞ্জে, স্কুল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে। নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক অধ্যাপক এমদাদুল হক ২০১৮ সালে এক গবেষণায় বলেছেন, দেশের প্রায় ৭০ লাক মাদকাসক্ত রয়েছে, যাদের অধিকাংশই ইয়াবাসেবী। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের হিসাব মতে বাংলাদেশে মাদক সেবীর সংখ্যা ৬০ লাখ, এর মধ্যে প্রায় অর্ধেকই ইয়াবাসেবী। বাংলাদেশে এক সময় মাদক হিসাবে হিরোইন ও ফেন্সিডিল বহুল প্রচলিত থাকলে ও ১৯৯৯ সাল থেকে ভয়াবহ মাদক ইয়াবা সে স্থান দখল করে আছে।
মাদকের চাহিদার ফলে মাদকের সরবরাহ ও বেড়েছে। বাংলাদেশ ভারত সীমান্তের প্রায় ৩০টি রুটের ৫১২টি পয়েন্ট দিয়ে প্রতিদিন বালাদেশে মাদকদ্রব্য প্রবেশ করছে। বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের প্রায় ১৫টি পয়েন্ট দিয়ে প্রতিদিন বাংলাদেশে প্রবেশ করছে ভয়াবহ মাদক ইয়াবার বড় বড় চালান। বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকার একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায় যে, গত এক যুগে মাদকাসক্ত ছেলের হাতে ২৭৩ জন মা-বাবা নৃশংস ভাবে খুন হয়েছে। একই সময়ে মাদকাসক্ত স্বমীর হাতে প্রাণ গেছে ৩ শতাধীক নারীর। মাদকসেবী বাবার হাতে নৃশংস ভাবে খুন হয়েছে ১১ জন সন্তান।

মাদক প্রতিরোধের উপায়: মাদক প্রতিরোধে পরিবার ও সমাজের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।
পারিবারিকভাবে:
১. সন্তানের উপর খেয়াল রাখতে হবে যেন সে কোন অস্বভাবিক জীবন যাপন করছে কিনা, কেমন বন্ধু-বান্ধবের সাথে সে মিশছে।
২. পরিবারের কেউ মাদকাসিক্ত হলে তাকে এর খারাপ দিকগুলো বুঝাতে হবে এবং প্রয়োজনে চিকিৎসার মাধ্যমে তাকে সুস্থ করে তুলতে হবে।
৩. খেলাধুলাসহ বিভিন্ন সমাজিক কাজে নিয়োজিত থাকতে উৎসাহিত করতে হবে।
সামাজিক ভাবে:
৪. মাদকদ্রব্য প্রসার রোধে এর খারাপ দিক সম্পর্কে গণসচেতনতা সৃষ্টি করা।
৫. মাদকাসক্তদের সুস্থ করে সামাজে প্রতিষ্ঠা করা।
৬. মাদকদ্রব্য সহজলভ্যতা রোধ করা।
৭. নৈতিক শিক্ষা কার্যক্রম গ্রহণ করা।

মোজাম্মেল হকঃ
প্রভাষক
রাষ্ট্র বিজ্ঞান বিভাগ
টেকনাফ সরকারি কলেজ।


শেয়ার করুন