বাঁকখালী নদীতে ২০ কিলোমিটারে ৩০ ড্রেজার

ডেস্ক নিউজঃ

কক্সবাজারের বাঁকখালী নদীতে ড্রেজার বসিয়ে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের মহোৎসব চলছে বলে অভিযোগ উঠেছে। নদীটির কিছু দূর পর পরই বসানো হয়েছে ড্রেজার আর ড্রেজার। কক্সবাজারের রামুর চাকমারকুল থেকে গর্জনিয়া ইউনিয়নের থিমছড়ি পর্যন্ত নদীর প্রায় ২০ কিলোমিটার এলাকায় সরকারি বালুমহাল রয়েছে ২টি। অথচ নদীর এতটুকু স্থানে অন্তত অর্ধশতাধিক ড্রেজার মেশিন বসিয়ে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। নদীটির বালু উত্তোলনে জড়িত রয়েছেন স্থানীয় ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মী এবং স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের কয়েকজন চেয়ারম্যান।

বান্দরবান জেলার নাইক্ষ্যংছড়ির পাহাড়ী ঝর্ণাধারা থেকে নেমে আসা বাঁকখালী নদীটি রামু ও কক্সবাজার শহর অতিক্রম করে মিলিত হয়েছে বঙ্গোপসাগরে। কক্সবাজারের অর্থনীতিতে বাঁকখালী নদীর অনেক গুরুত্ব রয়েছে। রামু ও কক্সবাজার সদর উপজেলার ১০টি ইউনিয়নের কয়েক লাখ বাসিন্দা নদীটির উপকারভোগী। এসব ইউনিয়নগুলো হচ্ছে রামুর ঈদগড়, গর্জনিয়া, কচ্ছপিয়া, কাউয়ারখোপ, ফতেখাঁরকুল, চাকমারকুল, রাজারকুল, দক্ষিণ মিঠাছড়ি ও কক্সবাজার সদরের ঝিলংজা এবং পিএমখালী।

কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. মামুনুর রশীদ এ বিষয়ে সোমবার সন্ধ্যায় কালের কণ্ঠকে জানিয়েছেন- ‘আমি গতকাল সোমবার রামু উপজেলা পরিষদ পরিদর্শনে গিয়ে বাঁকখালী নদীতে ড্রেজার বসিয়ে বালু উত্তোলনের কথা স্থানীয় সংবাদকর্মীদের নিকট শুনেই স্থানীয় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এবং উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) কে কঠোর পদক্ষেপ নিতে নির্দেশনা দিয়েছি। নদী থেকে ড্রেজারে বালু উত্তোলন সবার জন্য নিষিদ্ধ। এমনকি সরকারি বালু মহাল ইজারাদারও ড্রেজার বসিয়ে বালু উত্তোলন করতে পারবেন না। পরিস্থিতি সামাল দিতে প্রয়োজনে মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে জেল-জরিমানা করারও নির্দেশনা প্রদান করেছি।’

সরেজমিন দেখা গেছে, নদীর চাকমারকুল ইউনিয়নের (ইউপি) এলাকায় রয়েছে প্রায় ১৬টি ড্রেজার। নদীর তলদেশে ড্রেজার বসিয়ে উত্তোলন করা হচ্ছে বালু। ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা নুরুল ইসলাম নুরুর তত্ত্বাবধানেই সবগুলো ড্রেজার নিয়ে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। ওই এলাকায় রয়েছে খালেদ হোসেন টাপু নামের একজন বালু মহাল ইজারাদারের ৩টি ড্রেজার। ইজারার মহালটিও পরিচালনা করেন স্থানীয় চেয়ারম্যান।

সরকারি নিষেধাজ্ঞা অমান্য করেই বাকঁখালীর তলদেশ থেকে অবৈধ ড্রেজার মেশিন বসিয়ে বালি উত্তোলন করার অপরাধে ইতিপূর্বে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) চাকমারকুল বালু মহালের ইজারাদার খালেদ হোসেন টাপুকে বিশ হাজার টাকা জরিমানাও করেছিল। চাকমারকুল ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে ড্রেজার প্রতি টাকা নেওয়ারও অভিযোগ রয়েছে। তবে ইউপি চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম নুরু বালু উত্তোলনে জড়িত এবং টাকা নেওয়ার কথা অস্বীকার করে বলেন-‘নতুন একজন উপজেলা চেয়ারম্যান কয়েকদিন আগে যোগদান করায় সব ড্রেজার সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। বালু উত্তোলনে অন্যান্যরা জড়িত তবে আমি নই।’ নদীর তীর দিয়ে যাওয়ার সময় চোখে পড়ে কিছু দূর অন্তর অন্তর বসানো ড্রেজার। দেখলে মনে হয়, কোনো জেলে মাছ ধরছে। নদীতে ড্রেজার বসিয়ে পাইপ দিয়ে বহুদূরে নিয়ে যাওয়া হয় বালু। প্রত্যেক বালু উত্তোলনের পয়েন্টে বেশ কয়েকটা বালু পরিবহনের ডাম্প ট্রাক এবং রয়েছে স্কেভেটরও। কাউয়ারখোপ ইউনিয়নের চেরাংঘাটায় সুলতান আহমদ নামের একজন ড্রেজার বসিয়ে বালু উত্তোলন করছেন। তিনি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে আবেদন করেছেন বালু উত্তোলনের অনুমতির জন্য। সেই অনুমতিতে সুপারিশ করেছেন ইউপি চেয়ারম্যান শামশুল আলমের সঙ্গে রামু উপজেলা প্রকৌশলী মনজুর হাসান ভুঁইয়াও। যেখানে জেলা প্রশাসক বলেছেন, ড্রেজারে বালু উত্তোলন নিষিদ্ধ সেখানে উপজেলা প্রকৌশলীর মতো একজন সরকারি কর্মকর্তা কিভাবেইবা সুপারিশ করেন তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।

নদীর ফতেখারকুল হাইটুপি নামক স্থানে রয়েছে অপর একটি সরকারি বালু মহাল। জেলা প্রশাসকের দপ্তর থেকে এটি ইজারা নিয়েছেন রামু উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক নুরুল হক চৌধুরী। ইজারার বালু মহালেও ড্রেজার বসানোর অনুমতি না থাকা সত্বেও তিনি একাই বসিয়েছেন ৬টি ড্রেজার মেশিন। আবার নদীর আরো উজানের একটি এলাকায় তিনি ২টি ড্রেজার বসিয়েছেন। এ বিষয়ে তিনি জানান- ‘ইজারা নিয়েছি ৪৫ লাখ টাকায়। ড্রেজার বসানোর নিয়ম না থাকার কথা আমি জানি কিন্তু ড্রেজার না বসালে আমার বিনিয়োগের টাকা তুলতে পারব না।’

রাজারকুল ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি সরওয়ার কামাল সোহেল, আলাউদ্দিন নামের একজন স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা, রাজারকুল ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মুফিজুর রহমানসহ আরো অনেকেই নদীতে ড্রেজার বসিয়ে বালু উত্তোলন করছেন। অবস্থা এমনই দাঁড়িয়েছে যে বালু উত্তোলনের ব্যবসা লাভজনক হওয়ায় সেখানে স্থানীয় প্রভাবশালীরা প্রতিযাগিতা দিয়ে ড্রেজারে বালু উত্তোলন করতে ছুটছেন।

রামুর মুক্তিযোদ্ধা মোজাফ্ফর আহমদ জানিয়েছেন, দীর্ঘদিন ধরে অব্যাহতভাবে বালু উত্তোলন করায় নদীর দুই তীরে ভাঙন শুরু হয়েছে। এমনকি কক্সবাজারের রেল লাইন প্রকল্পের কয়েকটি পয়েন্টসহ কক্সবাজার-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কিয়দংশ এখন ঝুঁকির মুখে পড়েছে।


শেয়ার করুন