বহিষ্কৃত নেতাদের দলে ফেরাচ্ছে আ.লীগ

31.jpg_4772_0.31
পাঁচ সিটি কর্পোরেশন এবং উপজেলা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন সময় বহিষ্কৃত নেতাদের বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করতে যাচ্ছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। দলের কার্যনির্বাহী সংসদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এরই মধ্যে বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার চেয়ে সাধারণ সম্পাদক বরাবর আবেদন করতে শুরু করেছেন ‘নামমাত্র’ বহিষ্কৃত নেতারা। এর ভিত্তিতে বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহারের প্রক্রিয়াও শুরু হতে যাচ্ছে। দলীয় সূত্রে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
সূত্র জানায়, ১৮ মার্চ দলের সাধারণ সম্পাদক এবং এলজিআরডি মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের কাছে দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক কার্যালয়ের একজন স্টাফ দুটি চিঠিতে তার স্বাক্ষর নিতে যান। এর মধ্যে একটি জেলা-উপজেলা পর্যায়ে যেসব নেতাকে জেলা কমিটি বহিষ্কার করেছে সেগুলো প্রত্যাহারের অনুরোধ জানিয়ে এবং অন্যটি জেলায় জেলায় সদস্য নবায়ন ও সংগ্রহের রসিদের মুড়ি চেয়ে চিঠি।
সৈয়দ আশরাফের ঘনিষ্ঠ সূত্র জানায়, তিনি দ্বিতীয় চিঠিতে স্বাক্ষর করলেও বহিষ্কার সংক্রান্ত চিঠিটি দলীয় সভানেত্রীর পরামর্শক্রমে স্বাক্ষর করবেন উল্লেখ করে ফেরত দেন। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এ সংক্রান্ত চিঠিটি এখন দলীয় সভানেত্রীর কাছে জমা আছে। তার মতামত পেলেই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা সাপেক্ষে বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহারের নির্দেশ দিয়ে সৈয়দ আশরাফ স্বাক্ষরিত চিঠি জেলা নেতাদের কাছে পাঠানো হবে। এছাড়া কেন্দ্র থেকে যেসব নেতাকে ‘লোক দেখানো’ বহিষ্কার করা হয়েছিল তাদের বহিষ্কারাদেশও প্রত্যাহার করার চিঠি দেয়া হবে।
এ প্রসঙ্গে দলের সর্বশেষ কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকেও আলোচনা হয়। দলীয় সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদকদের তাদের দায়িত্বপ্রাপ্ত স্ব-স্ব বিভাগে বহিষ্কার সংক্রান্ত জটিলতার বিষয়ে জানতে চান। তিনি তাদের জেলা নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে সমন্বয়ের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেয়ার নির্দেশ দেন।
উল্লেখ্য, বিভিন্ন সময়ে উপনির্বাচন, জেলা-উপজেলা-ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন, সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে দলীয় নির্দেশ অমান্য করে দল মনোনীত বা সমর্থিত প্রার্থীদের বিরোধিতা করে অনেক আওয়ামী লীগ নেতা নির্বাচনে অংশ নেন। গাজীপুর, রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল ও সিলেট সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থীর ছড়াছড়ি হওয়ায় দলীয় নেতারা কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলেন। কিন্তু দলের গঠনতন্ত্রে বহিষ্কার সংক্রান্ত নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ার কথা উল্লেখ করে দলীয় সভানেত্রী তখন বলেন, হঠাৎ করেই কাউকে বহিষ্কার করা যায় না। এরপর বিদ্রোহীদের বারবার সতর্ক করা হয়। এরপরও যারা প্রার্থিতা প্রত্যাহার বা দল মনোনীত-সমর্থিত প্রার্থীদের বিরোধিতা অব্যাহত রাখেন তাদের কাউকে স্থানীয়ভাবে, কাউকে কেন্দ্র থেকেও বহিষ্কার করা হয়। অধিকাংশ সিদ্ধান্ত নেয় তৃণমূল পর্যায়ে জেলা বা উপজেলা কমিটি। ক্ষেত্রবিশেষে দলের দফতর থেকেও অনেককে বহিষ্কার করার কথা জানিয়ে গণমাধ্যমে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয়।
আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী জেলা-উপজেলা কমিটি কাউকে বহিষ্কার করতে পারে না। এমনকি কেন্দ্রীয় কমিটিও কাউকে বহিষ্কার করতে হলে কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠক ডেকে অধিকাংশের মতামতের ভিত্তিতে অভিযুক্তকে কারণ দর্শানো এবং জবাব পাওয়ার পর সেটা গৃহীত না হলেই কেবল এ সিদ্ধান্ত নিতে পারে। জেলা-উপজেলা কমিটি কাউকে বহিষ্কার করতে চাইলে সংশ্লিষ্ট নেতার বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে ধরে কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের কাছে সুপারিশ করে চিঠি দিতে হবে। সেটি গৃহীত হলে কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদ নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
দলের গঠনতন্ত্র বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ৪৬নং অনুচ্ছেদে প্রাতিষ্ঠানিক শৃংখলা শিরোনামের ‘ঠ’ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘জাতীয় নির্বাচনে কেহ দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে প্রার্থী হইলে দল হইতে সরাসরি বহিষ্কার হইবেন এবং যাহারা দলীয় প্রার্থীর বিরোধিতা করিবেন, তদন্ত সাপেক্ষে মূল দল বা সহযোগী সংগঠন হইতে বহিষ্কার হইবেন।’
‘ক’ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘দলের কোনো সদস্য আদর্শ, লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, গঠনতন্ত্র ও নিয়মাবলী বা প্রতিষ্ঠানের পরিপন্থী কার্যকলাপে অংশগ্রহণ করিলে এবং বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ কাউন্সিল, কার্যনির্বাহী সংসদ, সংসদীয় বোর্ড বা সংসদীয় পার্টির বিরুদ্ধে কোনো কাজ করিলে শৃংখলাভঙ্গের অভিযোগে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদ তাহার বিরুদ্ধে যে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করিতে পারিবে।’ ‘ঙ’ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘অভিযুক্ত ব্যক্তিকে যুক্তিসঙ্গত সময় দিয়ে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিতে হইবে।’ এছাড়া অন্যান্য অনুচ্ছেদের সারসংক্ষেপ এমন দাঁড়ায় যে, কাউকে বহিষ্কার করতে হলে সংশ্লিষ্ট কমিটির দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের সমর্থন, তার ওপরের কমিটির অনুমোদন সাপেক্ষে তা দলের সাধারণ সম্পাদকের কাছে পাঠাতে হবে। সাধারণ সম্পাদক সেটা কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে তুলবেন। ওই বৈঠকে অনুমোদন হলেই কেউ বহিষ্কার বলে গণ্য হবেন। তবে কেউ চূড়ান্ত বহিষ্কার হলেও জাতীয় কমিটিতে এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপিল করতে পারবেন। এ সংক্রান্ত সর্বশেষ প্রকৃষ্ট উদাহরণ দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য লতিফ সিদ্দিকীর বহিষ্কারের ঘটনা। গত বছরের অক্টোবরে ধর্মীয় বিষয়ে বিতর্কিত মন্তব্য করায় দল থেকে বহিষ্কার হন আবদুল লতিফ সিদ্দিকী। তাকে বহিষ্কারের লক্ষ্যে কার্যনির্বাহী সংসদের দুই দফা বৈঠক হয়। প্রথম বৈঠক থেকে তাকে কারণ দর্শানো হয়। জবাব পাওয়ার পর চূড়ান্তভাবে বহিষ্কারের জন্য দ্বিতীয় দফা বৈঠক করা হয়। এ নিয়ম দলের যে কোনো পর্যায়ের নেতাদের জন্যই প্রযোজ্য।
দলীয় সূত্র জানায়, নামমাত্র বা লোক দেখানো বহিষ্কার নিয়ে দলের সর্বশেষ কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে আলোচনা হয়। এর ভিত্তিতে বহিষ্কৃতদের বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহারের আবেদন করতে বলা হয়েছে। আবেদনপত্র যাচাই-বাছাই করে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা এবং দলীয় সভানেত্রীর রাজনৈতিক কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, এ পর্যন্ত বেশ কয়েকজন নেতা তাদের বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার চেয়ে দলের সাধারণ সম্পাদক বরাবর আবেদন করেছেন। দলের যুগ্ম সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ যুগান্তরকে বলেন, এবার আর ঢালাওভাবে বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার হবে না। কারও আবেদনের ভিত্তিতে তার বিষয়ে খোঁজখবর নিয়ে, যাচাই-বাছাই করে তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
উল্লেখ্য, ২০১২ সালে টাঙ্গাইল-৩ আসনে উপনির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থী হওয়ায় আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কার হন আমানুর রহমান খান রানা। গত বছরের মার্চে বিয়ানীবাজার উপজেলা পরিষদে দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে নির্বাচন করায় চেয়ারম্যান প্রার্থী আবুল কাশেম পল্লব এবং দুই ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থী খসরুল হক ও ফয়ছল আহমদকে বহিষ্কার করা হয়। সর্বশেষ গত বছরের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে ঢাকা-৪ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ায় ড. আওলাদ হোসেনকে বহিষ্কার ঘোষণা করা হয়। নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের কাউন্সিলর নজরুল ইসলামসহ সাত খুনের মামলায় প্রধান আসামি সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি নূর হোসেনকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। তার সঙ্গে সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হাজী মো. ইয়াসিন মিয়াকেও বহিষ্কার করা হয়। যুগান্তর


শেয়ার করুন