বন উজাড় ও পাহাড় কাটা কেন বন্ধ হবে না?

মাত্র এক যুগে পার্বত্য চট্টগ্রামের এক-চতুর্থাংশ বনভূমি ধ্বংস করা হয়েছে। পাহাড়ের ভূতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য নষ্ট করে নির্মাণ করা হয়েছে একের পর এক সড়ক। সেখানে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোয় গড়ে তোলা হয়েছে বসতি ও অবকাঠামো। এতে ভূতাত্ত্বিক গঠন নষ্ট হয়ে পাহাড় ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এর সাথে এবার অতিবৃষ্টি হওয়ায় বড় ধরনের ধস ও বিপর্যয় ঘটে গেল। বিভিন্ন গবেষণার ফলাফল ও বিশেষজ্ঞদের পর্যবেক্ষণে এ কথা বলা হয়েছে।
বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের ট্রাস্টি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড জিওগ্রাফিক্যাল ইনফরমেশন সার্ভিসেস এবং আন্তর্জাতিক সংস্থা ওয়াটার এইড বাংলাদেশের যৌথ গবেষণায় বলা হয়েছে, এক যুগে তিন পার্বত্য জেলায় বিভিন্ন ধরনের বনভূমি কমেছে তিন লাখ ৩২ হাজার ৩৬ হেক্টর। গত মে মাসে তারা এই প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছেন।
২০১২ সালে জাতিসঙ্ঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) এশিয়ার দেশগুলোয় ‘পাহাড়ধস ও বনভূমি’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। এতে ভারতের পূর্বাঞ্চল, নেপালের তরাই উপত্যকা এবং বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বিভাগের পাহাড়ধসের কারণ হিসেবে বনভূমি ধ্বংস হওয়া বা কমে যাওয়াকে দায়ী করা হয়েছে। গত ৩০ বছরে বাংলাদেশে বর্ষা মওসুমে বৃষ্টিপাত বৃদ্ধি পেয়েছে ৮ শতাংশ। তা ছাড়া বিশ্বজুড়ে আবহাওয়ার অস্বাভাবিক পরিবর্তনে এখন বৃষ্টিপাত হঠাৎ করে প্রবল আকার ধারণ করে। কোনো কোনো সময় মাত্র ৫-৬ ঘণ্টায় ১৫ দিনেরও বেশি সময়ে যা হওয়ার কথা সে পরিমাণ বৃষ্টিপাত হয়ে যায়। ফলে পাহাড়গুলো আরো ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
এ ছাড়া পরিবেশ আন্দোলনকারীদের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, ১২ জুন মধ্যরাতে তিন পার্বত্য জেলায় একের পর এক পাহাড়ধসের ঘটনায় দেখা যায়- উত্তর-দক্ষিণে বিস্তৃত সড়কগুলোর দুই পাশের পাহাড়গুলো বেশি ধসেছে। এসব পাহাড়ে বিভিন্ন স্তরে বালু ও মাটির স্তর রয়েছে। এ ধরনের বিশেষ ভূতাত্ত্বিক গঠনকে আমলে না নিয়ে এবং সম্ভাব্য ধস রোধের কোনো রকম ব্যবস্থা না রেখেই সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে।
ভৌগোলিক গঠন নষ্ট করে সড়ক নির্মাণের পর পাহাড়গুলোর ওপর আরেক বিপদ তৈরি করেছে নির্বিচারে বসতি স্থাপনকারীরা। সড়ক নির্মাণের ফলে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠা পাহাড়গুলোয় অপরিকল্পিত বসতি বেড়ে যাওয়ায় বড় বিপর্যয়কর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। সড়কের পাশে বসতি স্থাপন সহজ হওয়ায় সেখানে পাহাড়ের ঢালে অবৈধ বসতি বেড়ে গেছে। ফলে পাহাড়গুলোয় মহাবিপর্যয়ের সৃষ্টি হয়েছে। পাহাড় কেটে নানা পর্যটনকেন্দ্র স্থাপন এবং সরকারি-বেসরকারি স্থাপনা নির্মাণের ক্ষেত্রে পাহাড়ের ভূতাত্ত্বিক গঠন ও ঝুঁকিকে আমলে নেয়া হয়নি।
পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমির ধরন, পানির প্রবাহ ও বৈরী আবহাওয়াকে বিবেচনায় না নিয়ে নানা ধরনের উন্নয়ন প্রকল্প ও বসতি স্থাপিত হয়েছে। এর ফলে বনভূমি ও পানির উৎসগুলো ধ্বংস হয়ে গেছে। ভবিষ্যতে যাতে এমনটি আর না ঘটে তার জন্য তিন পার্বত্য জেলা রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি এবং কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের ভৌগোলিক গঠনের কোনো পরিবর্তন হয়ে গেল কি না, সামনে আরো বড় বিপর্যয়ের আশঙ্কা আছে কি না- তা দ্রুত সমীক্ষা চালিয়ে দেখতে হবে। সেখানকার মানুষকে বাঁচাতে হলে এ ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।
পরিবেশবিদরা বলছেন, পার্বত্য জেলাগুলোর মাটির গঠনবিন্যাসের ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার সাথে যোগ হয়েছে নির্বিচার পাহাড় কাটা। এসব কারণে পাহাড়গুলো শুকনো, ভঙ্গুর ও ঝরঝরে হয়ে উঠেছে। ফলে মাটির বন্ধন নষ্ট হওয়ায় তার মধ্য দিয়ে পানি চুইয়ে ভেতরে চলে যায় এবং পাহাড়ের কাঠামো দুর্বল করে। তখন মুষলধারে বৃষ্টি হলে পাহাড়ের ধস নামা দ্রুত হয়। প্রবল বৃষ্টির স্রোতে পাহাড়ের ওপরের শক্ত স্তরের মাটি ধুয়ে নিম্নাঞ্চলে চলে যায়। তার পরের দুর্বল প্রকৃতির স্তর সহজেই ভেঙে পড়ে। কোনো কোনো স্থানে পাহাড়ে ফাটল ধরে থাকে। তাতে বৃষ্টির পানি পাহাড়ের আরো গভীরে গিয়ে মাটির স্তরকে আরো দুর্বল করে দেয়। পরিণতিতে ঘটে যায় ভয়াবহ পাহাড়ধস।
পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রবীণ ব্যক্তি ও পর্যবেক্ষকরা বলেছেন, এবার পাহাড়ধসের যে বিরাট বিপর্যয় ঘটল তা সাম্প্রতিককালের সবচেয়ে ভয়াবহ। কয়েক যুগ ধরে অপরিণামদর্শী মানুষের নানামুখী অত্যাচারে ওই তিন পার্বত্য জেলার পাহাড়ের প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হয়ে গেছে। জনবসতি এলাকার বাইরে অনেক দুর্গম এলাকায়ও পাহাড়ের গায়ে বড় বড় ফাটল দেখা গিয়েছে।
গত ১২ জুন মধ্যরাতে তিন পাহাড়ি জেলা এবং চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার এলাকায় যে মঙ্গা বিপর্যয় ঘটে গেছে তাতে পাহাড়ধসে যে প্রায় ১৬০ জন মারা গেছে, তার মধ্যে শুধু রাঙ্গামাটিতেই ১০৫ জন প্রাণ হারায়। দেশের তিন পার্বত্য জেলা বনভূমি ও পানির উৎসের বিএসিজিআইএম এবং ওয়াটার এইডের একটি যৌথ সমীক্ষায় দেখা গেছে, ২০০৩ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে এখানে ২৭ দশমিক ৫২ শতাংশ প্রাকৃতিক বন ধ্বংস হয়েছে। আর ৬১ শতাংশ পাহাড়ি ঝরনা শুকিয়ে গেছে। ফলে পাহাড়ি অঞ্চলের মাটির বুনন নষ্ট হয়ে তা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। একই সময় ২৮ দশমিক ০৫ শতাংশ কৃষিজমি বেড়েছে। ভূ-উপগ্রহ থেকে নেয়া ভূমির ছবির ওপর ভিত্তি করে এসব তথ্য পাওয়া যায়।
ধসের সাথে পাহাড়ে বনভূমি কমে যাওয়ার সরাসরি সম্পর্ক আছে। গত কয়েক যুগে প্রাকৃতিক বন কেটে গজারি, সেগুন, রাবার ও বনজ বাগান তৈরি করা হয়েছে। এগুলোর শিকড় ছোট ও লতাগুল্ম কম। এতে মাটি আলগা ও শুকনো হয়ে গেছে। তদুপরি অতি বৃষ্টির ফলে মাটি দ্রুত ভেঙে পড়েছে। ফলে পাহাড়ধসের মতো বিপর্যয় ঘটেছে।
অপরিকল্পিতভাবে পাহাড়ের যত্রতত্র ঘরবাড়ি বানিয়ে যেমন বন উজাড় করা হচ্ছে, তেমনি পাহাড়ের পাদদেশে রাস্তার পাশে বাড়ি করে বিপদ বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। বন বিভাগ ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে পাহাড়ে বনায়নের তেমন উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে না। স্থানীয় উপজাতিরাও বনায়ন পছন্দ করে না তাদের পূর্বতন পদ্ধতির জুমচাষের স্বার্থে।
বেসরকারি সংস্থা দুর্যোগ ফোরামের সূত্র বলছে, পাহাড়ে বনভূমি ধ্বংস হওয়া, ঝরনা শুকিয়ে যাওয়া এবং অপরিকল্পিতভাবে সড়ক ও বসতি নির্মাণের পরিণামে পাহাড়ধসের হার ক্রমাগতভাবে বাড়ছে। ২০০৭ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে তিন পার্বত্য জেলা এবং কক্সবাজার ও চট্টগ্রামে বহু পাহাড়ধসে ৪৯০ জন মারা গেছে।
বন ও পাহাড়খেকোদের পার্বত্যাঞ্চল থেকে উৎখাত না করতে পারলে আবার ভূমিধসের মহাবিপর্যয়ে পড়তে হবে। বিশ্বে প্রাকৃতিক পরিবেশের দ্রুত পরিবর্তনের কারণে জলবায়ুর মারাত্মক পরিবর্তন হচ্ছে। আইন অনেক আছে, কিন্তু তার প্রয়োগ দেখা যায় না। প্রশাসনের নাকের ডগা দিয়ে বনখেকো ও পাহাড়খেকোরা তাদের অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু প্রশাসনের প্রত্যাশিত প্রতিক্রিয়া নেই। যখন কোনো একটি পাহাড়ধস ঘটে, তখন কুম্ভকর্ণের কানে পানি যায়। তাই কয়েকদিন হইচই, ত্রাণ বিতরণ ইত্যাদি চলে। তারপর সব চুপচাপ। যারা অবৈধভাবে পাহাড়ের পাদদেশে বসতি স্থাপন করে তাদের কেন উচ্ছেদ করা হয় না? উপযুক্ত জায়গায় তাদের পরিকল্পিতভাবে বসতির ব্যবস্থা কেন করা হয় না? তাহলে তো এত লোকের অকালমৃত্যু হতো না। যারা অবৈধভাবে পাহাড়ের মাটি কেটে নেয় কিংবা বন উজাড় করে, তাদের কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। পার্বত্য এলাকায় বহু সেনাক্যাম্প আছে। পুলিশ, বিজিবি ছাড়াও তাদের পাহাড় রক্ষার দায়িত্বে অংশীদার করলে মনে হয় সমস্যার তীব্রতা কমবে।
লেখক :
প্রকৌশলী এস এম ফজলে আলী
পরিবেশবিদ ও পানিবিশেষজ্ঞ


শেয়ার করুন