কক্সবাজার-টেকনাফ মহা সড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ: শিশুসহ ২ জনের লাশ উদ্ধার

বন্যা কবলিত ৫ লাখ মানুষের দুর্বিসহ জীবন

Cox--After-Comen-----বিশেষ প্রতিবেদক:

ঘুর্নিঝড় ‘কোমেন’র প্রভাব কাটিয়ে উঠার দিন না পেরুতেই কক্সবাজারের চকরিয়া ,পেকুয়া,কক্সবাজার সদর,ও রামু উপজেলার ৫ লাখ মানুষ আবারো বন্যার পানির তোপের মুখে পড়েছে। শুক্রবার বিকাল থেকেই কক্সবাজারের এই ৪ উপজেলার ৩৩টি ইউনিয়নের প্রায় শতাধিক গ্রাম বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। এইসব গ্রামের ২০ হাজার বসতবাড়ী এখন পানির নিচে। বিভিন্ন স্থানে বিদ্যুৎ ব্যবস্থা বিপর্যন্ত হয়ে পড়েছে। শুক্রবার ভোর থেকে জেলাজুড়ে থেমে থেমে মুষলধারে বৃষ্টিপাতও হয়েছে। সেই সাথে ধমকা হাওয়া বয়ে যায়। অন্যদিকে পানিবন্ধী হাজার হাজার লোকজন নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে ছুটছেন, কোথায়ও মাথাগুজার জায়গা পাচ্ছে না। সকল বাড়ি পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে। যে খানে উচুঁ উচুঁ ভবন রয়েছে বর্তমানে সেই সব ভবনগুলোতেও নেই কোনো থাকার ব্যবস্থা। সকল ভবনে লোকেলোকারন্য হয়ে পড়েছে। গত এক সপ্তাহ ধরে এ সব এলাকার কারো ঘরের চুলোয় আগুন জলেনি, রান্নার করতে না পারায় শ’শ’ পরিবারের লোকজন অর্ধাহারে দিন যাপন করছে। অপরদিকে কক্সবাজারে ঈদগাও বানের পানিতে ভেসে যাওয়া স্থানীয় আবুল কালামের পুত্র জুবাইর আহমদ (৫) নামের এক শিশুর লাশ উদ্ধার হয়েছে ইসলামাবাদে।

শুক্রবার দিবাগত রাতে ওই এলাকার পার্শ্ববর্তী বিল থেকে লাশটি উদ্ধার করা হয়। অন্যদিকে শনিবার বাকখালী রামু গর্জনিয়াস্থ বাঁকখালী নদী থেকে পাহাড়ী ঢলে ভেসে যাওয়া উপজাতির মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। সে নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ২৪২ নং মৌজার মিকিè মুরুং ছেলে পারই মুরুং (৩০)। সে গত এক সপ্তাহ আগে নাইক্ষ্যংছড়িতে বানের পানিতে ভেসে গিয়ে বাকখালী নদীতে নিখোজ ছিল। কোমেনের প্রভাবে গত ৩দিনে কুতুবদিয়া,মহেশখালী,টেকনাফের শাহপরীদ্বীপ,পেকুয়ার উপকূল এলাকার ৩০ কিলোমিটার বেড়ীবাধ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। একদিকে পুর্ণিমার প্রভাবে সৃষ্ট উচ্চ জোয়ার অপরদিকে বন্যার পানি মিলিয়ে দুর্ভোগে পরা হাজার হাজার মানুষের ত্রাহি অবস্থা।

মাতামুহুরী ও বাঁকখালী নদীর পানি বিপদ সীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। কক্সবাজার-টেকনাফ মহাসড়কের কয়েকটি পয়েন্ট দিয়ে বন্যার পানি প্রবাহিত হওয়ায় এইসড়কে যান চালাচল আজ শনিবার সকাল থেকে বন্ধ রয়েছে। তবে কক্সবাজার মেরিনড্রাইভ রোড দিয়ে বিকল্প হিসাবে যানবাহন চলাচল করছে। এদিকে গত গত বুধবার মধ্যরাতে ঘুর্নিঝড় কোমেনের আঘাতে টেকনাফের সেন্টমার্টিন দ্বীপে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্থ হয়। ২দিন পর কোস্টগার্ড,রেডক্রিসেন্টন কর্মীরা আজ সকালে সেন্টমার্টিনে গিয়ে ব্যাপক উদ্ধার কার্যক্রম শুরু করেছে।

 ১ সপ্তাহ ধরে কক্সবাজারের কয়েকটি উপজেলায় চলছে বন্যার মারাতœক তান্ডব। শুক্রবারের ঘুর্নিঝড় ‘কোমেন’র প্রভাবে ৩/৪ ফুট উচ্ছতার জোয়ার । এতে করে কক্সবাজারের উপকুল এলাকার কয়েক লাখ মানুষ পাহাড়ী ঢল আর সামুদ্রিক নোনা পানিতে আবারো তলিয়ে গেছে।

কক্সবাজারে ৪ উপজেলার স্কুল-মাদ্রাসাসহ বিভিন্ন এলাকা শিক্ষাপ্রতিষ্টান এখনো ডুবে আছে পানির নিচে। ভেসে গেছে শত শত মৎস খামার। বন্যাকবলিত এলাকায় ত্রাণসামগ্রী না পাওয়ায় অনেক মানবেতর জীবন যাপন করছে। প্রত্যেকের ঘরে সংগ্রহে রাখা ধান ও চাল পানিতে ভিজে নষ্ট হয়ে গেছে। গত এক সপ্তাহ ধরে এ সব এলাকার কারো ঘরের চুলোয় আগুন জলেনি, রান্নার করতে না পারায় শ’শ’ পরিবারের লোকজন অর্ধাহারে দিন যাপন করছে। গৃহপালিত গরু ছাগল হাঁস মুরগি নিয়েও বিপাকে পড়েছে মানুষ।সেখানে চলছে ত্রানের জন্য হাহাকার। এলাকাবাসী ভেলা ও নৌকায় করে যাতায়াত করছে। উপজেলার সাথে যোগাযোগের শাখা সড়ক গুলো ডুবে যাওয়ায় মানুষের দাঁড়ানোরও জায়গা নেই। এক অবর্ণনীয় অবস্থা বিরাজ করছে সর্বত্র। এ ছাড়া বিভিন্ন ইউনিয়নের গ্রামীণ সড়কগুলো পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় যোগাযোগব্যবস্থা আরও ভেঙে পড়েছে।

বিশেষ করে চকরিয়া ও পেকুয়া উপজেলার বদরখালী,কোনাখালী,পশ্চিম বড় ভেওলা, ঢেমুশিয়া,বিএমচর,কৈয়ারবিল,চিরিঙ্গা, কাকারা,ফাশিয়াখালী,হারবাং,বরইতলি,লক্ষারচর, চকরিয়া পৌরসভা,মগনামা,উজানটিয়া,পেকুয়া সদর ইউনিয়নের ১৫ হাজারেরও অধিক বসতবাড়ী পানির নিচে। রামু ও কক্সবাজার সদর উপজেলার ১৩ টি ইউনিয়নের ৫ হাজার বসতবাড়ী গতকাল শুক্রবার রাত থেকে পাহাড়ী ঢলের পানিতে তলিয়ে গেছে। অপরদিকে একদিকে উজান থেকে নেমে আসছে পাহাড়ীঢল অপরদিকে ভেঙ্গে যাওয়া বেড়ীবাধ দিয়ে ঢুকছে জোয়ারের পানি। এর ফলে দুর্বিসহ জীবনযাপন করছে এই সব এলাকার মানুষ। সড়কের উপর পানি চলাচল করায় যানবাহন চলাচল বন্ধ রয়েছে অনেক জায়গায়।

হাজার হাজার বন্যাদুর্গতরা বর্তমানে সাইক্লোন সেল্টারে ও পলিতিনের টাবু টাঙ্গিয়ে পরিবার পরিজন নিয়ে আশ্রায় নিয়েছে আঞ্চলিক মহাসড়কের উপর। দীর্ঘ সময় সেখানে আশ্রয় নেয়ার কারনে দুর্গত পরিবার গুলোতে খাবার ও বিশুদ্ধ পানীয় জলের সংকট দেখা দিয়েছে। বন্যাদুর্গত এলাকায় মানুষের মাঝে দেখা দিয়েছে নানা রোগের প্রার্দুভাব।

সামুদ্রিক জোয়ার ও পাহাড়ী ঢলে বেড়ীবাধ ভেঙ্গে যাওয়ার কারনে বন্যার পানি দ্রুত সাগরে নেমে যেতে পারচ্ছেনা। ফলে টিউবওয়েল গুলো পানিতে ডুবে থাকায় বিশুদ্ধ পানি ও খাবার সংকট দেখা দিয়েছে। এই অবস্থায় স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরাও উদ্বেগ উৎকন্ঠায় রয়েছে। এই সব জনপ্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, পানি উন্নয়ন বোর্ডের ভেঙ্গে যাওয়া বেড়িবাঁধের একাধিক পয়েন্ট দিয়ে মাতামুহুরী নদীর ঢলের পানি প্রতিনিয়ত লোকালয়ে ঢুকছে।

কক্সবাজারে রামু উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান রিয়াজুল আলম জানিয়েছেন, বাঁকখালী নদীর পানি ৭দিন ধরে বিপদ সীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এ কারনে বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে। ঘূর্ণিঝড় কোমেন এর প্রভাবে বৃষ্টিপাতের ফলে প্লাবিত এলাকাগুলো এখনো পানিতে একাকার হয়ে আছে। বন্যা কবলিত লোকজন বাসস্থান, খাদ্য, পানি সহ নানা সংকটে সময় পার করছেন। একমাস আগের বন্যার ক্ষয়ক্ষতির চিহ্ন না মুছতেই নতুন করে আবারো বন্যা এবং ঘূর্ণিঝড় এর প্রভাবে দমকা হাওয়া ও টানা বৃষ্টিপাত রামুবাসীর দূর্ভোগ আরো বাড়িয়ে দিয়েছে।

কুতুবদিয়া উপজেলা পরিষদেও চেয়ারম্যান নুরুল বশর চৌধুরী জানিয়েছেন, কুতুবদিয়ায় বেড়িবাঁধ না থাকায় উত্তর ধূরুং, লেমশীখালী, কৈয়ারবিল ও বড়ঘোপের দক্ষিণ মুরালিয়ায় পূর্নিমার জোয়ারের পানি ডুকেছে। প্রতিদিন সাগর থেকে সরাসরি লোকালয়ে সমুদ্রের নুনা পানি ডুকে বিস্তীর্ণ এলাকার আউশ ফসল ও বহু বসতঘর তলিয়ে গেছে। গত বৃহস্পতিবার ঘূণিঝড়ের কোমেনের আঘাত ও পক্ষকালের টানা ভারী বর্ষণে এমনিতে পানিবন্দী দেড় লাখ মানুষ। তার ওপর পূর্ণিমার জোয়ারের পানিতে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত দ্বীপের মানুষ।

এ অবস্থার সপ্তাহ ধরে বানের পানিতে ভাসছে বিস্তৃীণ জনপদ। জন প্রতিনিধিরা অভিযোগ করেছেন, সরকারিভাবে পর্যাপ্ত পরিমাণ ত্রাণ বরাদ্ধ না থাকায় এলাকার দুর্গত পরিবার গুলোকে ত্রাণ সহায়তা দেয়া যাচ্ছেনা। এ অবস্থার উত্তোরণের লক্ষ্যে তাঁরা অবিলম্বে পর্যাপ্ত ত্রাণ সহায়তা নিশ্চিত করতে প্রশাসনের কাছে জরুরী হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।

এদিকে ঘুর্নিঝড় কোমেনের আঘাতে প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিনে বসতবাড়ী হারিয়ে শতাধিক পরিবার খোলা আকাশের নিচে বসবাস করছে। আজ শনিবার সকালে টেকনাফ থেকে কোস্টগার্ড এবং রেডক্রিসেন্টনের কর্মীরা সেন্টমার্টিনে উদ্ধার কার্যক্রম ও ত্রান সহয়তা শুরু করে।


শেয়ার করুন