সিটিএন এর সাপ্তাহিক আয়োজন

বঙ্গোপসাগরীয় সভ্যতার ১০ কবির কবিতা

শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতির ক্ষেত্রে চলমান সাহিত্য পত্রিকার যে গতানুগতিক চিন্তাধারা তার উল্টে পিঠে হাঁটতে চাই আমরা। সব-সময় কবিতার বিষয়-আঙ্গিকে-প্রকরণে-মৌলিক সৌন্দর্য ও গণমনের মুক্তচিন্তার সংবেদনাকে সম্মানের সহিত এগিয়ে দিতে চাই। মানুষের মহৎ চিন্তার বাঁকে বাঁকে, ভাঁজে ভাঁজে আমরা ঢুকিয়ে দিতে চাই বিপ্লবও বিদ্রোহের চিন্তাবীজ। যে চিন্তাবীজ ফুটবে বর্ষায়, ষড়ঋতুর ভরসায়। সিটিএন এর এই নতুন আয়োজন ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হবে। ভবিষ্যতে বদলে যাবে এর চেহারা আমরা সেভাবে আগাচ্ছি। জয় তো সিটিএন, জয় তো নূতন কবিতা।    মনির ইউসুফ-সম্পাদক, কবিতার রাজপথ



1010709_10152217035074807_2764863704871143466_nসুলতান আহমেদ
জয়বার্তা নেই

 

 

 

যেদিকে তাকাই ভাঙা কাঁচে প্রতিবিম্ব
ভেঙে চুরে দূরে সরে যায়
চেনা আদলেও অপরিচয়ের ধূলোমাখা তীর
ক্ষয়জীর্ণ লাঙ্গলের ফলা
অকর্ষিত মাটি খরাতপ্ত শষ্য অফলন দাহ
বৈরাগী বৃষ্টিও দেশান্তরে , যাযাবার মেঘ
ভিনগ্রহে বাসর সাজায়;
ফুল নেই পাখি নেই বাঁশীও বাজেনা
সত্যের সপক্ষে নেই দৃঢ় কোন সাক্ষ্য
শক্তির অনুকুলে অঢেল সাফাই।

কোলাহলে ভীড় শুধু বাড়ে
পদজট শব্দজট কান্নাজট-গ্রন্থি বেড়ে যায়।
ডিঙোলেই মোক্ষলাভ প্রতীক্ষায় ‘দিল্লী দূর অস্ত’
তাপদাহ চাপদাহ বোধের দহন
আরশি নগরে নেই বসতি পড়শীর
জয়বার্তা কোথাও শুনি না।



 

সিরাজুল হক সিরাজ

উরুর পাণ্ডুলিপি

অসীম অসুখে দিনগুজরান করি
সদরঘাটের ঝুঁপড়িতে সাঁজ নেয় সন্ধ্যার তানপুরা
পানের দোকানে পুরনো খালা
ইশারায় পথ চিনিয়ে দেয়
তারপর খিল পড়ে দরজায়
গিঠ ছাড়ে এগার হাত বিষণœ নদী
নতুন বইয়ের মতো খুলে যায় উরুর পান্ডুলিপি

শেষ পর্যন্ত সঙ্গমেই পোষমানে নারী
বজ্রপাতেই হাঁফ ছাড়ে মেঘের শরীর

হুরপরী দুধের নহর পানপাত্র দরকার নেই
ইহকালে ডুবতে চাই ফর্দহীন উজানি উষ্ণতায়



ভাগ্যধন বড়ুয়া
শাদাকালো ছবি

বুঝিনি তোমার তোলা শাদাকালো ছবি!
মেঘ নাকি নুন ?

মেঘের সীমান্ত জুড়ে আকাশ
নুনের দিগন্ত ব্যাপি শাদা
এখনও বিভ্রম হই কাঁপা কাঁপা মনে…

ভাবি মেঘ, ঝরে যাবে মনের গোচরে
দেখি নুন, জমে থাকে চোখের দু’কোণে
কুহক জালের দোল কোলে পিঠে বাঁধা
রঙগুলো সরে যায় শাদাকালো দেহে!

এখনও বুঝিনা আমি ছবির আধার…

 

 



najib-1

 

সেবন্তী ঘোষ

বিবাহিত মেয়েদের সমস্যা

নারীবাদ ছাড়া বিবাহিত মেয়েরা কিচ্ছু লিখতে পারে না
কারণ তখন তারা আর নারী থাকে না; বাদী ও বিবাদীর মধ্যে
ঘুরপাক খায়। বিবাহিতা মেয়েরা আর মেয়েও থাকে না, কারণ
তখন তাদের বউ, স্ত্রী অথবা বউদি নামে ডাকা হয়। সবেচেয়ে
বিপদ হয় বিবাহিতারা কবিতা লিখতে এলো। তাদের কাছে
ভদ্রতা আর সহবৎ আশা করে, তারাও নিখুঁত গার্হস্থ
লেখে, সমাজ পরিবর্তন আর পরিবার ব্যবস্থা নিয়ে দু চার বাক্য
দেয়। কবিতা যে কী বিষম বস্তু অনেকেই জানেন।
বিবাহিতাদের কাছে তাই প্রেমের কবিতা আশা করেন না।

বিবাহিতা মেয়েরা আজকাল পাঁঠা ও কুকুর নিয়ে কবিতা
লিখছে। বিবাহিতা মেয়েরা আজকাল চমৎকার ভুতের গল্প
লেখে। কেবল মাঝেমধ্যে তাদের লেখায় ঘুরে ফিরে আসে
তাদের বরেরা।



মনির ইউসুফ

সমাজবদ্ধ বেদনা

মানুষের শিরায় শিরায় অবাধ্যতা, কেশে কেশে শিহরণ
কি করে তাকে বাধ্য করবে পৃথিবী,
কি করে তাকে করবে গ্রহণ
পুষ্পবাগানে আরক্ত সে, সৃষ্টিশীলতায় অন্তহীন

সাতষট্টি অশ্বমেধ জাহাজের চেয়েও দ্রুত তালে চলে তার চিন্তা
মানুষ ভ্রমণ করে মনোচোখে
তিনভুবনের মসজিদ মন্দির গির্জা

শালিক ঘুঘু টিয়ে হরিৎবন চারণভূমি
আবাদী এই সমাজবদ্ধ বেদনা
তাকে গ্রহণ করে না,
গ্রহন করে না সময়সিদ্ধ কোন স্বাধীন অধীনা

গুহা থেকে বের হয়ে নারী ও পুরুষ যেমন শরীর ঢেকেছিল বল্কলে
তেমনি বনের আরক্ত গোলাপকে বাগানে তোলে এনে
মানুষ বাধ্য করতে চেয়েছিল

পারেনি
সে এখন আরও বহুগামী
নরকের কাঁটাঝোপে সচেতন ঢোকে পড়ে
বাধ্য সে কখনো হতে পারে না

সচেতন সে, আত্মসচেতন নয়
তাই, তার কাছে নরক প্রিয় দেবালয়

সমাজবদ্ধ দুঃখ, কাতর এই আর্তনাদ বেদনা ও বিষাদে উড়ে
উত্তরাধুনিক যুগেও যাদের হৃদয় গুহার অন্ধকারে ঢাকা
আত্মার ঐশ্বর্য পায়নি খুঁজে
তারাই উপেক্ষায় ফেলে রাখে সকল অধিকার ও সম্ভাবনা
আলোকায়নটাই মানুষের জন্য এক আশ্চর্য নরক।



picasso

 

সোহেল হাসান গালিব
বাঘিনীর বার্তা

 
আমাকে আঁচড় কেটে নির্মম দন্তস্ফুটের পর
হঠাৎ বজ্রপাতের শব্দত্রাসে
যে বাঘিনী ছুটে পালিয়েছে ক্ষীয়মাণ অরণ্যের দিকে,

সে অরণ্য আমি আর দেখি না যে। তবু সেইখানে ধাবমান সব ছায়ার পেছনে
এখনও হয়তো শোনা যায় সমুদ্রের আর্ত কণ্ঠস্বর।
তারও বহুদিন পর, অনেক কুহক ও কুয়াশা-ভোর পার ক’রে
অপহৃত কোনো এক হৃদয়ের জখম-চূড়ায়

কুমারের হাঁড়ি-ভাঙা কালো-ঘুম-রাত্রি শেষে
পলাতকা বাঘিনীটি কে জানে কী আক্রোশে কীসের অনুতাপে

পাঠিয়েছে তার ভাঙা দাঁত, উপড়ানো নখ
তোমাদের সূর্যোদয়-দেশ থেকে

পাঠিয়েছে—সাত-সাতটি পাখির ঠোঁটে—যার নাম চঞ্চুখাম,
যাকে বলে উড়ন্ত হরকরা, ঢিল-পাহাড়ের।
আজ সারাদিন ঐ গগন হরকরাদের ডাকে পাওয়া হিংসা-ছুরি
নেড়ে-চেড়ে দেখি। প্রশ্ন জেগে ওঠে বাঁকানো কাস্তের রূপ ধরে। তারই

ধারের ওপর ন্যস্ত হয়ে থাকি, আমি একা, ডাকসিদ্ধ ডাকাতের মতো।
দূরের শ্মশানচারী বাতাসের দিকে চেয়ে আনমনে

সেই ধার ও ধারালো প্রতীকের ছোঁয়া ক্ষতচিহ্নে বুলাতেই,

যেন ইমালশন, ঢেকে দিলো এই পোড়োবাড়িটির
লোনা-ধরা দেয়ালের স্যাঁতা-পড়া দাগ।

আমি তো অবাক।



 

tidal-1অরণ্য শর্মা
বর্ষাবাস ও প্রিয় মাছরাঙা

 

 

আজ গরমের মাত্রা যেন খুব বেশি
প্রাণটা খাঁ খাঁ করছে, ঘরে টিকে থাকা দায়,
ভাবতেই বেড়িয়ে পড়লাম বিছানা ছেড়ে…
বাহিরে গাছের পাতাটিও নড়ছে না-
উঠান পেরিয়ে রাস্তায় উঠে দেখি চারদিক শুনশান
কেউ কোথাও নেই।
আমি আগাতে থাকলাম-
প্রেসক্লাবের সামনে এসে থমকে দাঁড়ালাম
একি! ভুল দেখছি না তো!
পাঁচটি মাছরাঙা লাইন ধরে হেঁটে চলেছে…
মাছরাঙা আমার প্রিয় পাখি
সবার মাথায় কাগজের ছাতা- আমিতো অবাক!

এরা সব পায়ে হেঁটে চললো কোথায়?
ভাবতেই দেখি পাখি নিল মোড়
বাঁয়ে একটু এগোলেই বাহারছড়া বাজার।
আমিও পিছু নিলাম কি মনে করে তা আর মনে নেই।
বাজার পেরিয়ে পাখি এগিয়ে চললো…
পি টি আই, সানিবীচ ও পানিবোর্ড ফেলে
পাখি থামলো গিয়ে শৈবালের দরোজায়।
ভাবলাম লক্ষ্য বুঝি শৈবালের দিঘীরই মাছ
কিন্তু তা নয়-
উঁকি দিয়ে দেখি দিঘীতে রোদে চৌচির হয়ে আছে মাটি
আর শুকিয়ে যাওয়া ঘাস।
শৈবালকে কখনো এমন দেখি নি-

পাখি এগিয়ে চললো অভ্যর্তনা কেন্দ্রের সামনে দিয়ে
শৈবাল সড়ক ধরে,
মাছরাঙার পিছু পিছু এগিয়ে চলি
আমার বাঁয়ে গলফ মাঠ, ডানে ঝাউবন
সামনে ছাতাওয়ালা পাঁচটি মাছরাঙা।
আমি ছুটছি ঘোরে-বেঘোরে
ঝাউ মাথা সবুজ দেখে দেখে ততক্ষণে মন কিছুটা নরম
আর একটু এগোতেই রৌদ্রময় সমুদ্র, সমুদ্রে প্রচন্ড ঢেউ
সৈকতে হাজারো মানুষ।

বর্ষাবাসে এসে ঢেউ এর মাথায় রাখাইন তরুনীরা জলকেলিতে মত্ত
তরুন যুবারা উত্তপ্ত সৈকতে আর ঝাউবনে তপ্ত শ্বাস ছাড়ছে
কেউবা প্রেঙ খেয়ে চিৎপটাং,
নেশার ঘোরে প্রায় যায় প্রাণ।
সৈকতের বালি মাতাল বাংলা মদের ঘ্রাণে
এরই মাঝে আমি হারিয়ে ফেলি মাছরাঙাদের



আবু নাসের ভূট্টো

অনিবার্য ধূলো রোজই ওড়ে

বিলাসী সমুদ্রের সড়ক ছুঁয়ে
যে নদী মরে গেছে এলোচুলে ভুলে
যেখানে স্বরচিত পদধ্বনি চিনে নেয়
সমুদ্রপথের ধুলো চেনা ঘ্রাণ বিবর্ণ অভিমান
নিশ্চল নিশ্চুপ
আগামী উড়ে যাই একাকী গন্ধবিধুর ধুপ
তখনও সমুদ্র পাড়ের মানুষগুলো ঘুম থেকে ওঠেনি।

সমুদ্র পৃথিবী ক্রমাগত ভেঙে যায়
উবে যায় কালের ওপিট মাধবী সময়
হাজারো ঢেউ-এ জন্ম নেয় সমকামিতা
একদা পুকুর ছিলো
বাগান ছিলো
ছিলো বৈঠকখানার চারছালা ছনের সামিয়ানা
অতএব, দ্বাররক্ষী জানে, বিচূর্ণ নি:শ্বাসের অর্চনা…

মনে পড়ে
যে ছেলেটি নাবালক চোখে স্বপ্ন এঁেক দিতো
জলে ডুবদিয়ে চঞ্চল অনুভূতি অবারিত আলোকিত
সেই ছেলেটি শীৎকারেও খোঁজে শারদীয় সম্প্রীতি
ঈশ্বর স্বাক্ষী আছে
ধুলো উড়ছে-
অনিবার্য ধূলো রোজই ওড়ে।



রাবেয়া সুলতানা
নেশাকাব্য

এমন দিনে তোমার নেশায় বিভোর হয়ে রই
বুকের মাঝে আসন পাতি চোখাচোখি হই
স্বপ্ন ভাসে আকাশেতে নিত্য প্রহর গুনি
নক্সীকাঁথার ফোঁড়ে ফোঁড়ে কাব্যকথা বুনি।
এই করে যে ফুরিয়ে যায় বয়স খাতার মাঠ
সময় গেলে সাধন হবে মনে’তে বিভ্রাট
কাজের মাঝে চিন্তা এসে শঙ্খসুরে দেয় হানা
তোমায় ছাড়া উড়বে কি এই পাখির ডানা?
তোমার ছায়ায়, তোমার পথে লেপ্টে দিয়ে হাত
যাদুর ছোঁয়ায় হঠাৎ করে রাঙ্গা সুপ্রভাত
তোমার ঘোরে, তোমার মোহে জানান দিয়ে মাতি
ভাটার টানে জোয়ার আনে জাগায় রাতারাতি।



12122521_10153371287289807_2818794956940805576_nফরিদা ইয়াসমিন সুমি

বিলীন

বরং সৃষ্টিকর্তা নিজেই স্তুতির প্রেমে মগ্ন
আর আমি তো অতি সাধারন এক মানবী
কী এমন দোষ বলো, না হয় তোমার কাছে একটু স্তুতির স্বীকৃতিই চেয়েছিলাম !
স্বয়ং নদী মুখ বুঝে সুখ খুঁজে নেয় সমুদ্র-বুকে
আর রমণী তো নদীর মতই
কী এমন ক্ষতি বলো, না হয় সমুদ্র ভেবে তোমার বুকে ঝাঁপেই দিয়েছিলাম !
স্বয়ং দিগন্তরেখা অনিমেষ বিলীন হয় আকাশের সোহাগে
আর বিলীন হওয়াতেই তো প্রাপ্তি!
কী এমন দোষ বলো, না হয় অধীর আগ্রহে তোমার সোহাগের প্রত্যাশী হয়েছিলাম


শেয়ার করুন