মুহম্মদ নূরুল হুদা, মনির ইউসুফ

বঙ্গোপসাগরীয় সভ্যতার দুই কবির সৃষ্টিশীল প্রবন্ধ

220px-MNHuda2007Geneva2নজরুলের জয় বাংলা

মুহম্মদ নূরুল হুদা :

পদ্মা-মেঘনা-যমুনা, সুরমা-ধলেশ্বরী-কর্ণফুলী, আরো কতো-শত নদনদীবাহিত, পলিগঠিত এই বঙ্গীয় অববাহিকা। অনাদিকাল থেকে এই ব-দ্বীপভূমিতে বিবর্তমান মানবগোষ্ঠির স্বাতন্ত্র্যসূচক অভিধার নাম বাঙালি। আর তার বসতভূমির নাম বাংলা নামের দেশ। ইতিহাসের অবশ্যম্ভাবী ধারাবাহিকতায় পূর্বদৃষ্টান্তরহিত এক রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন-সার্বভৌম-জাতিরাষ্ট্র হিসেবে জন্ম নেয়ার মুহূর্তে তার সাংবিধানিক নাম হলো ‘বাংলাদেশ’। এ-কারণে এই রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিকের কাছে ‘নদী বা ব-দ্বীপ বা পলি’-র মতো অনিবার্য ভৌগোলিক ও প্রাকৃতিক উপাদানের মতোই ‘বং, বাংলা বা বাঙালি’ শীর্ষক শব্দত্রয়ীও তার সত্তার পরিচয় নির্ণয়ে বিকল্পরহিত ব্যক্তিক ও সামষ্টিক অভিধা। আসলে হাজার বছরের বিবর্তনের ধারায় বাঙালি এই অভিধা স্বতঃপ্রাকৃতিকভাবেই অর্জন করেছে। এই অভিধা যেমন তার আপন অর্জন, তার সামাজিক-সাংস্কৃতিক-নৃতাত্ত্বিক বিবর্তনের পথও প্রায় স্বতঃসিদ্ধতাজাত। তাই এই জাতিরাষ্ট্র ও তার নাগরিকের সার্বিক বিজয় মানে বাংলা ও বাঙালির বিজয়।

ইতিহাসপূর্ব কাল থেকে এই সত্যটি স্বতঃপ্রণোদিতভাবে অনুধাবন করেছেন বাংলার লোককবি, লোকদার্শনিক ও ভাবুকসম্প্রদায়। আর তারই প্রকাশ দেখি ইতিহাস-স্বীকৃত যুগে বাঙালি কবির মৌখিক ও লিখিত অভিব্যক্তিতে। বাংলা ভাষার প্রথম লিখিত দলিল ‘চর্যাপদে’র কবি ভুসুকর কণ্ঠে উচ্চারিত হলো ‘বাঙালি’ অভিধাটি (‘আজি ভুসুকু বঙালি ভইলি’)। মধ্যযুগের কবি শ্রীধর দাসের কণ্ঠে উচ্চারিত হলে তার মাতৃভাষার নাম বাংলা, যদিও তার সাহিত্যচর্চার মাধ্যম ছিল সংস্কৃত। কেননা সমাজ তখন তাঁকে অন্য ভাষায় সাহিত্যচর্চার অধিকার দেয়নি। অথচ তিনিও তাঁর মাতৃভাষা বাংলাকে গঙ্গাজলের মতোই পবিত্র মনে করেছেন। পাশাপাশি স্মরণযোগ্য মধ্যযুগের মুসলমান কবি আবদুল হাকিমের কন্ঠে উচ্চারিত মাতৃভাষার সপক্ষে তীব্র শ্লেষাত্মক উক্তি, ‘যে জন বঙ্গেত জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী / সে জন কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি’। তার পর থেকে বাংলা ও বাঙালিত্বের এই ধারণা, প্রেরণা, শক্তিমত্তা ও বহুমাত্রিকতা বাঙালি কবির চিত্তে কতো বিচিত্র পথে সংজ্ঞায়িত হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। এই বিষয়ে একটি অনুপুঙ্খ গবেষণা হলেই কেবল এর ব্যাপ্তি উপলব্ধি করা যাবে। চর্যা-কবি, মঙ্গল-কবি, পুথি-কবি, বৈষ্ণব-কবি বা বাউল-কবির পরম্পরা পেরিয়ে পাশ্চাত্য মনন-দর্শনে সমৃদ্ধ হয়ে বিশ্বভিখারি ও আধুনিক হওয়ার মুহূর্তেও আধুনিক বাঙালি কবিরা অভ্রান্তভাবে বাংলা নামক দেশ ও বাংলা নামক ভাষার অনিবার্যতার জয়গান করেছেন। মাইকেলের মাতৃভাষা বন্দনা বাঙালির বোধ ও বিবর্তনের ইতিহাসে এ-রকমই এক নির্ণায়ক ঘটনা। আসলে এই হচ্ছে ইতিহাসের সেই কাব্যসম্মত রায়, যা অদ্যাবধি বাঙালি কবি, সারস্বত সমাজ ও বাংলার সর্বশ্রেণীর লোকমানুষকে সর্বাংশে মাতৃভাষী তথা বাংলাভাষী করে রেখেছে। তা নাহলে বাংলাদেশ, বাঙালি জাতি ও বাংলার স্বাধীনতা অর্জনের ইতিহাস অন্যরকম হতে পারতো। ভিন্নভাষা, ভিন্ন সংস্কৃতি ও ভিন্নতর মানসিকতার দাসত্ব বাঙালিকে স্ব-সত্তা থেকে বিযুক্ত করে ঔপনিবেশিকতার স্বর্ণশিকলে চিরপরাধীন করে রাখতো।
আসলে বাঙালি কবির কাছে বাঙালি ও বাংলার জয়গান মানে তার সনাক্তকৃত স্ব-সত্তার স্বাধীনতার গান। এই পথেই বাঙালি এগিয়েছে তার পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতার গন্তব্যে। বঙ্গভঙ্গের আশঙ্কায় ব্যথিত কবিচিত্ত তাই বাউল বাঙালির সুরে ও উক্তিতে বিশ-শতকের শুরুতেই জয়গান করলেন অখণ্ড বাংলার রূপৈশ্বের্যের : ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’। সঙ্গে সঙ্গে তা-ই হয়ে গেলো ধর্ম-বর্ণ-গোত্র-মত-পথ নির্বিশেষে বাঙালির জাতীয় উচ্চারণ। যার সর্বজনীন স্বীকৃতি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত।
আর এই বোধ-বিবর্তনের পথে বাঙালি কবির কণ্ঠে বিজয়সূচক ব্রহ্মধ্বনি : ‘জয় বাংলা’। এটি উচ্চারিত হয়েছে বিশশতকের দ্বিতীয় দশকের শুরুতে, যখন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম তার ‘পূর্ণ-অভিনন্দন’ কবিতাটি লিখলেন। কবিতাটি ১৯২৪ সালে প্রকাশিত তাঁর ভাঙার গান শীর্ষক গ্রন্থে সঙ্কলিত হয়েছে। বলা বাহুল্য, ১৩৩১ বঙ্গাব্দের শ্রাবণ (১৯২৪ সালের আগস্ট) মাসে প্রকাশিত হওয়ার মাস তিনেকের মধ্যে অর্থাৎ ১১ নভেম্বর তারিখে বইটি বৃটিশ সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। তার পর থেকে এই বইয়ের উপর এই নিষেধাজ্ঞাটি আর প্রত্যাহার করা হয়নি। এই গ্রন্থের প্রথম কবিতার প্রথম পঙক্তি, ‘কারার ঐ লৌহ-কবাট / ভেঙে ফেল কররে লোপাট / রক্ত-জমাট / শিকল-পুজোর পাষাণ-বেদী!/’।
মাত্র এগারোটি কবিতা নিয়ে সঙ্কলিত এই ব্রিটিশত্রাসী কাব্যগ্রন্থের চতুর্থ কবিতা ‘পূর্ণ-অভিনন্দন’। অগ্নিযুগের অগ্নিপুরুষ মাদারিপুরের শান্তিসেনাবাহিনীর প্রধান অধ্যক্ষ শ্রীযুক্ত পূর্ণচন্দ্র দাস মহাশয়ের কারা-মুক্তি উপলক্ষে নজরুল এই কবিতাটি রচনা করেন। কবিতাটি তিনি সঙ্গে সঙ্গে আবৃত্তি করেন এবং হারমোনিয়াম সহকারে গেয়ে শোনান। ছয়-পঙক্তির নয়টি স্তবকে সজ্জিত (মোট পঙক্তি ৫৪) এই দীর্ঘ কবিতাটি নজরুল তাঁর স্বভাবসুলভ মাত্রাবৃত্তের ধ্বনি-ঝঙ্কারে সংগ্রথিত করেছেন। প্রতিটি পঙক্তিতে ছয় মাত্রার তিনটি পর্ব ও তারপর একটি অপূর্ণ পর্ব। এই বিন্যাস একটি সুসজ্জিত সৈন্যদলের শৃঙ্খলাপরায়ণ মার্চপাস্টের ভঙ্গি ও বীর্যবত্তাকে স্মরণ করিয়ে দেয়। এই কবিতার সুশৃঙ্খল চরণে-স্তবকে বাংলার ইতিহাস, পুরাণ, কিংবদন্তির পাশাপাশি বাঙালির ভবিষ্যৎ মুক্তিযুদ্ধ ও অবশ্যম্ভাবী বিজয়ের বার্তা আভাসিত হয়ে আছে।
আশ্চর্যজনকভাবে এই কবিতার ৫১ ও ৫২ পঙক্তি নিম্নরূপ : ‘জননীর যবে মিলিবে আদেশ, মুক্ত সেনানী দিবে হুকুম / শত্রু-খড়্গছিন্ন-মুণ্ড দানিবে ও-পায়ে প্রণাম-চুম’। তারপরেই এক অবিসম্বাদিত নেতার প্রতি কবির স্বাগতিক উচ্চারণ : ‘স্বাগত ফরিদপুরের ফরিদ, মাদারীপুরের মর্দবীর, / বাংলা মায়ের বুকের মানিক, মিলন পদ্মা-ভাগীরথীর!’ জননীর আদেশ পেলেই মুক্ত সেনানী হুকুম দেবেন যুদ্ধের, এবং সেই ঘোষিত মুক্তিযুদ্ধে শত্রুর ছিন্ন মস্তক লুটাবে জননীর পায়ের তলায়। এখানে সম্ভাব্য হুকুমদাতা মাদারীপুর তথা ফরিদপুরনিবাসী এক বিপ্লবী, যিনি সদ্য কারামুক্ত। কী আশচর্য, তার মাত্র ৪৭ (১৯৭১-১৯২৪ = ৪৭) বছর পর সর্বযুগের আরেক শ্রেষ্ঠ বাঙালি-বিপ্লবী ‘জননীর আদেশ পেয়ে’ অর্থাৎ ‘নির্বাচনে নিরংকুশ সংখ্যা গরিষ্ঠতা লাভ করে’ ঘোষণা করছেন বাংলার পূর্ণাঙ্গ ‘স্বাধীনতা’ আর হুকুম দিচ্ছেন সর্বাত্মক মুক্তিযুদ্ধের (৭মার্চ, ১৯৭১, বঙ্গবন্ধু, ফরিদপুরবিাসী)। রাজনীতির কবি বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণকাব্যেও ‘স্বাধীনতা’, ‘হুকুম’ ও ‘জয় বাংলা’ ধ্বনিগুচ্ছ দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছে। আর এ-ও লক্ষ্য করার বিষয় যে, কবিতাটির ২৭ নং পঙক্তির শুরতেই ‘জয় বাঙলা’ ধ্বনি বাংলা ভাষায় প্রথম উচ্চারিত : ‘জয় বাঙলা-র পূর্ণচন্দ্র, জয় জয় আদি-অন্তরীণ’। ২৮ নং পঙক্তি : ‘জয় যুগে-যুগে-আসা-সেনাপতি, জয় প্রাণ আদি-অন্তহীন’। এই জোড়া পঙক্তিতে (২৭-২৮) ‘জয়’ ধ্বনিটি ঘূর্ণিছন্দে ৫ বার উচ্চারিত হয়েছে এবং নজরুলের আরেকটি সমুহ গুরুত্বপূর্ণ গদ্যে (‘বাঙালির বাঙলা’) একই আবহে বারবার প্রযুক্ত হয়েছে। ‘যুগে-যুগে-আসা-সেনাপতি’ বলার সঙ্গে সঙ্গে পূর্ণচন্দ্র মহাশয়ের পর ভবিষ্যৎ নেতা-সেনানীদের প্রতিও এই আহ্বান সম্প্রসারিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধু সেই ঐতিহ্যিক ধারারই শ্রেষ্ঠ ও চূড়ান্ত নেতা-সেনানী; আর তাঁর কণ্ঠেই পুনরুচ্চারিত সেই বিজয়-ধ্বনি : ‘জয় বাংলা’। ১৯৪২ সালে রচিত ‘বাঙালির বাঙলা’ প্রবন্ধে নজরুল লিখেছেন, “বাঙালিকে, বাঙালির ছেলেমেয়েকে ছেলেবেলা থেকে শুধু এই এক মন্ত্র শেখাও : ‘এই পবিত্র বাংলাদেশ / বাঙালির – আমাদের।/ দিয়া প্রহারেণ ধনঞ্জয় / তাড়াব আমরা করি না ভয় /যত পরদেশী দস্যু ডাকাত / রামা-দের গামা-দের’। বাঙলা বাঙালির হোক। বাঙলার জয় হোক।! বাঙালির জয় হোক”। কাজেই ‘জয় বাংলা’ শীর্ষক বাঙালির চিরকালীন জয়ধ্বনির উৎস নজরুলের চিরদ্রোহী কবিচিত্ত। তার প্রথম উচ্চারণও যে নজরুলেরই চিরমুক্ত কবিকণ্ঠ, তা আজ তর্কাতীত। নজরুলের ‘বিদ্রোহী আত্মা ও স্বাধীন ঐতিহাসিক সত্তার’ সুস্পষ্ট সনাক্তকারী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সচেতনভাবেই নজরুলের কাছ থেকে এই ব্রহ্মধ্বনি গ্রহণ করে সকল কালের সকল বাঙালির জন্যে পুনরায় উন্মুুক্ত করেছেন। নজরুল সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর মূল্যায়ন এখানে বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক, ‘নজরুল বাংলার বিদ্রোহী আত্মা ও বাঙালির স্বাধীন ঐতিহাসিক সত্তার রূপকার। ৃ পরাধীন জাতির তিমির ঘন অন্ধকারে বিশ্ববিধাতা নজরুলকে এক স্বতন্ত্র ছাঁচে গড়ে পাঠিয়েছিলেন এই ধরার ধুলায়’। কাজেই নজরুল ও বঙ্গবন্ধু উক্তিতে ও উপলব্ধিতে অভিন্ন। একজন বিদ্রোহের উচ্চারক ও পরিকল্পক, অন্যজন তার ধারক ও বাস্তবায়ক। বাঙালির পরিশ্রুত প্রতিকৃতির নাম নজরুল আর বাঙালির শুদ্ধ নাম শেখ মুজিবুর রহমান। আমরা বিশ্বাস করি, এই বিষয়টি বক্ষ্যমাণ কবিতার টেক্সট বিশ্লেষণ করে আরো পূর্ণতা দেয়া আবশ্যক। বিষয়টি সামাজিক ও নান্দনিকভাবে তাৎপর্যপূর্ণ।
যাহোক, বাঙালির এই বিদ্রোহী সত্তা ও বিজয়ী চেতনার ধারাবাহিকতার আলোকে একালের কবির প্রতিধ্বনি :
‘নজরুলেরর সেই ‘জয় বাংলা’ কণ্ঠে নিল বাংলার গণপ্রকৃতি, বিলঝিল, শঙ্খচিল, ধরিত্রী উদগ্রীব ৃ/
নজরুলেরর সেই ‘জয় বাংলা’ কণ্ঠে নিল বাঙালির জাতিপিতা শেখ মুজিব।/
সেই থেকে এই ধ্বনি অনন্তপ্রবাহিনী।/
সেই থেকে এই ধ্বনি বাঙালির বিপদনাশিনী।/
সেই থেকে এই ধ্বনি জনগণমন গিরিতটমন সাগরনদীর।/
সেই থেকে ‘বল বীর বল চির-উন্নত-মম শির’।/

বিদ্রোহী বাঙালি ও বিজয়ী বাঙালির এই জয়ধ্বনি ক্রমপ্রসারমান বিশ্ববাঙালির বুকে-মুখে হয়ে উঠুক এক অসাম্প্রদায়িক ও অভিন্ন উচ্চারণ।

 


 

MONIR eকবি ও ঔপন্যাসিক গ্যুন্টার গ্রাসের মহাপ্রয়াণ

মনির ইউসুফ :

‘কবি সেই সুদীর্ঘ অতীত ও বর্তমান সত্তা, একই সঙ্গে জটিল ও সরল, যেন দাঁড়িয়ে আছেন স্বপ্ন ও বাস্তবতার, দিন ও রাত্রির সীমানা ছুঁয়ে; এবং তাঁরই ভেতর দিয়ে উঠে আসছে সমস্ত প্রকার উপস্থিতি ও অনুপস্থিতি; এবং যেন তিনি হঠাৎ অর্ন্তগত বিস্ফোরণ খুঁজছেন এবং গ্রহণ করছেন সমস্ত ধ্বংস ও বিপর্যয়ের শক্তি ও উন্মেষের মুক্তিমন্ত্র।’ (এমে সেজায়ার)

কট্টর ইউরোপিয় একদেশদর্শী এনলাাইটেন্টমেন্টের বিপক্ষে কথা বলার শেষ সাহসী কবি ও কথাসাহিত্যিক গ্যুন্টার গ্রাস চলে গেলেন পৃথিবীর বাইরে, অন্যলোকে। সাহিত্যে বিংশ শতাব্দীর শেষ নোবেল বিজয়ী গ্রাস মহাজীবনে প্রবেশ করলেন সোমবার ১৩ এপ্রিল ২০১৫। জার্মান লেখকদের মধ্যে গ্যেটে যেমন অনেক মানুষের প্রিয় কবি ও লেখক, তেমনিভাবে গ্যেটে-পরবর্তী শতাব্দীর জার্মান কবি কথাসাহিত্যিক চিত্রকরদের মধ্যে গ্যুন্টার গ্রাসও মানুষের বাস্তব আকাঙ্ক্ষার সাহিত্যিক নায়ক। বাংলাদেশে গ্যুন্টার গ্রাসকে ব্যাপক ও বিপুলভাবে পরিপ্লাবিত হতে দেখি গুন্টার গ্রাসের ঢাকা আবিষ্কার নামক একটি বড় মলাটের গ্রন্থে। ফেব্রুয়ারি ২০০১ ‘আগামি প্রকাশনী’ থেকে প্রকাশিত ‘নাসির আলী মামুন’ সম্পাদিত গ্রন্থটিতে লেখক গ্রাসকে পেয়ে শিল্পের শুভ্রতায় চমকিত হই। পুরো গ্রন্থের পৃষ্ঠায়-পৃষ্ঠায় গ্রাসের বাংলাদেশ ভ্রমণের ছবি এমন আকর্ষণ ও মোহময় করে রাখে, দেখলেই আবিষ্ট হয়ে পড়বে যে কোনো সৃষ্টিশীল মানুষ। মনের ভেতর তৈরি হবে একটি নতুন জগত। গ্রন্থটি দেখে যেমন অনেক কিছু জানা যায়, তেমনি পাঠ করে গ্রাসের মনোভঙ্গি সম্পর্কেও আঁচ করা যায়। নান্দনিক স্বপ্নের পেছনে ছুটতে ছুটতে কোনো এক কৌতূহলী পরিব্রাজক যেন খুঁজে ফিরছেন একটি শান্তিময় পৃথিবী। যে স্বর্গের জন্য পৃথিবীর হাজারো মহৎ-মানব নিজের জীবন ও যৌবনকে ঢেলে দিয়েছেন একান্ত নিজস্বতায়-সার্বভৌম স্বপ্নে, যে স্বর্গের পিছনে ছুটতে ছুটতে তছনছ হয়েছে মানুষের স্বাভাবিক জীবন। অনেক রক্ত-ঋণ, অনেক কষ্ট ও গ্লানি, নির্মমতা, মানুষের হিংস্রতা দেখেছে মানুষ। কিন্তু কোথাও কি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে স্বর্গকানন! সেই স্বর্গ প্রতিষ্ঠা করার জন্য জার্মানিতেও ঘটে গিয়েছিল এক তুলকালাম কাণ্ড, এক ব্যাপক তোলপাড়। সেই তোলপাড়ের ভেতর বেড়ে ওঠে জার্মান তরুণ গ্যুন্টার গ্রাস। স্বদেশের মানুষের নির্মমতা দেখে দেখে ‘বুকের তলে হৃদয় নামক আঁখি’ দিয়ে নীরবে তাকিয়ে থাকেন মূল্যবোধহীন পৃথিবীর দিকে আর গুটিয়ে যেতে থাকেন নিজের ভেতর। গুটিয়ে যেতে যেতেই গহন সুখে আলো জ্বালানোর বিরাট এক দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে মানুষের সামনে হাজির হন তিনি দি টিন ড্রাম নিয়ে। বলা যায়, এই ড্রামের শব্দের ঝংকারে জার্মানি সচকিত হল এবং এরই নিনাদ ছড়িয়ে পড়ল তাবৎ পৃথিবীতে। বিশ্ব সাহিত্য নতুন এক ‘বর’কে খুঁজে পেল তার আঙ্গিনায়।

বর্তমান শতাব্দীর জার্মানি এমন এক দুর্বিষহ ও ভয়াবহ বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে এগিয়ে এসেছে, যার মধ্যে ছিল দুটি মহাযুদ্ধ। যার কঠিনতম নৃশংসতায় জার্মানির অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়েছিল এবং দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ জার্মান অস্তিত্বকেই বিলুপ্ত করে দিয়েছিল প্রায়। শতাব্দীর এমন ভয়াবহ নৃশংসতায় থমকে দাঁড়িয়েছিল মানবতার সকল বোধ, সমগ্র নৈতিকতা। আমরা জানি সে সময়, হাজার বছর ধরে মানুষের রক্তের বিনিময়ে একটু একটু করে অর্জন করা মানবিক সৌন্দর্য এক ধাক্কায় উল্টে পড়ে গিয়েছিল। পৃথিবী ভিজে গিয়েছিল মানুষের রক্তে। জার্মানি তখন শুধু নিজেদের অস্তিত্বকে বিপর্যস্ত করে তোলেনি, ‘পৃথিবীর হৃদয়কেও ক্ষত-বিক্ষত করে দিয়েছিল’। সেই সময় জার্মান কোন লেখকই নিজের স্বাধীন সত্তাকে বাঁচিয়ে লেখালেখি করতে পারেনি। জার্মান একনায়ক এডলফ হিটলার তখন ক্ষমতায়। রাষ্ট্রে কারো নিরাপত্তা ছিল না। না লেখক, না কবি, না সাধারণ মানুষ। স্বাধীন চিন্তার সৃষ্টিশীল মানুষগুলো দেশ ছেড়ে অন্য দেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিল। এইরকম দুঃসময়ে কোনো লেখকই তার নিজের লেখাটি লিখতে পারে না, রাষ্ট্রের শ্যেণচক্ষু তাকে পাহারা দিয়ে রাখে। সেই পাহারা থেকে পালিয়ে বাঁচতে পারাটা লেখকের জন্য হয়ে ওঠে আরেক নতুন জীবন পাওয়ার স্বাদ। এই সময় স্বাভাবিভাবেই বুদ্ধিজীবীদের চিন্তায় একটি নতুন আদর্শ- রূপলাভ করতে লাগলো, তা হচ্ছে সমাজতান্ত্রিক আদর্শবাদ। সকল নৈরাশ্যের সামনে এই সমাজতান্ত্রিক আদর্শবাদ উপস্থিত হল একটি আশার প্রতীক হিসেবে। প্রকৃত প্রস্তাবে, এই সময় শিল্প-ক্ষেত্রে যে অভিব্যক্তিবাদ বা এক্সপ্রেসনিজমের জন্ম তা এ কালের অসীম যন্ত্রণারই ফলশ্রুতি।

মানবতার কল্যাণের জন্য যে লেখক নিষ্ঠাবান, হৃদয়ে ধারণ করে মহত্ত্ব, সে রকম গুরুত্বপূর্ণ লেখকের মৃত্যু অবশ্যই পৃথিবীর জন্য মৌলিক ক্ষতি। গ্রাসের মৃত্যুও পৃথিবীর জন্য তেমনি এক ঘটনা। বর্তমানে সা¤্রাজ্যবাদি বহুজাতিক কোম্পানিগুলো যে অস্ত্র তৈরি করছে, মাদক তৈরি করছে, কর্পোরেটোক্রেসির সুযোগ সুবিধার মাধ্যমে মানুষকে দাস মনোবৃত্তির দিকে ঠেলে দিচ্ছে, নারীদের প্রসাধনী-পাগল বানাচ্ছে, বাজারের উদ্দেশ্যে টেলিভিশন মিডিয়াগুলো যে ভাবে পণ্যের প্রচারের জন্য নগ্ন হয়ে ওঠছে তা পৃথিবীর জন্য ভয়ঙ্কর এক ফাঁদ। মানুষের কষ্টার্জিত অর্থগুলো তারা ছলনার গোপন কৌশলে সুধে-আসলে শুষে ও নিংড়ে নিচ্ছে। সে সব বহুজাতিক ষড়যন্ত্রের দিকে তীব্র নজর ছিল গ্রাসের। সেই ষড়যন্ত্র বুঝতেন বলেই মানুষের ভবিষ্যৎ নিয়ে তিনি ব্যতিত ও চিন্তাগ্রস্ত ছিলেন এবং রাজপথে প্রতিবাদ করতেন। ইউরোপের শ্বেত চামড়ার লেখক হয়েও তিনি মিশতেন সাধারণ নিরীহ মানুষের সঙ্গে। ১৯৮৬ সালে সস্ত্রীক বাংলাদেশ সফর করেছেন তিনি, সেই সময় যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশে লালবাগ কেল্লা থেকে শুরু করে বস্তী পর্যন্ত চষে বেড়িয়েছেন। কলকাতা ও বাংলাদেশ ভ্রমণ অভিঙ্গতা নিয়ে ‘সো ইওর টাং’ (জিভ কাটো লজ্জায়) নামে গ্রন্থ লিখেছেন। গ্রন্থটিতে তিনি কলকাতার বিভিন্ন সামাজিক চিত্রের সরাসরি সমালোচনা করেছেন। একজন প্রত্যক্ষদর্শ্যী হিসেবে গ্রাস কলকাতার সংগ্রামী ও লোক-মানুষকে যেভাবে দেখেছেন সেভাবেই বর্ণনা করেছেন তাঁর লেখায়। যার পাল্টা সমালোচনা করেন অনেকে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তোর জার্মান ভূমি ফুঁড়ে ওঠে আসা শিল্পীর নাম গ্যুন্টার গ্রাস। যুদ্ধের নানান বিভিষীকা ছুঁয়ে ‘টিন ড্রাম’ সময়পর্ব পর্যন্ত জার্মানকে আবারও মানুষের কাছে গ্রহণীয় করে তুলেন তিনি। গ্রাস হয়ে উঠলেন মৌলিক মানবতার পক্ষে এক সাহসী কলম যোদ্ধা। উল্লেখ্য,একজন লেখক যখন প্রতিষ্ঠিত হন, তখন সে কত বড় লেখক সেটি বিবেচ্য থাকে না আর। বিবেচ্য হয়ে ওঠে গণমানুষের পক্ষে তার অবস্থান কি, মানবিক সুন্দরের জন্য তার আকুলতা আছে কিনা ইত্যাদি। গ্যুন্টার গ্রাসের বেলায়ও সেটাই বিবেচ্য। প্রাচ্য-প্রতীচ্যের ভাষিক ও সমর দ্বন্দ্বে গ্রাস গণমানুষের পক্ষে তার অবস্থান শুরুতেই ঘোষণা করেছিলেন। এখানেই তার গুরুত্ব, এই জন্যই তাকে নিয়ে এত আলোচনা-সমালোচনা। ইসরাইলি নৃশংসতার বিরুদ্ধে নির্যাতিত ফিলিস্তিনিদের পক্ষে এই ক’দিন আগেও ‘কতদিন আর মুখ বন্ধ করে রাখব’ নামে কবিতা লিখে ইউরোপসহ সারাবিশ্বে হইচই ফেলে দেন।এরই ফলশ্রুতিতে প্রাচ্যবাদী একদেশদর্শী চিন্তকেরা শেষ বয়সে তাকে একঘরে করে ফেলে। গ্রাসের ব্যাপক সমালোচনা শুরু করেন, নোবেল পুরস্কার ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য সুইডিশ একাডেমিকে চাপ সৃষ্টি করেন। তবু গ্রাস অবিচল দৃঢ়তায় মানবতার পক্ষে শেষ সত্যটি বলে যান এবং সভ্যতার সুবিধাভোগী বুদ্ধিজীবীগণ শ্রেণিস্বার্থে যে বৈষম্য জিইয়ে রেখেছে তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেন। বলেন ‘চুপ করে থাকার সময় নেই আর। কথা বলো- কথা বলো সত্যের পক্ষে। তা না হলে পৃথিবীর ভবিষ্যৎ অন্ধকার’। সবচেয়ে বড় কথা, ইহুদি-খ্রিষ্টান- হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধচক্র, বহুজাতিক এই কতিপয় উগ্র জনগোষ্ঠির ষড়যন্ত্র নিয়ে কথা বলতেন তিনি এবং সে মোতাবেক সবাইকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন। যে কারণে গ্রাস পৃথিবীর জন্য মৌলিক ও গুরুত্বপূর্ণ এক কথক ও সমালোচক।

যুদ্ধোত্তোর কালে জার্মানি তাঁর ধ্বংসস্তুপের ওপর দিয়ে নতুন স্বপ্নসৌধ নির্মাণ করেছে। আর এই নির্মাণের পেছনে যারা ভাষা-শ্রমিকের ভূমিকায় অবর্তীণ হয়েছিলেন তাঁরা ঐ মাটিরই সংবেদনশীল সন্তান। জর্মান রাষ্ট্র ও সমাজের আচরিত সংস্কৃতি হতাশার অতল গহ্বরে নিমজ্জিত হলেও সেই সীমাহীন হতাশা কাটিয়ে একটি নান্দনিক বাস্তবতার সন্ধানে আশার আলো নিয়ে এগিয়ে গেছে। ‘জীবনের অনন্ত ধারা সকল বাধা ও বিপত্তিকে যে শেষ পর্যন্ত অতিক্রম করে চলতে থাকে তারই কথা বর্তমান জার্মান সাহিত্যে উপজীব্য। অতীতের সকল কালিমা এবং বিপর্যয়ের যেন চিরকালের জন্যে হারিয়ে যায় অনন্তে, তা যেন আর কোনদিন ফিরে না আসে তারই সাধনা চলে সাম্প্রতিক জার্মান সাহিত্যে’। আর এই সাহিত্য বিনির্মাণের পেছনে গ্রুপ- ৪৭ এর ভূমিকাই সবচেয়ে বেশি। গ্রাস সেই ভূমিকা পালনকারী জার্মানির শ্রেষ্ঠ সন্তানদেরই একজন। ।

ব্যক্তি জীবনেও বহুমুখি সংঘাতের মধ্য দিয়ে গ্রাসকে অগ্রসর হতে হয়েছে। ‘একজন লেখককে শুধু তার অর্জন দিয়ে মাপলে হয় না, তিনি কি ধরনের বাধা ও বিপদ মোকাবেলা করেছেন, কিভাবে জীবন যাপন করেছেন, কিভাবে ভাষাশৈলীকে ভেঙ্গে-চুরে বিনির্মাণ করেছেন, সার্বিক বিচারে এই বিষয়গুলোও বিবেচনায় নিতে হয় এবং তা-ই হয় ঐ লেখকের মানদণ্ড।

মৃত্যুর আগে গ্রাস ঢাকার জেনেভা ক্যাম্প, কলকাতার সামাজিক প্রকল্প, ভেনেজুয়েলার সংকটাপন্ন মহিলাদের জন্য নিবেদিত সংস্থাসহ বহু প্রতিষ্ঠানকে আর্থিক ও মানসিক সাহায্য দিয়েছেন। গ্রাস নির্যাতিত ও দলিত বিপন্ন মানুষের সহযোগিতায় সবসময় এগিয়ে আসতেন। এবং প্রতিশ্রুতিশীল লেখক শিল্পীদের ক্ষেত্রেও সহযোগিতার হাত প্রসারিত রাখতেন । ছিলেন বড় রাজনীতিবীদ। এসডিপি’র নির্বাচনে বিজয়ের পর উইলি ব্রান্ট একসময় গ্রাসকে মন্ত্রী হতে অনুরোধ করেন, অন্তত সংস্কৃতিবিষয়ক প্রধান হতে বলেন। গ্রাস সে অনুরোধ সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যাখান করেন।
গ্রাস অনেকগুলো উপন্যাস ও ভ্রমণবিষয়ক গ্রন্থ ও কাব্য রচনা করেছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য দি টিন ড্রাম, ক্যাটস এন্ড মাউস, ডগ ইয়ারস, লোকাল এ্যানেসথেটিক, দি প্লেবিয়ান্স রিহার্স দি অপরাইজিং’ মাইন ইয়ার হন্ডার্ট, দি কল অব দ্য টোড ইত্যাদি।


শেয়ার করুন