বঙ্গবন্ধুর ছেলেবেলার গল্প

Untitled-24সিটিএন ডেস্ক:

১৯৩৯ সালের কথা। গোপালগঞ্জ মাথুরানাথ ইনস্টিউট মিশন স্কুলের ছাত্র-শিক্ষক, স্কুল পরিচালনা পর্ষদ সবাই ব্যস্ত। স্কুলের ক্লাশরুম, বারান্দা, পায়খানা ও প্রসাবখানা সব ঝকঝকে পরিষ্কার। দু’সপ্তাহ আগেই ছাত্র-ছাত্রীদের বলে দেয়া হয়েছে সেদিন যেন সকলে পরিষ্কার-পরিছন্ন মার্জিত পোশাক পরে স্কুলে হাজির হয়। কারণ ওইদিন অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক স্কুল পরিদর্শনে আসবেন। সঙ্গে থাকবেন বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী।

ভালোয় ভালোয় স্কুল পরিদর্শন শেষে মন্ত্রী মহোদ্বয় ডাকবাংলার দিকে হেঁটে যাচ্ছিলেন এমন সময় একদল ছাত্র এসে হঠাৎ তাদের পথ আগলে দাঁড়ালো। ছাত্রদের এমন কাণ্ড দেখে হেডমাস্টার সাহেব তো রীতিমতো ভড়কে গেলেন। তিনি চিৎকার দিয়ে বললেন, ‘এই তোমরা কী করছো রাস্তা ছেড়ে দাও।’ ছাত্ররা হেডমাস্টারের কথায় কর্ণপাত না করে হ্যাংলা পাতলা লম্বা ছিপছিপে মাথায় ঘন কালো চুল ব্যাক ব্রাশ করা একটি ছেলে গিয়ে দাঁড়ালো একেবারে মুখ্যমন্ত্রীর সম্মুখে।

মন্ত্রী মহোদয় জিজ্ঞেস করলেন, ‘ কি চাও?’ বুকে সাহস নিয়ে নির্ভয়ে সে উত্তর দিল, ‘আমরা গোপালগঞ্জ মাথুরানাথ ইনস্টিউট মিশনারি হাইস্কুলেরই ছাত্র। স্কুলের ছাদে ফাটল ধরেছে। সামান্য বৃষ্টি হলেই সেখান থেকে বৃষ্টির পানি চুয়িয়ে পড়ে। আমাদের বই-খাতা ভিজে যায়। ক্লাশ করতে অসুবিধা হয়। স্কুল কর্তৃপক্ষের কাছে বারবার এ ব্যাপারে বলা হলেও কোনো ফল হয়নি। ছাদ সংস্কারের আর্থিক সাহায্য না দিলে রাস্তা মুক্ত করা হবে না।’

কিশোর ছাত্রের বলিষ্ঠ নেতৃত্ব , সৎ সাহস আর স্পষ্টবাদীতায় মুগ্ধ হয়ে হক সাহেব জানতে চাইলেন, ‘ছাদ সংস্কার করতে তোমাদের কত টাকা প্রয়োজন?’ সাহসী কণ্ঠে সে জানাল, “বারশ টাকা।’ মুখ্যমন্ত্রী প্রতুত্তোরে বললেন, ‘ঠিক আছে , তোমরা যাও। আমি তোমাদের ছাদ সংস্কারের ব্যবস্থা করছি।’ তিনি তার তহবিল থেকে উক্ত টাকা মঞ্জুর করে অবিলম্বে ছাদ সংস্কারের জন্য জেলা প্রশাসককে নির্দেশ দিলেন। এমনি এক দাবি আদায়ের মধ্য দিয়ে যার জীবনযাত্রা শুরু এই ছাত্রনেতা তিনি আর কেউ নন। তিনি হলেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি আধুনিক বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

উল্লেখ যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সে সময়ে গোপালগঞ্জ মাথুরানাথ ইনিস্টিউট মিশনারি হাইস্কুলে অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র ছিলেন। টুঙ্গিপাড়ার শ্যামল পরিবেশে শেখ মুজিবের জীবন কাটে দূরন্তপনায়। মধুমতির ঘোলাজলে গ্রামের ছেলেদের সঙ্গে সাঁতার কাটা, দল বেঁধে হা-ডু-ডু, ফুটবল, ভলিবল খেলায় তিনি ছিলেন দস্যি বালকদের নেতা। তখন কে জানত এই দস্যি বালকদের নেতাই একদিন বিশ্বনেতা, বাঙালি জাতির পিতা হবেন।

১৭ মার্চ, ১৯২০। এদিনেই জন্মেছিলেন বঙ্গবন্ধু। বড় দুই বোনের পর তিনি ছিলেন বাবা-মার প্রথম ছেলে। পরে অবশ্য তাঁর আরো দুই বোন আর এক ভাই জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর অন্যান্য ভাই-বোনদের নাম হলো যথাক্রমে ফাতেমা বেগম, আছিয়া বেগম, হেলেন, লাইলী। আর তাঁর ছোট ভাইয়ের নাম শেখ আবু নাসের।

আচ্ছা, ভাই বোনদের নাম না হয় হলো, কিন্তু তাঁর অমন সুন্দর নাম শেখ মুজিবুর রহমান কে রেখেছিলেন বলো তো? তাঁর নানা। আর নাম রাখার পরে বলেছিলেন, ‘দেখিস, এই নাম জগৎজোড়া খ্যাত হবে।’ দেখেছ, কেমন করে ফলে গেছে তাঁর নানার কথাটি! তবে বাসায় কিন্তু তাঁকে মোটেও এ নামে ডাকা হতো না। তাঁর আব্বু-আম্মু তাঁকে আদর করে ডাকতেন খোকা বলে। আর ভাই বোন আর গ্রামের আর আর সব লোক কী বলে ডাকতো জানো? মিয়া ভাই।

ছোট থেকেই তিনি ছিলেন ভারি দয়ালু। কোনোদিন দেখলেন, কোনো ছেলে ভীষণ গরিব, টাকার অভাবে ছাতা কিনতে পারে না, রোদ-বৃষ্টিতে ভারি কষ্ট পায়, অমনি তাঁর ছাতাটা দিয়ে দিতেন। কিংবা টাকার অভাবে কোনো ছেলে বইপত্র কিনতে পারছে না, দিয়ে দিলেন তাঁর নিজের বইপত্র। এমনকি একদিন নাকি এক ছেলেকে ছেঁড়া কাপড় চোপড় পরে থাকতে দেখে নিজের পড়নের কাপড়ই খুলে দিয়ে দিয়েছিলেন

শেখ মুজিব অনেকটা দেরিতে পড়ালেখা শুরু করেন। গৃহ শিক্ষক মৌলবি সাখাওয়াৎ উল্লাহর কাছে তাঁর শিক্ষার হাতেখড়ি। ১৯২৭ সালে শেখ মুজিব গিমাডাঙ্গা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা শুরু করেন যখন তাঁর বয়স সাত বছর। ১৯৩১ সালে বাবা লুৎফর রহমান পরিবারবর্গ নিয়ে আসেন তাঁর কর্মস্থল গোপালগঞ্জ। খোকাকে ভর্তি করে দেন গোপালগঞ্জ পাবলিক স্কুলের চতুর্থ শ্রেণীতে। এখানে বছর দেড়েক যেতে না যেতেই খোকা আক্রান্ত হলো বেরিবেরি রোগে। এই বেরিবেরি রোগ থেকেই তার চোখে জটিল অসুখ দেখা দেয়। যার নাম ‘গ্লোফুমা।’ পূত্রস্নেহে বাবা লুৎফর রহমান অস্থির হয়ে পড়লেন।

শুভাকাঙ্ক্ষিরা পরামর্শ দিলেন খোকাকে চিকিৎসার জন্য কলকাতা নিয়ে যাওয়ার জন্যে। কলকাতা তখন ছিল বঙ্গ প্রদেশের রাজধানী। সেখানে কলকাতা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চক্ষু বিশেজ্ঞ ডা. টি আহমেদ তার চোখের সার্জারি করেন এবং তিনি সুস্থ হয়ে উঠেন। গ্লোফুমা থেকে সুস্থ হলেও ডাক্তার তাঁকে চোখে চশমা ব্যবহারের পরামর্শ দিলেন। চোখে অসুখের কারণে ১৯৩৪ থেকে চার বছর তিনি বিদ্যালয়ের পাঠ চালিয়ে যেতে পারেননি। সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ১৯৩৭ সালে গোপালগঞ্জ মাথুরানাথ ইনিস্টিউট মিশন স্কুলে সপ্তম শ্রেনীতে ভর্তি হন। এই স্কুলে থাকাকালীন সময়েই তার প্রতিভা আর নেতৃত্বের বিকাশ ঘটে। এমনিতেই ক্লাশের অন্যান্য ছেলেদের চেয়ে কিছুটা বয়সে বড় সেই সাথে তাঁর চরিত্রের দৃঢ়তা সবাইকে মুগ্ধ করে। সকলের প্রিয় পাত্রে পরিণত হন তিনি। তাঁর পরিচিতি বাড়তে থাকে ‘মুজিব’ ভাই হিসেবে।

আগেই বলেছি অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী শেরে বাংলা একে ফজলুল হক যখন গোপালগঞ্জ মাথুরানাথ ইনিস্টিউট মিশন স্কুল পরিদর্শনে আসেন তখন তার সঙ্গে ছিলেন বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। শেখ মুজিব যখন মুখ্যমন্ত্রী শেরে বাংলা একে ফজলুল হকের সঙ্গে বাদানুবাদ করছিলেন তিনি পিছনে দাঁড়িয়ে তা প্রত্যক্ষ করছিলেন। শেখ মুজিবের সৎসাহস, কর্তব্যবোধ তাঁর মনোযোগ আকর্ষণ করে। ডাকবাংলোতে ফেরেই তিনি শেখ মুজিবকে ডেকে পাঠালেন। তিনি তাঁর সঙ্গে কিছুক্ষণ ক্থা বললেন এবং কলকাতায় তাঁর সঙ্গে দেখা করতে বললেন। পরবর্তীতে তিনি এই হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর হাত ধরেই শেখ মুজিব রাজনীতিতে প্রবেশ করেন।

স্কুল জীবনেই শেখ মুজিব প্রগতিশীল রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলেন। মুজিব যখন নবম শ্রেণীর ছাত্র এ সময়ে ছাত্রদের উদ্দেশে এক ভাষণ দেয়ার সময় তাঁকে মিথ্যে অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়। সম্ভবত এটাই ছিল তার জীবনের প্রথম গ্রেপ্তার। পরে ছাত্রদের চাপের মুখে পুলিশ শেখ মুজিবকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়।

এরকম আরো হাজারো ঘটনায় সমৃদ্ধ বঙ্গবন্ধুর ছেলেবেলা। তিনি সাধারণ শিশুদের মতোই বড় হয়েছেন। আর নিজগুণে ও নেতৃত্বের দৃঢ়তায় হয়ে উঠেছেন বাংলাদেশের তথা উপমহাদেশের মহান নেতা।


শেয়ার করুন