ফুলের বন্দরে স্বপ্নের হাতছানি

01সিটিএন ডেস্ক

ফুল ছাড়া কি প্রিয় মানুষকে হৃদয়ের জমে থাকা ভালোবাসার কথা ব্যক্ত করা যায়? হৃদয়ে জমে থাকা সেই ভালোবাসা ফুল ছাড়া যেন অসম্পূর্ণই থেকে যায়। প্রিয় মানুষটিকে মূল্যবান কোনো উপহার দিতে পারুক আর নাই পারুক ছোট্ট একটি ফুল তুলে দিয়ে প্রকাশ করতে পারে হৃদয়ের গভীর ভালোবাসার কথা। তাইতো ভালোবাসা প্রকাশের মহামূল্যবান ফুলটি দেশের অগণিত তরুণ তরুণীসহ সব বয়সী মানুষের হাতে তুলে দিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন বন্দরের ফুল চাষীরা। বিশ্ব ভালোবাসা দিবস ও পহেলা ফাল্গুন প্রস্তুতি নিয়ে ব্যস্ত ফুল চাষী ও ব্যবসায়ীরা।

ফুল শুধু পবিত্রতার প্রতীকই নয়। ভালোবাসায়, শ্রদ্ধায় এমনকি শোকেরও একমাত্র অনুষঙ্গ। আর এর চাহিদা দিনদিন বাড়ছে। এদেশের অনেক জায়গায় বাণিজ্যিকভাবে ফুলের চাষ হচ্ছে। তেমনি নারায়ণগঞ্জ বন্দর উপজেলার দঘলদী ও সাবদী এলাকায় হচ্ছে ফুলের চাষ।

প্রতিবছর বসন্ত বরণ, ভালোবাসা দিবস, বাংলা ও ইংরেজি নববর্ষ, স্বাধীনতা দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মতো দিনগুলোতে ফুলের অতিরিক্ত চাহিদা থাকে। আর এ চাহিদার মেটাতে চেষ্টা করে বন্দর উপজেলার দখলদী এলাকার ফুল চাষীরা। যার কারণে দিন দিন বন্দরে ফুল চাষ বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষ করে বন্দর উপজেলার দঘলদী ও সাবদী গ্রামের প্রায় ২৫০ কানি (বিঘা) জমিতে এখন চাষ হচ্ছে গাঁদা, গ্লাডিয়াস, চ্যারি, জাপানি, চন্দ্রমল্লিকাসহ নানান জাতের ফুল। মাঠের পর মাঠ লাল গাদা ও গ্লাডিয়াস ফুলের দৃশ্য দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়।

02১৩ ফেব্রুয়ারির পহেলা ফাল্গুন ও ১৪ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব ভালোবাসা দিবস উপলক্ষ্যে বন্দর উপজেলার ফুলচাষীরা কয়েক লাখ টাকার ফুল বিক্রির টার্গেট নিয়েছে। আর এ লক্ষ্য পূরণের জন্য চাষীরা ব্যস্ত সময় পার করছেন। নিয়মিত জমির পরিচর্যা, সার, কীটনাশক ও পানি দিয়েছেন।

শুক্রবার সরেজমিনে বন্দর উপজেলার দীঘলদী এলাকার এমনি একজন ফুলচাষী মো. তাওলাদ হোসেনের সঙ্গে কথা হয়। তিনি বাংলামেইল প্রতিবেদককে জানান, বর্তমান বাজারের ফুলের চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ বেশি থাকায় বাজারে তেমন একটা ভালো দাম পাওয়া যাচ্ছে না। তবে আগামী ১৩ ও ১৪ ফেব্রুয়ারি বিশেষ দুইদিন দিন থাকায় দাম ভালো পাওয়ার প্রত্যাশা করছেন। আর এ লক্ষ্যে ফুলের ক্ষেতে অধিক পরিশ্রমও করছেন তিনি।

তাওলাদ হোসেন বাংলামেইলকে বলেন, ‘বর্তমানের একটি গ্লাডিয়াস ফুলের বাজার দাম মাত্র ৩ থেকে ৪ টাকা। কিন্তু আগামী ১৩ ফেব্রুয়ারি পহেলা ফাল্গুন হিসাবে তার দাম হবে ১০ থেকে ১৫ টাকা। আর ১৪ ফেব্রুয়ারি ভালোবাসা দিবসে ১৫ থেকে ২০ টাকা পর্যন্ত হতে পারে। এজন্যই এখন তেমন বেশি ফুল কাটা হচ্ছে না। চেষ্টা করছি যেসব ফুলগুলো যতদিন পর্যন্ত ক্ষেতে রাখা যায়। আর যে ফুলগুলো কোনোভাবেই ক্ষেতে রাখা সম্ভব না সেগুলো কেটে এখন কম দামে বিক্রি করছি।’

দু’টি দিবসকে সামনে রেখে বিশেষ পরির্চযার বিষয়ে তিনি বাংলামেইলকে বলেন, ‘ফুল কোনোভাবেই নির্দিষ্ট সময়ের বেশি ক্ষেতে রাখা সম্ভব না। তবে পর্যাপ্ত পানি ও সার দিলে এগুলো দু’একদিন বেশি ক্ষেতে রাখা যায়। এছাড়াও যেসব ফুলগুলো মাত্র কলি এসেছে সেগুলো ১৩ ফেব্রুয়ারি ও ১৪ ফেব্রুয়ারি বিক্রি করা জন্যই এ বিশেষ পরির্চযা। এজন্য প্রতিদিন ২০০ থেকে ৩০০ টাকার খরচ হচ্ছে।’

তিনি বাংলামেইলকে আরো বলেন, ‘বর্তমান সময় ফুলের মৌসুম। এ সময় যেমন বেশি ফুল পাওয়া যায়। তেমনি এ সময় ফুলের কাদরও বেশি থাকে। তাই এ এলাকায় ফুলচাষী যারা আছে সকলের প্রত্যাশা এ সময় কয়েক লাখ টাকার ফুল বিক্রি করা। যাতে করে ক্ষুদ্র ঋণ পরিশোধ করা যায় ‘

এবং ফুলকন্যারা…
ছোট ফুলকন্যা একটা কি দু’টা ফুল হাতে নিলে আর ফুল নেয়া তার পক্ষে সম্ভব হয় না। তাই ফুল রাখতে ছুটে যায় ঝুড়িতে। ফুল ছিঁড়তেও ওকে প্রচুর যুদ্ধ করতে হয় গাছের সঙ্গে। খুব জোরে ফুল ছিড়তে গেলে গাছ চলে আসে। আবার খুব আস্তে টান দিলে ফুল আসে না। তারপরও মায়ের সঙ্গে মাত্র ৪ বছরের ফুলকন্যা ব্যস্ত ফুল তুলতে। ফুল কন্যার নাম মীম। সদ্য গ্রামের একটি প্রাইমারি স্কুলে যাওয়া আসা করে।

প্রচুর লাজুক ফুলকন্যা মীম শুক্রবার সকালে মায়ের সঙ্গে বন্দর উপজেলার দিঘলদী এলাকার নিজেদের ফুলের ক্ষেতে ফুলতে ব্যস্ত দেখা যায়। কথা হয় মীমের মা নাসির বেগমের সঙ্গে। তিনি বাংলামেইল জানান, মীম বাসায় একা থাকবে সেই জন্যই তিনি সঙ্গে নিয়ে এসেছেন। আর তিনি কয়েক ঘণ্টা ফুল তুলবেন। এর জন্যই মূলত নিয়ে আসা।

এর মাঝে কথা হয় আরেক ফুলকন্যা ঝরণা বেগমের সঙ্গে। তিনিও একই জমিতে ফুল তুলছেন। মালা গাঁথার জন্য। তবে সেটা নিজের জন্য না জীবিকার তাগিদে ফুল তুলে ১০০ মালা তৈরি করবেন। যার বিনিময়ে পাবেন ৫০ টাকা। এভাবে সংসারের কাজের ফাঁকে ফুল তুলে মালা তৈরি করেন তিনি।

ঝরণা বেগম বাংলামেইলকে জানান, বিগত ৮ থেকে ৯ বছর ধরে তিনি এ ফুলের মালা তৈরি করার পেশায় কাজ করছেন। ফুলের জমি থেকে ফুল তুলে তা দিয়ে ১০০ মালার লহর তৈরি করে পাবেন ৫০ টাকা। আর একদিনে ২০০ থেকে ৩০০ মালার লহর তৈরি করতে পারেন তিনি। স্বামী নজরুল ইসলামও ফুলের কাজ করেন। এছাড়াও এক ছেলে এক মেয়ে আছে। যারা পড়ালেখা করে। ছেলে আমিনুল ইসলাম মাদবপাশা উচ্চ বিদ্যালয়ে নবম শ্রেণিতে আর মেয়ে সাদিয়া সুলতানা গ্রামের প্রাইমারি স্কুলের ৩য় শ্রেণিতে। স্বামীর উপার্জনে ছেলে-মেয়েদের লেখাপাড়ার ও সংসার খরচ চলতে খুব কষ্ট হয়। এজন্যই তিনি সাংসারিক কাজের ফাঁকে ফাঁকে এসব কাজ করেন।

04ফুল চাষীদের স্বপ্ন:
ফুল চাষীরা জানায়, বন্দর উপজেলার ৬০ থেকে ৭০টি পরিবারের লোকজন ফুল চাষাবাদের সঙ্গে জড়িত। যাদের মধ্যে মাত্র কয়েকজন আর্থিকভাবে স্বচ্ছল আছেন। যাদের পরিবারের লোকজন ফুল ব্যবসায় সফলতার মুখ দেখতে পেরেছেন। তবে তাদের মধ্যে অনেকই ফুলের চাষাবাদ বন্ধ করে নিজেই অন্য কারো জমিতে কাজ করছেন। তেমনি একজন মিজানুর রহমান। স্ত্রী, ২ মেয়ে ও এক ছেলে নিয়ে তাদের সংসার।

মিজানুর রহমান বাংলামেইলকে বলেন, ‘বর্তমানের ফুলের ব্যবসার অনেক চাহিদা বেড়েছে। সেই সঙ্গে বেড়েছে ফুলের চাষাবাদ। আজ থেকে প্রায় ৮/১০ বছর আগে বন্দর এলাকায় হাতেগোনা কয়েকজন মানুষ ফুল চাষ করতো। তাদের মধ্যে আমিও একজন। তখন ফুল চাষের জন্য বীজ, সার, কীটনাশক, পানি সব কিছুরই সমস্যা ছিল যা এখন নেই। চাহিদা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ফুল চাষের অনেক কিছুই এখন হাতের কাছে পাওয়া যায়।’

এদিকে, কথা হয় অরেক ফুলচাষী যতন মণ্ডলের সঙ্গে। দুই ভাই ও দুই বোনসহ ৬ জনের পরিবার তাদের। বাবা সত্যেন্দ্র মণ্ডল ফুল চাষের প্রধান। যতন বাবার সঙ্গে ফুলের চাষাবাদের কাজে সহযোগিতা করেন।

যতন মণ্ডল বাংলামেইলকে আরো বলেন, ‘২৫ কানি (বিঘা) জায়গায় ফুল চাষ করি। যার মধ্যে দেড় কানি (বিঘা) নিজেদের বাকি সব জায়গা ভাড়ায় নেয়া। প্রতি বছর এক কানি জায়াগার জন্য ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত ভাড়া দিতে হয়। এরপরও জমি পাওয়া যায় না। দিন দিন জায়গা কমছে। শুধু তাই নয়। পানির সমস্যা, ওষুধ, সার, লোকবল, রাস্তাঘাট ও বাজারসহ বেশ কিছুর সমস্যা আছে। এসব সমস্যাগুলো সমাধান হলে ফুলের ব্যবসা আরো ভালো হবে। আমরা ন্যায্য দাম পাবো। বর্তমানে ফুলের বাজারের চাহিদা থাকলে তেমন দাম পাওয়া যায় না।

05ফুলের ন্যায্য মূল্য পায় না চাষীরা:
দেশের অর্থনীতে ভূমিকা রাখলেও দ্রুত পচনশীল এ ফসল সংরক্ষণের জন্য নেই কোনো ব্যবস্থা। ফলে কৃষকরা বঞ্চিত হন ন্যায্যমূল্য থেকে।

চাষীরা বলেন, হলুদ গাদা ফুলের চাহিদা থাকা সত্ত্বেও ঢাকার ব্যবসায়ীরা নারায়ণগঞ্জে এসে ফুল নিতে আগ্রহী না। তাছাড়া ঢাকা ফুল নিয়ে গেলেও ন্যায্য দাম পায় না। এছাড়াও এ ফুল ঢাকা শাহবাগ ছাড়া অন্য কোথায় বিক্রি করার সুবিধা পাচ্ছেন না।

ফুলের খরচ হিসাবে সত্যেন্দ্র মণ্ডল বাংলামেইলকে বলেন, এক বিঘা জমি এক বছরের জন্য ভাড়া দিতে হয় ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা। তার উপর এক বিঘা জমিতে ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকার বীজ, ৫ থেকে ৭ হাজার টাকার কীটনাশক, ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা সারসহ পানি, শ্রমিকের মজুরিসহ প্রায় আরো ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা খরচ আছে। এসব কিছু দিয়ের পর একশ ফুলের লহর বিক্রি করতে হয় ১৮০ থেকে ২০০ টাকা। এছাড়াও গ্লাডিয়াস একটি ফুলের চাষে এরচেয়ে দ্বিগুণ খরচ। তারপরও একটি ফুল বিক্রি করতে হয় ৪ থেকে ৫ টাকা। যাতে চাষাবাদের খরচের টাকা উঠে কিন্তু লাভ হয় না।

তিনি বাংলামেইলকে আরো বলেন, বর্ষার কারণে ১২ মাস ফুলের চাষ করা সম্ভব হয় না। তখন অনেকে অন্যান পেশায় চলে যায়। তাদের উঁচু জায়গা বেশি টাকা দিয়ে ভাড়া নিতে পারে তারাই কিছু ফুলের চাষ করতে পারে। এছাড়াও বর্ষার সময় অতি বৃষ্টিতে গাছ ও ফুল নষ্ট হয়ে যায়। শুধু তাই নয় বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ভাইরাসে আক্রান্ত হলে এক বিঘা ফুলের ক্ষেত নষ্ট হয়ে যায়।

ফুলের চাহিদা বাড়লেও স্থানীয় ফুলচাষী মো. ইকবাল হোসেন বাংলামেইলকে জানান, এলাকার কৃষকরা কষ্ট করে ফুল উৎপাদন করলেও প্রায় তারা ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হয়। মধ্যভোগী ব্যবসায়ীরা কম দামে কিনে অনেক লাভবান হয়। কিন্তু ফুল সংরক্ষণের কোনো ব্যবস্থা না থাকায় বাধ্য হয়ে কৃষকরা কম দামে তাদের হাতে ফুল তুলে দেয়।


শেয়ার করুন