ফাহিমের মৃত্যু অনেক প্রশ্ন

2016_06_18_10_46_06_JKZKJraHOY1LJvfRgpDvdIzWamlebD_originalসিটিএন ডেস্ক :

ঢাকা: গুপ্তহত্যায় জড়িতরা যখন ধরাছোঁয়ার বাইরে, আটক তো দূরের কথা শনাক্ত করতেই যখন পুলিশ হিমশিম খাচ্ছে তখন মাদারীপুরে শিক্ষক রিপন চক্রবর্তীর ওপর হামলার পর হাতেনাতে আটক হন ফাইজুল্লাহ ফাহিম। হামলার ধরণ দেখে রিপন হত্যাচেষ্টার ঘটনাটিকে জঙ্গি হামলা হিসেবেই ধরে নিয়েছিল। ফাহিমের মাধ্যমেই জঙ্গি চক্রের মূলোৎপাটনের আশা করছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তাকে ১০ দিনের রিমান্ডেও নিয়েছিল পুলিশ। কিন্তু জিজ্ঞাসাবাদের প্রথম দিনেই মারা গেলেন ফাহিম।

রিমান্ডের আসামিকে রাতে নিয়ে কেন পুলিশ বের হয়েছে, সে প্রশ্ন তুলছেন মানবাধিকার কর্মী, রাজনীতিবিদ, নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, ফাহিমের কাছ থেকে জঙ্গিদের সম্পর্কে আরও বেশি তথ্য পাওয়া যেত। সেটা না করে তাকে ‘ক্রসফায়ার’ দিয়ে কোনো লাভ হয়নি। এরই মধ্যে বিএনপি প্রশ্ন তুলেছে, ফাহিমকে হত্যা করে বড় কোনো ঘটনা আড়াল করার চেষ্টা করা হয়েছে।

গত দুই বছরে পরিকল্পিত হামলায় হত্যা করা হয়েছে ৫০ জনেরও বেশি মানুষকে। শুরুর দিকে ব্লগার বা অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট বা গণজাগরণমঞ্চের কর্মীরা আক্রান্ত হলেও পরে রাজনৈতিক কর্মী, লেখক, প্রকাশক, মানবাধিকার কর্মী, শিক্ষকরা এমনকি ভিন্ন মতাবলম্বী ধর্মীয় নেতা এবং সবশেষ সংখ্যালঘু ধর্মীয় গুরু বা সেবায়েতরা।

বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই খুনিরা ধরা ছোঁয়ার বাইরে। কিছু ঘটনায় পুলিশ তদন্তে অগ্রগতির দাবি করলেও মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দিতে পারছে না। এই অবস্থায় গত বুধবার মাদারীপুর নাজিমউদ্দিন সরকারি কলেজের প্রভাষক রিপন চক্রবর্তীকে হত্যা চেষ্টার পর পর এলাকাবাসী ধাওয়া করে ধরে ফেলে ফাহিমকে।

শুক্রবার রিমান্ডে নেয়ার আগেও ফাহিমদে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ করেছে পুলিশ। তাকে নিয়ে ঢাকায় অভিযানও চালানো হয়েছে। পরে আবার মাদারীপুর ফিরিয়ে নিয়ে আদালতে তোলা হয়। আর জিজ্ঞাসাবাদে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যাবে-এমন বক্তব্য দিয়েই পুলিশ রিমান্ড আবেদন করে। কিন্তু প্রথম রাতেই তাকে নিয়ে ‘সহযোগী’দেরকে ধরতে অভিযানে বের হওয়ার দাবি করে তারা। আর ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মৃত্যুর বহুল প্রচারিত কাহিনি প্রকাশ করে পুলিশ। বাহিনীটির দাবি, ফাহিমের সঙ্গীরা তাদের গাড়িতে আক্রমণ করে এবং এক পর্যায়ে গোলাগুলিতে মারা যান সন্দেহভাজন এই জঙ্গি।

পুলিশের এই বক্তব্যকে বানোয়াট বলছেন মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিচালক নূর খান। ঢাকাটাইমসকে তিনি বলেন, ‘পুলিশের হেফাজতে যদি কেউ নিরাপদ না থাকে তাহলে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা কীভাবে নিশ্চিত হবে?’। তিনি বলেন, ‘আমি ভেবেছিলাম পুলিশ ফাহিমের কাছ থেকে অনেক তথ্য পাবে। জঙ্গিদের সম্পর্কে আমরা পরিষ্কার ধারণা পাবো। সে কারণে ফাহিম আমাদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তার মাধ্যমে আমরা জঙ্গি সম্পর্কে অনেক দূর এগুতে পারতাম। কিন্তু সেটা হলো না। ২৪ ঘণ্টা পেরুতে না পেরুতেই তাকে ‘বন্ধুকযুদ্ধ’ এ নিহত হতে হলো’।

ফাহিমের মাধ্যমে বিভিন্ন কাজ করা যেতো উল্লেখ করে নূর খান বলেন, ‘এরকম একজন গুরুত্বপূর্ণ লোকের কাছ থেকে তথ্য পাওয়ার পরও তাকে পর্যবেক্ষণে রাখা যেতো। যথাযথ নিরাপত্তা ব্যতিরেকে রিমান্ড চলাকালীন অবস্থায় অভিযানে নেয়াটা কতটুকু যুক্তযুক্ত সেটা ভাবার সময় এসেছে’।

কোনো ঘটনাকে আড়াল করতে ফাহিমকে বন্দুকযুদ্ধের নামে হত্যা করা হয়েছে কি না- জনগণের কাছে এখন এটা এক বড় প্রশ্ন- এমন মন্তব্যও করেন নূর খান। বলেন, ‘এ ঘটনার ফলে জনগণের মধ্যে আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে। একদিকে জঙ্গিরা নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে। অপর দিকে পুলিশও একই কাজ করছে। এতে জনগণ আর ভালো কাজে এগিয়ে আসবে না। তারা আস্থা-বিশ্বাস হারিয়ে ফেলবে। এসব চলতে থাকলে জঙ্গিবাদকে প্রতিহত করার ঘটনা মূলত বুমেরাং হতে পারে।

ফাহিমের ‘ক্রসফায়ার’ নিয়ে কঠোর সমালোচনা করেছে বিএনপি। বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহল কবির রিজভীর অভিযোগ, পুলিশ কাউকে আড়াল করতে বা কাউকে বাঁচাতে ফাহিমকে সরিয়ে দিয়েছে।

একের পর এক গুপ্তহত্যার ঘটনায় যখন আতঙ্ক ছড়াচ্ছে তখন দেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক দল আওয়ামী ও বিএনপি এর জন্য একে অন্যকে দায়ী করছে। সরকারি দলের অভিযোগ, বিএনপি জঙ্গিদের মদদ দিয়ে দেশকে অস্থিতিশীল করতে চাইছে আর বিএনপি নেতাদের অভিযোগ, আওয়ামী লীগ বিদেশিদের আনুকূল্য পেতে জঙ্গি তৎপরতা উস্কে দিচ্ছে।

ফাহিমের মৃত্যুর পর বিএনপি নেতা রিজভী আবারও পুরনো অভিযোগ তুলে ধরলেন। তিনি বলেন, ‘ফাহিম জঙ্গি কি না বা তার সঙ্গে আরও কেউ আছে কি না, জিজ্ঞাসাবাদে তা বের হয়ে আসত। তার আগেই তাকে হত্যা করা হলো। আসল ঘটনা আড়াল করতেই রিমান্ডে থাকা ফাইজুল্লাহ ফাহিমকে ক্রসফায়ারে দেয়া হয়েছে। হয়ত ফাহিম এমন কোনো তথ্য দিয়েছে যাতে সরকার বিব্রত হয়। সে কারণেই তাকে ক্রসফায়ারে দেয়া হলো’।

তবে আওয়ামী লীগের আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক দীপু মনি ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘বিএনপি নিজেদের বাঁচাতে নানা কথা বলছে। তাদের সঙ্গে যে জঙ্গি সংশ্লিষ্টতা আছে এটা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত’।

আওয়ামী লীগের একজন কেন্দ্রীয় নেতা অবশ্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকাটাইমসকে বলেছেন, বন্দুকযুদ্ধে ফাহিমের মৃত্যুর বিষয়টি সরকারের জন্য বিব্রতকর হয়েছে। তিনি বলেন, ‘রিমান্ডে নেয়া হয়েছের ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই তাকে ক্রসফায়ারে দেয়া হলো। এটা হয় না’।

মাদারীপুরের পুলিশ সুপার সারোয়ার হোসেন অবশ্য বলেছেন, ফাহিমের মৃত্যুর পেছনে তাদের কোনো হাত ছিল না। তিনি বলেন, ‘কীভাবে এটি হয়েছে তা সবাই দেখেছে। আমাদের ওপর আক্রমণ হয়েছে, আমাদের লোকজন আহতও হয়েছে’।

জঙ্গি তৎপরতার বিষয়ে ফাহিম পুলিশকে বেশ কিছু তথ্য দিয়েছেন জানিয়ে পুলিশ সুপার বলেন, এসব তথ্য যাচাই বাছাই করা হচ্ছে। তবে ফাহিম কী তথ্য দিয়েছেন সে বিষয়ে কিছু বলতে রাজি হননি সারোয়ার হোসেন।


শেয়ার করুন