পয়লা বৈশাখ, বাংলা নববর্ষ ও ইলিশ কথন

আতিকুর রহমান মানিক

এগিয়ে আসছে পয়লা বৈশাখ, বাংলা নববর্ষ। বর্ষবরণ ও নববর্ষের দিনে পান্তা ভাত সহযোগে ইলিশ মাছ খাওয়া অধুনা বাংলাদেশীদের অন্যতম অনুসঙ্গ হয়ে দাড়িয়েছে দীর্ঘদিন ধরে। অনেকের কাছে আবার এটা একটা ফ্যাশন। পয়লা বৈশাখের সকালে পোড়া মাটির খোরায় করে পান্তা ভাত ও একটুকরা ইলিশ খেয়ে দিন তথা বর্ষ শুরু করার মজাই যেন আলাদা। সব মিলিয়ে বাংলা নববর্ষ ও পান্তা ইলিশ যেন একে অপরের পরিপুরক। এভাবে পান্তা ইলিশ খাওয়া খুব উপভোগ্য ব্যাপার হলেও অন্যদিকে এখানে চরম হতাশার একটা ব্যাপার আছে। আর তা হল, পান্তা ইলিশের অন্যতম উপাদান ইলিশ মাছের চলমান অকাল ও দু®প্রাপ্যতা। কোথাও যেন মিলছেনা মহামুল্যবান ইলিশ। কক্সবাজার সংলগ্ন বঙ্গোপসাগরতো বটেই, বরং হাট বাজার, আড়ৎ, ভ্রাম্যমান বিক্রেতার চুপড়িসহ সবখানেই চলছে ইলিশ হাহাকার। পর্যটন রাজধানী কক্সবাজার ইলিশ মাছের জন্য মোটামুটি বিখ্যাত। এখানে রয়েছে গভীর সমুদ্রগামী ফিশিং বোটের বিশাল বহর। প্রায় সারা বছরই সাগরে ইলিশ শিকারে ব্যস্ত থাকে এ বোট গুলো। বঙ্গোপসাগরের এ ইলিশ সম্পদকে ঘিরে কক্সবাজারে গড়ে উঠেছে সহায়ক আরও অনেক শিল্প Ñ বানিজ্য। আহরিত ইলিশ সংরক্ষণের জন্য বরফকল, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও রপ্তানীর জন্য অত্যাধুনিক কারখানা, বোট মেরামতের জন্য ডকইয়ার্ড, বোটে তেল সরবরাহের জন্য বাঁকখালী নদী তীরে পেট্রোল পাম্প, বোটের ইঞ্জিন ও যন্ত্রাংশ মেরামতের জন্য ওয়ার্কসপ, দেশব্যাপী মাছ সরবরাহের জন্য পরিবহন ব্যবস্থা ও জালÑ বয়াসহ অপরাপর সরঞ্জাম বিক্রির ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ইত্যাদির মালিকÑ শ্রমিকদের জীবন-জীবিকা আবর্তিত হচ্ছে ইলিশ মাছকে ঘিরে। বিশাল এ জনগোষ্ঠী বলতে গেলে ইলিশ নির্ভর। কিন্তু হালÑআমলে সাগরে ইলিশ না মিলায় উপরের সব শিল্প বাণিজ্যে স্থবিরতা বিরাজ করছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় ইলিশ সম্প্রদায় যেন মহা অভিমান করে কোথাও অদৃশ্য হয়ে গেছেন। কিন্তু কেন এই অভিমান? কেউ অভিমান করলেতো তা যোগ্যতা থাকতে হবে। কারণ যোগ্যতা ব্যতিরেকে অভিমান বেমানান। তাই আমাদের জাতীয় মাছ ইলিশেরও এ গুনাগুনÑ যোগ্যতা আছে কিনা দেখা যাক।……….. সু-স্বাদু মাছ ইলিশ সম্পর্কে যৎসামান্য আলোকপাত করতেই এই ইলিশ কথন। বাংলাদেশের জাতীয় মাছ ইলিশ। সাম্প্রতিক সময়ে মা ইলিশ সংরক্ষণ ও অবাধ প্রজনন নিশ্চিত করতে ব্যাপক কর্মযজ্ঞ পরিচালিত হচ্ছে। ইলিশ মাছ একক প্রজাতি হিসেবে সর্ববৃহৎ এবং সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ। দেশের মোট মৎস্য উৎপাদনে একক ভাবে ইলিশের অবদান শতকরা ১৩-১৫ ভাগ। এর বার্ষিক গড় উৎপাদন প্রায় ৩.৫ লক্ষ মেট্রিক টন, যার মূল্য প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা। জি.ডি.পি-তে ইলিশ মাছের অবদান প্রায় ২.০%। জাতীয় রপ্তানী আয়েও ইলিশ মাছ উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে থাকে। প্রতি বছর ইলিশ মাছ অন্যান্য দেশে রপ্তানি করে প্রায় ১’শ কোটি টাকার বৈদেশিক মূদ্রা অর্জিত হয়। কর্মসংস্থানেও ইলিশ মাছ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। বাংলাদেশের ৪০টি জেলার প্রায় ১৪৫টি উপজেলার ১৫০০ ইউনিয়নের ৪ লাখ ৫০ হাজার জেলে ইলিশ মাছ ধরে থাকে। ইলিশ ধরা ছাড়াও বিপনন, পরিবহণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ, রপ্তানী, জাল-নৌকা তৈরী ইত্যাদি কাজে সার্বিক ভাবে প্রায় ২৫-৩০ লক্ষ লোক জীবন-জীবিকার জন্য এ মাছের উপর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে নির্ভরশীল। সাম্প্রতিক সময়ে কক্সবাজার সংলগ্ন বঙ্গোপসাগরে ইলিশ মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে। ইলিশ মৌসুমে কক্সবাজার মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র (বিএফডিসি ফিসারী ঘাট) থেকে ইলিশ মাছ বোঝাই করে প্রতিদিন শত শত গাড়ি দেশের বিভিন্ন স্থানে রওয়ানা হচ্ছে। বাংলাদেশে অত্যন্ত জনপ্রিয় ও সু-স্বাদু মাছ ইলিশ। ইলিশ মাছ খাদ্যমানেও অত্যন্ত সমৃদ্ধ। এ মাছে উচ্চ মাত্রায় আমিষ চর্বি ও খনিজ-পাদার্থ পাওয়া যায়। ইলিশ মাছের চর্বিতে প্রায় ৫০% অসম্পৃক্ত ফ্যাটি এ্যসিড থাকে। উক্ত অসম্পৃক্ত ফ্যাটি এ্যসিডের প্রায় ২% ওমেগা-৩ ফ্যাটি এ্যাসিড, যা মানুষের দেহের রক্তের কোলেসটেরলের মাত্রা হ্রাস করে ও হৃদরোগ উপশম করে। ইলিশ মাছের আমিষে ৯ ধরণের এ্যামাইনো এ্যাসিড পাওয়া যায়,যা মানুষের পাকস্থলী উৎপাদন করতে পারে না। এছাড়া ইলিশ মাছে রয়েছে উচ্চ পরিমাণে ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, লৌহ ইত্যাদি। ইলিশের তেলে উচ্চ পরিমাণে ভিটামিন এ ও ডি থাকে এবং কিছু বি ও মেলে। ইলিশ মাছের যকৃতে ১২০ আই,ইউ পর্যন্ত ভিটামিন এ পাওয়া যায়। এ মাছের কিছু ঔষুধি গুণও আছে। ইলিশ মাছে গড়ে ৫৩.৭ ভাগ পানি, ১৯.৪ ভাগ চর্বি, ২১.৮ ভাগ আমিষ এবং অবশিষ্ট পরিমাণ খনিজ পদার্থ থাকে। ইলিশ হতে প্রায় ৬০% খাবার উপযোগী মাছ পাওয়া যায়। ইলিশের স্বাাদ ও গন্ধ মাছের তৈলের উপর নির্ভরশীল। এর দেহস্থ সুঘ্রাণ এবং ভাজার সময়ও অসাধারণ ঘ্রাণ আশপাশের উল্লেখযোগ্য দূরত্বে ছড়িয়ে পড়ে। ইলিশ নিঃসৃত এ সুগন্ধি পার্থিব অনেক সুগন্ধিকে হার মানায়। প্রাচীন বাংলা সংস্কৃত সাহিত্য এবং লোকজ সংস্কৃতিতে ইলিশ মাছের স্বাদ খাওয়ার পদ্ধতি এবং সংরক্ষণের বিষয়ে উল্লেখযোগ্য দিক-নিদের্শনা পাওয়া যায়। কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের ইলশে গুড়ি কবিতা এখনো আমাদেরকে আলোড়িত করে। প্রাচীন কালের লোকজনের বিশ্বাস ছিল যে আশ্বিন- কার্তিক মাসের দূর্গা পুঁজার দশমীর দিন হতে মাঘ-ফাল্গুন মানের শ্রী পঞ্চমী পর্যন্ত ইলিশ মাছ ধরা এবং খাওয়া বন্ধ রাখা হলে এ মাছ বহু গুণে বৃদ্ধি পায়। বাংলাদেশে প্রায় সারা বছর কম-বেশী ইলিশ মাছ ধরা পড়ে। তবে ইলিশ মাছ ধরার প্রধান মৌসুম হচ্ছে প্রতিবছর আগষ্ট হতে অক্টোবর মাস পর্যন্ত। এ তিন মাসে গড়ে প্রায় ৬০% ইলিশ মাছ ধরা পড়ে। প্রায় সারা বছর কম-বেশী প্রজনন করে থাকলেও সেপ্টেম্বও-অক্টোবর মাসে সর্বোচ্চ প্রজনন করে থাকে ইলিশ মাছ। সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসের ভরাপূর্ণিমা ও আমাবস্যার জোয়ারের সময় পরিপক্ক ও ডিম পূর্ণ মা-ইলিশ মাছ ঝাঁকে ঝাঁকে প্রজনন এলাকায় প্রবেশ করে থাকে। ইলিশের প্রজনন নিশ্চিত করতে এসময় মা-মাছ আহরণ থেকে বিরত থাকা প্রয়োজন। ইলিশ মাছের কৌটজাতকরণ বা ক্যানিংয়ের ফলাফল অত্যন্ত সম্ভাবনাময়। বাংলাদেশ মাৎস্য গবেষনা ইনষ্টিটিউট এর নদীকেন্দ্রে পরীক্ষামূলক ভাবে উচ্চ চাপ এবং তাপপ্রয়োগে এ মাছকে কাটামুক্ত করে সফল ভাবে কৌটজাত করা হয়েছে। উক্ত কৌটজাতরকণ পদ্ধতি বাণিজ্যিক ভাবে প্রচলন করা সম্ভব হলে কৌটজাত মাছ বিদেশে রপ্তানি করে বৈদেশি মূদ্রা আয়ের পথ সুগম হবে। মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, অষ্ট্রেলিয়া, কানাডা, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রসহ ইত্যাদি দেশে ইলিশ মাছের লবণাক্ত ডিমের ব্যাপক চাহিদা এবং উচ্চ বাজার মূল্য রয়েছে (প্রতি কেজি ৮০-৯০ আমেরিকান ডলার)। আমাদের দেশ হতে কিছু পরিমাণ ইলিশ মালয়েশিয়াতে রপ্তানি হলেও লবণাক্ত ডিম রপ্তানি হয় না। ইলিশ মাছের লবণাক্ত ডিম প্রস্তুত করে রপ্তানি করা হলে অধিক পরিমাণে বৈদেশিক মূদ্রা আয় করা সম্ভব হবে। এ মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি করা সম্ভব হলে রপ্তানির পরিমাণ আরো বৃদ্ধি পাবে এবং সার্বিক ভাবে সকল স্তরের জনসাধারণ ইলিশ সম্পদ উন্নয়নে আরো আগ্রহী হবে। এই হলো ইলিশ কথন। জাতীয় মাছ ইলিশের এতই গুনাগুন? কিন্তু ক্রমাগত পরিবেশÑ সমুদ্রদুষন, জলবায়ু পরিবর্তন, জলাশয় সংকোচন ও সর্বোপরি অতি আহরন এবং জাটকা নিধনের ফলে অর্থনৈতিক ও সাস্কৃতিক গুরুত্বপূর্ণ এ মাছের ভবিষ্যৎ ক্রমেই অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে। তাই ইলিশের স্থায়িত্বশীল উৎপাদন নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় স্থানীয় ও আঞ্চলিক পর্যায়ে প্রয়োজন বহুমাত্রিক দায়িত্বশীল ব্যবস্থাপনা কৌশল। তবেই ভবিষ্যতে আর ইলিশ সংকট হবেনা ও পয়লা বৈশাখÑ নর্ববর্ষ সহ অন্যান্য উৎসবÑ পার্বনে ইলিশ অভিমান করার সুযোগ পাবে না।

আতিকুর রহমান মানিক
সংবাদকর্মী, সংগঠক ও ফিশারীজ কনসালটেন্ট,
সাংগঠনিক সম্পাদক, ঈদগাঁহ প্রেসক্লাব,
সদর কক্সবাজার।
সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক অনলাইন রিপোর্টার্স এসোশিয়েশন অব কক্সবাজার।


শেয়ার করুন