প্রিয় প্রজন্মের ছেলেমেয়েকে কি দেশ ছেড়ে পালাতে বলতে পারি?

Fazlul-Bari4-400x300ফজলুল বারী :

প্রিয় প্রজন্মের ছেলেটার কান্না স্পর্শ করে! আমাকে সে বললো বাসায় বোনটা তার খুব কাঁদছে। ৬৮.৫ % নম্বর পেয়েও সে মেডিক্যালের ভর্তি পরীক্ষায় উতরাতে পারেনি। অথচ বোনটা তার প্রস্তুতির জন্যে অনেক পরিশ্রম করেছিল। তার বান্ধবীরা ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্রে ৯০-১০০% নম্বর পেয়ে মেয়ে মেডিক্যালে চান্স পেয়ে গেছে। বাড়িতে তাকে বলা হচ্ছে, ‘বা—–‘ রাজনীতি করোস! বোনের জন্যে একটা প্রশ্ন জোগাড় করতে পারসনা! ছেলেটি আমাকে বলে, বারী ভাই আমি তো এর কারণে রাজনীতি করি না। আমার ইনবক্সে সে একাধিক জনের ফেসবুক প্রোফাইলের স্ক্রিনশট দিয়ে বললো, দেখেন অবস্থা বারী ভাই। ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্রে মেডিক্যালে চান্স পেয়েছে! আবার বড়াই করে প্রচারও করছে! ছেলেটি প্রশ্ন রেখে বলে, এ অবস্থা থেকে আমাদের মুক্তির পথ কোথায় বারী ভাই? তার প্রশ্নের উত্তর কি আমি, আমরা জানি?
প্রশ্নপত্র ফাঁস এখন বাংলাদেশের অন্যতম বাস্তব এক সমস্যা। এ সমস্যা আগেও ছিল। এখন তা মহামারীর রূপ নিয়েছে! অনেকে এ ব্যাপারে এক তরফা সরকারকে দোষারোপ করেন। এমনও এক তরফা বলেন, সরকার পরিকল্পিতভাবে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে ধবংস করছে! কোনও দেশের কোনও সরকার কি এটা চায় যে তার নেতৃত্বের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা ধবংস হোক? কেন চাইবে? তবে ঠিক, অ্যাট দ্য এন্ড অব দ্য ডে সব দায়দায়িত্ব সরকারের ওপরই এসে পড়ে এবং পড়ছে। তাদের লোকজন ঘোড়ার ঘাস কাটে নাকি? বাংলাদেশের অনেক সমস্যার বড় একটি হলো গোয়েন্দা ব্যর্থতা! নানান বাহারি নামের গোয়েন্দা সংস্থা সমূহ এবং তাদের নানান ‘চৌকষ’ বিশেষণের গোয়েন্দা বাহিনীসমূহ আছে! কিন্তু দেশের চাঞ্চল্যকর নানান ঘটনার পর জানা যায়, উনারা টের পাননি! বাংলাদেশের হাজার হাজার লোক সাগর দিয়ে বেরিয়ে চলে গেলো মালয়েশিয়ার উদ্দেশ্যে! সারাদেশ থেকে এই লোকগুলোকে সংগ্রহ করা হলো! এরা নানা জায়গায় ধরা পড়ার পর, লাশ উদ্ধারের পর জানা গেলো চাঞ্চল্যকর নানা কাহিনী! কিন্তু গোয়েন্দা বাহিনী কী আগাম টের পেয়েছিল এসব? না তারা ঘুমিয়ে ছিল অথবা টাকার বিনিময়ে পার করে দিয়েছিল?
পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস কেলেংকারির একের পর এক ঘটনায় সরকার বেকায়দায় পড়ছে। কিন্তু কেন একবারও জানা-শোনা গেলো না এসবের গোয়েন্দা ব্যর্থতার জন্যে কিছু লোকজনকে ফাঁসি দিয়েছে সরকার? এসব নানা সমস্যার পাশাপাশি বড় আরেকটা সমস্যা আমাদের লোভ! সামাজিক পারিবারিকভাবে আমাদের বেশিরভাগ লোকজন আমরা সব ধরনের নৈতিকতা হারিয়েছি! এখানে বাবা ছেলে বা মেয়ের জন্যে ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্র জোগাড় করেন! প্রশ্নপত্র জোগাড় করতে না পারার জন্যে পরিবার থেকে আমার এই প্রিয় প্রজন্ম ছেলেটির মতো অনেককে ভৎর্সনা করা হয়! যে কোনওভাবে আমরা পেতে চাই! কারণ এটাই এখন দেশের লোকজনের সামনে একমাত্র মডেল! যে কোনওভাবে কিছু পেয়ে গেলে তো আর সেটি কারও কাছে অচ্ছুৎ কিছু থাকে না! যেন এমন চলে আসছে এবং আসবে! ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্র নিয়ে আমরা সরকার ও সংশ্লিষ্ট লোকজনকে গালি দিচ্ছি। কিন্তু ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্রসহ কাউকে ধরিয়ে দিচ্ছি কি? বেশিরভাগ লোকজন এখন এমন সুযোগের ধান্ধায় থাকেন! সুযোগ পেয়ে গেলে আলহামদুলিল্লাহ বলেন! না পেলে গালি দেন! আবার খুব কম সংখ্যক আছেন যারা এমন সুযোগ নিতে চান না। মনে করুন আমার এই প্রিয় প্রজন্ম ছেলেটা তাদের একজন। কিন্তু আমরা কী তাদের এপ্রিসিয়েট করি? না করি তিরস্কার!
আমি সিডনিতে বাংলাদেশের প্রিয় প্রজন্ম নতুন ছেলেমেয়েদের দেখা পেলে তাদের প্রথম সংগ্রামের দিনগুলোতে সহায়তা দেবার চেষ্টা করি। বাংলাদেশ থেকে কেউ আসতে চাইলে সহযোগিতা করি তথ্য দিয়ে। এক্ষেত্রে আমার মাঝে কিছু নিজস্ব চিন্তা কাজ করে। এক হলো ছেলেমেয়েগুলো যত বাইরে বেরুবে প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বের সঙ্গে তারা পরিচিত হবে। নিজেকে নিজের দেশকে মেলে ধরবে। আর তাদের মাধ্যমে আরও বড় সম্প্রসারিত হবে আমার জন্মভূমি। আরেকটি চিন্তা কাজ করে। সিডনিতে তারা পড়াশুনা করবে নিজের পরিশ্রমের পয়সায়। বাবা-মা’র ওপর থেকে চাপ কমবে। ছেলেমেয়ের পড়াশুনার ব্যয় সামাল দিতে গিয়ে দুর্নীতি করেন অনেক বাবা অথবা অভিভাবক। ছেলেমেয়ে নিজের টাকায় পড়লে বাবা বা অভিভাবককে এ বাবদ দুর্নীতি করতে হবে না। অন্তত এ খাত থেকে বাঁঁচবে আমার দেশ। আরেক কারণে তাদের আমি ওয়েলকাম করি অস্ট্রেলিয়ায়। এদেশের প্রয়োজনীয় বিষয় বুঝে পড়াশুনা করলে ভবিষ্যতে তার অভিবাসন হয়ে যাবে প্রশান্তপারের এই দেশে। আমার আরেকটা ভাইবোন অথবা বন্ধু বাড়বে।
অনেকে এটিকে ব্রেন ড্রেন বলে তিরস্কার করেন। কারণ দেশের ক্রিম ছেলেমেয়েরা আইএলটিএস স্কোর, পঞ্চাশ লাখ টাকার বেশি ব্যাংক সলভেন্সি দেখিয়ে পড়তে যায় অস্ট্রেলিয়ায়। এখানে প্রথম দিনগুলোতে ছেলেরা মেয়েরা যে একা একা কত কষ্টে কাঁদে। দেশ থেকে মনে করে আসে যে কাজ পাই তাই করবো। কিন্তু কাজটা যে কী তাদের তা কেউ জানে না। নতুন আসা বিদেশি ছাত্রছাত্রীরা এসব কাজই এদেশে করেন। অনভ্যস্ত কাজের কান্নায় তাদের পাশে দাঁড়াই। প্যারাসিটামল প্যানাডল খাওয়াই। আর সাহস দিয়ে বলি, তুমিতো দুর্নীতিমুক্ত একজন সৎ মানুষ হতে এদেশে এসেছো। বাংলাদেশে থাকলে সৎ মানুষ হয়ে বেঁচে থাকা অনেক কঠিন হয়ে যেতো। আর এখান থেকে পরিবারকে যে সাপোর্ট দিতে পারবে তা দেশে থাকলে হয়তো পারতে না। এদেশের প্রথম রোজগারের টাকাটা দেশে বাবা-মার কাছে পাঠাতে উৎসাহ দেই। ওই বাবা-মা’র হয়তো তার সোনামনি জাদুমনির ওই টাকার দরকার ছিলো না। ওই টাকা পেয়ে তারা আনন্দে কাঁদেন। অর্থমূল্য হয় না এই আনন্দের!
এখানে এই দেশটায় এসে প্রিয় প্রজন্ম ছেলেমেয়েরা যা উপভোগ করেন তাহলো একটি দুর্নীতিমুক্ত শিক্ষা ব্যবস্থা। কোথাও কোনও প্রশ্নপত্র ফাঁস আর তদবিরের বালাই নেই। অরিয়েন্টেশনের দিন যে কোর্স আউটলাইন, রুটিন তাকে ধরিয়ে দেয়া হয়, সেভাবেই চলে, চলবে পুরো সেমিস্টার। এদেশের জীবনে কোনও হরতাল-ধর্মঘট নেই। কোনও কারণে কোনও একটি ক্লাস বা পরীক্ষার হেরফের হবে না। এর কারণে তার পড়াশুনা, ক্লাস-পরীক্ষা-কাজ সব চলে নিয়মমাফিক। পড়াশুনাটা এদেশে পণ্য। টিউশন ফি উচ্চমূল্য। কিন্তু টাকাটা তারা কড়ায়-গ-ায় উসুল দেখিয়ে নেয়। ক্লাসেই একজন ছাত্রকে বুঝে ফেলেন একজন শিক্ষক। মামা নয় চাচা নয় বা রাজনৈতিক পরিচয় নয়। তার মূল্যায়ণ হয় তার মেধার গুণে। মেধায় যোগ্যতায় একজন ছাত্র চলে যায় তার উপযুক্ত জব মার্কেটে। অথচ এই দেশটা এমন আহামরি উন্নত দেশ নয়। কাগজে কলমে এখনও একটি উন্নয়নশীল দেশ। শুধু সততা নিষ্ঠার গুণে এ দেশ এগিয়ে যাচ্ছেই শুধু। এরা আমাদের মতো দেশগুলোর মেধাবী প্রিয় প্রজন্মদের মেধার মূল্যায়ন করেই শুধু এগোচ্ছে। বাংলাদেশ শুধু সামাজিক রাজনৈতিক দুই নাম্বারি চিন্তায় নিজের দেশে নিজের মেধাবী প্রিয় প্রজন্ম ছেলেমেয়েদের মূল্যায়ণ করেনি, কাজে লাগায়নি, তারাই আজ অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশে এসে সবচেয়ে কাজের মানুষ! এদের হাত ধরে প্রতিদিন অস্ট্রেলিয়ায় বড় হচ্ছে বাংলাদেশ!
এর মানে এই না যে আমি আমার প্রিয় প্রজন্ম ছেলেমেয়ে সবাইকে দেশ ছেড়ে পালাতে বলছি। চাইলেই সবাই আরেক দেশে চলে যেতেও পারবে না অথবা যাবে না। বাংলাদেশের নেতাদের বলছি আর কিছু না পারুন আমাদের এই ছেলেমেয়েকে একটু সততা দিন। মেধার ভিত্তিতে তাদের এগিয়ে যাবার পথ করে দিন। এত প-িত একেকজন আপনারা। কথাবার্তায় সব পারেন। এমন সব মেধাবী কোমলমতি প্রতিভাবান প্রিয় প্রজন্ম ছেলেমেয়ে আমাদের। এরা তো আপনাদের কাছে টেন্ডার বা কোনও দয়া চায় না। শুধু তার মেধার ভিত্তিতে সব পরীক্ষায় সৎভাবে অংশ নেওয়ার সুযোগ চায়। সব জায়গাতে প্রতিযোগিতামূলক নিজস্ব মেধায় যোগ্যতায় অংশ নিয়ে যেতে চায় তার নিজস্ব জায়গায়। শুধু এইটুক চাহিদা আমাদের প্রিয় প্রজন্ম ছেলেমেয়েদের পূরণ করতে অপরাগ ব্যর্থ আপনারা প্রিয় নেতৃবৃন্দ? বুকে হাত দিয়ে বলুন তো এই একটা চাহিদা মেটাতে পারেন না যদি আপনাদের এখানে আসতে থাকতে কেউ হাতে-পায়ে ধরেছে কী? দেশের মানুষের চাহিদা মেটাতে যে লাটবহর শুধু প্রশ্নপত্র ফাঁস ইস্যুতে তাদের কোথায় কার ব্যর্থতা এটাও চিহ্নিত করতে পারেন না? তাহলে তো সোজা এক কথা, বিদায় হোন। -বাংলাট্রিবিউন
লেখক: অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী সাংবাদিক


শেয়ার করুন