প্রার্থী জটিলতায় আওয়ামী লীগ বিএনপি জাপা

3_102-400x208সিটিএন ডেস্ক :

আসন্ন ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন দেওয়া নিয়ে নানা জটিলতায় পড়েছে প্রধান তিন রাজনৈতিক দল। আজ প্রথম ধাপের মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ দিন। কিন্তু গতকালও বিভিন্ন ইউপিতে প্রার্থী পরিবর্তন করেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। বিএনপির প্রার্থী মনোনয়ন নিয়েও তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা ক্ষোভ প্রকাশ করছেন। তৃণমূলকে উপেক্ষা করে অনেক ইউনিয়নে কেন্দ্র থেকে বিশেষ ব্যবস্থায় বিএনপির প্রার্থী মনোনয়ন দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে।

এ ছাড়া প্রথম ধাপের ৭৩৯ ইউপিতে প্রার্থী দিতে পারছে না বর্তমানের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টি। গতকাল পর্যন্ত ২৮২টি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান পদে জাতীয় পার্টির প্রার্থী মনোনয়ন চূড়ান্ত করা হয়েছে।

অভিযোগের শেষ নেই : ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে মনোনয়ন নিয়ে আওয়ামী লীগের অভিযোগের শেষ নেই। পরিবর্তন করা হচ্ছে প্রার্থীও। আগামী ২২ মার্চ অনুষ্ঠেয় প্রথম দফা ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীর নাম চেয়ে তৃণমূলে চিঠি পাঠানো হয় কেন্দ্র থেকে। এ তালিকা ১৫ ফেব্র“য়ারির মধ্যে কেন্দ্রে জমা দিতে নির্দেশনা দেয় কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ। এরপর থেকেই আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে চেয়ারম্যান প্রার্থীদের নাম আসার পাশাপাশি অভিযোগনামাও আসতে থাকে। গত ৭ দিনে কমপক্ষে এক হাজার অভিযোগ জমা পড়েছে কেন্দ্রে। অভিযোগগুলোর অধিকাংশই স্থানীয় এমপি-জেলা ও উপজেলা সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকরা প্রভাব খাটিয়ে বা মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে দলের গ্রহণযোগ্য প্রার্থীদের বাদ দিয়ে অনুপ্রবেশকারী বা যুদ্ধাপরাধী-রাজাকারের সন্তানদের নাম সুপারিশ করেছেন।

প্রথম দফায় ৭৩৯ জন চেয়ারম্যান প্রার্থীর তালিকা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, কমপক্ষে ১৫-২০ জন আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন যারা রাজাকার, যুদ্ধাপরাধীর সন্তান ও বিএনপি-জামায়াতের নেতা। সূত্রমতে, বিভিন্ন অভিযোগ খতিয়ে দেখে প্রার্থী পরিবর্তন করছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। গতকাল দুপুরে ধানমন্ডি আওয়ামী লীগ সভাপতির কার্যালয়ে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন পরিচালনা কমিটির একটি অনির্ধারিত বৈঠকে বেশ কয়েকটি ইউনিয়নে চেয়ারম্যান প্রার্থীর নাম পরিবর্তন করা হয়।

এ প্রসঙ্গে দলের দফতর সম্পাদক ড. আবদুস সোবহান গোলাপ বলেন, প্রার্থী পরিবর্তন করা হচ্ছে না। তবে বিভিন্ন অভিযোগ আসছে, সেগুলো খতিয়ে দেখা হচ্ছে। আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেও খোঁজখবর নিচ্ছেন। প্রার্থিতা পরিবর্তন করার প্রয়োজন হলে দলের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী দেয়া বিশেষ ক্ষমতাবলে তিনি তা করছেন।

প্রথম দফায় তিন-চারজন প্রার্থী পরিবর্তন করা হয়েছে বলে দলীয় একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে। খুলনার দিঘলিয়া উপজেলার জোড়িপোল ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছিলেন সাজাদ্দুর রহমান লিংকন। গতকাল তাকে বাদ দিয়ে প্রার্থী ঘোষণা করে চিঠি দেওয়া হয়েছে শেখ আনিসুর রহমানের নামে। শেখ আনিসুর রহমান উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক ছাত্রনেতা। আর যিনি দলীয় মনোনয়ন পেয়েছিলেন তার রাজনৈতিক তেমন ব্যাকগ্রাউন্ড ছিল না। দলীয় মনোনয়ন ঘোষণার পর স্থানীয় আওয়ামী লীগ বিক্ষোভ সমাবেশ করে বলেও জানা গেছে। পটুয়াখালীর দুমকী উপজেলার ১ নম্বর পাঙ্গাশিয়া ইউনিয়নে চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন আলমগীর সিকদার। তার পিতা ইউনুচ সিকদার রাজাকার ছিলেন বলে অভিযোগ করেছেন স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা ও আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা।

জানা গেছে, ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ বর্ধিত সভা করে এই ইউনিয়নে নজরুল ইসলাম ও আলমগীর সিকদারের নাম প্রস্তাব করে। পরে জেলা আওয়ামী লীগ নজরুল ইসলামের নাম বাদ দিয়ে আলমগীরের একক নাম কেন্দ্রে পাঠায়। পরে দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার পর স্থানীয়রা ক্ষোভে ফেটে পড়ে।

স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা ও অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক মো. চান মিয়া তালুকদার বলেন, আমাদের নেত্রী রাজাকার-যুদ্ধাপরাধীর বিচার করছেন। আর তার দলের নেতা-কর্মীরা রাজাকারপুত্রকে নৌকার টিকিট দিয়ে চেয়ারম্যান প্রার্থী করছেন। নেত্রী সঠিক তথ্য পেলে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করবেন— এমন প্রত্যাশা আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের।

তিনি বলেন, আলমগীরের বাবা ইউনুচ রাজাকার আমার চোখের সামনে অনেক মুক্তিযোদ্ধার বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ করেছেন। যুদ্ধের পর দুই বছর জেলও খাটেন ওই রাজাকার। বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জের জিউধরা ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন জাহাঙ্গীর আলম বাদশা। তার পিতা ছিলেন স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ওই ইউনিয়নের শান্তি কমিটির সহ-সভাপতি আকবর আলী। বাদশার নামে হত্যা-ঘের দখলসহ বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়াও তার শ্বশুর মোস্তফা মোল্লা মংলা থানার উপজেলা জামায়াত নেতা।

অভিযোগ রয়েছে, স্থানীয় এমপি প্রভাব খাটিয়ে তাকে প্রার্থী করেছেন। ঝালকাঠির রাজাপুর মঠবাড়িয়া ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন সাবেক শিবির সভাপতি কামাল সিকদার। অভিযোগ রয়েছে, রাজাপুর উপজেলার প্রায় প্রত্যেকটি ইউনিয়নেই চেয়ারম্যান পদে মনোনয়ন পেয়েছেন অনুপ্রবেশকারীরা।

বিএনপির মনোনয়ন বিশেষ ব্যবস্থায় : স্থানীয় পাঁচজন নেতার স্বাক্ষরে মনোনয়ন প্রক্রিয়া নির্ধারণ করে দেওয়া হলেও বিভিন্ন এলাকার অনেক ইউনিয়নে কেন্দ্র থেকে বিশেষ ব্যবস্থায় বিএনপির প্রার্থী মনোনয়ন দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। এ নিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে দলটির তৃণমূলে ব্যাপক ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। দলের এমন আচরণে অনেক এলাকার যোগ্য প্রার্থীরা ক্ষোভে-দুঃখে নির্বাচনে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ায় বেশ কিছু এলাকায় প্রার্থী সংকটও দেখা দিচ্ছে দলটিতে।

জানা গেছে, দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব ও সংশ্লিষ্ট একজন যুগ্ম মহাসচিবকে এড়িয়ে বেশ কিছু এলাকায় যোগ্য প্রার্থীদের বাদ দিয়ে নগদ অর্থের বিনিময়ে যেনতেন ব্যক্তিদের ইউপি নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে মনোনয়ন দেওয়া হচ্ছে। চেয়ারপারসন কার্যালয়ের একটি বিশেষ সিন্ডিকেটের তত্ত্বাবধানে বিশেষ ব্যবস্থায় মনোনয়নের এ কার্যটি সম্পাদিত হচ্ছে। একজন প্রভাবশালী কর্মকর্তা এ কাজে দলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির একজন সর্বকনিষ্ঠ সহ-দফতর সম্পাদককে ‘কালেক্টরের’ কাজে ব্যবহার করছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে। এ ছাড়াও স্বাক্ষর জাল করে প্রার্থী ঘোষণা, সাবেক মন্ত্রী-এমপিদের প্রভাব ও আর্থিক লেনদেনসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ এসেছে। ঢাকায় বসে প্রার্থী মনোনয়ন দেওয়ারও অভিযোগ উঠেছে সাবেক মন্ত্রী, এমপি ও নেতাদের বিরুদ্ধে।

জানা গেছে, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জ, শরণখোলা, খুলনার ডুমুরিয়াসহ সাতক্ষীরা, বরিশালের গৌরনদী ও শেরপুরসহ বৃহত্তর ময়মনসিংহের বেশ কয়েকটি উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে এ ধরনের অভিযোগ পাওয়া গেছে। পত্র-পত্রিকাসহ বিভিন্ন মিডিয়ায় এসব অভিযোগের খবর পড়ে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা হাবিবুর রহমান হাবিব তার নিজের এলাকা পাবনা ও ঈশ্বরদী নিয়ে বেশ চিন্তিত।

তিনি বলেন, আমি জানি না এ অভিযোগের সত্যতা কতটুকু? কারণ আমার এলাকার নির্বাচনী মনোনয়ন প্রক্রিয়া এখনো শুরু হয়নি। তবে দলের কমিটি যেহেতু কেন্দ্র থেকে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে সেহেতু এই মনোনয়নও কেন্দ্র থেকে বিশেষ ব্যবস্থায় দেওয়া হতেই পারে। মনোনয়ন বঞ্চিতরা অভিযোগ করেন, উপজেলা বিএনপির সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক ও ইউনিয়নের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক ও সাংগঠনিক সম্পাদকের সমন্বয়ে নির্বাচনী বোর্ড সংশ্লিষ্ট এলাকার প্রার্থী চূড়ান্ত করার কথা। কিন্তু উপজেলায় তারা প্রার্থীদের সঙ্গে আলোচনা না করে ঢাকায় বসেই প্রার্থী চূড়ান্ত করে চেয়ারপারসন কার্যালয়ের উল্লিখিত সিন্ডিকেটের মাধ্যমে কেন্দ্র থেকে অনুমোদন করিয়ে নিচ্ছেন। শেরপুর জেলার ১২টি ইউনিয়নের প্রার্থী তালিকা এ প্রক্রিয়ায় চূড়ান্ত করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

অর্ধেক ইউপিতেও মনোনয়ন দিতে পারেনি জাপা : আগামী ২২ মার্চ দেশের ৩৫টি জেলার ৭৩৯টি ইউনিয়ন পরিষদে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এই নির্বাচনকে ‘টেস্ট কেস’ হিসেবে নিয়েছে জাতীয় সংসদের বর্তমানের বিরোধী দল জাতীয় পার্টি। সে অনুযায়ী জেলা কমিটিগুলোকে নির্দেশ দিলেও সাড়া মিলছে না। গতকাল পর্যন্ত ২৮২টি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান পদে জাতীয় পার্টির প্রার্থী মনোনয়ন চূড়ান্ত করা হয়েছে। এর বাইরে আরও ১২০টি মনোনয়ন ফরম জেলার নেতারা কেন্দ্র থেকে নিয়ে গেছেন। নির্বাচন কমিশনে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ দিন আজ।

পার্টির মহাসচিব এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার বলেন, নতুন করে মহাসচিবের দায়িত্ব পেয়েছি এক মাস হলো। রাতারাতি সব কিছু পরিবর্তন সম্ভব নয়। আরেকটু সময় পেলে আরও ভালো করা সম্ভব হতো। তবে লক্ষণীয় বিষয়, সারা দেশের নেতা-কর্মীরা আজ উজ্জীবিত। সময় কম পেলেও অতীতের চেয়ে ভালো ফল পাব।

সূত্র বলছে, নেতৃৃত্বের দ্বন্দ্ব, সাংগঠনিক কার্যক্রম না থাকা, সরকারি দলের সঙ্গে সুসম্পর্ক, দলীয় বিশৃক্সখলা, কথায় কথায় বহিষ্কারসহ নানা ইস্যুতে দলটির এ অবস্থা। তারা বলেন, অধিকাংশ জেলায় কমিটি মেয়াদোত্তীর্ণ হয়েছে অনেক আগেই, সরকারে দলের তিনজন মন্ত্রী রয়েছেন। জাপা সরকারি দল না বিরোধী দল এটাই স্পষ্ট নয়। এর প্রভাব পড়েছে তৃণমূলে। যে ৩৫টি জেলায় নির্বাচন হচ্ছে তার মধ্যে ২৪টি জেলায়ই এখনো কাউন্সিল সম্পন্ন করতে পারেনি জাতীয় পার্টি। ইউপি নির্বাচন পরিচালনা কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য মীর আবদুস সবুর আসুদ বলেন, কোনো ষড়যন্ত্রই জাতীয় পার্টির অগ্রযাত্রা ব্যাহত করতে পারবে না। তিনি দাবি করেন, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সারা দেশে জাতীয় পার্টির নেতা-কর্মীরা আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। তৃণমূল নেতারা বলেন, দীর্ঘদিন ধরে সম্মেলন না হওয়ায় ঝিমিয়ে পড়েছেন জেলা নেতারা। বাংলাদেশ প্রতিদিন

স্থানীয় সময় : ০৬.৪৮ ঘণ্টা, ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৬


শেয়ার করুন