প্রধানমন্ত্রী হার্ড লাইনে

Federal_Reserve_Bank_Fronta1-696x228-400x131ডেস্ক রিপোর্ট:

যুক্তরাষ্ট্রের ‘ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউইয়র্ক’ থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গচ্ছিত টাকা লোপাটের ঘটনায় উচ্চ পর্যায়ের তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থ মন্ত্রণালয় এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোকে পৃথক তদন্ত সেল করে দ্রুত সময়ের মধ্যে প্রতিবেদন দেওয়ারও নির্দেশ দিয়েছেন তিনি।

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের একটি সূত্র জানিয়েছে, বুধবার ঘটনাটি প্রকাশ হওয়ার পরদিন বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রী সংশ্লিষ্টদের এই নির্দেশ দেন। প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও প্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ও এ বিষয়টি নিয়ে কাজ করছেন বলে জানা গেছে।

বিষয়টি খুবই স্পর্শকাতর হওয়ায় কোনওভাবেই যেন কোনও মহলের তদবিরে তদন্ত বাধাগ্রস্ত না হয়, সেদিকটিও নিশ্চিত করার দিকে নজর রাখতেও বলা হয়েছে শীর্ষ পর্যায় থেকে।

একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী অর্থমন্ত্রীর কাছে জানতে চেয়েছেন কেন গত ৫ ফেব্র“য়ারিতে ঘটে যাওয়া এরকম একটি স্পর্শকাতর ঘটনা এখনো পর্যন্ত সরকারকে জানানো হয়নি। বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্ণরের কাছ থেকে জানতে বলেছেন অর্থমন্ত্রীকে। দ্রুত এই ঘটনার তদন্ত প্রতিবেদন চেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।

অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত অর্থসচিবসহ অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের বলেছেন, এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত কাউকে একচুল ছাড় দেওয়া হবে না।

অর্থমন্ত্রী আরও বলেছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ অ্যাকাউন্ট থেকে এভাবে কয়েকদফায় টাকা হ্যাকড হওয়ায় ইমেজ সংকটে পড়েছে সরকার। তাই বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে দেখছেন সরকারের নীতিনির্ধারকরা। এর সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তাদের সংশ্লিষ্ট থাকার বিষয়টিকেও গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে সরকার।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানিয়েছে, প্রধানমন্ত্রী ও সরকার বিষয়টি নিয়ে বিব্রত। বলা হয়েছে, এই ঘটনার সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংক বা অন্য যে কোনো প্রভাবশালীই জড়িত থাকুক না কেন তাকে খুঁজে বের করতে হবে।

জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রীর এই কঠোর নির্দেশের পর বাংলাদেশ ব্যাংকে নেমে এসেছে আতংকের ছায়া। এরই মধ্যে দেশের প্রায় সবকটি গোয়েন্দা সংস্থা মাঠে নেমেছে।

এ্ররই মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বিভিন্ন পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। প্রতিনিয়ত সেসব কমিটির কার্যক্রম সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে তথ্য জানানো হচ্ছে বলে ব্যাংকের একজন শীর্ষ ব্যাংকের কর্মকর্তা জানান।

ওই কর্মকর্তা জানান, গত ছয়মাসে বিদেশ সফরকারী বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের নজরদারিতে রাখা হয়েছে। টাকা পাচারের সঙ্গে ব্যাংকের কেউ জড়িত রয়েছেন কিনা গোয়েন্দাদের তা খতিয়ে দেখতে বলা হয়েছে।

বাংলাদেশের ব্যাংকের একজন উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, একই সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে গত ৬ মাসে যারা প্রশিক্ষণ, কর্মশালা বা সভা-সেমিনারে ফিলিপাইন ও শ্রীলঙ্কায় গিয়েছিলেন, তাদেরও একটি তালিকা তৈরি করা হয়েছে। তবে তালিকায় কতজন আছেন, কারা-কারা আছেন, সে বিষয়ে কেউই মুখ খুলছেন না।

সূত্র আরও জানায়, সরকারের প্রভাবশালী একটি গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষে বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্টদের বলা হয়েছে, কারও ব্যাপারে ন্যূনতম সন্দেহ থাকলে তার ওপর কঠোর নজরদারি রাখতে হবে। ওই তালিকায় যারা আছেন, তাদের কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া ঢাকার বাইরে না যাওয়ার জন্য মৌখিক নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন ডেপুটি গভর্ণর নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, বিষয়টি সরেজমিন তদন্ত করতে ফিলিপাইন সফরে যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি উচ্চ পর্যায়ের টিম। একজন নির্বাহী পরিচালকের নেতৃত্বে ওই টিমে একজন মহা-ব্যবস্থাপক (জিএম) ও একজন উপ-মহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) পর্যায়ের কর্মকর্তা রয়েছেন। সোমবার (১৪ মার্চ) সকালে টিমটি ফিলিপাইনের রাজধানী ম্যানিলার উদ্দেশে রওয়ানা হতে পারে।।

বিষয়টি নিয়ে খুবই বিব্রত অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। তার নির্দেশেই বাংলাদেশ ব্যাংকের ওই টিমের সঙ্গে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগকে যুক্ত করা হচ্ছে বলে জানিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র। ওই টিমে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের একজন উপ-সচিব পর্যায়ের কর্মকর্তারও যুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক (বিবি) সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট হ্যাকড হওয়ার ঘটনায় সংশ্লিষ্ট গন্তব্য শনাক্ত করে উদ্ধারের বিষয়ে বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট ফিলিপাইনের এন্টি-মানি লন্ডারিং কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ করছে।

বিবি সূত্র জানায়, ঘটনাটি নিয়ে বিব্রত গভর্ণর ড. আতিউর রহমান। বৃহস্পতিবার তিনি সন্দেহভাজনদের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় তথ্য উদ্ধার করতে বাংলাদেশ ব্যাংকের ৪ কর্মকর্তাকে গোপনে নিজ কক্ষে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন।

ড. আতিউর রহমান বর্তমানে দিল্লি অবস্থান করছেন। গভর্নর দিল্লিতে থেকেই এ সম্পর্কিত বিষয়গুলো মনিটর করছেন বলে জানান তিনি। তিনি পূর্ব নির্ধারিত কর্মসূচি অনুযায়ী এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলভুক্ত দেশগুলোর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরদের জন্য আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) আয়োজিত তিনদিনব্যাপী এক সেমিনারে অংশগ্রহণের লক্ষ্যে বৃহস্পতিবার দিল্লি গেছেন। দিল্লির তাজ হোটেলে অনুষ্ঠিত হচ্ছে এই সেমিনার। আতিউর রহমান আগামী ১৪ মার্চ সকালে ঢাকায় ফিরবেন বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের মহা-ব্যবস্থাপক এএফএম আসাদুজ্জামান।

গভর্নর ড. আতিউর রহমানের অনুপস্থিতিতে ডেপুটি গভর্নর আবু হেনা মোহাম্মদ রাজী হাসান ও নাজনীন সুলতানা।

জানা গেছে, বিবি এই ঘটনা তদন্তে অনেক প্রতিষ্ঠানের সহায়তা নিচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ডাটাবেজ বা সার্ভার সম্পর্কে জানে এমন সব প্রতিষ্ঠানকেও তদন্তের আওতায় আনার কথা বলা হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের দুই কর্মকর্তা বিষয়টি নিয়ে আলোচনার জন্য ফিলিপাইনের ব্যাংক ও সেন্ট্রাল এনজি ফিলিপিনাসের সঙ্গে আলোচনা শেষে দেশে ফিরেই কয়েকটি উদ্যোগ নিয়েছেন। হ্যাকড হওয়ার ঘটনায় কোনও বিদেশি প্রতিষ্ঠান জড়িত আছে কিনা বিশেষজ্ঞরা সে বিষয়টিও খতিয়ে দেখছেন।

এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা শাখার একটি চৌকস দল বাংলাদেশ ব্যাংকের কয়েকজন কর্মকর্তার ওপর কড়া নজরদারি করছেন। তদন্তের স্বার্থে পদ পদবিসহ তাদের পরিচয় কঠোরভাবে গোপন রাখা হয়েছে। তদন্তের স্বার্থে তাদের কাছ থেকে প্রযুক্তিগত কিছু তথ্য ইতোমধ্যেই জানতে চাওয়া হয়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটি সূত্র জানায়, ফিলিপাইনের অ্যান্টি-মানি লন্ডারিং কর্তৃপক্ষ তাদের দেশের আদালতে মামলা দায়ের করে এবং সংশ্লিষ্ট ব্যাংক হিসাবগুলো ফ্রিজ আদেশ আদালত থেকে সংগ্রহ করেছে। পাশাপাশি বিশ্বব্যাংকে দীর্ঘ অভিজ্ঞতা সম্পন্ন একজন সাইবার বিশেষজ্ঞ পরামর্শক ও তার ফরেনসিক ইনভেস্টিগেশন টিম এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের টিমের সঙ্গে কাজ করছে বলে জানা গেছে।

সূত্র আরও জানায়, বাংলাদেশ ব্যাংকের পরামর্শক রাকেশ আস্তানা বলেছেন, শুধু টাকা হ্যাকডই নয়, বাংলাদেশ ব্যাংকের আরও অনেক গোপন তথ্য হ্যাকারদের কাছে রয়েছে। যে প্রক্রিয়ায় টাকা হ্যাকের ঘটনা ঘটেছে বা ঘটানো হয়েছে তাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের কেউ সরাসরি জড়িত থাকতে পারেন বলে তিনি মনে করেন না। তিনি ধারণা করছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ পরিচালনা ব্যবস্থা সম্পর্কে হ্যাকারদের খুব স্বচ্ছ ধারণা ছিল। কেননা, রিজার্ভের অর্থ চুরির জন্য এমন একটি সময়কে তারা বেছে নিয়েছে যখন বাংলাদেশ ব্যাংকের তিনজন ডেপুটি গভর্নরের পদই শূন্য ছিল।

চারজন ডেপুটি গভর্নরের মধ্যে আবুল কাশেম ছাড়া অন্য তিনজন ডেপুটি গভর্নর—এস কে সুর চৌধুরী, আবু হেনা মোহাম্মদ রাজী হাসান ও নাজনীন সুলতানার মেয়াদ শেষে হয় গত ২১ জানুয়ারি। এর প্রায় ১৫দিন পর গত ৭ ফেব্র“য়ারি এই তিনজন ডেপুটি গভর্নরের চুক্তির মেয়াদ বাড়ানোর আদেশ জারি করে সরকার। এ বিষয়টিকেও বিবেচনায় রাখা হচ্ছে।

এদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক শুভঙ্কর সাহাও মেপে মেপে কথা বলছেন। তিনি জানান, চুরি হওয়া অর্থ ফেরত আনতে বাংলাদেশ ব্যাংক তৎপর রয়েছে। ফিলিপাইন কর্তৃপক্ষের তৎপরতাও সন্তোষজনক। দেশটির আদালতসহ সব কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করছে। ফলে অর্থ ফেরত পাওয়া সম্ভব হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের অন্য একটি সূত্রে জানা গেছে, মার্কিন দুটি দল বিমানবন্দর ও সাইবার নিরাপত্তা বিষয়ে আলোচনা করতে শিগগিরই ঢাকায় আসবেন। বিষয়টি পররাষ্ট্র সচিব এম শহিদুল হককে জানিয়েছেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা স্টিফেন্স ব্লুম বার্নিকাট। পূর্বপশ্চিম, আমাদের সময়


শেয়ার করুন