পুরনো বঙ্গবন্ধু দিয়ে কি আর হচ্ছে না?

bongobondhu-400x275সিটিএন ডেস্ক:

দুটো ছবিই হিট করেছে। দ্বিতীয়টা শুধুই হিট আর প্রথমটা সুপারহিট। প্রথমটা ছিল ‘আইলানে’র। দ্বিতীয়টা ‘ওলেমা লীগ’-এর। দ্বিতীয়টা নিয়ে একটু পরে বলছি। আগে প্রথমটা নিয়ে বলি। প্রথমটার কল্যাণে ইউরোপে এখন দরদের বন্যা বইছে। শরণার্থী নেওয়ার জন্য সবাই দরজা খুলছে। ইংল্যান্ড প্রথমে কিছু গাঁইগুই করে, এখন আবার মিটিংয়ে বসেছে। মনে হচ্ছে আপাততঃ কিছুদিন শরণার্থী একটি হিট টপিক হবে। কে কত উদার হস্তে এই সমস্যা মোকাবিলা করছে, তার নাতিদীর্ঘ বর্ণনা থাকবে প্রতিদিনের সংবাদপত্রে। কে কে এখনও ঘাড় কাত করে থাকল, তাদের ধিক্কার চলবে। কলামিস্টরা অন্তত একটা কলাম তো লিখবেনই।
তাহলে, বর্তমান পরিস্থিতি দেখে কি শিখলাম? শিখলাম, সমস্যা কতটা, তা নিয়ে আমাদের খুব একটা মাথাব্যথা নেই। চাই সমস্যার মার্কেটিং। দারুণ সুচারুভাবে মার্কেটিং করতে পারলেই, পাবলিক খাবে। সেই ঘটনার প্রতিক্রিয়া হবে। সভ্য সমাজ নড়েচড়ে বসবে। পত্রিকা রিপোর্ট করবে। তাই ঘটনা শুধু করুণ হলেই হবে না, সেখানে নতুনত্বও থাকতে হবে। আর যদি দুটোই হয়, তবে আর পায় কে? মনে আছে, কিছুদিন আগে একজন সিরীয় শিশুর ‘আমি উপরে গিয়ে সব বলে দিব’Ñ ডায়ালগটা? দারুণ হিট করেছিল। কিছুদিন বিশ্ববাসী নাকি কান্না কেঁদেওছিল। এরপর? এরপর আবার যে কার সেই। এবারও হয়ত তেমনই হবে, তবে তার আগে কাহিনী কতদূর গড়াবে, কে জানে।
একবারও কি ভেবে দেখেছেন, আইসিস এমন সব বর্বর কার্যকলাপ কেন করে বেড়াচ্ছে? ইসলাম ধর্মের দোহাই দিয়ে যৌনদাসী বানানো থেকে শুরু করে শুধু অমুসলিম হওয়ার কারণে জবাই? সেই একই ব্যাপার, মার্কেটিং, প্রোপাগান্ডা। ‘দেখো’ ‘আমাদের কার্যকলাপ দেখো’ ‘মনে রাখো আমাদের’Ñ ব্যাস এটাই চাওয়া। ‘আইসিসের দখলে থাকা এলাকায় দারুণ শান্তি’Ñ এমন কোনো খবর কি মার্কেট পেত? পেত না।
যেহেতু আমেরিকার যেকোনো অন্যায় যুদ্ধের বিরুদ্ধে কেউই কোনো কথা বলছে না কিংবা কিছু বলার সাহস দেখাচ্ছে না, তাই আইসিসের কোনো এক ‘সাদা চামড়া’কে হত্যা করা দেখে মনে মনে অনেকে শান্তি পাচ্ছে। ‘ওদের দেশের একজনকে তো মারলো’। এত বর্বরতার পরও তাই আইসিসের একটা ফ্যানক্লাব তৈরি হয়ে বসে আছে। যেমনটা হয়েছিল সাদ্দাম হোসেনের জন্য। কুয়েত আক্রমণ কিংবা ইরাকে চলা স্বৈরশাসনের কথা ভুলে গিয়ে সবার মনে মুখ্য হয়ে উঠেছিল, ‘আমেরিকার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে, বাপের ব্যাটা’।
সর্বত্র চলা এই মার্কেটিংয়ে, তার কথাই আমরা শুনি বা আলোচনা করি, যে নিজেকে খুব ভালোভাবে মার্কেটিং করতে পেরেছে। নির্দয়ভাবে হোক আর সানি লিওনের মতো করে হোক। হতে হবে ‘টক অব দ্যা টাউন’। একটা কথা ভেবে দেখেছেন, কিছুদিন আগেও তালেবান, মোল্লা ওমর আর লাদেন কতটা কাভারেজ পেয়েছে? সেই তালেবান কি আর আলোচনায় আছে? নেই। কারণ? কারণ খুবই সিম্পল। নতুন বর্বর জাতের কোনো সহিংস ঘটনা ওদের কাছ থেকে আসছে না। বর্বর হত্যাকান্ড, জবাই, মূর্তি ভাঙ্গা, নারী, মানবতাকর্মী হত্যাÑ তেমন কিছুই নেই। আর নেই বলে, তারা শিরোনামেও নেই।
এবার দ্বিতীয় ছবিটার কথায় আসি। ছবিটা দেশের। ওলেমা লীগের। একটি ব্যানার হাতে নিয়ে মজার এক দাবি জানানোর ফটোসেশান। আচ্ছা বলুন তো, ইসলাম ধর্মঘটিত কোনো কথাবার্তার কথা মনে এলে সাথে সাথে আর কার নাম মনে আস্তে ঠিক বলেছেন। ‘হেফাজত’। কিন্তু কেন? সেখানেই মজাটা। গত বেশকিছুদিন যাবত ধর্মসংক্রান্ত যেকোনো নির্দেশনা-টাইপ বক্তব্যগুলোর ভেতর সবচেয়ে বেশি মার্কেট পেয়েছে? ঠিক ধরেছেন ‘হেফাজত’। ফেসবুক, ব্লগে যান, ধর্মসংক্রান্ত যত কটাক্ষ, সেখানে শফি হুজুর কিংবা ‘হেফাজত’ পাবেনই। বাঁশের কেল্ল­াও সেখানে এত বাজার পায়নি। তাহলে কি দাঁড়াল? ধর্মের বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে একমাত্র বক্তা হয়ে দাঁড়িয়েছে, ‘হেফাজত’। কিন্তু সেটা কি তাদের ধর্মসংক্রান্ত পড়াশোনা কিংবা জ্ঞানের জন্য? না।
এখানেই খেলার শুরু। শহিদ কিংবা রহমাতুল্লাহে আলাইহে নিয়ে সম্প্রতি ‘ওলেমা লীগ’য়ের দেওয়া বক্তব্য দেখে মনে হল, এতদিন পর এবার তারা সত্যিই ‘ব্যাং অন টার্গেট।’ অন্যসব দল বা গ্র“প ধর্মীয় বক্তব্য দেয় এবং তাদের বক্তব্যকে যতটা হাইলাইট করা হয় ‘ওলেমা লীগ’য়ের অবস্থান তার ধারেকাছেও না। হেফাজত যে কাভারেজ পায়, ওলেমালীগ সেই তুলনায় কোনো কাভারেজই পেত না। হেফাজতের দেওয়া একটা বক্তব্য যেভাবে সব পত্রিকা লুফে নেয়, তার সিকিভাগ পাবলিসিটিও পায় না ওলেমালীগ। এবার, অনেকদিন পর, তারা লাইম লাইটে আসবার মতো একটা কাজ করেছে।
তবে, তাদের দেওয়া বক্তব্যটা আসলে তাদের উর্বর মস্তিষ্ক থেকে বেরিয়েছে, না আরও উপরের কারো মস্তিষ্ক থেকে, সেটা এখনও পরিষ্কার না। আসলে বঙ্গবন্ধুকে শহিদ বলা হবে কি না, তা নিয়ে মনে হয় আওয়ামী থিঙ্কট্যাঙ্ক মনে হয় না এতদিন ভেবেছে। গত বছর খানেক ধরে সম্ভবত তারা এ নিয়ে একটা বড়সড় সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে। ভালো কিংবা মন্দÑ যেটাই হোক, এখনও এদেশে ‘আরবি’ শব্দের সাথে একটা ধর্মীয় ভাব মিশে আছে। মৃতর চেয়ে মরহুম বলতে অনেকেই বেশি পছন্দ করেন। আর মৃতদের সম্মান দেখানোর জন্য এই সিঁড়ির সবচেয়ে ওপরের ধাপ ‘শহিদ’। কাকে শহিদ বলা হবে কিংবা কে সিদ্ধান্ত নেবে একজন শহিদ কি নাÑ এদেশে যেহেতু তার কোনো নিয়ম-কানুন নাই, তাই এ শব্দটির যথেচ্ছ ব্যবহার স্বাভাবিক। আর ‘শহিদ’ শব্দটার যেহেতু রাজনৈতিক বাজারদর একটু বেশি, তাই সুযোগ পেলে সব দলই সেটার দখল নিতে আগ্রহী হয়ে ওঠে।
এদেশের আরও একটি বাস্তবতা হচ্ছে, দেশের দুই বড়দল তাদের মৃত নেতার ঘাড়ে চড়েই এখনও রাজনীতি করে যাচ্ছেন। তাই ‘শহিদ’ শব্দটার মতো রাজনৈতিকভাবে উপকারী শব্দ নেতার আগে যোগ করা অনেকে জরুরি ভাবছেন। ব্যাপারটা অনেক আগেই কাজে লাগিয়েছেন সশস্ত্র বিদ্রোহী সেনা সদস্যদের গুলিতে মারা যাওয়া অপর বৃহৎ দল। তারা শুরু থেকেই তাদের শীর্ষ নেতার গায়ে শহিদ লাগিয়ে ফেলেছেন। তখন আওয়ামীদের তেমন কিছু করার সুযোগ ছিল না, তাই বাঁধা দেয়নি। আর ধর্মীয় লেবাস গায়ে লাগাবে না, এমন একটা নীতি নিয়ে চলছিল দেখে নিজেদের নেতার গায়েও শব্দটি লাগায়নি।
তবে মনের কোনায় সম্ভবত একটা আক্ষেপ থেকে গিয়েছিল। অন্য দলের শীর্ষ নেতার গায়ে ‘শহিদ’ লেগে থাকায়, সেটা হয়তো আওয়ামীদের কিছুটা মনঃকষ্টের কারণ হয়েছিল। মনঃকষ্টটা ঠিক কোনটা সে বিষয়ে আমি কিছুটা দ্বিধান্বিত। ‘ওদের নেতা শহিদ হলে আমাদের নেতাও শহিদ’ এমন? না ‘আমরা যেহেতু শহিদ ব্যবহার করছি না, তোমরাও করতে পারবা না।’ ঘটনা যেটাই হোক, ‘ওলেমালীগ’ আগুনে ঘি ঢেলে দিয়েছে।
বুঝেই হোক আর না বুঝে বিতর্কটা তারা শুরু করে দিল। ওপর মহলের নির্দেশ আছে কি নাÑ সেটা আগামী কিছুদিনের মধ্যেই স্পষ্ট হয়ে যাবে। তবে মনে হচ্ছে, খেলা একটা পরিণতির দিকে যাবে। বঙ্গবন্ধুকে তারা ঠিক কিভাবে মার্কেটিং করতে চাইছে, ঠিক কোন ফর্মটাকে আওয়ামীরা বেশি ফলদায়ক ভাবছে, আগামী কিছুদিনের ভেতরেই হয়তো জানা যাবে। তখন আমরা নতুন এক লেবেল পাবÑ ‘মৃত’, ‘মরহুম’ কিংবা ‘শহিদ’।


শেয়ার করুন