‘পরের ‘রেপ’টায় আরও বড় পরিসরে ইভেন্ট করতে হবে’

xPKI3zx6JYuE1-400x288যায়নুদ্দিন সানী

একটা ‘রেপ’ হইল আর তসলিমা নাসরিন কিংবা নাস্তিক্যবাদী গ্রুপ একটা স্ট্যাটাস দিবেন না, হতেই পারে না। এই মুহূর্তে ফেসবুক আর ব্লগে তনুকে নিয়ে যথারীতি শুরু হয়ে গেছে স্ট্যাটাস উৎসব। যে যেভাবে পারছে, স্ট্যাটাস দিচ্ছে। ‘রেপ’কে শুধু কটাক্ষ করলে তো আর সেই স্ট্যাটাস কেউ পড়বে না। তাই সেখানে ধর্মকে টানা হচ্ছে। ধর্মকে কটাক্ষ করা স্ট্যাটাসের একটা বেশ ভালো বাজার আছে। অন্তত: বামপন্থি গ্রুপটা এমন কোনো লেখাকে হিট করাবার আপ্রাণ চেষ্টা চালায়।

কমবেশি প্রায় প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও ‘রেপ’ হচ্ছে। পত্রিকায় আসে কিছু সিলেক্টেড কেস। চার বছরের শিশু কিংবা ‘বাবার হাতে এসবের বাজার দর বেশ ভালো। শহরে এবং শিক্ষিত পরিবারের কোনো মেয়ে হলে, সেটাও প্রথম পাতায় আসে। এরপরে ঘটনায় নাটকীয়তার পরিমাণের ওপর নির্ভর করে, কতদিন তা শিরোনাম হবে। এদিক দিয়ে ভাবলে, তনু ভিক্টিম হিসেবে একের মধ্যে অনেক। মফস্বল, টিউশানি, হিজাব, সন্ধ্যা, নাটক করা হিট করার মতো একটা খবর। খবরটা ব্লগ বা ফেসবুকের জন্যও লুফে নেওয়ার মতো একটা আইটেম। আসলে তনু একই সঙ্গে বেশ অনেকেরই পারপাস সার্ভ করেছেন। ঘটনাটা নিয়ে গরুর রচনাও যথারীতি শুরু হয়ে গেছে। আবৃত্তি, নাটক করতেন। তাই অনেকেই দেখলাম সেই কার্যক্রমকে টেনেহিঁচড়ে ধর্মের দরজায় নিয়ে হাজির করেছেন। এরপরে ধর্মের গোষ্ঠী উদ্ধার। কেউ ইস্যু বানাচ্ছে তার হিজাব পড়াকে। সেটাকেও নিয়ে গিয়ে হাজির করছে ধর্মের কাছে, ‘এই মেয়ে তো হিজাব পড়ত, চুলও ঢেকে রাখত, তাহলে কেন রেপ করা হলো?’

ইভেন্ট খোলা হয়ে গেছে। দলে দলে মানুষ হয়তো সেখানে যাবে। যে যার মতো দোষী নির্ধারণ করবে। এরপরে কিছু গালিগালাজ আর সমালোচনা করে, দায়িত্ব শেষ। তনুর পরিবার যে তিমিরে আছে, সেই তিমিরেই থাকবে। হয়তো ‘আই ওয়াশ’ হিসেবে কিছু অ্যারেস্ট হবে। এরপর খবরটা শিরোনাম থেকে সরতে না সরতেই জামিন হয়ে যাবে। অতঃপর? সেই পুরনো খেলা। হুমকি, কেস উঠানো কিংবা লম্বা কেস চলা। অবশেষে তনুর পরিবারের রণে ভঙ্গ দেওয়া।

ধর্মকে যারা কটাক্ষ করছেন, তারা নিজের অজান্তে কিংবা জ্ঞাতসারে যে কাজটা করছেন, তা হচ্ছে পুরো ব্যাপারটাকে হালকা করে দিচ্ছেন। ধর্মকে গালি দেওয়ার জন্য ইস্যু খোঁজা মানুষগুলো, যথারীতি সব ঘটনার একটাই সারাংশ দাঁড় করাচ্ছেন, ধর্ষণের জন্য ধর্মই দায়ী। কারণ হিসেবে তারা যে যুক্তিগুলো নিয়ে আসছেন, তা হচ্ছে কোনো কোনো ধর্ম বিশারদের বয়ান। যে ধর্ম বিশারদ, কোনো এক ধর্ষণের পরে কিংবা প্রায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে, সম্ভব হলে, তারা যে বয়ানগুলো দেন তা হচ্ছেÑ ‘মেয়েটি সঠিক পোশাক পড়লে।’ আমি একটা ব্যাপার বুঝি না। কোথাও চুরি হলে, ডাকাতি হলে তো আমরা ধর্মীয় বয়ান শুনতে যাই না। কিংবা কোনো ধর্ম বিশারদ এই ব্যাপারে কি ফতোয়া দিয়েছেন, তা নিয়ে কটাক্ষ করি না। ব্যতিক্রম শুধু রেপকে নিয়ে। সেক্স, যৌনতা কিংবা যৌনঘটিত কোনো কেলেঙ্কারি, সবকিছুতেই বোধ হয় একটা উদ্দাম আকর্ষণ আছে। আর সেখানে যদি কোনোভাবে রাজনীতি আর ধর্মকে জড়ানো যায়, তবে ব্যাপারটা হয়ে যাবে সুপারহিট।

আপনাদের কি মনে হয়? তনুর ক্ষেত্রে কিছু হবে? অপরাধী শাস্তি পাবে? কিংবা কাল বা পরশু যে রেপগুলো হবে? সেখানেও কি কোনো সমাধান আসবে? উত্তর হচ্ছে বড়সর একটা ‘না’। তারচেয়ে বড় কথা, এনিয়ে আমরা আদৌ উদ্বিগ্ন না। আমরা এখনও সেই পুরনো কাসুন্দি ঘেঁটে বেড়াচ্ছি। কবে কোনো ধর্ম বিশারদ ‘রেপ’-এর পরে সেই নারীটিকেই দায়ী করে কিংবা তার পোশাককে দায়ী করে ফতোয়া দেয়। ধর্মকে গালি দেওয়াই যেহেতু এখন প্রগতিশীলতার শর্ত, তাই সেটা নিয়েই পড়ে আছেন কিছু ফেসবুক সেলিব্রিটি। ফলাফল যা হচ্ছে তা হলোÑ আইনশৃঙ্খলা জাতীয় সমস্যা থেকে আমাদের চোখটা সরে যাচ্ছে।

মূল আলোচনায় কেন যেন আমরা আসছি না। এটি একটি অপরাধ। দেশে যেকোনো অপরাধের পরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যা করণীয়, তা কি হচ্ছে? হচ্ছে না। কেন হচ্ছে না, তা নিয়ে কি কেউ কথা বলছি? বলছি না। কেন? কারণ, সেসব ‘টিপিক্যাল ঘ্যানঘ্যানানির’ কোনো বাজার দর নেই। শুধু সেসবের বলছি কেন, এই ‘তনু’ ইস্যুটিরও আর কিছুদিন পরে কোনো বাজার দর থাকবে না। যারা ইভেন্ট আয়োজন করছেন, তাদেরই আর কোনো পাত্তা পাওয়া যাবে না কিছুদিন পরে। কেস-এর কি অগ্রগতি হলো, কেউ সাজা পেল কি না, কেস এখন কোন পর্যায়ে রয়েছে এসব কোনোদিন জানতেও পারবেন না।

আমরা কোথায় যেন কেবল মুখসর্বস্ব আর লেখা সর্বস্ব সমাজ হয়ে গেছি। একটা ‘স্কেপগোট’ খুঁজি। কারও ঘাড়ে দোষ চাপাতে পারলেই ‘কাজ শেষ’। এবার অন্য কাজে মন দেওয়া যেতে পারে। অন্য কোনো ইস্যু নিয়ে ‘প্যাঁচাল’ শুরু করা যেতে পারে। যারা এসব ঘ্যানঘ্যান করছেন, তারা কি কেউ জানেন, ‘রেপ’সংক্রান্ত একটি কেসে পুলিশের সাহায্য চাইতে গেলে কি ধরনের ঘটনার সম্মুখীন হতে হয়? রেপসংক্রান্ত আইনি কার্যক্রমগুলো কতটা ধীরলয়ে চলে? কিংবা কতজন রেপ ভিক্টিম পরে আর কেস চালায় না?

তারা জানেন না, এমনটা আমি বলছি না। বলছি, এসব নিয়ে তারা আদৌ ভাবিত না। এসব সমস্যার আদৌ কোনো সমাধান তাদের মাথায় নেই। যা আছে তা হচ্ছে, এসব ঘটনাকে ভাজি করে কিছুদিন খাওয়া। গরম গরম স্ট্যাটাস দেওয়া, ভিক্টিমের ছবি দিয়ে নিজের প্রোফাইল পিকচার পাল্টানো আর ইভেন্ট করে কিছু লোক জড় করে চ্যাঁচানো।

‘রেপ’সংক্রান্ত কেসগুলো দ্রুততার সাথে সমাধা করার ব্যাপারে কেউ কি কোনো কথা বলছে? কিংবা ‘হাই ভ্যাজাইনাল সোয়াব’ এনালাইসিস করার কয়টা ল্যাব দেশে আছে, তা কি তারা জানেন? আসলে সমস্যাটার মূলে রয়েছে একটি করুণ সত্য। এদেশের পুরো বিচার ব্যবস্থাই রেপিস্টকে সাহায্য করার জন্য তৈরি। সেটায় পরিবর্তন না আসলে এ সমস্যা থামবে না। ঘ্যানঘ্যান-প্যানপ্যান চলতেই থাকবে। আর রেপ হতেই থাকবে। আর আমরা ইভেন্ট খুলতেই থাকব। আর ফলোয়ারদের ম্যাসেজ দিব, ‘ইভেন্টটায় এতো লোক আসবে ভাবিনি। পরের রেপটায় ইভেন্টটা আরও বড় পরিসরে করতে হবে।’


শেয়ার করুন