পবিত্র হজ আল্লাহ প্রেমের নিদর্শন

hajj_102740:মুফতি আমজাদ হোসাইন:
পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হচ্ছে, নিঃসন্দেহে সর্বপ্রথম ঘর যা মানুষের জন্য নির্ধারিত হয়েছে, সেটাই হচ্ছে এ ঘর, যা বাক্বায় (মক্কায়) অবস্থিত এবং সারা জাহানের মানুষের জন্য হেদায়েত ও বরকতময়। এতে রয়েছে ‘মকামে ইবরাহিমের’ মতো প্রকৃষ্ট নিদর্শন। আর যে লোক এর ভিতরে প্রবেশ করেছে, সে নিরাপত্তা লাভ করেছে। আর এ ঘরের হজ করা হলো মানুষের ওপর আল্লাহর প্রাপ্য; যে লোকের সামর্থ্য রয়েছে এ পর্যন্ত পৌঁছার। আর যে লোক তা মানে না, আল্লাহ সারা বিশ্বের কোনো কিছুরই পরোয়া করেন না। (সূরা আলে ইমরান : ৯৬-৯৭) আলোচ্য আয়াতদ্বয়ে পবিত্র কাবা শরিফের বরকত সম্পর্কে আল্লাহপাক কিছুটা আলোকপাত করেছেন। গভীরভাবে চিন্তা করলে দেখা যায়, কাবা শরিফ বাহ্যিক ও আধ্যাত্দিক বরকতে পরিপূর্ণ। বাহ্যিক বরকত তো দিবালোকের মতো সুস্পষ্ট। প্রতি বছর লাখ লাখ মানুষ হজ ও উমরা করার জন্য পবিত্র মক্কা-মদিনায় ভিড় জমায়। পবিত্র মক্কা ও তৎপার্শ্ববর্তী এলাকা শুষ্ক বালুকাময় অনুর্বর মরুভূমি হওয়া সত্ত্বেও এতে সব সময় সব মৌসুমে সব ধরনের ফলমূল, তরিতরকারি এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় যাবতীয় কিছু বিপুল পরিমাণে মজুদ থাকে। যা শুধু সেখানের বাসিন্দাদের জন্যই যথেষ্ট নয় বরং সারা বিশ্ব থেকে লাখ লাখ হজ ও উমরাকারীদের জন্যও যথেষ্ট। আজ পর্যন্ত কখনো এ কথা শোনা যায়নি এ বছর পবিত্র মক্কা ও মদিনায় নিত্যপণ্যের ঘাটতি দেখা দিয়েছে কিংবা পশুর কোরবানি বেশি হওয়ার কারণে ভেড়া, দুম্বা বা উটের কমতি হয়েছে। হাজার হাজার পশু কোরবানি করার পরও কখনো পশুর কমতি হয়নি। আল্লাহপাক কুদরতিভাবেই এই শহরকে সবদিক থেকে চিন্তামুক্ত রেখেছেন। আর আধ্যাত্দিক বরকত যে কি পরিমাণ, তা নির্ণয় করা সম্ভব নয়। অনেক ইবাদত এমন রয়েছে যা কাবাগৃহে আদায় করলে সোয়াব বহুগুণে বেড়ে যায়। যেমন রসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন- বাসগৃহে নামাজ আদায় করলে এক ওয়াক্ত নামাজের সোয়াব কিন্তু মহল্লার মসজিদে আদায় করলে ২৫ ওয়াক্ত নামাজের সোয়াব, জামে মসজিদে আদায় করলে পাঁচশত ওয়াক্ত নামাজের সোয়াব, মসজিদে আকসায় আদায় করলে এক হাজার ওয়াক্ত নামাজের সোয়াব, আমার মসজিদে (মসজিদে নববীতে) আদায় করলে পঞ্চাশ হাজার ওয়াক্ত নামাজের সোয়াব, আর মসজিদে হারামে আদায় করলে এক লাখ ওয়াক্ত নামাজের সোয়াব পাওয়া যায়। সুবহানাল্লাহ। (ইবনে মাজাহ, তাহাবি)। মহান রাব্বুল আলামিনের সৃষ্ট জগতের কোনো সৃষ্টির উদ্দেশ্য হেকমত থেকে খালি নয়। আশরাফুল মাখলুকাতের ইবাদতের বিধানাবলীও হেকমতমুক্ত নয়। যেমন- নামাজ, রোজা, হজ এবং জাকাত। বিশেষ করে হজের বিধান প্রবর্তনের পেছনে রয়েছে তার মহাহেকমত। বুখারি ও মুসলিমের এক রেওয়াতে আছে, হজরত রসুলে আরাবি (সা.) বলেন, তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের ইবাদত কর। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ওয়াক্তমতো আদায় কর, রমজানের রোজা রাখ, তোমাদের প্রতিপালকের ঘরের (বাইতুল্লাহ শরিফ) হজ কর এবং খুশি মনে তোমাদের মালের জাকাত প্রদান কর। আর হাসতে হাসতে জান্নাতে বিজলির মতো প্রবেশ কর। উক্ত চারটি ইবাদত বিশেষ করে পবিত্র হজের মাধ্যমে বান্দার জন্য মিলবে আল্লাহর প্রেম, পরকালে জান্নাত। হাজী সাহেবকে যখন আত্দীয়স্বজন বিমানবন্দরে অশ্রুসিক্ত নয়নে বিদায় জানায়, তখন তাকে লাশের খাটিয়ার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। আরাফার ময়দানে লাখ লাখ হাজীর অবস্থান, জবানে ‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক লাশারিকা লাকা লাব্বাইক ইন্নাল হামদা ওয়ান নে’মাতা লাকা ওয়াল মুলক লাশারিকা লাকা লাব্বাইক’ সমস্বরে আওয়াজ, ময়দানে মাহশারের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। হাজীর হৃদয়পটে যখন আল্লাহ প্রেমের প্রবল আকর্ষণ জাগে এবং ইব্রাহিমি মশাল দাউদাউ করে জ্বলতে থাকে তখনই সে আল্লাহর প্রেমে মাতোয়ারা হয়ে সবকিছু রেখে প্রেমিকের ঘর বাইতুল্লাহর জিয়ারতের উদ্দেশে চলতে শুরু করে। তার খাওয়া-দাওয়ার ঠিকঠিকানা থাকে না, কখনো কাবাতুল্লাহর চতুর্পার্শ্বে চক্কর মারতে থাকে, চক্করের পর কাবার পাশেই দুই রাকাত নামাজ আদায় করে আল্লাহর দরবারে দুই হাত তুলে প্রেম নিবেদন করতে থাকে ও নিজের অপরাধ স্বীকার করে এবং ভবিষ্যতে অপরাধ না করার অঙ্গীকার করে, মুলতাজামকে জড়িয়ে ধরে, কাবার চৌকাঠে মাথা ঠুকিয়ে প্রেমাস্পদের জন্য চিৎকার করতে থাকে, হজরে আসওয়াদে চুম্বন দেওয়ার চেষ্টা ও সাফা মারওয়ার মাঝে ছোটাছুটি করে, জমরাতে কঙ্কর নিক্ষেপ করে, তাও আবার একবার নয়, একস্থান থেকে নয়, তিন-তিনবার তিন স্থান থেকে। আরাফার ঐতিহাসিক ময়দানে সারা দিন অবস্থান করে সূর্য ডোবার সঙ্গে সঙ্গে চলে আসে মুজদালিফার ময়দানে খোলা আকাশের নিচে। এত কিছুর পরও তার মনে তৃপ্তি আসে না। মনের তৃপ্তি আর ইব্রাহিমি তরিকার বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে পশু কোরবানি করে, বিনিময় যদি পাওয়া যায় স্থায়ী শান্তির জায়গা জান্নাত, তাহলেই তো এই প্রেম ও কোরবানি সার্থক হবে। এই যেন এক ঐশী অনুভূতি, যা ব্যক্ত করার ভাষা জানা থাকে না, বলে শেষ করা যায় না, লিখে প্রকাশ করা যায় না। হাজী সাহেব নবজাত শিশুর মতো মাসুম হয়ে দেশে ফিরে কিন্তু মাহবুবে ইলাহির প্রেম তার হৃদয়ের প্রতিটি কোণে কোণে দাউদাউ করে জ্বলতে থাকে। মহান রাব্বুল আলামিন আমাদের তার প্রেমের সুধা পান করার তৌফিক দান করুন। আমিন।
লেখক : মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও খতিব বারিধারা, ঢাকা।

শেয়ার করুন