পবিত্র হজ আজ

152904_1আজ পবিত্র হজ। ‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লা-শারিকা লাকা লাব্বাইক’ এই ধ্বনিতে মুখরিত হবে আরাফাতের ময়দান।

সৌদি আরবের গণনা অনুযায়ী আজ ৯ জিলহজ রোজ রবিবার পবিত্র হজ। হাজীদের ‘উকুফে আরাফা’ বা আরাফাতের ময়দানে অবস্থানের দিন। বিশ্ব মুসলমানের মহাসম্মিলনের দিন।

আজ বিশ্বের ১৬০টির বেশি দেশের ২০ লাখেরও বেশি হাজীর কণ্ঠে উচ্চারিত ‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লা-শারিকা লাকা লাব্বাইক’ ধ্বনিতে প্রকম্পিত হবে আরাফার আকাশ-বাতাস। এক নূরানী আবহ পুরো ময়দানে। সবার পরনে সাদা দুই খণ্ড বস্ত্র। সবার দীন বেশ।

দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণ, রহমতপ্রাপ্তি ও নিজের গুনাহ মাফের জন্য আল্লাহ তায়ালার কাছে আকুল ফরিয়াদ জানাবেন সমবেত মুসলমানেরা। একে অপরের সাথে পরিচিত হবেন, কুশল বিনিময় করবেন। বিশ্বভ্রাতৃত্বের এক অনুপম দৃশ্যেরও অবতারণা হবে আজ এই ময়দানে।

আজ জোহরের নামাজের ওয়াক্তের আগেই বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছুটে আসা মুসলমানেরা সমবেত হচ্ছেন মসজিদুল হারাম থেকে প্রায় ২২ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ঐতিহাসিক আরাফাতের ময়দানে। ১৪০০ বছর আগে এই ময়দানেই রাসূল সা: লাধিক সাহাবিকে সামনে রেখে ঐতিহাসিক বিদায় হজের ভাষণ দিয়েছিলেন। এই ময়দানেই ইসলামের পরিপূর্ণতার ঘোষণা দিয়ে কুরআনের সূরা মায়েদার ৩ নম্বর আয়াত নাজিল হয়েছিল।

আরাফার ময়দান হেরেম এলাকার বাইরে কাবা শরিফ থেকে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে অবস্থিত। এই ময়দান প্রায় সাড়ে ১০ কিলোমিটার বিস্তৃত।

হাজীরা আজ আরাফাতের বিশাল প্রান্তরে অবস্থান করে মসজিদে নামিরাহ থেকে প্রদত্ত খুতবা শুনবেন এবং একসাথে জোহর ও আসরের নামাজ একই ইমামের পেছনে জোহরের ওয়াক্তে আদায় করবেন। সূর্যাস্তের পর ময়দান ত্যাগ করবেন।

টানা পাঁচ দিন ধরে হজের আরো অনেক করণীয় থাকলেও আজ ৯ জিলহজ আরাফাতের ময়দানে অবস্থানের দিনকেই হজের দিন বলা হয়। হজের কার্যাদি আনুষ্ঠানিকভাবে পালন শুরু হয়েছে গতকাল ৮ জিলহজ শনিবার মিনার তাঁবুতে অবস্থানের মধ্য দিয়ে। ভিড় এড়াতে অনেক হাজী আগের দিন শুক্রবার রাত থেকেই মিনায় যাওয়া শুরু করেন।

মিনায় গিয়ে তালবিয়া, জিকির, নফল নামাজ ও হজের মাসায়েল আলোচনার মধ্য দিয়ে সময় অতিবাহিত করেন হাজীরা। আজ ফজরের নামাজের পর সূর্যোদয়ের পর থেকে আরাফাতের ময়দানের উদ্দেশে হাজীদের রওনা হওয়ার নিয়ম। তবে ভিড় এড়াতে অনেক হাজী গত রাতেই আরাফাতের উদ্দেশে রওনা হন এবং সেখানে গিয়ে অস্থায়ী তাঁবুতে অবস্থান নিয়েছেন।

বাকিরা আজ সকালে মিনা থেকে সরাসরি আরাফার ময়দানে চলে যাবেন। সূর্য পশ্চিমাকাশে হেলে পড়ার পর থেকে সূর্যাস্ত পর্যস্ত আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করা হজের অন্যতম ফরজ। কেউ এই সময়ের মধ্যে এই ময়দানে অবস্থান করতে না পারলে হজ আদায় হবে না।

এই ময়দানে জোহরের সময় পরপর জোহর ও আসরের নামাজ জামাতের সাথে আদায় করবেন হাজীরা। মুসাফির হওয়ার কারণে নামাজ কসর করবেন (চার রাকাতের স্থলে দুই রাকাত)। নামাজের আগেই মসজিদে নামিরাহ থেকে খুতবা দেয়া হবে। এর আগে-পরে হজযাত্রীদের কণ্ঠে উচ্চারিত ‘লাব্বাইক’ ধ্বনিতে মুখরিত হবে পুরো ময়দান। আমির-ফকির, ধনী-গরিব, সাদা-কালোর ভেদাভেদ থাকবে না সেখানে। সবার পরনে একই ধরনের সেলাইবিহীন কাপড়, আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্বের ঘোষণা, আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ এবং তারই কাছে গুনাহ মাফ ও রহমতপ্রাপ্তির আকুতি জানাবেন সবাই।

সূর্যাস্তের সাথে সাথেই আবার মিনায় ফেরার পথে মুজদালিফায় রাতে অবস্থান নেবেন হাজীরা। ওই স্থানে রাতে অবস্থান করবেন খোলা আকাশের নিচে। সেখানে মাগরিব ও এশার নামাজ একসাথে আদায় করবেন। মিনায় জামারাতে নিেেপর জন্য এখান থেকেই কঙ্কর সংগ্রহ করবেন। রাতে সেখানে অবস্থানের পর কাল ১০ জিলহজ সোমবার ফজরের নামাজ শেষে মিনার দিকে রওনা হবেন। কাল সৌদি আরবে ঈদুল আজহা উদযাপিত হবে। মিনায় গিয়ে জামারাতে কঙ্কর নিপে এবং কোরবানি করবেন হাজীরা। মিনায় কোরবানি করার পর হাজীরা মাথা মুণ্ডন করে অথবা চুল ছোট করে ইহরাম ভেঙে ফেলবেন।

এরপর তাওয়াফে জিয়ারাহ করার জন্য মক্কায় যাবেন। সেখানে হেরেম শরিফ সংলগ্ন সাফা-মারওয়া পাহাড়দ্বয়ের মাঝে দৌড়াবেন (সায়ি করবেন)। জিলহজের ১১, ১২ তারিখ মিনার তাঁবুতে অবস্থান করেই জামারাতে কঙ্কর নিপে করার নিয়ম। ১২জিলহজ হজের আনুষ্ঠানিক কার্যাদির সমাপ্তি ঘটবে। কেউ ১২ তারিখ মিনা ত্যাগ না করলে ১৩ তারিখও তাকে জামারাতে কঙ্কর নিক্ষেপ করতে হবে। মিনার তাঁবুতে অবস্থান করেই পাঁচ দিনের হজের কার্যাদি সম্পন্ন করবেন হাজীরা।

আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করা একজন হাজীর জন্য পরম সৌভাগ্যের বিষয়। যদিও এই অবস্থান হজের অন্যতম ফরজ। হাজীরা এ দিনটিসহ পুরো হজকার্য সম্পাদনের জন্য আজীবন স্বপ্ন লালন করেন।

আরাফাতের ময়দান দোয়া কবুলের জায়গা। এখানেই আদিপিতা আদম ও হাওয়া আ:-এর পুনর্মিলন হয়েছিল এবং তাদের দোয়া কবুল হয়েছিল মর্মে বর্ণনা পাওয়া যায়। এই ময়দান রাসূল সা:-এর বিদায় হজের ভাষণের স্মৃতিবিজড়িত। সূর্য হেলে পড়ার পর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত হাজীরা বিভিন্ন গ্রুপে এবং আলাদা আলাদাভাবে দোয়া করতে থাকেন।

দুই হাত উঁচু করে অঝোরধারায় কান্নাকাটি করেন হাজীরা। গুনাহ মাফের আকুতি ছাড়াও জীবনের সব চাওয়াই আল্লাহর দরবারে পেশ করেন। সূর্যাস্তের পর আরাফার ময়দান ত্যাগের সময় নিজেকে নির্ভার-নিষ্পাপ জ্ঞান করে মুজদালিফার দিকে এগোতে থাকেন আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য ছুটে যাওয়া মুসলমানেরা।

হজরত আদম আ: কর্তৃক নির্মিত পৃথিবীর প্রথম ঘর কাবাকে কেন্দ্র করেই মূলত হজের কার্যাদি আবর্তিত হয়। আজ থেকে প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে মুসলিম মিল্লাতের পিতা হজরত ইব্রাহিম আ: ও তার পুত্র ইসমাইল আ: এই কাবাঘর পুনর্নির্মাণ করেন।

হজের বেশির ভাগ কাজই হজরত ইব্রাহিম আ:, তার স্ত্রী হাজেরা এবং পুত্র ইসমাইল আ:-এর সম্পাদিত কাজের সাথে সম্পর্কিত। মুসলমানেরা পশু কোরবানি করেন আল্লাহর নির্দেশ পালনার্থে ইব্রাহিম আ: কর্তৃক নিজ শিশুপুত্র ইসমাইলকে কোরবানি করতে যাওয়ার মহান ত্যাগের ঘটনার অনুকরণে।

হজ ইসলামের পাঁচ স্তম্ভের অন্যতম এবং সামর্থ্যবান মুসলমানের ওপর জীবনে একবার হজ করা ফরজ।

এ বছর ২০ লাখের বেশি মুসলমান পবিত্র হজ পালন করছেন। এ বছর বাংলাদেশী হজযাত্রীর সংখ্যা এক লাখ এক হাজার ৭৫৮ জন।


শেয়ার করুন